বহুগুণের মিশেলে নিভৃতচারী এক কর্মবীর আল্লামা আবদুল হালিম বোখারী (রহ.)
রোকন এনাম লোবান
আল্লামা আবদুল হালিম বুখারী (১৯৪৫-২০২২) ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা মনস্বী মনীষী। আমাদের দেশের কওমি ঘরানার আলেমগণ ভালো খতীব তথা আলোচক হন সাধারণত। পাশাপাশি লেখালেখিতে সিদ্ধহস্ত আলেম বিরলপ্রজ প্রায়। আবার কিছু আলেম আছেন তাঁরা চমৎকার লেখালেখি করেন কিন্তু আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্ত নন।
বুখারী সাহেব ছিলেন চমৎকার আলোচক, চমকদার লেখক। এরকম লেখালেখিতে প্রাঞ্জল আলোচনায় সমুজ্জ্বল বাঙালি মাওলানা খুবই কম।
কওমি ঘরানার আলেমগণ উর্দুতে পারঙ্গম, কেউ কেউ আরবি ভাষাতেও পারদর্শী। কিন্তু বাংলা ভাষায় যৌক্তিক কারণে আলেমগণ কিছুটা দুর্বল।
ইংরেজি ভাষায় সুদক্ষ আলেম খুবই দুর্লভ। মাওলানা বুখারী (রহ.) উর্দুতে উর্দুভাষী সাহিত্যিকদের মতো শক্তিমান ছিলেন। পাশাপাশি আরবিতে ছিলেন পারঙ্গম। হযরতের বাংলা ভাষা ছিল যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তাঁর লেখালেখি অত্যন্ত সুগঠিত, সুচিন্তিত, সুপরিণত ছিল এবং বাংলা ভাষার আলোচনাসমূহ ছিল মনোজ্ঞ ও মনোমুগ্ধকর।
যুগপৎভাবে ইংরেজি ভাষার প্রাথমিক, অফিশিয়াল এবং যোগাযোগের পরিভাষায়ও তিনি সহজাত ছিলেন। এমনকি ইসলামের ঐতিহ্য ও সাহিত্যের ভাষা ফারসি ভাষাও তাঁর দখলে ছিল। এতগুলো ভাষা দখলে থাকার কারণে কোরআন হাদিস থেকে নিয়ে অজস্র শাখা, জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখিকা হতে বিপুল জ্ঞান অর্জনের সুযোগ মরহুম রহমতুল্লাহি আলাইহ অবারিতভাবে পেয়েছিলেন।
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে মানুষই। একজন মহীরুহ মহিয়ান মানুষ গড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে বড় বড় মানুষের সান্নিধ্য।
গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে শুরু করে পুরো অর্ধশতাব্দী শ্রেষ্ঠ সকল মানুষের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছিলেন। বিশেষ করে ইসলাম ঘরানার বড় বড় আলেম, চিন্তাবিদ, সংস্কারক, বড় বড় চিন্তার উদ্বোধক, এবং বড় বড় কর্মকাণ্ডের স্বাপ্নিক পুরুষদের সাহচর্যে তিনি ঝদ্ধ হয়ে এসেছিলেন।
তাঁর জীবনে এসব আল্লাহঅলা, আমলঅলা, ইলমঅলা এবং দীনের ফেরিওয়ালাদের ব্যাপক প্রভাব ছিল সমগ্র জীবন।
আল্লামা বুখারী (রহ.)-এর পিতা ছিলেন মাওলানা আবদুল গনী (রহ.)। তিনি একজন আহলে দিল, আল্লাহঅলা, মুখলেস, সাচ্ছা দরদী আলেমে দীন।
বুখারী (রহ.) তাঁর বাবার সোনালি শাসন সোনালু শিক্ষা এবং সোনাঝরা দোয়ায় বেড়ে উঠেছেন। আল্লামা বুখারী (রহ.) নিশ্চিতভাবে পটিয়া মাদরাসার সূর্য-স্বর্ণ সন্তানদের অগ্রভাগে জ্বলজ্বল করবেন। পড়াশোনা শেষ করার পরে তিনি মুহাদ্দিস হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেছেন। আমৃত্যু তিনি হাদিসের দরস প্রদান করে জীবনকে হৈমিক স্তবকে সওগাত করে রেখেছেন। কওমি মাদরাসার পাশাপাশি সরকারি মাদরাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি তাঁর ছিল। তিনি সরকারি মাদরাসায়ও হাদিসের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন।
আল্লামা বুখারী (রহ.) অত্যন্ত সাবলীলভাবে সহজ সরল ভাষায় সবক প্রদান করতেন। তিনি যখন উর্দু ভাষায় ক্লাস নিতেন আপনার মনে হতে পারে এটা পাকিস্তানের কোন শ্রেষ্ঠ আল্লামা ক্লাস নিচ্ছেন।
বাংলা ভাষায় যখন আলোচনা করতেন মনে হতো তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। মুক্তার মালার মতো ছিল তার প্রত্যেকটা ক্লাস। ফুলে ফুলে গ্রন্থিত। থোপা থোপা আলোচনার ফুলঝুরি। দুর্বোধ্য যেকোনো বিষয়কে সকলের বোধগম্য ভাষায় তিনি পরিবেশন করার অসাধারণ ক্ষমতা রাখতেন।
খুবই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর রসবোধ ছিল খুবই উঁচু মাপের। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি হাসি, কৌতুক, মিষ্টি গল্প এসব দিয়ে মজমাকে আরও টইটম্বুর করে তুলতেন। কখনো কারো সমালোচনা করতেন না এমনকি কোন সমালোচনায় যোগ দিতেন না। হযরতের এই চমৎকার গুন আমাকে খুব প্রলুব্ধ করে। কখনো সময় নষ্ট করতেন না। জীবনের সময়ের অপচয় করেছেন বলে আমার মনে হয় না। প্রচুর কাজ করতেন। অজস্র মিটিং,জলসা, সমস্যার সমাধানে আঁটোসাঁটো সময়সূচিতে ব্যস্ত ছিলেন।
জীবনকে ইবাদাত, পড়াশোনা, দাওয়াত এবং উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড এই চার জগতে মনোনিবেশ করে কাটিয়ে দিয়েছেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত অবসর পাননি, অবকাশ যাপন করেননি। আল্লামা বুখারী (রহ.) পটিয়া মাদরাসার প্রধান পরিচালক হওয়ার কারণে মাদরাসার প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। মাদরাসার শৃঙ্খলা মজবুত ও টেকসই করেছেন তিনি। সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তিনি অসাধারণ কিছু যোগ্য, প্রাজ্ঞ এবং সুদক্ষ শিক্ষকদের সমাহার করেছেন পটিয়া মাদরাসার শিক্ষায়তনে।
তিনি তো জহুরী, অনেক যাচাই-বাছাই করে সেরা সেরা মুক্তোগুলো পটিয়া মাদরাসায় একত্রিত করেছেন। তাঁর এই অসাধারণ বড় ইবাদতটির জন্য পটিয়া মাদরাসা এবং এই জাতি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। নিজে খুবই উচ্চাঙ্গের ইসলাম বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণে সবচেয়ে মেধাবী, পরিশ্রমী এবং সম্ভাবনাময়ী শিক্ষকদের একটা ক্যারাভান তৈরি করতে তিনি সমর্থবান হয়েছেন। মহান রাব্বুল ইজ্জত তাঁর এই সুদূরপ্রসারী জ্ঞানের বৃন্দাবনসদৃশ প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। হযরতের এই নিভৃতচারী ইবাদতের ফসল জাতি অনেকদিন পাবে ইনশাআল্লাহ।
তদুপরি তিনি পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম হওয়ার কারণে এবং পরিচালনা সংশ্লিষ্ট অতি ব্যস্ততার কারণে হযরতের গবেষণা, পড়াশোনা ও যোগ্যতার সবটুকু উজাড় করে দিতে পারেননি এবং উম্মাহ (রহ.)-এর জ্ঞানের বিশাল আধার থেকে মাহরুম হয়েছে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। একসাথে সব রং খেলেনা। একটা রঙ প্রাধান্য বিস্তার করলে অন্য অনেক রং ফিকে হয়ে আসে।
পটিয়ার মতো বিশাল মাদরাসার কর্মযজ্ঞ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য বুখারী (রহ.)-এর ইলমি খেদমতের কিয়দাংশ কুরবানী হয়ে যায়। বাংলাদেশের সর্বজনমান্য, অগ্রগণ্য ও বরেণ্য এই মহান ইলমের সাধক আমাদের পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।
রেখে গেছেন লক্ষ লক্ষ আলেম। বাংলাদেশে যাঁরা এখন তরুণ প্রজন্মের আলেম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, তাঁদের শিখড় অথবা লতাগুল্ম কোননা কোনভাবে বুখারী রহমতুল্লাহি এর সাথে জড়ানো। সরাসরি ছাত্র না হলেও ছাত্রের ছাত্র। এরকম সৌভাগ্য অনেক সাধনার পরে মেলে; আল্লাহ কবুল করলে তখনি মেলে।
তার জানাজায় বিপুল মানুষের স্রোত বিশেষত আলেমদের জোয়ার হয়ে উঠেছিল। এরকম বরকতময় বিদায়, সম্মানজনক ইন্তেকাল এবং দোয়ার পুষ্প বৃষ্টির সাথে আল্লাহর কাছে সমর্পণ কয়জনের ভাগ্যে জুটে? তিনি এখন জান্নাতে ঘুমাচ্ছেন। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়ে রহমতের চাদরে অবকাশ যাপন করতে দিয়েছেন। এসব আমার শুধু আশা নয়; বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের উৎস_ তাঁর অসাধারণ জীবনী, তাঁর রেখে যাওয়া লক্ষ আলেম, তাঁর রেখে যাওয়া ইলমের অবিরাম সিলসিলা।
পটিয়া মাদরাসাসহ অসংখ্য মাদরাসা এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম আলেম তৈরি করতে থাকবে, ইলমের সাধনা করতে থাকবে এবং এই আলেমদের নসিহতে পুরো জাতি বিশুদ্ধ আমলে মনোনিবেশ করতেই থাকবে। আর আল্লামা বোখারীদের মতো জাতির দিশারীদের কবরে পুষ্পাঞ্জলির মতো, খুশবুর মতো, বৃষ্টির মতো সওয়াব জমা হতে থাকবে। রব্বুল আলামিন আমি এই কাফেলায় শরিক হতে চাই।