জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাওলানা ভাসানী: বাম রাজনীতি ছেড়ে হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের প্রচেষ্টা

মাওলানা ভাসানী: বাম রাজনীতি ছেড়ে হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের প্রচেষ্টা

সাঈদ হোসাইন

মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। তাঁকে অনেকেই একজন বামপন্থী নেতা হিসেবে জানেন। জীবনের বিরাট একটি অংশ তিনি বামপন্থীদের সাহচর্যে কাটিয়েছেন। কিন্তু তাদের মতো ধর্মবিরোধী মনোভাব তাঁর মধ্যে কখনোই ছিল না। আজীবন তিনি ছিলেন ধর্মীয় জীবনবোধে গভীর বিশ্বাসী একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর শিক্ষাজীবন কেটেছে মাদরাসা ও পীর-মাশায়েখের ছায়ায়। দেওবন্দে পড়াকালীন তিনি শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীর মাধ্যমে প্রভাবিত হন। সে-সময় তিনি শাইখুল হিন্দের সংগ্রামী চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে নিজেও সংগ্রামী জীবনের সূচনা করেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মাওলানা ভাসানী ইসলামি আদর্শভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের প্রশ্নে ছিলেন আপোসহীন। এই জন্যেই পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী শাসকগোষ্ঠীর সাথে তাঁর আদর্শিক দ্বন্দ্ব তীব্র হয়। এসময় মার্কসীয় দর্শনের ঢেউয়ে সারা বিশ্ব প্লাবিত ছিল। একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশাকে পুঁজি করে এই দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। মাওলানা ভাসানী তখন সমাজবিপ্লবের স্বার্থে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে মার্কসবাদীদের কাছে টানেন। কারণ মার্কসবাদের কতিপয় বিষয় ইসলামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই তখন তিনি মার্কসবাদকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেন। এই দর্শন যে ইসলামি আদর্শের পরিপন্থী, তা তিনি ভালো করেই জানতেন। কমিউনিস্ট ও কমিউনিজম সম্পর্কে মাওলানা ভাসানীর কয়েকটি মন্তব্য লক্ষ করলেই বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। নিম্নে তাঁর কয়েকটি মন্তব্য দেওয়া হল:

  1. একবার তিনি হাজী মুহাম্মদ দানেশ নামক এক কমিউনিস্টকে বলেন, ‘হাজী সাহেব, আমার ইসলাম যদি সত্য হয় তবে হাজারটা কমিউনিস্টও ইসলামকে ঠেকাতে পারবে না।’ (মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, হাসান আবদুল কাইয়ূম সম্পাদিত, প্রকাশনায়: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: ২০ জানুয়ারি ১৯৮৮, পৃ. ৪)
  2. ১৯৭৪ সালে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তথাকথিত বিপ্লবী নামধারী কমিউনিস্টরা গত ৩০ বছর যাবৎ আমার ঘাড়ে সওয়ার হইয়া রাজনীতি করিতে চাহিয়াছে। কিন্তু সে আশা তাহারা পূরণ করিতে পারে নাই। কারণ কোনো কালেই আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না এবং বর্তমানেও না, ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও হইব না। আমি আজীবন ইসলামের জন্য এবং শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছি। ইনশাআল্লাহ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাহাই করিয়া যাইব। তথাকথিত বিপ্লবীদের আমি আগেও বলিয়াছি, আমার পিছনে ঘুরিয়া কমিউনিজম প্রচার করিয়া কোনো লাভ হইবে না। তোমরা নিজস্ব আদর্শ অনুযায়ী পৃথক সংগঠন গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা কর। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৮৯-৭৯০)
  3. মওলানা ভাসানী পঞ্চাশের দশকে গণচীন সফরে যান। মাও সেতুংয়ের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মওলানা ভাসানী চেয়ারম্যান মাওকে বলেছিলেন, ‘আপনার সমাজতন্ত্র আমি গ্রহণ করতে পারতাম, যদি এতে আল্লাহ থাকতেন।’ মাও সেতুং হেসে বলেছিলেন,

‘মি. মওলানা, আপনারা কুরআনে যা পড়েন, আমরা বাস্তবে তা কাজে লাগিয়ে সমাজতন্ত্র গড়ে তুলছি।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭০)

  1. মওলানা ভাসানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বলেন, ‘তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হলে নতুন সংবিধান রচনা করবে। তিনি ইসলামী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করার জন্য সকলকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ইসলাম মার্কসবাদ, লেনিনবাদ বা মুজিববাদ হইতে অনেক বেহতর।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭৬)

সমকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাধারা তাঁকে আকৃষ্ট করেছে এটা সত্য। কিন্তু তিনি কোনোটাই গ্রহণ করেননি। সমকালের বেশকিছু আলেম তাঁকে কাফের সাব্যস্ত করত। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বামপন্থীদের সঙ্গে কাজ করেছেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মন থেকে কখনোই তাদের মতবাদ গ্রহণ করেননি—এটাই চিরসত্য। এ কারণেই দেখা যায়, রাজনৈতিক দীর্ঘ জীবনের এক পর্যায় এসে তিনি বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও নির্বাচনের রাজনীতির বিরোধিতা করেন। শেষ জীবনে তিনি প্রায় সব রাজনৈতিক সহচরকে ছেড়ে দিয়ে ১৯৭৪ সালে ‘হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। হুকুমতে রব্বানিয়া সম্বন্ধে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর জমিনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম করাই হুকুমতে রব্বানিয়া।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪১)

জীবনের শেষকালে এসে মওলানা ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবার আমি এদেশের কৃষক-শ্রমিক, সর্বহারা-মেহনতি মানুষকে নিয়ে এমন এক বিপ্লব করব, যা বিশ্বের কেউ কোথাও দেখেনি—আমি হুকুমাতে রব্বানি কায়েম করব—যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে এক শোষণহীন খোদায়ী সমাজব্যবস্থা।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৬৭)

বিপ্লবী দার্শনিক আল্লামা আজাদ সোবহানী তাঁকে রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলেও মূলত হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের লক্ষ্যেই যেন তিনি সংগ্রাম করেন, সে-ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে ‘হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতি’ প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে ‘রবুবিয়াতের ভূমিকা’ শিরোনামে এক পুস্তিকায় মওলানা ভাসানী নিজেই এ সম্পর্কে লিখেছেন,

‘আল্লামা বলিলেন, তবে আজ ওয়াদা কর—তুমি রাজনৈতিক জীবনে যত কলাকৌশলই লও না কেন মূলত হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের লক্ষ্যে সংগ্রাম করিয়া যাইবা। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়িল মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা হাসরত মোহানী, মওলানা ওবায়দীর কথা। আমার মনে পড়িল খিলাফত আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু ও মওলানা মোহাম্মদ আলীর সাহচর্যের কথা। আমি দেখিলাম, যৌবনের উচ্ছ্বাস শেষে যে রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়াছিলাম আজ প্রৌঢ় জীবনে সেই রাজনৈতিক দর্শনের দাওয়াতই আসিয়াছে। আমি তাই ইতস্তত করিলাম না। মওলানা আজাদ সোবহানীর হাতের ওপর আমার হাত ছিল। তাঁহার কল্পনায় আমাদের হাত কাবাতে নিবদ্ধ ছিল। আমি বলিলাম, হাঁ, ওয়াদা করিলাম, রাজনীতিতে যা কিছুই করি হুকুমতে রব্বানিয়া হইতে লক্ষ্যচ্যুত হইব না।

দীর্ঘ ২৭টি বছর কাটিয়া গিয়াছে। আজ আমি ব্যাখ্যা করিয়া বলিতে চাই না কিভাবে আমি ধাপে ধাপে হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের পথে চলিয়া আসিয়াছি। অন্তঃদৃষ্টিসম্পন্ন কোন ভাষ্যকার যদি আবিষ্কার করিতে পারেন, তবে দেখিবেন ১৯২১ সাল হইতে আমি এই পথ ধরিয়াছি। কখনো কোথাও আমি কর্মি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছি। কোথাও আবার নেতৃত্ব দান করিয়াছি। আজ আমি পরিষ্কার ভঙ্গিমায় শুরু করিয়াছি হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের প্রস্তুতি। তাই গত ৮ই এপ্রিল (৭৪) সন্তোষে হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতি প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। সবারই মনে প্রশ্ন জাগে, এতদিনে কেন? আমি বিশ্বাস করি, সব কথা ও কাজের একটি মৌসুম আছে। যদি তাহা মৌসুম মাফিক মানুষের নিকট পেশ করা না হয় তবে অতীব কল্যাণকর বিষয়ও অর্থহীন এবং গুরুত্বহীন হইয়া পড়ে।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮৫-৪৮৬)

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনাও তিনি গ্রহণ করেছিলেন আল্লাহর জমীনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম করার আন্দোলনে আত্মনিবেদিত কর্মি সৃষ্টির লক্ষ্যে। ১৯৭৪ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-এর রূপরেখা ঠিক করে তিনি সেটা অনুমোদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের নিকট পাঠান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় রাখার সুপারিশ করেন। ভাসানী সাহেব তখনও তাঁর আদর্শে অবিচল থেকে সে প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আসলে আদর্শ প্রতিষ্ঠারই লড়াই। এর আদর্শ ইসলাম ও রুবুবিয়াত প্রচার। এতে মওলানা ভাসানীর নাম সংযোজন মানেই বিসমিল্লাতেই গলদ—রবুবিয়াতের বরখেলফে নফসানিয়াত কায়েম করে দেয়। আমি একজন একক ব্যক্তি। আর ইসলম একটি সুমহান আদর্শ, বিশ্বজনীন জীবনব্যবস্থা। কাজেই আমি তোমার পরামর্শ মেনে নিতে পারলাম না ।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪১)

১৯৭৬ সালের ২ অক্টোবর তিনি খোদায়ী খিদমতগার নামে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৭৬ সালের ১৩ই নভেম্বর তাঁর ইন্তিকালের মাত্র ৪ দিন পূর্বে সন্তোষস্থ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে খোদায়ী খিদমতগার সমাবেশে তিনি বলেন, ‘মদীনার নবীর আসহাবে সুফফার জীবনই হইবে তাহাদের আদর্শ। ক্ষমতার দন্দ্ব ও জাগতিক দেনা-পাওনাকে তাহারা এড়াইয়া চলিবে ঘৃণাভরে। মানুষের শাসনবাদকে উৎখাত করিয়া আল্লাহর শাসনবাদ কায়েম করাই হইবে খোদায়ী খিদমতগারদের লক্ষ্য।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২৫)

মাওলানা ভাসানী হুকুমতে রব্বানিয়া তথা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন কায়েমের সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তবে এই সত্যটা তিনি মানুষের কাছে তুলে ধরতে পেরেছেন যে, একমাত্র হুকুমতে রব্বানিয়ার মাধ্যমেই শোষণহীন, কল্যাণকর, প্রশান্তিদায়ক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব। বাকি সব মতবাদই ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদ, সৌদি আরব

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ