ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা
নাজমুল হাসান সাকিব
ইসলাম পূর্ব যুগে নারীদেরকে সামাজিকভাবে অত্যন্ত হেয় ও লাঞ্ছিত করা হতো। তৎকালীন আরবে নারীদের ভোগ্য সামগ্রী মনে করতো। তারা ছিলো পুরুষদের দাসী মাত্র। তাদের সাথে একজন দাসদাসীর সাথে যে আচরণ করা হয়, তার চেয়েও নিকৃষ্ট আচরণ করা হতো। কন্যা সন্তানদের জীবন্ত দাফন প্রথা সিদ্ধ ছিলো। পরিবারের কর্তা ইচ্ছা করলে নারীকে ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তর করতে পারতো।
নারী তার আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তি বা মিরাসের অধিকারিণী হতো না; বরং সে নিজেই ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্রের ন্যায় পরিত্যক্ত সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো। তাদেরকে মনে করা হতো পুরুষের স্বত্বাধীন; কোনো জিনিসেই তাদের নিজস্ব কোনো স্বত্ব ছিলো না। আর যা কিছুই নারীর স্বত্ব বলে গণ্য করা হতো তাতেও পুরুষের অনুমতি ছাড়া ভোগ-দখল করার এতটুকু অধিকার তাদের ছিলো না। তবে স্বামীর এ অধিকার স্বীকৃত ছিলো যে, সে তার নারীরূপী নিজস্ব সম্পত্তি যেভাবে খুশি, যেখানে খুশি ব্যবহার করতে পারবে। তাতে তাকে স্পর্শ করারও কেউ ছিলো না।
এমনকি ইউরোপের যেসব দেশকে আধুনিক বিশ্বের সর্বাধিক সভ্য দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেগুলোতেও কোনো কোনো এলাকায় এমন ছিলো যারা নারীর মানব সত্তাই স্বীকার করতো না। মহানবী (সা.) ও তাঁর প্রবর্তিত দীনই বিশ্ববাসীর চোখের পর্দা উন্মোচন করেছেন। নারী সমাজের অধিকার সংরক্ষণ পুরুষদের ওপর ফরজ করেছেন। দিয়েছেন সমাজে নারীদের পরিপূর্ণ মর্যাদা। তিনি অনেক ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমমর্যাদা দিয়েছেন। ঘোষণা করেন, ‘জননীর পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর সাথে সর্বোত্তম ব্যবহার করে।’
সর্ব প্রথম তিনিই নারীগণকে সম্পত্তির অধিকারীণী বলে ঘোষণা করেন। ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। দিয়েছে নারীর জান-মালের নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সম্মান। এসবের জন্যই নারী জাতি সমাজের অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদে পরিণত হলো।
মা হিসেবে নারীর মর্যাদা
ইসলাম নারীদের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে মা হিসেবে। পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম বা মতবাদে নারীকে মা হিসেবে এত মর্যাদা ও ইজ্জত দেওয়া হয়নি। পবিত্র কুরআনুল করীমে মহান আল্লাহ বলেন,
وَوَصَّيْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ اِحْسٰنًا١ؕ حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ كُرْهًا وَّ وَضَعَتْهُ كُرْهًاؕ ۰۰۱۵
‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। (মায়ের জন্য বেশি দিয়েছি) কারণ তার মা জননী তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে।’[1]
আয়াতের শুরুতে পিতা-মাতা উভয়ের সাথে সদ্ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ স্থলে কেবল মাতার কষ্টের কথা উল্লেখ করার তাৎপর্য হলো, মাতার পরিশ্রম ও কষ্ট অপরিহার্য ও জরুরি। গর্ভধারণের সময়ের কষ্ট, প্রসব বেদনার কষ্ট সর্বাবস্থায় ও সব সন্তানের ক্ষেত্রে মাকেই সহ্য করতে হয়। পক্ষান্তরে পিতা এসবের কিছুই সহ্য করতে হয় না। এ কারণেই রসুলুল্লাহ (সা.) সন্তানের ওপর মাতার হক বেশি রেখেছেন।
এক হাদীসে এসেছে, একবার এক সাহাবী এসে নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কার সাথে সদ্ব্যবহার করবো? নবীজি বললেন, তোমার মায়ের সাথে। লোকটি বলল, তারপর কার সাথে? নবীজি আবারো বললেন, তোমার মায়ের সাথে। লোকটি (তৃতীয়বার) আবারো বললেন, অতঃপর কার সাথে? নবীজি (সা.)ও (তৃতীয়বারে) বললেন, তোমার মায়ের সাথে। (তিরমিযী: ১৯০৩)
বোন হিসেবে নারীর মর্যাদা
ইসলাম যেমনিভাবে মা হিসেবে নারীর মর্যাদা দিয়েছে তেমনিভাবে বোন হিসেবেও নারীর মর্যাদা দিয়েছে। এমনকি পিতার সম্পত্তি থেকেও তার জন্য অংশ নির্ধারণ করেছে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যার তিনটি মেয়ে কিংবা তিনটি বোন থাকে অথবা দুটি মেয়ে কিংবা দুটি বোন থাকে সে যদি তাদের সাথে সবসময় সদ্বব্যবহার করে এবং তাদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করে, তবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত।’ (তিরমিযী: ১৯১৮)
কন্যা হিসেবে নারীর অধিকার
ইসলাম পূর্ব অন্ধকারচ্ছন্ন সমাজের মূর্খ লোকেরা কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াকে পাপ বা অভিশাপ মনে করত বিধায় কোনো পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমানে সে কন্যা সন্তান জীবন্ত পুঁতে দিতো। কিন্তু ইসলাম নারীকে কন্যা হিসেবে যে সম্মান আর মর্যাদা দিয়েছে ইতিহাসে এর তুলনাই হয় না। নবীজি (সা.) বলেন, ‘মেয়ে দিয়ে যাকে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়, সে যদি তাদের বিষয়ে ধৈর্যধারণ করে তবে তারাই তার জন্য জাহান্নামের পথে পর্দা হয়ে দাঁড়াবে।’ (তিরমিযী: ১৯১৯)
অন্য হাদীসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি দুটি মেয়ে সন্তান লালন-পালন করবে, সে আর আমি এমনভাবে জান্নাতে প্রবেশ করবো। এই বলে তিনি দুটি আঙ্গুল ইশারা করে দেখান।’ (তিরমিযী: ১৯২০)
স্ত্রী হিসেবে নারীর মর্যাদা
লক্ষ করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে এমন দুটি বস্তু রয়েছে যা গোটা বিশ্বের অস্তিত্ব, সংগঠন ও উন্নয়নের স্তম্ভস্বরূপ। তার একটি হচ্ছে নারী, অপরটি হচ্ছে সম্পদ। যদি এগুলোকে তাদের প্রকৃত মর্যাদা, স্থান ও উদ্দেশ্যের ওপর রাখা যায় তখনই এগুলোর দ্বারা দুনিয়ার সবচাইতে বড় বড় কল্যাণের আশা করা যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনুল করীমে মহান প্রভু বলেন,
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَاَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّؕ ۰۰۱۸۷
‘তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ।’[2]
আর মহানবী (সা.) বলেন, ‘উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক।’ (মুসলিম শরীফ)
তিনি আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। (তিরমিযী: ৩৮৯৫, ইবনে মাজাহ: ২০৫৩)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَعَاشِرُوْهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ١ۚ فَاِنْ كَرِهْتُمُوْهُنَّ فَعَسٰۤى اَنْ تَكْرَهُوْا شَيْـًٔا وَّيَجْعَلَ اللّٰهُ فِيْهِ خَيْرًا كَثِيْرًا۰۰۱۹
‘তোমরা নারীদের সাথে সম্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ করো তবে হয়তো তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ তাআলা অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’[3]
অন্যত্রে আছে,
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِيْ عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوْفِ۪ ۰۰۲۲۸
‘পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার আছে তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর নিয়ম অনুযায়ী।’[4]
পবিত্র কুরআনুল করীমে নিসা অর্থাৎ মহিলা শব্দটি ৫৭ বার এবং ইমরান অর্থাৎ নারী শব্দটি ২৬ বার উল্লেখ হয়েছে। কুরআনুল করীমে নিসা তথা মহিলা শিরোনামে নারীর অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র সূরা রয়েছে। এছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এবং হাদীসে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। নিশ্চিত করেছে ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার।
[1] আল-কুরআন, সুরা আল-আহকাফ, ১৫:১৫
[2] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৮৭
[3] আল-কুরআন, সুরা আন-নিসা, ৪:১৯
[4] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকরা, ২:২২৮