হাকীমুল ইসলাম আল্লামা শাহ আবদুল হালীম বোখারী (রহ.): স্মৃতি ও স্মরণ
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি
জীবনের অন্তিম শয্যায় যে সুন্নাহর ওপর আমল করলেন
আমাদের প্রিয় শায়খ আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)। তাঁর কাছ থেকে হেদায়া তৃতীয় খণ্ড, তিরমিযী শরীফ ও বোখারী শরীফের মতো গুরত্বপূর্ণ কিতাবাদির দরস গ্রহণ করে ধন্য হয়েছি। তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি ছিলেন আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সফল মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদীস। সুদীর্ঘ আট দশকের ইতিহাসে জামিয়া পটিয়া যেসব সৃজনশীল মনীষী, তীক্ষ্ণ মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান আলিম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় হলেন আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)। প্রতিভার বহুমাত্রিকতা ও জ্ঞান গভীরতা তাঁর জীবনকে বিশিষ্টতা দান করে। তাঁর পুরো জীবনটাই ইলমে দ্বীন আহরণ ও বিতরণে ব্যয়িত হয়। হৃদয়গ্রাহী পাঠদান পদ্ধতির ফলে অতি মেধাবী ও কম মেধাবী সব ছাত্রই তাঁর অভিভাষণ থেকে উপকৃত হতো। তাঁর জীবনের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম ছিলো নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাপ্রিয়তা। সময়ের মূল্যায়ন ও যথা সময়ে কাজ আঞ্জাম দেওয়া তাঁর অন্যতম স্বভাব। কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও নীতিমালা অনুসরণে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। তাঁর সুষ্ঠু পরিচালনায় জামিয়া পটিয়ার নিয়ম-শৃঙ্খলা নতুনভাবে সজীবতা লাভ করে।
জামিয়ার ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিলো সদা নিবিষ্ট। তাই তিনি যখন অনুভব করলেন যে, জীবন হয়ত বেশি দিন সঙ্গ দেবে না, তখনই তিনি ২০২০ সালে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করেন। প্রথমত মজলিসে আমেলার মাধ্যমে, পরবর্তীতে মজলিসে শোরার অনুমোদনক্রমে আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযা (হাফি.)-কে নায়েবে মুহতামিম নির্ধারণ করেন। দীর্ঘ দুই বছর যাবত তাঁকে কাছে রেখে জামিয়ার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কাজগুলো আঞ্জাম দিয়ে যান। কিন্তু ইন্তিকালের আগের দিন নায়েবে মুহতামিম মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ (হাফি.)-এর মাধ্যমে জামিয়া পটিয়ার শিক্ষক-কর্মচারীর এক গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ সভার সভাপতিত্বের মাধ্যমে দেখে যেতে চান যে, তাঁরই নির্বাচিত ব্যক্তি জামিয়ার কার্যাদি কীভাবে আঞ্জাম দেবেন? যেন তাঁর চলে যাওয়ার পর তাঁর আত্মা প্রশান্তিবোধ লাভ করতে পারেন। তাই তিনি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেই সুন্নাহটি পালন করেছেন, যা রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ইন্তিকালের দিন হজরত আবু বকর (রাযি.)-কে নামাযের ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে পালন করেছিলেন। নিম্নে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ উল্লেখ করা হলো:
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় প্রতি বছর শিক্ষক-কর্মচারীর দুটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। একটি কুরবানের পূর্বে এবং অপরটি রমযানের পূর্বে। জামিয়া প্রধানের সভাপতিত্বেই সভাগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেহেতু এই সাধারণ সভাগুলো অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তাই সভার কয়েকদিন পূর্বেই এর তারিখ ঘোষণা করা হয়। যেন সকলেই উপস্থিত থাকতে পারেন।
এ বছরও জামিয়া প্রধান হাকীমুল ইসলামা আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)-এর নির্দেশক্রমে সাধারণ সভার তারিখ ঘোষণা করা হয়। জামিয়ার মসজিদে ঘোষণা হলো, ‘আগামী ২০ জুন ২০২২ ইংরেজি (সোমবার) বাদে মাগরিব জামিয়ার মেহমানখানায় সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে।’ কিন্তু অকস্মাৎ এর একদিন পূর্বেই (১৯ জুন, রবিবার) আল্লামা বোখারী (রহ.) অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হন। তাই আমাদের ধারণা ছিলো, হয়ত নির্ধারিত সময়ে সেই সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে না। কিন্তু সোমবার বাদে আসর আবারো জামিয়ার মসজিদে ঘোষণা করা হলো, ‘পূর্বের ঘোষণা মতে আজ বাদে মাগরিব শিক্ষক-কর্মচারীর সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে, ইনশা আল্লাহ।’
সুতরাং বাদে মাগরিব জামিয়ার মেহমানখানায় শিক্ষক-কর্মচারীগণ উপস্থিত হলেন। মেহমানখানায় প্রবেশ করেন জামিয়ার প্রধান মুফতি ও মুহাদ্দিস আল্লামা মুফতি আহমদুল্লাহ (হাফি.)। তিনি বলেন, আজকের সভায় মুহতামিম সাহেবের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন জামিয়ার নায়েবে মুহতামিম মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ (হাফি.)। সুতরাং তার জন্য একটি চেয়ারের ব্যবস্থা করুন।
-কিন্তু তিনি চেয়ারে বসতে সংকোচবোধ করলেন। পরে মুরব্বিদের জন্যও আরো কয়েকটি চেয়ারের ব্যবস্থা করা হলো। অতঃপর তাঁকে উদ্বোধনী আলোচনা করতে বলা হলো। তখন তাঁর পার্শ্বের চেয়ারে বসা ছিলেন জামিয়ার সিনিয়র মুফতি ও মুহাদ্দিস আল্লামা মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া (হাফি.)।
-তিনি বিনয়ের সাথে তাঁকে কানে কানে বললেন, হুজুর, আমি কী বলবো? হুজুর বললেন, আরম্ভ করো, প্রয়োজনীয় কথা আল্লাহ বের করে দেবেন, ইনশা আল্লাহ। এবার আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ (হাফি.) আলোচনা শুরু করলেন।
-তিনি বলেন, আমরা সকলেই জানি আমাদের মুহতামিম সাহেব অসুস্থ। তিনি এখন আইসিইউতে আছেন। তাই পরামর্শক্রমে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আজকে সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে না। কিন্তু মুহতামিম সাহেব নিজেই ফোন করে বলেছেন, বৈঠক চালিয়ে যেতে। তাই আমি কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো, ইনশা আল্লাহ। মূলত আমি নিজেকে নসীহা এবং আমার বিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলির সামনে দরসের হাজিরা ও তাকরারের উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বলছি। অতঃপর তিনি খুবই বিনয়ী ও অত্যন্ত নম্র ভাষায় কুরআন-হাদীসের আলোকে সাধারণ সভা সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। অতঃপর প্রস্তাবিত এজান্ডাগুলোর পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেন। উপস্থিত সকলেই সন্তুষ্টচিত্রে তা মেনে নেন।
অতঃপর ২১ জুন মঙ্গলবার সকাল ১০ ঘটিকায় জামিয়ার মুহতামিম হাকীমুল ইসলাম আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) ইন্তিকাল করেন। বিষয়টি দেখে মনে হলো, তিনি যেন, সেই সুন্নাহর ওপর আমল করলেন, যা রসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তিকালের পূর্বে করেছিলেন। অর্থাৎ রসুলুল্লাহ (সা.) রোগ শয্যায় শায়িত থেকে হজরত আবু বকর (রাযি.)-কে নামাযের ইমামতির ভার দিয়েছিলেন। এর মধ্যে এই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল যে, তাঁর ইন্তিকালের পর হজরত আবু বকর (রাযি.) খিলাফত প্রাপ্ত হবেন।
أَخْبَرَنِيْ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ الْأَنْصَارِيُّ – وَكَانَ تَبِعَ النَّبِيَّ ﷺ وَخَدَمَهُ وَصَحِبَهُ – أَنَّ أَبَا بَكْرٍ كَانَ يُصَلِّيْ لَـهُمْ فِي وَجَعِ النَّبِيِّ ﷺ الَّذِيْ تُوُفِّيَ فِيهِ، حَتَّىٰ إِذَا كَانَ يَوْمُ الْاِثْنَيْنِ وَهُمْ صُفُوْفٌ فِي الصَّلاَةِ، فَكَشَفَ النَّبِيُّ ﷺ سِتْرَ الْـحُجْرَةِ يَنْظُرُ إِلَيْنَا وَهُوَ قَائِمٌ كَأَنَّ وَجْهَهُ وَرَقَةُ مُصْحَفٍ، ثُمَّ تَبَسَّمَ يَضْحَكُ، فَهَمَمْنَا أَنْ نَفْتَتِنَ مِنَ الفَرَحِ بِرُؤْيَةِ النَّبِيِّ ﷺ، فَنَكَصَ أَبُو بَكْرٍ عَلَى عَقِبَيْهِ لِيَصِلَ الصَّفَّ، وَظَنَّ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ خَارِجٌ إِلَى الصَّلاَةِ «فَأَشَارَ إِلَيْنَا النَّبِيُّ ﷺ أَنْ أَتِمُّوا صَلاَتَكُمْ وَأَرْخَى السِّتْرَ فَتُوُفِّيَ مِنْ يَوْمِهِ».
‘হজরত আনাস ইবনে মালিক আনসারী (রাযি.) যিনি নবী করীম (সা.)-এর (আকিদা ও আমলের) পূর্ণ অনুসারী ছিলেন এবং একাধারে দশ বৎসর আল্লাহর হাবীবের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন আর তিনি তাঁর একজন জলিল কদর সাহাবিও ছিলেন। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তিম রোগ থাকাকালীন অবস্থায় হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.) সাহাবায়ে কেরামগণকে নিয়ে (ইমাম হয়ে) নামায আদায় করতেন। অবশেষে সোমবার দিনে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.)-এর ইমামতিতে সাহাবায়ে কেরামগণ নামাযরত অবস্থায় কাতারবন্দী ছিলেন। তখন নবী করীম (সা.) নিজ কামরার পর্দা উঠিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় আমাদের দিকে তাকালেন। এ সময়ে তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) চেহারা মোবারক কোরআন করীমের স্বচ্ছ পৃষ্ঠার ন্যায় ঝলমল করছিল। অতঃপর তিঁনি মুচকি হাসছিলেন।নবী করীম (সা.)-এর নূরানী চেহারা মোবারক দর্শনে আমরা (সাহাবায়ে কেরামগণ) স্বেচ্ছায় আনন্দে-আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম।নবী করীম (সা.) নামাযের জামায়াতে আসবেন এ ভেবে হজরত আবু বকর (রাযি.) (ইমামতির স্থান থেকে) পিছন দিকে সরে নামাযের প্রথম কাতারে এসে হাজির হলেন। তখন নবী করীম (সা.) আমাদেরকে ইশারায় বললেন, ‘তোমরা অসম্পূর্ণ নামাযকে পূর্ণ করে নাও।’ অতঃপর আল্লাহর প্রিয় রসুল (সা.) পর্দা মোবারক ফেলে দিলেন। সে দিন নবী (সা.)-এর ইন্তিকাল হয়েছিল।’[1]
রব্বে করীম! দয়া করে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমাদেরকে তাঁর জীবন-আদর্শ মোতবেক জীবন গড়ার তৌফিক দান করুন এবং যিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন তাঁর মাধ্যমে জামিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার তওফিক দান করুন, আমীন।
তাঁর সান্নিধ্যে গেলেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতাম
হাকীমুল ইসলাম আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) ছিলেন জাতির যোগ্য রাহবর। তিনি ছিলেন আমাদের দয়ালু অভিভাবক। নিজের সুখ-দুঃখের কথা তাঁর সামনে পেশ করা হতো। সুখের কথায় তিনি হাসতেন ও অনন্দিত হতেন। দুঃখের কথায় তিনি ব্যথিত হতেন এবং কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দিতেন।
কিছুদিন পূর্বে পারিবারিক একটি পেরিশানি নিয়ে তাঁর শরাণাপন্ন হলাম। বললাম, হজরত একটি পারিবারিক সমস্যায় পড়েছি। তিনি বললেন, কী সমস্যা? বললাম, জায়গা-জমি সংক্রান্ত একটি সমস্যা। অনেক ছাড় দিয়ে মীমাংসার উদ্দেশ্যেই একটি আপোষনামা তৈরি করা হলো। সকলেই মেনে নিয়ে তাতে স্বাক্ষরও করলো। কিন্তু এখন আবার সামান্য বিষয় নিয়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, এমনটি আশঙ্কা করছি। তিনি মনোযোগ দিয়ে বিষয়টি সবিস্তার শুনলেন। অতঃপর আমাকে সান্তনা দিয়ে বলেন, জায়গা-জমি থাকলে অনেক ধরনের সমস্যা হয়। তাতে অস্তির হওয়া যাবে না। তবে আমি তোমাকে একটি আমল শিখিয়ে দিচ্ছি, করতে থাকো। যে কোনো মাধ্যমে আল্লাহ তোমার সাহায্য করবে এবং সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ইনশা আল্লাহ। আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। হজরত, সেই আমলটি কী? তখন তিনি বলেন, তুমি বেশি বেশি দোয়ায়ে ইউনুস পড়তে থাকো।
لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحٰنَكَ١ۖۗ اِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِيْنَۚۖ۰۰۸۷[2]
আমি বললাম, ঠিক আছে হুজুর। আমি তার ওপর আমল করবো, ইনশা আল্লাহ।
তখন তিনি বলেন, শুন, দোয়ায়ে ইউনুসের বড় ফযীলত আছে। হাদীস শরীফে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমার ভাই ইউনুসের দোয়াটি খুব সুন্দর। এর প্রথম অংশে আছে কালিমায়ে তায়্যিবা। মাঝের অংশে আছে তাসবিহ। আর শেষের অংশে আছে অপরাধের স্বীকারোক্তি। যে কোনো চিন্তিত, দুঃখিত, বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি প্রতি দিন এ দোয়া তিন বার পাঠ করবে আল্লাহতাআলা তার ডাকে সাড়া দেবেন। (কানযুল উম্মাল: ৩৪২৮)
আরেকটি হাদীসে উল্লেখ আছে, হজরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাযি.) বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! এই দোয়াটি কি হজরত ইউনুস (আ.)-এর বৈশিষ্ট্য, নাকি সব মুসলমানের জন্যই? তখন রসুল (সা.) বললেন, তুমি কি পড়নি,
وَنَجَّيْنٰهُ مِنَ الْغَمِّ١ؕ وَكَذٰلِكَ نُـْۨجِي الْمُؤْمِنِيْنَ۰۰۸۸[3]
(অর্থাৎ আমি তাকে চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছি আর আমি এভাবেই মুমিনদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি।) অতএব যে কোনো ব্যক্তিই এইভাবে দোয়া করবে আল্লাহ তাআলা সে দোয়া কবুল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অতঃপর তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস হলো, এটি ইসমে আযম। যা পাঠ করে দোয়া করলে, আল্লাহ কবুল করেন। তাফসিরে ইবনে কাসিরে উল্লেখ আছে, হজরত ইবনে আবি হাতিম (রহ.) হজরত কাসির ইবেন সা’দ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি হাসান বসরী (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, আল্লাহর ইসমে আযম কোনটি, যে নামের দ্বারা দোয়া করলে দোয়া কবুল হয় এবং কোনো কিছু চাইলে তা দেওয়া হয়? উত্তরে তিনি বললেন, ভ্রাতুষ্পুত্র! তুমি কি আল্লাহর এই বানীটি পড়নি? অতপর তিনি এই আয়াত দুটি তেলাওয়াত করে বললেন, এটাই হলো সে ইসমে আযম, যার দ্বারা দোয়া করলে দোয়া কবুল হয় এবং কোনো কিছু চাওয়া হলে তা দেওয়া হয়। (তাফসীরে ইবনে কসীর, ৩/৩৯৫-৩৯৬)
দোয়ায়ে ইউনুসের আমলে ভিসার সমস্যার সামাধান
অতঃপর তিনি বলেন, আমার নিকট অনেকেই অনেক জটিল জটিল সমস্যা নিয়ে এসেছে। আমি তাদেরকে এই দোয়ার আমল করতে বলেছি। যারা আমল করেছে তারাই উপকৃত হয়েছে। আমি একবার আরব আমিরাতের সফরে ছিলাম। একজন প্রবাসী আমার কাছে এসে খুব কান্নাকাটি করতে লাগলো। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তোমার কী সমস্যা? তখন সে বলল, হুজুর আমার কফিল আমাকে বলেছেন, আর ভিসা লাগিয়ে দেবেন না। তিনি বলেছেন, আমার ভিসা ক্যান্সেল করে দেবেন। এখন আমি খুব বেশি পেরিশানিতে আছে। আমি এখন কী করবো বুঝতে পারছি না। তখন আমি তাকে বললাম, তুমি দোয়ায়ে ইউনুসের আমল করতে থাকো। আল্লাহ ব্যবস্থা করে দেবেন, ইনশা আল্লাহ।
এর কিছুদিন পর ওই লোক আমার সাথে সাক্ষাত করতে আসলো। এসে বলল, হুজুর, আপনার কথা অনুযায়ী আমি আমল করেছি। আল্লাহ আমার পেরিশানি দূর করে দিয়েছেন। একদিন আমার কফিল আমাকে ডেকে বলেন, তোমার পাসপোর্ট দাও। আমি খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু দেখি, তিনি ক্যান্সেল না করে ভিসা লাগিয়ে আমাকে পাসপোর্ট ফেরত দিলেন। এ রকম অনেক ঘটনা আছে। তাই তোমাকে বলছি, তুমিও দোয়ায়ে ইউনুসের ওপর আমল করতে থাকো। আল্লাহ তাআলা সমাধান বের করে দেবেন, ইনশা আল্লাহ।
হজরতের সন্তনা ও সমাধানটি উত্তম মনে হলো। তাতে পেরিশানি অনেকটা হলকা হলো। হজরতের কথা অনুযায়ী আমল করে মানসিক প্রশান্তি অনুভব করছি। আশা করি আল্লাহ তাআলা সকল পেরিশানি মুক্ত করে দেবেন, ইনশা আল্লাহ।
ফরিয়াদ! হে আল্লাহ, যিনি আমাদের সঙ্কটে সাহয্য-সহযোগিতা করতেন, তিনি আজ আপনার মেহমান হয়েছেন। দয়া করে আপনি তাঁর কবরের সঙ্কটে সহযোগিতা করুন। তাঁর কবরকে জান্নাতে পরিণত করুন। জান্নাতের পোশাক পরিধান করুন। জান্নাতের নায-নেয়ামতের ব্যবস্থা করুন, আমীন।
সততা ও আমানতদারির মূর্ত-প্রতীক আল্লামা বোখারী (রহ.)
হাকীমুল ইসলাম আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) ছিলেন সততা ও আমানতদারির মূর্তপ্রতীক। তাঁর কাছে এই গুণটি ছিলো সর্বাগ্রে। তাঁর সংশ্রবে না থাকলে, তাঁর সাথে সফর না করলে হয়ত বিষয়টি অত বেশি স্পষ্ট হতো না। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানি তাঁর সুহবত-সংশ্রবে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর সাথে সফর করার সুযোগ হয়েছে। তাঁর সততা ও আমানতদারি স্বচক্ষে অবলোকন করার তাওফীক হয়েছে। তাই দৃঢ়ভাবে তাঁর সততার কথা বলতে পারি।
আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)-এর সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সফরে ছিলাম। জামিয়ার প্রয়োজনে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। আবুদাবি, আলাইন, শারজাহ, দুবাই, আজমানসহ সংযুক্ত আমিরাতের প্রায় প্রদেশে সফর করেছেন। অধমকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তাঁর বেশ কিছু আচরণ অধমকে বিমুগ্ধ করেছে। তাঁর অনেকগুলো স্বভাব অধমকে হতভম্ব করেছে। সেগুলোকে হৃদয়ের মণিকোঠায় গেঁথে নিতাম এবং আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতাম। তাঁর যে স্বভাবটি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে, তা হলো তাঁর সততা ও আমানতদারি। মূলত তাঁর এই গুণটি তাঁকে মহান করেছে। জাতি ও মানুষের তিনি গ্রহণযোগ হয়েছেন। বড় বড় বিষয়ের সততা ও আমানতদারি বিষয়গুলো দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। অধম ছোট ছোট কিছু বিষয় উল্লেখ করছে। বিষয়গুলো যদিও সামান্য মনে হয়, কিন্তু তাতে প্রস্ফুটিত হয় তিনি কত বড় মাপের খোদাভীরু ও তাকওয়াবান ছিলেন!
আবুদাবির ‘মুসাফফা’ আবাসিক এলাকায় আমরা থাকতাম। সেখানে হযূরের সাহেবযাদা মাওলানা রেজাউল করীম বোখারী (হাফি.) স্বপরিবারে থাকতেন। সেখানেই অবস্থান করতাম। খাওয়া-থাকা সবকিছু যিম্মাদারি মাওলানা রেজাউল করীম বোখারী (হাফি.)-ই বহন করতেন। সত্যিই, তার ব্যবস্থাপনা ও আন্তরিকতা দেখে মনে হতো না যে, আমরা কোনো সফরে আছি। মনে হতো, হুজুর নিজ বাড়িতেই আছেন আর আমি আমার আত্মীয়ের বাসায় আছি। প্রবাসের অপরিচিতির গ্লানি ও অস্থিরতা পোহাতে হয়নি। মাওলানা রেজাউল করীম (হাফি.)-এর বাসা থেকে জামিয়ার কাজে বিভিন্ন জায়গায় সফর করতে হতো। মাওলানা রেজাউল করীম (হাফি.) নিজেই ড্রাইভ করে আমাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। তিনি তো ভাড়া গ্রহণ করতেন না, বরং জালানি খরচ দিতে চাইলেও তিনি অভিমান করতেন। বলতেন, আমার ওপর কি জামিয়ার এইটুকু হক্ব নেই? আমি জামিয়ার এই খেদমতটুকু আঞ্জাম দিতে পারি না? ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই সফরে মাওলানা রেজাউল করীম বোখারী, মাওলানা হাফেজ আব্বাস, হাফেজ নূর হোসেন (হাফি.)-সহ আরো যাদের আপ্যায়ন, আন্তরিকতা, উধারতা ও জামিয়ার জন্য আত্মত্যাগ ইত্যাদি স্বচক্ষে দেখেছি, তাদেরকে নিয়ে নিয়ে আজ নয়, অন্য কোনো সুযোগে লিখবো হবে, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ তাআলা তাদের খেদমাত কবুল করুন এবং উত্তম প্রতিদান দান করুন, আমীন।
মাওলানা রেজাউল করীম বোখারী (হাফি.) একদিন ব্যস্ত ছিলেন। জামিয়ার কাজে আমরা একটি ভাড়াকৃত কার নিয়ে আবুদাবি শহরে গেলাম। জামিয়ার কাজটি সেরে হুজুর বলেন, আমার একটি হাত ঘড়ির প্রয়োজন। তাই সেখান থেকে ফেরার পথে পার্শ্বের একটি মার্কেটে গিয়ে হাত ঘড়ি ক্রয় করলেন। অতঃপর আরেকটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে আমরা ‘মুসাফফা’য় মাওলানা রেজাউল করীম বোখারির বাসায় পৌঁছে যাই। বাসায় এসে তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমাদের যাথায়থ ভাড়া কতো খরচ হলো? আমি বললাম, ২০০ দিরহাম। তিনি বলেন, একশ দিরহাম মাদরাসার খরচে লিখেছি। আর বাকি একশ দিরহাম আমার নিজ যিম্মায় রেখেছি। আমি বললাম, কেন হুজুর? তিনি বলেন, সেই যে সেখানে আমি নিজের কাজ করেছি। নিজের জন্য ঘড়ি ক্রয় করেছি। তাই অর্ধেক খরচ নিজ যিম্মায় নিলাম।
এ কথা শুনে নিস্তবদ্ধ হয়ে গেলাম! এখানে তো ঘড়ির টাকাও জামিয়ার যিম্মায় দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যেহেতু তিনি জামিয়ার কাজেই গিয়েছেন। জামিয়ার কাজগুলো সঠিক সময়ে আঞ্জাম দেওয়ার জন্য ঘড়ির প্রয়োজন। তাই ঘড়ি ক্রয় করেছেন। কিন্তু না। তিনি ঘড়ির টাকা তো দূরে থাক, জামিয়ার কাজে জন্য যাওয়ার পথে ব্যক্তিগত সামান্য কাজ করার কারণে খরচটুকুও জামিয়ার ফান্ডে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হননি।
অঃপর তিনি আমাকে বলেন, এটি তোমাকে শেখানোর উদ্দেশ্যই আমি তোমাকে বলেছি এবং ভবিষ্যতে যদি জামিয়ার কাজ করো, তাহলে এই ছোট ছোট বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখবে, সততা ও আমানতদারি হলো মানবজীবনের প্রধান মূলধন। যারা এ সম্পদে সমৃদ্ধ তারা সবার আস্থার পাত্র। এ জন্য ইসলামে ব্যক্তিগত সততাকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে। হজরত ইবনে মাসউদ (রাযি.) বলেন, কেয়ামতের দিন আমানতের খেয়ানতকারীকে হাজির করে বলা হবে, তোমার কাছে গচ্ছিত আমানত ফিরিয়ে দাও। সে জবাব দেবে, হে আল্লাহ! কিভাবে তা ফিরিয়ে দেব? পৃথিবী তো ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন তার কাছে গচ্ছিত রাখা জিনিসটি যেভাবে রাখা হয়েছিল ঠিক অনুরূপ আকারে জাহান্নামের সবচেয়ে নিচের স্তরে তাকে দেখানো হবে। তারপর তাকে বলা হবে, যাও, ওখানে নেমে ওটা তুলে আনো। অতঃপর সে নেমে গিয়ে সেটি কাঁধে বয়ে নিয়ে আসবে। তার কাছে জিনিসটির ওজন পৃথিবীর সব পর্বত অপেক্ষা অধিক ভারী মনে হবে। তার ধারণা হবে, তুলে আনলেই সে দোজখের আগুন থেকে নাজাত পাবে। কিন্তু সে যখন জাহান্নামের শেষ প্রান্তে চলে আসবে, তখনই ওই জিনিসটি নিয়ে আবার জাহান্নামের সবচেয়ে নিচের স্তরে পড়ে যাবে। এভাবে সে চিরকালই জাহান্নামে থাকবে। তারপর হজরত ইবনে মাসউদ (রাযি.) বলেন, নামায, অজু, গোসল, পরিমাপ ও পরিমাপের দাঁড়িপাল্লা সবই আমানতের শামিল, আর কারো রক্ষিত জিনিস সবচেয়ে বড় আমানত।
রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে তোমাকে বিশ্বাস করে তার বিশ্বাস রক্ষা করো, আর যে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তুমি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো না।’ রসুল (সা.) অন্যত্র বলেছেন, ‘মুমিনের মধ্যে আর যত দোষই থাক, খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যাচার থাকতে পারে না (মুসনাদে আহমদ)।’
অতঃপর তিনি বলেন, আমানত শুধু অর্থ-সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর বিষয়বস্তু ব্যাপক। ব্যবসায়-বাণিজ্য, চাকরি, সরকারি-বেসরকারি দাফতরিক কাজকর্ম, শিক্ষকতা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্ব, মজুরি ইত্যাদি সবই আমানতের অন্তর্র্ভুক্ত। অনুরূপ মানুষের সুস্থ বিবেক, হাত-পা, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ঠোঁট ইত্যাদি প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যক্তির কাছে আমানতস্বরূপ। এগুলোর ব্যবহার প্রসঙ্গে বিচার দিবসে জিজ্ঞেস করা হবে।
আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘চবক ফের পর চাদাকাত কা আদালাত কা শুযাআত কা লিয়া যায়ে গা তুম ছে কাম দুনিয়া কি ইমামত কা।’ (তোমরা যদি গ্রহণ করতে পারো সততা, বিশ্বস্ততা এবং বীরত্বের পাঠ, তোমাদের থেকেই নেওয়া হবে দুনিয়ার নেতৃত্বের কাজ)। অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে তিনটি গুণ তথা সততা, বিশ্বস্ততা ও বীরত্ব থাকলে সমগ্র পৃথিবীর নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। মুমিনের কাছে সর্বাপেক্ষা উত্তম সম্পদ হলো আমানতদারিতা। তাই মুমিন আমানতদারিতা রক্ষা করতে সদা সচেষ্ট থাকে।
ফরিয়াদ, হে আল্লাহ দয়া করে তাঁকে তাঁর সততা ও আমানতদারির পুরষ্কার দান করুন এবং আমাদেরকে তাঁর আদর্শে আদর্শবান হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।
একজন অনন্য কলম সৈনিক ও আদর্শ লেখক আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)
হাকীমুল ইসলাম আল্লামা শাহ মুফতী আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) একজন অনন্য কলম সৈনিক ও আদর্শ লেখক ছিলেন। ১৯৮২ সাথে থেকে জামিয়ার মুখপাত্র মাসিক আত-তাওহীদের প্রথমত সম্পাদক এবং পরবর্তীতে প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লেখালেখি করতেন। ছাত্রজীবনে লেখালেখির স্মৃতি চারণ করে বলেন, জামিয়া পটিয়ায় আমাদের অত্যন্ত দয়ালু এবং প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মুফতি ইবরাহীম (রহ.)। তিনি নিরলস লেখালেখি করতেন আর আমাদেরকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি ছাত্রদেরকে রচনাশৈলির প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। উর্দু ভাষার প্রতি আমাদেরকে তিনিই উদ্বুদ্ধ করেছেন। আল-জামিয়া পটিয়ার কাফেলায় যখন তিনি শামিল হন, তখন থেকেই লেখালেখি, রচনাশৈলী ও শিক্ষকতার পদ্ধতির রঙ পাল্টে যায়। তাঁর দিক-নির্দেশনায় উর্দু লেখার প্রতি একটা ঝোঁকের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীকালে আমাদেরকে উন্নতির রাজপথে এনে দাঁড় করিয়েছে। তাঁর লেখালেখিও বয়ানের মতো স্পষ্ট ছিলো। পাঠ্যক্রমভুক্ত অনেক কিতাবের ব্যাখ্যা লিখেছেন। তাঁর গদ্য কি পদ্য, উভয়ই প্রাঞ্জল ছিলো। কবিতা ও কাব্যচর্চা খুব উপভোগ করতেন।
তাঁর লিখিত রচনাই প্রথম স্থান অধিকার করে তবে কেউ পুরস্কৃত হয়নি
আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) নিজেই বলেছেন, ছাত্র যামানায় জামিয়া পটিয়ায় ‘কওমী মাদরাসার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ বিষয়ক একটি রচনা প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হলো। যে কোনো কারণে আমি সেখানে অংশ গ্রহণ করতে পারিনি। তখন আমার জুনিয়ার এক ছাত্র এসে বলল, ‘আমাকে একটি রচনা লিখে দিন’। আমি তাতে রাজি হয়ে যাই। সে বিষয়ে একটি রচনা লিখে দিই। আমার হাতের লেখা দেখে হুজুর ধরে পেলতে পারবেন। তাই ফাউন্টেন ফ্যান কলমকে উল্টো করে লিখেছি। যেন হুজুররা ধরতে না পারেন। অতঃপর ওই ছাত্র রচনাটি তার নামে জমা দেয়। ফলাফলে সেই রচনাটি প্রথম স্থান অধিকার করল। যখন রচনায় প্রথম স্থানে সেই ছাত্রের নাম দেখল, তখন সকলেই হতবাক হয়ে গেল। এই ছেলে কীভাবে এত সুন্দর রচনা লিখল?! অতঃপর খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ (রহ.) ও মুফতি ইবরাহীম (রহ.) অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হন যে, এটি আমার লেখা ছিলো। তখন তাঁরা আমাকে ডেকে বলেন, ‘‘জ্ঞান কি বেচা-কেনা করা যায়?” তুমি কেন এই ছাত্রকে রচনা লিখে দিলে? আমি লজ্জিত হয়ে চুপ হয়ে গেলাম। তাই সেই প্রতিযোগিতায় আর কাউকেই পুরস্কৃত করা হয়নি।
আমরা থাকবো না, কিন্তু আমাদের রচনাসমগ্র পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে
আল্লামা বোখারী (রহ.) বলেছেন, ছাত্র জামানায় আমি একবার মুফতি ইবরাহীম (রহ.)-এর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গেলাম। দেখলাম, তিনি সেখানেও লেখালেখি করছেন। তখন আমি বললাম, হজরত, একদিনের জন্য বাড়িতে এসেছেন। এখানেও কি লেখালেখি করতে হয়? তখন হজরত (রহ.) বলেন, আমি তো পৃথিবী থেকে চলে যাবো, কিন্তু আমার এ রচনাসমগ্র পৃথিবীতে থাকবে। এ জন্য যথটুকু সম্ভব এর জন্য মেহনত চালিয়ে যেতে হবে।
কতইনা সুন্দর এই ব্যাখ্যাগ্রন্থ!
আল্লামা মুফতি আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) বলেন, আমরা মুফতী ইবরাহী (রহ.)-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থের জন্য কবিতা লিখতাম। আমি যখন টাঙ্গাইল চলে যাই তখনও তিনি চিঠির মারফত নতুন ব্যাখ্যাগ্রন্থের সুসংবাদ শুনাতেন এবং কবিতা লিখতে বলতেন। মুসাল্লামুস সুবূতের একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেন আত-তাকরীরুল মুনাজ্জম। আমি এর জন্য একটি কবিতা লিখলাম। আর এর তারেখী নাম ঐতিহাসিক নাম বের করলাম وه شرح منظم কিন্তু সেখানে সংখ্যা মেলাতে আরো ‘এক’ সংযুক্ত করতে হচ্ছে। অর্থাৎ আলিফ সংযুক্ত করতে হচ্ছে। আমি চিন্তা-ফিকর করছি। এমন সময় হজরতের আরেক শিষ্য মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব তাশরীফ আনলেন। তিনি আমাদের নিকটে এক মসজিদে ইমামতী করতেন। তিনিও কবি ছিলেন। তিনিও হজরতের জন্য কবিতা লিখতেন। তাকে বললাম তারেখী নামে ‘এক’ সংযুক্ত করতে হচ্ছে। তখন তিনি বলেন, وه شرح منظم-এর পরিবর্তে واه شرح منظم বললে তো মিলে যাবে এবং অর্থও সুন্দর হয়ে যায়। অর্থ হবে, কতইনা সুন্দর এই ব্যাখ্যাগ্রন্থ!
তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলি
আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) প্রতিটি দরসের নোট নিজ হাতেই তৈরী করেছিলেন। পরবর্তীতে পাঠ্যক্রমভুক্ত অনেক কিতাবের ব্যাখ্যা লিখেছেন। এসব ব্যাখ্যাগ্রন্থ হতে ছাত্র-শিক্ষক সমানভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। নিম্নে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো।
- তাসহীলুত তাহাবী (তাহাবী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ),
- তাসহীলুত তিরমিযী (তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ) ও
- তাসহীলুল উসূল (যা দরসের অর্ন্তভুক্ত)।
পরিশেষে দোয়া করি, আল্লাহ তাঁর খেদমাত কবুল করুন, তাঁর পাঠদান ও লেখালেখিসহ সকল উম্মতের জন্য উপকারী বানান এবং আমাদেরকে তাঁর আদর্শে আদর্শবান হওয়ার তওফিক দান করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চু মাকাম দান করুন, আমীন। (চলবে ইনশা আল্লাহ)
[1] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৩৬-১৩৭, হাদীস: ৬৮০
[2] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:৮৭
[3] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:৮৮