রবিবার-১৬ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি-৯ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দিল্লির কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে গণেশের মূর্তি স্থাপন

দিল্লির কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে গণেশের মূর্তি স্থাপন

 

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

ভারত ঐতিহ্যগতভাবে বহুধর্ম, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির দেশ। ভারতের সমাজ বিনির্মাণ, রাষ্ট্রগঠন, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভারতে বসবাসকারী সব জাতিগোষ্ঠীর ত্যাগ ও কুরবানি রয়েছে। কিন্তু দলীয় স্বার্থ ও রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ ধ্বংস করে দেয়ার খেলায় মেতে ওঠেছে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। দিল্লির ঐতিহাসিক স্থাপনা কুতুব মিনারকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। উগ্রবাদীদের দাবি মুসলিম সম্প্রদায় গায়ের জোরে মন্দির ভেঙে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ ও মিনার তৈরি করেছে। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আগে বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও মুসলিম স্থাপত্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়। এরই মধ্যে দিল্লির কুতুব মিনার চত্বরে পূজা করার অনুমতি দিতে আবেদন করা হয়েছিল দিল্লির আদালতে। আইনজীবীর দাবি, ওই অঞ্চলে হিন্দু ও জৈনদের মোট ২৭টি মন্দির ছিল। সেই মন্দিরগুলোতে দেবদেবীদের পূজা হত এবং কুতুব মিনার আসলে ছিল বিষ্ণুস্তম্ভ। তবে আদালত আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। হিন্দু মহাসভার আলিগড় ইউনিট তাদের প্রকাশিত হিন্দু নববর্ষ ক্যালেন্ডারে কুতুব মিনারের ছবির পাশে বিষ্ণু-স্তম্ভ লেখা নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়েছে। শুধু কুতুব মিনার নয়, মুঘল আমলের সাতটি মসজিদ ও স্মৃতিস্তম্ভকে হিন্দুমন্দির বলে দাবি করা হয়েছে এই ক্যালেন্ডারে। যে তালিকায় রয়েছে তাজমহলও। তাজ মহলের নামের পাশে লেখা তেজো মহালয়া মন্দির। মধ্যপ্রদেশের কমল মৌলা মসজিদ আসলে ভোজশালা বলে দাবি করা হয়েছে। কাশির জ্ঞানব্যাপী মসজিদের ছবির পাশে লেখা বিশ্বনাথ মন্দির, জৌনপুরের আটালা মসজিদের ছবির পাশে লেখা অটলা দেবী মন্দির এবং অযোধ্যায় করসেবকদের হাতে ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদের ছবির পাশে লেখা রয়েছে রাম জন্মভূমি। হিন্দু মহাসভার ন্যাশনাল সেক্রেটারি জানিয়েছেন, ‘এই পবিত্র হিন্দু ক্যালেন্ডার প্রকাশ উপলক্ষ্যে আমরা যাগ-যজ্ঞের আয়োজন করি এবং এই দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার শপথ নিই।’

উগ্রবাদীরা কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে দুটি গণেশ মূর্তি রেখে আসে। এগুলো অযত্নে পড়ে আছে। ন্যাশনাল মন্যুমেন্ট অথরিটি সম্প্রতি ওই দুই মূর্তি উদ্ধার করে জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগকে নির্দেশ দেয়। মন্যুমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান বলেন, প্রতিমা দুইটি এভাবে রাখা অসম্মানজনক। কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে দুটি গণেশ মূর্তি যাতে সরানো না হয় তার জন্য দিল্লির একটি আদালত ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগকে ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখতে নির্দেশনা দিয়েছে। জনৈক রিশাভা দেব মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় বলা হয়েছে যে এটি একটি জাতীয় লজ্জার বিষয় যে ভগবান গণপতি, যিনি কোটি কোটি হিন্দুদের দ্বারা পূজিত হন, তাকে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় বিতর্কিত সম্পত্তির মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। এতে ভগবান গণেশের কোটি ভক্তদের অনুভূতিকে আহত করে। মন্যুমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যানের পরামর্শ অনুসারে প্রশ্নবিদ্ধ এলাকার বাইরে ভগবান গণেশের মূর্তি পাঠানোর কোনো ক্ষমতা বা এখতিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের নেই (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নয়া দিল্লি, ১৮ এপ্রিল ২০২২)। কয়দিন পর কুতুব মিনারের পাশে যদি সুদৃশ্য গণেশ মন্দির গড়ে ওঠে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

বিগত ১৪ নভেম্বর ২০০০ বিবিসি পরিবেশিত খবরে প্রকাশ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরংদল ও দিল্লি সান্ত মহামণ্ডল একসাথে রাজধানীর বিখ্যাত পর্যটক আকর্ষণ কুতুব মিনার ও কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের সামনে একসাথে যজ্ঞের আয়োজন করে। বিশ্বহিন্দু পরিষদের শ্রী শ্রী আচার্য গিরিরাজ কিশোর বলেন, এ যজ্ঞের মাধ্যমে হৃদয় পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হচ্ছে তবে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকে মন্দির তৈরি করার ও মিনারের জায়গাটি যজ্ঞের মাধ্যমে পবিত্র করাই তাদের উদ্দেশ্য। দিল্লির মুসলিম শাসকদের আমলে তৈরি ওই মিনারটির সামনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ওই যজ্ঞের প্রভাব দূরপ্রসারী হতে পারে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তারা ভারতবর্ষের বুক থেকে ইসলামি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার চিহ্ন মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। মসজিদ, মিনার ও মাদরাসা ইসলামের দেড় হাজার বছরের উত্তরাধিকার ঐতিহ্যের স্মারক। উগ্রবাদীরা পরধর্মে সহিষ্ণু নয় এবং ভারতের মত বহুমাত্রিক সমাজে তারা মনুবাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। মনুসংহিতার সমাজে অপরাপর ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অবকাশ নেই। মাদরাসার প্রাসাদ, মসজিদের গম্বুজ ও সুউচ্চ মিনারা হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার পথে বড় অন্তরায় মনে করে নানা অজুহাতে এগুলোকে ধূলোয় গুড়িয়ে দিতে চায়। পুরনো মুসলিম স্থাপত্য ও ইমারতগুলোকে ক্রমশ ধ্বংস করে দিতে পারলে ইতিহাসকে বদলে ফেলা সম্ভব হবে কারণ ভারতের উত্তর প্রদেশ ও গুজরাট সরকার ‘ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন অ্যাক্ট’ নামে রাজ্যসভায় নতুন যে আইন পাশ করেছে তাতে সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো মসজিদ, মাদরাসা ও মিনার স্থাপন করা যাবে না এমনকি নিজের জমির ওপর হলেও। গোয়েন্দা সুপারিশের ভিত্তিতে উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাট সরকার নতুন মসজিদ, মাদরাসা ও মিনার নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কুতুব মিনারের পাশে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের সামনে যজ্ঞ করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা বলেন, যজ্ঞ করা হচ্ছে জায়গাটি পবিত্র করার জন্য। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠে মসজিদ ও মিনার সংলগ্ন এলাকা কি অপবিত্র? যজ্ঞ ও পূজা করে তাকে পবিত্র করতে হবে কেন? নিছক জিঘাংসা ও সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি ছাড়া এ যজ্ঞের পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই। বিশিষ্ট গবেষক ড. এ কে এম আইয়ুব আলী বলেন, ‘কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদটি দিল্লির একটি নির্বাচিত স্থানে নির্মিত হয়। ইতিহাসবিদরা এই সম্পর্কে নিশ্চিত যে, পূর্বে ওই স্থানে কোনো ইমারত অথবা হিন্দু মন্দির ছিল না। উপমহাদেশের বহু প্রখ্যাত আলিম ও সুফি সাধকের পুণ্যস্মৃতি ওই ঐতিহাসিক মসজিদটির সাথে বিজড়িত’ (ইসলামী বিশ্বকোষ, ইফাবা, ১৯৯০, ঢাকা, ৮/২৭০)

যজ্ঞ ও পূজা-পার্বণের এ অনুষ্ঠান প্রতিবাদহীনভাবে অব্যাহত থাকলে মসজিদ ও মিনারের স্থান স্থায়ী পূজার স্থানে পরিণত হবে, এতে মোটেই সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিক কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ বর্তমানে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমনিতে ভগ্নদশায় পতিত হয়েছে। দক্ষিণ দিল্লিতে অবস্থিত কুতুব মিনার ১১৯৯-১২২০ সালের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল। ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পাওয়া কুতুব মিনার কেবল ভারতীয় উপমহাদেশেরই নয়, দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপনা হিসেবে গণ্য।কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু করেন দিল্লির শাসক কুতুবুদ্দিন আইবক। কিন্তু তার আমলে কেবল এর নিচতলাটিই নির্মিত হয়। তার উত্তরাধিকারী ইলতুৎমিশ আরও কয়েক তলা নির্মাণ করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক তৈরি করেন এর পঞ্চম ও সর্বশেষ তলাটি। কুতুবুদ্দিন আইবক থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলক পর্যন্ত এর স্থাপত্য রীতিতে ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্যের যথাযথ ছাপ অঙ্কিত হয়েছে। তা ছাড়া এর নির্মাণপদ্ধতি ও নির্মাণকর্মে ব্যবহৃত মাল-মসলাও ভিন্নতর। মধ্য এশিয়া থেকে আগত ক্যালিগ্রাফারদের হাতেতৈরি হওয়া সর্পিল বক্ররেখা ও পরিশীলিত জ্যামিতিক নিদর্শন কুতুব মিনারকে অনন্য করে তোলে। ১৩৬৮ সালে বজ্রাঘাতে কুতুব মিনারটি বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে ফিরোজ শাহ তুঘলক মিনারের পঞ্চম তলাটি মেরামত করেন, কিন্তু এরপরেও মিনারটির অবকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমানে ৫তলাবিশিষ্ট কুতুব মিনারের দরজা পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তার কারণে। মিনার গাত্রে বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কেন এক হাজার বছরের পুরনো এ মিনারটির প্রতি হাত বাড়াল এর পেছনে ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। ১১৯৩ সালে সুলতান কুতুবুদ্দীন আইবক পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে দিল্লি অধিকার করার অব্যাবহতি পর এ মিনার নির্মাণ কাজে হাত দেন। বিখ্যাত সুফি-দরবেশ হযরত কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকির নামে এ মিনারের নামকরণ করা হয়। ২৩৮ ফুট (৭২.৫ মিটার) উচ্চ এ মিনারের শীর্ষদেশ হতে মুয়াজ্জিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য আযান দিতেন। সুলতান ইলতুৎমিশ ১২২৫ সালে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বের আঙ্গিনার সাথে এ মিনারটিকে সংযুক্ত করে দেন। কুতুব মিনারের বহিরাবরণের ওপর পবিত্র কুরআনের আয়াত উৎকীর্ণ রয়েছে। কুতুব মিনার মুসলমানদের দিল্লি বিজয়ের স্মারকস্তম্ভ অপরদিকে হিন্দুদের কাছে এ মিনার পৃথ্বিরাজের পরাজয়ের তিলকরেখা। সুতরাং ভারতমাতার কপাল থেকে কলঙ্কের এ তিলক মুছে ফেলতে মাঠে নেমেছে সঙ্ঘ পরিবার। পৃথ্বিরাজের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এক হাজার বছর পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরংদল মিনারের পাশে যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করছে। কুতুব মিনার ভারতের প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন। পৃথিবীর হাজার হাজার পর্যটক প্রতি বছর কুতুব মিনার, লালকেল্লা, আগ্রার দূর্গ, শাহী মসজিদ, খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া ও খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতী আজমিরির মাজার জেয়ারত ও সাহারানপুরের দারুল উলুম দেওবন্দ, লখনউয়ের নদওয়াতুল উলামা, মুরাদাবাদের শাহি মাদরাসা পরিদর্শনের জন্য ভারত সফর করেন। এতে ভারত সরকারের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এসব ঐতিহাসিক ইমারত ও মধ্যযুগের স্থাপত্য নিদর্শন বিধ্বস্ত করে দিলে পর্যটকদের কাছে ভারতের আকর্ষণ যে হ্রাস পাবে হিন্দু মৌলবাদীরা তা বিলক্ষণ জানেন তারপরেও তারা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে পারঙ্গম। কুতুব মিনারের স্থাপত্য কৌশল পর্যটকদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এটা গঠনের দিক দিয়ে আয়তাকার হলেও সরালাকার নয়। পাঁচটি পৃথক পৃথক তলায় বিভক্ত এ মিনারটি উপরের দিকে ক্রমশ সরু। এসব তলায় সর্বোচ্চতমটি ব্যতীত অন্যান্য তলায় ঝুলন্ত বারান্দা রয়েছে যার নিম্নাংশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ খোদাইকৃত শিলালিপি দ্বারা সুশোভিত। পাশ্চাত্যের গবেষক ফারগুসন বলেন, এ জাতীয় মিনার পৃথিবীর সুন্দরতম সৌধরাজির অন্যতম। কুতুব মিনারের নির্মাণশৈলীতে আফগানিস্তানের স্থাপত্যরীতি ও ইরানি নকশা-নমুনার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

মৌলবাদী হিন্দুদের হাতে ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হওয়ার পর গোটা মুসলিম দুনিয়ায় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। সাধারণ মুসলমানরা প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দাঙ্গায় দুইহাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী কংগ্রেস নেতা শ্রী শ্রী নরসীমা রাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিধ্বস্ত মসজিদের স্থানে নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করে দেবে সরকার। এ প্রতিশ্রুতি ছিল মূলত চাণক্যসূলভ কূটনীতি ও ম্যাকিয়াভেলিয়ান রাজনীতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। আরব বিশ্বে ভারত সরকার বিশেষ দূত পাঠিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং নতুনভাবে মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। অথচ শ্রী নরসীমা রাও তার মেয়াদকালে বাবরি মসজিদের স্থলে নতুন মসজিদ নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা বা উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এমনকি তিনি যদি পূর্বাহ্নে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন তাহলে ধর্মান্ধ হিন্দুরা এ মসজিদ ভাঙতে পারত না। কারণ এটা আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। বহুদিন যাবত আরএসএস, বজরংদল, বিজেপির কর সেবক, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের হুংকার দিয়ে আসছিল এবং ব্যাপক রণপ্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হওয়ার পর মুসলিম দুনিয়া বিশেষ করে আরব বিশ্বের সরকারগুলো যদি ভারতের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতেন তাহলে ভারত সরকার উচিত শিক্ষা পেত এবং সঙ্ঘ পরিবারভুক্ত উগ্রবাদীরা অন্ততঃ কুতুব মিনার ও কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের পবিত্র অঙ্গনে পূজা ও যজ্ঞ করার দুঃসাহস দেখাত না। ভারতের হাজার হাজার হিন্দু আরব দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশে চাকরি ও ব্যবসার সাথে জড়িত। কোটি কোটি ডলারের শাক-সব্জি, মাছ-শুঁটকি থেকে শুরু করে শিল্পের কাঁচামাল পর্যন্ত আরব বিশ্বে রপ্তানি হয় ভারত থেকে। মুসলিম বিশ্বকে এড়িয়ে ভারত আধুনিক যুগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, মিশর প্রভৃতি আরব দেশের ইসলামের ব্যাপারে নির্বীর্য মানসিকতা ও ঢিলেঢালা মনোভাবের ফলে ভারতের উগ্রবাদীরা আস্কারা পাচ্ছে। ঈমানের এ দূর্বলতা ও আমলের এ অধঃপতনের ফলে আরবরা প্রতিবাদী ভূমিকা ছেড়ে দিয়ে বিলাসব্যাসনে মত্ত হয়ে নিজেদের গৌরবদীপ্ত অতীত হারিয়ে ফেলেছে।

ভারতের ৬৭জন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ, কূটনীতিক ও পুলিশ অফিসাররা যারা কর্মজীবনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন নরেন্দ্র মোদি সরকারের উদ্দেশে লেখা এক খোলা চিঠিতে বলেন, ‘আসলে গত দুই-চার বছরে যে সব কাণ্ডকারখানা চলছে তাতে আর চুপ থাকা যাচ্ছে না। আমরা আমাদের কাজ করছি, যদিও সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি। ভারতে মুসলিম-খ্রিস্টানদের মতো সংখ্যালঘুরা যেভাবে ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছেন, সেটাই যে এই চিঠিতে সই করতে তাকে প্রণোদিত করছে, বিবিসি বাংলাকে স্পষ্টভাবেই তা বলছিলেন মহারাষ্ট্রের সাবেক পুলিশ-প্রধান মীরন বোরওয়ানকার। ইদানীং আমি অনুভব করছি সংবিধান যে সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলে এ দেশে তা মানা হচ্ছে না। সংখ্যালঘু সমাজ যে অস্বস্তিতে আছে সেটা তো দেখাই যাচ্ছে, তাদের ওপর হামলা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের সাহায্য করছে না। আমি এমন একটা দেশ দেখতে চাই, যেখানে সব ধর্ম, সব জাতির সমান অধিকার নিশ্চিত হবে, কিন্তু সেটা আজকাল আর হচ্ছে না বলেই আমাদের এখানে সই করতে হল। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আগেও ঘটেছে, কিন্তু এখন যেভাবে দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এখন মানুষে-মানুষে যেভাবে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে, এ জিনিস আমরা ভারতে আগে কখনও দেখিনি। একের পর এক উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে। তবে ঘটনাগুলো যত না, আমরা তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন ওই সব ঘটনায় সরকারের প্রতিক্রিয়ায়। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এই সব ঘটনায় হয় নীরব থাকছেন, নয়তো দায়সারা জবাব দিচ্ছেন।’ কিন্তু রাষ্ট্র যে এই সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের আবেগ বা উদ্বেগের দাম দিতে প্রস্তুত, এখনও পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে তেমন কোনো আভাস নেই (বিবিসি বাংলা, দিল্লি)।

ভারতে ১৯৯১ সালে প্রণীত প্লেসেস অব ওয়ারশিপ (স্পেশাল প্রভিশন) আইনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর যেকোনো উপাসনালয়ের ধর্মীয় চরিত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, ধর্মীয় স্থাপনা বদলানো যাবে না বা দখল করা যাবে না। তারপরও কয়েকটি হিন্দু সংগঠন ও বিজেপি নেতারা মুসলিমদের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের সুশীল সমাজকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পারস্পরিক সৌহার্দ্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ