হযরতুল উস্তায বোখারী (রহ.)-এর শেষ সময়গুলো
যুবাইর হানীফ
দিনটি ছিল ১৯ জুন রোববার৷ অন্যান্য দিনের মতো আজও সকাল ৯টার দিকে হযরতুল উস্তায অফিসে আসেন৷ মাওলানা সুহাইল, মাওলানা কামালুদ্দীন, মাওলানা আসহাবুদ্দীন ও মাওলানা রিয়াযুদ্দীন হুযুরকে হুইল চেয়ারে করে বাসা থেকে দফতরে নিয়ে আসেন৷ দরসের সময় হলে সহীহ বোখারী শরীফের দরস দিতে যান৷ পূর্ণ সুস্থতার সাথে দরস প্রদান করেন৷ আজ সহীহ বোখারী শরীফের দরসে ইসমতে আম্বিয়া ও শানে সাহাবা নিয়ে লম্বা আলোচনা করেন৷ শানদার দরস দেন৷ দরস থেকে দফতরে আসলে হুযুরের খাদেম মাওলানা রিয়াযকে চিনি দিয়ে রঙ চা দিতে বলেন৷ কারণ এর ৩ দিন পূর্ব থেকে হুযুরের সুগার ডাউন (কম) ছিল৷
এরপর হযরতুল উস্তাযের শেষ ১৫ মাসের পিএস ও একান্ত খাদেম মাওলানা সুহাইল বিন রশীদকে বলেন, মৌলভি সুহাইল! আজকে বোখারীর দরসে কিতাব তেমন পড়াইনি, বিষয়ভিত্তিক একটা আলোচনা করেছি৷ সে আলোচনাটা রেকর্ড থেকে মাসিক আত-তাওহীদে অনুলিখন করে দেবে৷ অতঃপর হযরত ওবায়দুল্ললাহ হামযা (হাফি.) ও রাঙ্গুনিয়া বদুপাড়ার জনাব হাজী শামসুল আলম সাহেবের সাথে কয়েকটি মাদরাসার শূরা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা যাবৎ রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন৷ একান্ত বিষয়ে পরামর্শ করেন৷ মাদরাসার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন৷ এর কিছুক্ষণ পর দ্রুত বাসায় চলে যান৷ বাসায় গিয়ে সুগার বাড়ানোর জন্য আম খান৷ আম খাওয়ার পর পর ডায়াবেটিস খুব বেড়ে যায়৷ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়৷ অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে বিধায় ডাক্তার দেখানোর ইচ্ছে করেন, চট্টগ্রাম যাবেন ডাক্তার দেখাতে৷
আসরের পর চট্টগ্রাম শহরে যেতে চাইলে পরিবার থেকে জানানো হয়, শহরে পানি৷ কীভাবে যাবেন? তখন মাওলানা জাকের সাহেব (হাফি.)-কে ফোন করেন, পটিয়ার আশপাশে ভালো কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় কিনা দেখতে বলেন৷ পাওয়া গেলে বাসায় নিয়ে আসার জন্য বলেন৷ এ দিকে মাগরিব হতে হতে হুযুরের অবস্থা আরও খারাপের দিকে চলে যায়৷ নিঃশ্বাস নিতে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছিল৷ মাগরিবের পর খুব বৃষ্টি হচ্ছিল৷ এ অবস্থায় খাদেমদের দিয়ে হুইল চেয়ারে করে নিচে নামেন৷ নামার সময় খুব জোরে জোরে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করছেন৷ অবস্থা দেখেই মনে হচ্ছিল খুব কষ্ট হচ্ছে৷ পরে গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রাওয়া হন৷
হাসপাতালের উদ্দেশ্যে
গাড়িতে উঠে হযরতুল উস্তায তাঁর সাহেবজাদা মাওলানা মানযার সাহেবকে কল করে একথা বলতে বলেন যে, যেন ভালো উন্নতমানের কেবিন নেয়৷ ভেতরে হাম্মাম ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে এমন৷ এদিকে পুরো চট্টগ্রাম শহর বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে৷ হাজার হাজার গাড়ির জ্যাম লেগেই আছে৷ সবগুলো ফ্লাইওভার পর্যন্ত জ্যামে পড়ে আছে৷ গাড়ি সামনে অগ্রসর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না৷ হযরতুল উস্তায খুব কষ্ট সহ্য করে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় করে চট্টগ্রাম সিএসসিআরে পৌঁছান৷ অথচ এক ঘণ্টার পথ মাত্র৷
পথিমধ্যে হযরতুল উস্তায গাড়িতে খুব বেশি কষ্ট পাচ্ছিলেন বুঝাই যাচ্ছিল৷ কিছুক্ষণ সিটে শুয়ে পড়েন৷ আবার উঠেন বসেন৷ আবার শুয়ে উঠেন৷ একবার এসি বাড়িয়ে দিতে বলেন৷ কিছুক্ষণ পর আরও বাড়িয়ে দিতে বলেন৷ অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছিল যে, ভেতরে খুব বেশি অস্থিরতা অস্থিরতা ভাব কাজ করছে। কারণ হযরতুল উস্তাযের হালাত তখন যায় যায়৷ কিন্তু মুখে কোনো আওয়াজ নেই৷ কোনো শেকায়েত নেই৷ সারাজীবনও তিনি এমন স্থীর ছিলেন৷ কখনও কাউকে অস্থিরতা দেখাতেন না৷
হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে গিয়ে দেখেন, যে নির্ধারিত ডাক্তারের চিকিৎসা নেওয়ার কথা, তিনি নেই৷ তার রোগী দেখার সময় শেষ৷ বাসায় চলে গেছেন৷ পরে তিন ডাবল অতিরিক্ত ফি দিয়ে তাকে বাসা থেকে আনানো হয়৷ ইমার্জেন্সি ডাক্তার এসে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অক্সিজেন ও ইঞ্জেকশন ইত্যাদি দেন৷ একটু পর হুযুরের জন্য রাতের খাবার আনা হলে অক্সিজেন খুলে খাবার খাওয়ানো হয়৷ হুযুর খাবার খান৷ সামান্য একটু খাবার খেয়ে উঠে হাম্মামে যান৷ হাম্মাম থেকে বের হওয়ার সময় হুযুরের হালাত আগের চেয়ে আরও বহুগুণে খারাপ হয়ে যায়৷ পুরো শরীর ঝাকুনি দিয়ে একদম নিস্তেজ হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়৷ এ অবস্থা দেখে ডাক্তার আইসিইউতে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন৷ সে হিসেবে রাতেই আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়৷ এখন থেকে সবকিছু ডাক্তারদের নিয়ন্ত্রণে চলে৷ আসা-যাওয়া সীমিত হয়ে যায়৷ খাবার-দাবার সব তাদের মতো করে দিচ্ছেন৷ পাইপ দিয়ে খাওয়াচ্ছেন৷ বাইরের খাবার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ!
সোমবার দুপুর বেলায় শরীর কিছু উন্নতির দিকে যাচ্ছিল৷ ডাক্তার বলেছেন, রাতে কেবিনে দেবেন৷ এ সময় একান্ত খাদেম মাওলানা সুহাইলকে ডেকে প্রায় এক ঘণ্টার মতো কথা বলেন৷ হুযুরের আইসিইউতে ভালো লাগছে না৷ তারা খাবার দিচ্ছেন না৷ পছন্দের খাবারগুলো পাচ্ছেন না৷ তাদেরগুলো দিচ্ছেন ইত্যাদি বলছিলেন৷ হুযুরকে বিকালে কেবিনে নিয়ে যাবে বলে ডাক্তারের পরামর্শটা শুনান তিনি৷ এরপর হযরতুল উস্তাযের ছোট সাহেবজাদা পটিয়া মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা আহমদ সাহেবকে ডেকে একান্তে কথা বলেন৷ এ দিন বিকালে মাগরিবের পর জামিয়া পটিয়ায় পূর্ব থেকে উস্তাযের সাধারণ মজলিসের তারিখ ছিল৷ হযরতুল উস্তাযই তারিখ দিয়েছিলেন৷ হুযুর তখন কল করে বলেন, মজলিসটি চালিয়ে যেতে৷ আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা না করতে৷ রাতের বেলায় হাসপাতালে হুযুরের নিজস্ব ডাক্তার পূর্ব থেকে যার চিকিৎসা নিয়ে আসছিলেন হুযুরকে দেখতে আসেন৷ তিনি অবস্থা দেখে পরামর্শ দেন, আপাতত কেবিনে না নিয়ে যেতে৷ আরও কিছু সময় আইসিইউতে রাখতে৷ অবস্থা আরও উন্নত হলে তখন নিয়ে যাওয়া যাবে৷
দুপুরের তুলনায় রাতে অবস্থা আরও খারাপের দিকে চলে যায়৷ এদিকে ডাক্তাররা বারবার দেখছেন৷ হুযুরের সাহেবজাদারাও আসা-যাওয়া করছিলেন৷ ১০ টার পর রাতে আর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি৷ পুরো রাত কীভাবে ছিলেন, কী করেছেন তা আল্লাহই ভালো জানেন৷ সকালে ফজরের পর মাওলানা রিয়ায হুযুরকে দেখতে গেলে দেখেন, চোখগুলো বড় বড় হয়ে আছে৷ মুখে জিকির করছেন৷ আর হাত দিয়ে অক্সিজেনের পাইপটা নাড়াছাড়া করছেন৷ মূলত তখন থেকে সাকারাত চলছে৷
সকাল নয়টার সময় ডাক্তার ডেকে বলেন, আপনাদের রোগীর মেশিন বন্ধ হয়ে গেছে৷ একটু পর জানালেন, তিনি আর নেই৷ উপস্থিত সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন৷
إنا لله وإنا إليه راجعون، إِنَّ للّهِ مَا أَخَذَ، وَلَهُ مَا أَعْطَى، وَكُلُّ شَيءٍ عِنْدَهُ بِأَجَلٍ مُسَمَّىٰ.
পরে জানা যায়, সকাল ৮:৪৫-এর দিকে এই দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে আল্লাহর প্রিয় হয়ে যান৷ ২০ জিলদক ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক ২১ জুন ২০২২ ইংরেজি মঙ্গলবার সকাল ৮:৪৫-এর দিকে ইন্তিকাল করেন৷
হাসপাতালে হুযুরকে সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করেন, হযরতুল উস্তাযের দুই সাহেবজাদা, পিএস ও খাদেম৷ মাওলানা মানযার সাহেব ও মাওলানা আহমদ সাহেব, একান্ত খাদেম মাওলানা সুহাইল বিন রশিদ কাসেমী ও খাদেম মাওলানা রিয়াযুদ্দীন৷ আল্লাহ তাদের জাযায়ে খায়ের দান করুন৷ পরিবার-পরিজন ও জামিয়ার সকল আসাতিযাকে সবরে জমিল নসিব করুন৷
এ শোকবার্তা মুহূর্তে পুরো বিশ্বের নিকট ছড়িয়ে পড়ে৷ পুরো জামিয়া পটিয়ায় শোকের ছায়া নেমে আসে৷ আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে৷ যে উস্তাযই শুনেন সে উস্তায কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ পুরো পরিবেশটা কান্নামুখর হয়ে উঠে৷
জানাযার নামাজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় রাত ১০টায়৷ এদিকে হযরতুল উস্তাযের বড় সাহেবজাদা মাওলানা রেজাউল করীম বোখারী সাহেব দুবাই থেকে তৎক্ষণাৎ ইমার্জেন্সি টিকেট করে বিকাল ৫টায় চট্টগ্রাম বন্দরে অবতরণ করে৷
হাসপাতালের পাওনা পরিশোধ করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হুযুরকে জামিয়া পটিয়ায় আনা হয়৷ হাজার হাজার ছাত্র উস্তায রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন কখন হুযুরকে আনা হবে৷ হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স করে আনা হয়৷ অ্যাম্বুলেন্স জামিয়া পৌঁছালে গাড়ি থেকে নামিয়ে গোসল দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়৷ তখনও উপস্থিত কেউ দেখেননি৷ গোসলের নির্ধারিত স্থান (তাফসীর বিভাগের সামানে) নিয়ে যাওয়ার পর হুযুরকে একনজর দেখার জন্য জামিয়ার মুরব্বি উস্তাযগণ উপস্থিত হন৷ হযরত আমিনুল হক (হাফি.), হযরত শামসুদ্দীন জিয়া (হাফি.), হযরত নায়েবে মুহতামিম ওবায়দুল্লাহ হামযা (হাফি.), নাজিমে তালিমাত হযরত জসিমুদ্দীন (হাফি.) ও নায়েবে নাযেমে তালিমাত হযরত যাকারিয়া আজহারী (হাফি.)সহ অন্যান্য উস্তাযগণ একত্রিত হন৷
হযরতুল উস্তায (রহ.)-কে গোসলের খাটে রেখে সবেমাত্র চেহারাখানা খোলা হল, চেহারাটুকু দেখেই মুরব্বি আসাতিযা থেকে নিয়ে উপস্থিত সকল আসাযিতা এভাবে কান্না শুরু করেন, মনে হচ্ছে আজ হৃদয়ের স্পন্দনকে হারিয়ে ফেলেছেন৷ বাস্তবেই তিনি আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন ছিলেন৷ সকল আসাতিযা হুহু করে কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ এ যেন আমরা আমাদের ঘরের অভিভাবককে হারালাম৷ সকলের চোখের কোণায় পানি ভাসছে৷ সইতে না পেরে এক নজর দেখে এসে গেলাম৷
গত বছর ডিসেম্বরের দিকে হযরতুল উস্তায কিছুটা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলন৷ জামিয়ার উস্তাযগণ সকলে মিলে খতম করে দোয়া করেছেন৷ সে দিন হযরত মুফতি হাফেজ আহমদুল্লাহ সাহেব (হাফি.) দোয়ার প্রাক্কালে কেঁদে কেঁদে বলেন, এত বড় বিশাল জাহাজ পরিচালনা করছেন তিনি, কত সুন্দর, সুষ্ঠুভাবে চলছে! তিনি চলে গেলে আমাদের কী হবে? এভাবে বলতে বলতে কাঁদতে আরম্ভ করেন৷ খুব দোয়া করেন৷
হযরতুল উস্তায মৃত্যুর দুইদিন পূর্বেও সুস্থ ছিলেন৷ মৃত্যুর আগের দিন রাতে কুরবানি বিষয়ে উস্তাযদের আম মজলিস হয়৷ জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় প্রতি বছর শিক্ষক ও খাদেমদের নিয়ে দুটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। একটি কুরবানের পূর্বে, অপরটি রমজানের পূর্বে। জামিয়া প্রধানের সভাপতিত্বেই সভাগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেহেতু এ সাধারণ সভাগুলো অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তাই সভার কয়েকদিন পূর্বেই এর তারিখ ঘোষণা করা হয়। যেন সকলেই উপস্থিত থাকতে পারেন। এ বছরও জামিয়া প্রধান হাকীমুল ইসলাম আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)-এর নির্দেশক্রমে সাধারণ সভার তারিখ ঘোষণা করা হয়। জামিয়ার মসজিদে ঘোষণা হলো, ‘আগামী ২০ জুন ২০২২ ইংরেজি সোমবার বাদে মাগরিব জামিয়ার মেহমানখানায় সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে।’ কিন্তু হঠাৎ এর একদিন পূর্বেই (১৯ জুন, রবিবার) হযরতুল উস্তায অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হন। তাই আমাদের ধারণা ছিলো, হয়তো নির্ধারিত সময়ে সেই সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে না। কিন্তু সোমবার বাদে আসর আবারো জামিয়ার মসজিদে ঘোষণা করা হলো, ‘পূর্বের ঘোষণা মতে আজ বাদে মাগরিব শিক্ষক ও খাদেমদের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে, ইনশা আল্লাহ।’
সুতরাং বাদে মাগরিব জামিয়ার মেহমানখানায় শিক্ষক ও খাদেমগণ উপস্থিত হলেন। শেষের দিকে মেহমানখানায় প্রবেশ করেন জামিয়ার প্রধান মুফতি ও মুহাদ্দিস আল্লামা মুফতি আহমদুল্লাহ সাহেব (হাফি.)। তিনি বলেন, আজকের সভায় মুহতামিম সাহেবের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন জামিয়ার নায়েবে মুহতামিম মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা (হাফি.)। সুতরাং তার জন্য একটি চেয়ারের ব্যবস্থা করুন। এতক্ষণ তিনি নিচে এক কোণায় বসা ছিলেন৷ কিন্তু তিনি চেয়ারে বসতে সংকোচবোধ করলেন। পরে মুরব্বিদের জন্যও আরও কয়েকটি চেয়ারের ব্যবস্থা করা হলো। এরপর তাঁকে উদ্ভোধনী আলোচনা করতে বলা হলো। তখন তাঁর পাশের চেয়ারে বসা ছিলেন জামিয়ার সিনিয়র মুফতি ও মুহাদ্দিস হযরতুল উস্তাত আল্লামা মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া (হাফি.)। তিনি বিনয়ের সাথে তাঁকে কানে কানে বললেন, হুযুর! আমি কী বলবো? হুযুর বললেন,
خدا جب حسن دیتا ہے نزاکت آہی جاتی ہے۔
আরম্ভ করো, প্রয়োজনীয় কথা আল্লাহ বের করে দেবেন, ইনশাআল্লাহ। এবার আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযা (হাফি.) আলোচনা শুরু করলেন।
তিনি বলেন, আমরা সকলেই জানি আমাদের মুহতামিম সাহেব হুযুর অসুস্থ। তিনি এখন আইসিইউতে আছেন। তাই পরামর্শক্রমে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আজকে সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে না। কিন্তু মুহতামিম সাহেব হুযুর নিজেই ফোন করে বলেছেন, বৈঠক চালিয়ে যেতে। তাই আমি কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ। মূলত আমি নিজেকে নসিহত এবং আমার বিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর সামনে দরসের হাজিরি ও তাকরারের উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বলছি। তিনি খুবই বিনয়ী ও অত্যন্ত নম্র ভাষায় কুরআন-হাদীসের আলোকে সাধারণ সভা সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এরপর প্রস্তাবিত অ্যাজেন্ডাগুলোর পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। উপস্থিত সকলেই সন্তুষ্টচিত্রে তা মেনে নেন। ঠিক এর এক দিনের মাথায় আল্লাহ আপন করে নিলেন আমাদের হযরতুল উস্তাযকে৷ এ যেন জান্নাতি মানুষের পরপার যাত্রা!
১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছর পটিয়া মাদরাসায় খেদমত করেছেন৷ নিজের জীবনের বিশাল একটা সময় এখানে কাটিয়েছেন৷ রক্ত-ঘাম দিয়ে পটিয়াকে তিলে তিলে সাজিয়েছেন৷ ইত্তেহাদুল মাদাসির বাংলাদেশ বোর্ডকে সমুন্নত করেছেন৷
দীর্ঘ ১৪ বছর মুহতামিম ও ৫ বছর নায়েবে মুহতামিমর জিম্মাদারি পালন করেছেন৷ খুবই নিখুঁত ও সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করেছেন৷ হুযুরের জীবন পুরোটাই হেকমত ও ইলমে ভরপুর ছিল৷ দরসে যার কোন মেসাল ছিল না৷ এত স্পষ্টভাষী, গোছানো ও সুন্দর দরস ছিল যা যেকোনো ছাত্র, অতিথিকে মুগ্ধ করত৷
দেখানো আরম্ভ
জোহরের পর থেকে দেখনো আরম্ভ হয়৷ ছাত্র ও আগত মেহমানদের উপচে পড়া ভিড় শুরু হতে থাকে৷ দূর দূর থেকে মেহমানরা দল বেঁধে আসতে থাকেন৷ মাগরিব হতে না হতে পুরো জামিয়া কানায় কানায় ভরে যায়৷ সুদূর দিনাজপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল থেকে নিয়ে ঢাকা, কুমিল্লা, বি. বাড়িয়া, নেয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবন, টেকনাফ পর্যন্ত থেকে ওলামায়ে কেরাম এসেছেন৷ উত্তরবঙ্গের অসংখ্য গাড়ি জ্যামে আটকে নির্ধারিত সময়ে জানাযায় উপস্থিত হতে পারেনি৷ রাত ৮টার পর বাইপাস থেকে আর ভেতরে গাড়ি প্রবেশ করতে পারেনি৷ রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দেখানো হয়৷ ৯টার পর নামাজের প্রস্তুতি৷ সাড়ে ৯টায় ইশার নামাজ হয়ে সাথে সাথে জানাযার প্রস্তুতি শুরু হয়৷
পুলিশ মোতায়েন
হুযুরের ইন্তিকালের খবর শোনামাত্র পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম শহর থেকে এক বাস পুলিশ পাঠিয়ে দেন৷ মূল মূল পয়েন্টগুলোতে শখানেক পুলিশ মোতায়েন করা হয়৷ পুরো পরিবেশ পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রদের পাহারার মাধ্যমে সুশৃঙ্খল রাখা চেষ্টা করা হয়৷ আল-হামদু লিল্লাহ শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলার সাথে সবকিছু আঞ্জাম দেওয়া হয়৷
হাজারো মানুষের জানাযায় অংশগ্রহণ
হযরতুল উস্তাযের জানাযায় হাজার হাজার ছাত্র, মুরিদ, মুহিব্বীন অংশ গ্রহণ করেন৷ দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম অংশগ্রহণ করেন৷ ঢাকা থেকে বায়তুল মুকাররমের খতীব হযরত রুহুল আমিন সাহেব, বেফাকের মহাসচিব হযরত মাহফুল হক সাহেব, আফতাব নগর মাদরাসার মুহতামিম মুফতি মুহাম্মাদ আলী কাসেমী সাহেব, হযরত ইয়াহইয়া মাহমুদ সাহেব, সাইনবোর্ড ওলামানগর মাদরাসা মুহতামিম হযরত মুফতি মুখলিসুর রহমান কাসেমী সাহেব, ছনটেক মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান রহমানী সাহেব, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ ও জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আয়িম্মা পরিষদের মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানসহ অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম৷
চট্টগ্রাম থেকে দারুল মাআরিফের মুহতামিম পটিয়ার শূরার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হযরত সুলতান যাওক সাহেব (হাফি.), মাওলানা ফুরকানুল্লাহ খলিল সাহেব, হাটহাজারী মাদরাসারা মুহতামিম হযরত ইয়াহইয়া সাহেব, হযরত জসিম সাহেব, নানুপুর মাদরাসার মুহতামিম সালাহুদ্দীন সাহেব, হযরত ইমদাদুল্লাহ সাহেব, চট্টগ্রাম ইসলামিক বিশ্ববিদ্যায়ের প্রধান ড. আবু রেজা নদভী এমপি সাহেব, শূরা সদস্য জামালপুর মাদরাসার মুহতামিম সাহেব ও অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালেদ হুসাইন সাহেব৷ ফেনী থেকে জামিয়া মাদানিয়া সিলোনায়ার মুহতামিম হযরত সাইফুদ্দীন কাসেমী, নায়েবে মুহতামিম হযরত মুফতি আহমদুল্লাহ সাহেব, ছাগলনাইয়া আজিজিয়ার মুহতামিম রুহুল আমিন সাহেব৷ বগুড়া জামিল মাদরাসার মুহতামিম হযরত আবদুল হক হক্কানী ও হযরত শফি কাসেমীসহ একটি জামায়াত৷ এছাড়া বিভিন্ন সরকারি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত ছিলেন৷
জানাযার নামাজ সম্পন্ন
জানাযার নামাজের পূর্বে সময় সল্পতার দরুন শুধু ৩জন মানুষ কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন৷ হুযুরের বড় সাহেবজাদা মাওলানা রেজাউল করীম সাহেব৷ তিনি কথা শেষ করে জানাযার নামাজে ইমামতি করার হযরত মুফতি আহমদুল্লাহ সাহেব (হাফি.)-কে অনুরোধ করেন৷ এরপর হযরত মুফতি হাফেজ আহমদুল্লাহ সাহেব (হাফি.) সংক্ষিপ্তভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন৷ তিনি বলেন, হযরত বোখারী সাহেব তাঁর জীবদ্দশায় দুটি কাজ করে গেছেন৷
- পটিয়া জামিয়ায় তিনি তাঁর তত্ত্বাবধানে স্কলারদের নিয়ে জামিয়ার শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রদত্ত ৬৪ ভলিয়মের পাণ্ডুলিপির ফতোয়াকোষ প্রণয়নের বৃহৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিলেন। পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ বেশ এগিয়ে চলে, কিন্তু হায়াতের অভাবে তিনি পূর্ণতা দিতে পারেননি। কুরবানির পূর্বে ইনশাআল্লাহ দুই খণ্ডের কাজ শেষ হবে৷
- তিনি তার জীবদ্দশায় নায়েবে মুহতামিম নির্ধারণ করে গেছেন৷ তার সাথে রেখে সকল কাজ বুঝিয়ে ও দেখিয়ে দিয়ে গেছেন৷ এখন থেকে পরবর্তী শূরার বৈঠক হওয়ার আগ পর্যন্ত পরামর্শ ও সংবিধানের সিদ্ধান্ত মতে মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম হলেন হযরত ওবাইদুল্লাহ হামযা সাহেব৷ তিনি মাদরাসায় বোখারী সাহেব (রহ.)-এর কাজগুলো আঞ্জাম দেবেন৷
এরপর হযরত ওবাইদুল্লাহ হামযা সাহেব (হাফি.)সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন৷ যারা এসেছেন দূরদূরান্ত থেকে তাদের জন্য দোয়া করেন৷ পটিয়ার জন্য দোয়া চান৷ সকলের কষ্টের জন্য ক্ষমা চান৷ শেষে হযরত মুফতি হাফেজ আহমদুল্লাহ সাহেব (হাফি.)-এর ইমামতিতে রাত ১০:২০ মিনিটে নামাজ সম্পন্ন হয়৷ জানাযার সময় পুরো জামিয়ার কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না৷ মাঠ, মসজিদ, প্রত্যেক তলার বারান্দা, রাস্তা, রেল লাইন ইত্যাদি সব কানায় কানায় ভরপুর ছিল৷ জানাযা রাখা হয়েছিল রেল লাইনের পশ্চিম পাশে৷ অবশেষে রাত ১১টার পর হযরতুল উস্তাযকে জামিয়ার মাকবায়ে আযীযীতে হযরত নূরুল ইসলাম কাদীম সাহেব (রহ.)-এর পাশে চিরসমাহিত করা হয়৷
نوره الله مرقده وجعل الجنة مثواه.
হযরতুল উস্তাযের কিছু বৈশিষ্ট্য
হুযুর কখনো অলস সময় কাটাতেন না। হুযুরের জীবন ছিল গোছানো। যতক্ষণ জেগে থাকতেন, কাজে কাটাতেন। দেখা যেতো তার ঘুম হতো না, ঘুমের ওষুধ খেতে হতো। তখনও যতক্ষণ জেগে থাকতেন, কাজ করতেন। আলসেমিকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না, পছন্দও করতেন না। অলসতা কী জিনিস তা তাঁর ডাইরিতে ছিল না৷ প্রতিটি কাজ তিনি ঠিক সময়ে আঞ্জাম দিতেন৷
হযরতুল উস্তায নিজে একাই একটা সমাজ ছিলেন৷ একটা লাজনা (বোর্ড) ছিলেন৷ বৃহৎ একটা লাজনার কাজ নিজে একাই আঞ্জাম দিতেন৷ তিনি একাধারে
- জামিয়া পটিয়ার প্রধান,
- জামিয়ার শায়খুল হাদীস,
- মাসিক আত-তাওহীদের প্রধান সম্পাদক,
- বাংলাদেশ তাহফীজুল কুরআন সংস্থার সভাপতি,
- আঞ্জুমনে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের মহাসচিব,
- বাংলাদেশ ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সভাপতি।
ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ বোর্ডকে নিজে ঢেলে সাজিয়েছেন৷ হুযুর বলেন, ইত্তেহাদের কাজ করতে করতে চট্টগ্রাম শহরে আসা-যাওয়ায় গাড়ির ধুলাবালিতে আমার চুল সাদা হয়ে গেছে৷’ হুযুর পুরো জীবন পটিয়ার জন্য, পটিয়া সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন৷
জামায়াতের সাথে নামাজ
হুযুর দৈনিক জামায়াতের সঙ্গে সবসময় নামাজ পড়তেন। কিন্তু শেষ বয়সে দুর্বলতার কারণে মাঝে-মধ্যে পড়তে পারতেন না। তিনি ঘরে থাকেন কিংবা সফরে, বাইরে, তাহাজ্জুদ তার ছুটতো না। যত রাতেই ঘুমাতেন, ঠিক তাহাজ্জুদে উঠে যেতেন। এলার্ম বাজুক আর না বাজুক। শেষরাতে যখন উঠতেন, কাউকে ডাকতেন না। নিজে কষ্ট করে অজু-ইস্তেঞ্জা করে নামাজ পড়তেন। জিকির করতেন। এছাড়া অন্য সময় হুযুরকে ধরে ধরে সব করাতে হতো অজু, গোসল ইত্যাদি।
হাদীসের দরস
হযরতুল উস্তায আজীবন হাদীসের খেদমত করেছেন৷ পটিয়ায়ই ৪০ বছর হাদীসের খেদমত করেছেন৷ সর্বমোট ৫০ বছর হাদীসের খেদমতের সাথে জড়িত ছিলেন৷ হাদীসের দরসে হুযুর ছিলেন পুরোধা। সেই যৌবনদীপ্ত সময়ে হুযুর তিরমিযীর দরস দিতেন নিজস্ব ও অনন্য কৌশলে। সে সময়কার তালিবুল ইলমরা পটিয়ায় দাওরা পড়ে ইলম আহরণের জন্য যেতেন দারুল উলুম দেওবন্দ। তারা দেওবন্দে অন্য সব দরসে নতুনত্ব খুঁজে পেলেও হুযুরের তিরমিযীর দরসের চেয়ে নতুন ও বাড়তি কিছু পেতেন না। পরে হুযুর নিজস্ব ধারায় বুখারী আওয়ালের দরস দিয়েছেন আমৃত্যু। ঠাণ্ডা-মাথায় স্পষ্ট ভাষায় ধীরে-সুস্থে তাকরীর, গুছানো বর্ণনা ও অভিনব পদ্ধতিতে বিবরণ ছিল হুযুরের দরসের মূল বৈশিষ্ট্য। হাদীসশাস্ত্রের ওপর বিশেষ পাণ্ডিত্য থাকলেও তাফসীর, ফিকহ, সাহিত্য, ইলমুল কালাম, নাহভ-সারাফ ও বালাগত শাস্ত্রে তাঁর সমান বিচরণ ছিল।
সফল মুহতামিম
তিনি ছিলেন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সফল মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদীস। সুদীর্ঘ আট দশকের ইতিহাসে জামিয়া পটিয়া যেসব সৃজনশীল মনীষী, তীক্ষ্ণ মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান আলেম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় হলেন আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)। প্রতিভার বহুমাত্রিকতা ও জ্ঞান গভীরতা তাঁর জীবনকে বিশিষ্টতা দান করে। তাঁর পুরো জীবনটাই ইলমে দীন আহরণ ও বিতরণে ব্যয় হয়। হৃদয়গ্রাহী, মনোমুগ্ধকর পাঠদান পদ্ধতির ফলে অতি মেধাবী ও কম মেধাবী সব ছাত্রই তাঁর দরস থেকে উপকৃত হতো। তাঁর জীবনের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম ছিলো নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাপ্রিয়তা। সময়ের মূল্যায়ন ও যথা সময়ে কাজ আঞ্জাম দেওয়া তাঁর অন্যতম স্বভাব। কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও নীতিমালা অনুসরণে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। তাঁর সুষ্ঠু পরিচালনায় জামিয়া পটিয়ার নিয়ম-শৃঙ্খলা নতুনভাবে সজীবতা লাভ করে।
নায়েবে মুহতামিম নিয়োগ
জামিয়ার ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিলো সদা নিবিষ্ট। তাই তিনি যখন অনুভব করলেন যে, জীবন হয়তো বেশিদিন সঙ্গ দেবে না, তখনই তিনি ২০২০ সালের অক্টবর মাসেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করেন। প্রথমত মজলিসে আমেলার মাধ্যমে, পরবর্তীতে মজলিসে শূরার অনুমোদনক্রমে হযরত ওবায়দুল্লাহ হামযা (হাফি.)-কে নায়েবে মুহতামিম নির্ধারণ করেন। দীর্ঘ দুই বছর যাবৎ তাঁকে কাছে রেখে জামিয়ার আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কাজগুলো আঞ্জাম দিয়ে যান।
হযরত হাফেজ আহমদুল্লাহ সাহেব (হাফি.) বলেন, ২০২০ সালে আক্টবর মাসে এক জুমার পবিত্র দিনে হযরত বোখারী সাহেব আমার পাশে মসজিদে মেহরাবের পাশে গিয়ে বসলেন৷ বললেন, মুহাদ্দিস সাহেব! আমি তো দুর্বল হয়ে গেছি৷ বেশি কাজ-কর্ম করতে পারছি না৷ বাইরের সফরগুলো করা সম্ভব হচ্ছে না৷ এত বড় এদারা কীভাবে চলবে? এরপর বললেন, আমি চাচ্ছি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাকে জামিয়ার নায়েবে মুহতামিম বানাতে৷ সে মাশাআল্লাহ, কর্মঠ মানুষ৷ যোগাযোগ ইত্যাদি ভালো৷ আমি তাঁকে নিয়ে আশাবাদী৷ হাফেজ সাহেব হুযুর উত্তরে বললেন, খুব যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনি৷ বেশ ভালো হবে৷ আল্লাহ তাআলা উভয় হযরতের অন্তরে পবিত্র দিনে, পবিত্র স্থানে, মুবারক সময়ে এ বিষয়টি ঢেলে দেন৷ উভয়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছান৷ এরপর আরও কয়েক মাস যাবৎ হযরতুল উস্তায মুহতামিম সাহেব (হাফি.) বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ভাবেন৷ ইস্তেখারা করেন৷ পরবর্তীতে মন পরিপূর্ণভাবে সায় দিলে তা মজলিসে আমেলাতে তা পাশ করান৷
এদিকে হযরতুল উস্তায (রহ.)-এর ইন্তিকালের ১১-১২ দিন পূর্বে ঢাকার এক মাদরাসার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও শায়খুল হাদীস পটিয়া মাদরাসায় তাশরীফ আনেন৷ মাদরাসায় এসে হযরত ওবায়দুল্লাহ হামযা সাহেব (হাফি.)-এর সাথে বিশেষ সাক্ষৎ করেন৷ সাক্ষাতের পর হযরত ওবায়দুল্লাহ হামযা সাহেব (হাফি.) মেহমানকে নিয়ে হযরতুল উস্তায আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)-এর নিকট মুলকাত করতে যান৷ মেহমানদের সাথে হযরতুল উস্তায (রহ.) দীর্ঘ সময় ধরে কথাবার্তা বলছিলেন৷ ওই সময় হযরতুল উস্তায (রহ.)-এর নিকট ঢাকার মেহমান তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটি পটিয়ার মুরব্বিদের পরামর্শে পরিচানলার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলে, হযরতুল উস্তায ওই মাদরাসার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন৷ আর বলেন, ‘আপনারা আমাদের নায়েবে মুহতামিম হযরত ওবায়দুল্লাহ হামযা মুদ্দাযিল্লুহর সাথে যেকোনো বিষয়ে পরামর্শ করবেন৷ আমার সব কাজ এখন তিনিই আঞ্জাম দিচ্ছেন৷ আল্লাহর শোকর আমাদেরকে তাঁর মতো এরকম যোগ্যতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তিত্ব মিলিয়ে দিয়েছেন৷ আরবি, বাংলা, ইংরেজি সব ভাষায়ই তিনি সমান পারদর্শী৷ দেশ-বিদেশে বেশ সুনাম-সুখ্যাতি রয়েছে৷ তাছাড়া দেশের প্রসিদ্ধ একজন ইলমি বক্তা৷ আমরা তাঁকে নিয়ে সামনে আশাবাদী৷ বিগত দুই বছর যাবৎ আমার সব জিম্মাদারি, যোগাযোগ, শূরার মিটিং, সভা ইত্যাদি আমার পক্ষ হয়ে তিনি সব খুব সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিচ্ছেন, মাশাআল্লাহ৷ এ রকম ব্যক্তি আল্লাহ আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন, আল-হামদু লিল্লাহ৷ তার সাথে যোগাযোগ করে কাজ চালিয়ে যাবেন৷ সুযোগ হলে, আমার শরীর সায় দিলে আমি আপনাদের মাদরাসায় নিজেই উপস্থিত হব৷ আশপাশের মাদরাসার উস্তাযদেরসহ নিয়ে বসব৷ কথা বলব ইনশাআল্লাহ।
হযরত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা সাহেব (হাফি.)
তিনি ১৯৭২ সালে কক্সবাজার উখিয়ায় হযরত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা সাহেব এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন৷ তিনি জামিয়া পটিয়া হতে ১৯৯২ সালে বেফাকুল মাদারিস বোর্ডের তাকমীল শ্রেণিতে রেকর্ড সংখ্যক মার্ক পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন৷ ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় পাঠ দান করে যাচ্ছেন৷
মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা (হাফি.) তারুণ্যদীপ্ত দায়ী ও মুফাক্কিরে ইসলাম৷ দারুল উলুম দেওবন্দের যোগ্য উত্তরসূরি৷ দেওবন্দের ফিকির লালন করেন৷ বহুমাত্রিক মেধা ও চিন্তাশীল মননের অধিকারী। তিনি একাধারে জামিয়ার সিনিয়র উস্তায, বাংলা-আরবি, উর্দু ও ইংলিশে সমান পারদর্শী। জামিয়ার ত্রৈমাসি আরবি ও ইংরেজি ম্যাগাজিন বালাগুশ শারকের সম্পাদক ও মাসিক আত-তাওহীদের সহকারী সম্পাদক। এছাড়াও তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাসম্পন্ন সুবক্তা ও সুপরিচিত লেখক।
তিনি দেশে-বিদেশে অনেক প্রোগ্রাম, অনুষ্ঠান-সভা ও সেমিনারে অতিথি-আলোচক বা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিয়মিত। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকা পযর্ন্ত তাঁর রয়েছে সমৃদ্ধ দাওয়াতী তৎপরতা। এছাড়া তাঁর রয়েছে বেশ কিছু প্রকাশনা, চিন্তাঋদ্ধ বক্তৃতা ও আলোচনাপুঞ্জ মাশাআল্লাহ। পাশাপাশি আধ্যাত্মিক লাইনে হযরত পীর যুলফিকার নাকশবন্দী (হাফি.)-এর বায়আত৷ তিনি তাঁর সাথে পরামর্শ করে চলে থাকেন৷
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক একাডেমিক সেমিনারে অংশ নিতে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লেবানন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, পাকিস্তান, হংকং, থাইল্যান্ড, ওমান, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, লেবনান ও বাহরাইনে সফর করেছেন। এছাড়াও তিনি সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংকের শরীয়াহ অ্যঅডভাইজারি বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে ১৯৯৪-২০০০ পর্যন্ত সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা ও বিমানচলাচল মন্ত্রণালয়ে অনুবাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
হযরতুল উস্তায আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)-এর মৃত্যুর পর পরামর্শের ভিত্তিতে জামিয়ার ভারপ্রাপ্ত মুহতামিমের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা সাহেবকে৷ আমরা আশা করি, হযরত হাজী ইউনুস (রহ.), হযরত হারুন ইসলামাবাদী (রহ.) ও আল্লামা বোখারী (রহ.)-এর মতো হযরতুল উস্তায মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা সাহেব (হাফি.)ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জামিয়ার সফল প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হবেন। জামিয়াকে তিনি রুহানিয়াত ও ইলমিয়াতের উৎকর্ষতায় দারুল উলুম দেওবন্দের আদলে একটি ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইনস্টিটিউশনে রূপান্তরের ভিশন হাতে নেবেন। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা জামিয়ার সন্তানদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র ইনশাআল্লাহ। জামিয়া পরিণত হতে পারে উম্মাহর গর্ব ও প্রত্যাশার শান্তি সুনিবিড় এবং শীতল-মৃদুল ছায়াঘেরা এক বটবৃক্ষে।
শিক্ষক: জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম