আল্লামা হাফেজ ওবায়দুল্লাহ হামযাহ
إن الحمد لله، نحمده ونستعينه، ونستغفره ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا، من يهده ألله فلا مضل له، ومن يضلله فلا هادي له، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، و أشهد أن محمدًا عبده و رسوله، صلى الله عليه وسلم تسليمًا كثيرًا كثيرًا.
أما بعد! فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمٰن الرحيم، [قَالُوْا سَمِعْنَا فَتًى يَّذْكُرُهُمْ يُقَالُ لَهٗۤ اِبْرٰهِيْمُؕ۰۰۶۰] {الأنبياء: 60}، وقال تعالىٰ: [اِنَّهُمْ فِتْيَةٌ اٰمَنُوْا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنٰهُمْ هُدًىۗۖ۰۰۱۳] {الكهف: 13}، وقال النبي ﷺ: «سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ يَوْمَ لا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ: …».
বক্তব্যের বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘যৌবনের মূল্যায়ন’। এ বিষয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
মুহতারম হাজিরীন!
এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বিশাল একশ্রেণি হচ্ছে যুবক শ্রেণি। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় চার কোটির উপরে এ দেশে যুবক রয়েছে। যুবকরা আমাদের সমাজকে ব্যস্ত রাখে, মাতিয়ে তোলে। বর্তমান যুবকদের হাতে রয়েছে ভবিষ্যত প্রজম্মের ভার। আজকে একজন মাদরাসা ছাত্র স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র আগামীতে মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মুফতি, মুহাদ্দিস ও প্রফেসর হবে, প্রশাসনের আমলা হবে, সমাজ নেতৃত্বদানকারী প্রতিনিধি হবে।
সেজন্যই আজকের সমাজ ভবিষ্যতে যুবকদের ব্যাপারে আশাবাদী। আপনি যুবকদের বর্তমান অবস্থা দেখবেন, যদি তার দিকে তাকিয়ে আপনার অন্তর আনন্দিত হয়, তাহলে আপনি সেই যুবক সম্পর্কে অনেক কিছু আশা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এর বিপরীত ও ভয়ানক! এজন্য তাদের নিয়ে অনেক চিন্তিত হতে হয়। কারণ আমাদের এ ভবিষ্যৎ তা দুনিয়ার দিক থেকে হোক অথবা আখিরাতের দিক দিয়েই হোক, তাদের হাতেই নির্মিত হবে। তারাই ভবিষ্যৎ গড়বে।
আমরা যে অঞ্চলে বসবাস করেছি, তা কেয়ামত পর্যন্ত ১৭ বছরের এক বালকের ওপর ঋণী। ইমাদুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে কাসেম আস-সাকাফী (রহ.)। যিনি সেনা অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন হিন্দুস্তান জয় করার জন্য। একপর্যায়ে তিনি যে জিহাদ করতে করতে শহীদ হয়ে যান। নিজের জান আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দেন।
যুবকরা ইসলাম আগে গ্রহণ করেছেন এবং তারাই সলামের প্রচার-প্রসারও করেছেন। যেমন হযরত ওসমান (রাযি.), হযরত আলী (রাযি.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.)। তাঁরা পুরো পৃথিবীতে ইসলামের আলো জ্বালিয়েছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, ‘এজন্যই আল্লাহ তাআলা নবীদেরকে ৪০ বছর বয়সে নুবুওয়ত দান করেছেন।’ তখন যুবকরা আল্লাহর কাছে যেমন প্রিয় থাকে, তেমনি সমাজের কাছেও প্রিয় থাকে।
সমাজের মধ্যেও যুবকদের মূল্যায়ন করা হয়। যেকোনো সরকারি পোস্টে, সেনাবাহিনীতে, বিজিবিতে, সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুবকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। যুবক আমাদের শরীরে নতুন রক্তের মতো। শরীরে রক্ত থাকলে শরীর সুস্থ থাকে, শরীর শক্তি থাকে। যুবকরা হচ্ছে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তির উৎস। যুবকরাই সমাজের সবচেয়ে কঠিন কঠিন কাজগুলো করবে।
আজ আমাদের সামনে সেসব যুবকদের ইতিহাস নেই, যারা ইসলামের জন্য কিছু করে গেছেন। তাদের ইতিহাসগুলো বেশি বেশি পড়তে হবে। যেমন- মুহাম্মদ ইবনে কাসেম (রহ.), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.), আবু হুরায়রা (রাযি.), খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাযি.), মুসআব ইবনে উমাইর (রাযি.) প্রমুখের জীবনচরিত অধ্যয়ন করা উচিত।
আজকে আমরা বিধর্মী খেলোয়াড়, গায়ক ও নায়কদের আলোচনা করছি। অথচ ভুলে গেছি, সেসব যুবকদের কথা, যারা পারস্য ও রোমান সম্রাটকে পরাজিত করে তাদের ওপর বিজয়ী হয়ে ইসলামকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কবি ইকবাল খুব দুঃখ করে বলেছেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা কাজের মাধ্যমে দাবিকে প্রমাণ করেছেন। আর আমরা শুধুমাত্র কথাই পাকা। একথাকে কাজের ধারা প্রমাণিত করি না। তারা দীনের জন্য পুরো দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছেন। আর আমরা নিজের স্থানে জমে রয়েছি।
মুহতারাম হাজিরীন!
আমাদের আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। আমরা হযরত ইমাম শাফিয়ী (রহ.)-এর নাম শুনি। হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.), মুহাম্মদ ইবনে সিরীন, মালেক ইবনে দিনার (রহ.) প্রমুখের নাম শুনি। তাঁরা নিজেদের যৌবনকালকে কিভাবে দামি করেছেন?
যেমন ইমাম শাফিয়ী (রহ.) ১২ বছর বয়সে ইমাম হয়েছেন। মানুষ মাসআলা জানতে আসে ১০ বছর বয়সে। তিনি মুয়াত্তা মালেক মুখস্ত করেন। ইমাম সিবওয়াই (রহ.) ৩২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। অথচ এ অল্প বয়সেই তিনি এমন আরবি শাস্ত্রে ভূমিকা রেখেছেন যে, তার কিতাব পড়া ছাড়া কেউ আরবি কিতাব বুঝবে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, আল্লাহ তাআলা যদি কারো সাথে কল্যাণের ইচ্ছে করেন, তাহলে এ বয়সটি দান করেন। আজকে যাকে আমরা এমবিবিএস, এফআরসিএস, মুফতি, মুহাদ্দিস বলে থাকি, আপনি কি জানেন? তিনি এসব ডিগ্রি অর্জন করার জন্য যৌবনকালে কি পরিশ্রমই না করেছেন! যৌবনকালকে দাম না দিয়ে কোনো মানুষ বড় হতে পারিনি আর কখনো পারবেও না।
সম্মানিত শ্রোতা!
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমাদের পুরো হায়াতটি একটি মূল্যবান নেয়ামত। এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হচ্ছে যৌবনকাল। যেমন মানুষ বছরে ছয়টি ঋতুর মধ্যে বসন্ত কালকেই পছন্দ করে। কেননা বসন্তকালে গাছের মধ্যে নতুন পাতা গজায় এবং সবুজ-শ্যামলও নির্মল পরিবেশ তৈরি হয়। তেমনি পুরো জীবনের মধ্যে যৌবনকাল। এজন্যই আমাদের যুবকদের উচিত, যেসব যুবকরা যৌবনকালকে দাম দিয়ে সফলকাম হয়েছেন, তাদের কাহিনীগুলো বেশি বেশি পড়া।
আজকে কোনো এক জায়গায় কনসার্ট হলে সেখানে হাজার হাজার যুবকের ঢল। খেলাধুলায়, ফেসবুকে ঝুঁকে পড়েছে। আমাদেরকেহ যরত ইউসুফ (আ.) থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। তাঁকে ‘ইমরআতে আজিজে মিসর’ অপকর্মে লিপ্ত করার জন্য একদম অন্দর মহলে নিয়ে গেলেন। এরপর ইউসুফ (আ.)-এর সাথে অপকর্মে মিলিত হওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি কোনো মতেই রাজি হলেন না, বরং আল্লাহর তাআলার নিকট প্রার্থনা করলেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে গাইবিভাবে আল্লাহর নাফরমানি করা থেকে হেফাজত করেছেন।
হে যুবক! আমাদেরকে হযরত মুসা (আ.) থেকে শিক্ষা অর্জন করা দরকার। দেখুন কিভাবে তিনি তার সম্ভ্রমকে হেফাজত করলেন দুজন যুবতী মহিলা থেকে। যারা তাদের পশুকে পানি পান করানোর জন্য দূরবর্তী এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন হযরত মুসা (আ.) তাদেরকে সাহায্য করার কারণে হযরত শোয়াইব (আ.) হযরত মুসা (আ.)-কে বাড়িতে আসার দাওয়াত দিলেন।
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় হযরত মুসা (আ.) তাদেরকে বললেন, তোমরা আমার পিছনে থেকো। পিছন থেকে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দাও কোন দিকে যেতে হবে? কারণ মহিলারা যদি আগে যায়, তাহলে তাদের শরীর থেকে কাপড় সরে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এভাবেই আল্লাহর নবী আপন দৃষ্টিকে হেফাজত করলেন। এজন্যই যুবকদের ইসলামের জন্য মন চাইলে যৌবনকালেই করতে হবে।
«يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ! مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، وَمَنْ لَـمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ؛ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ».
‘হে সম্মানিত যুবকগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি স্ত্রীর ভরণ-পোষণের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে অবনতকারী এবং লজ্জাস্থানকে সংযতকারী। আর যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে না সে যেন রোজা রাখে। কেননা রোজা রাখাটা তার জন্য খসী হওয়ার মতো।’[1]
আমরা দেখেছি আমাদের পূর্বকার আকাবির যৌবনকালে গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য তারা দিনের পর দিন রোজা রাখতেন। যুবক সাহাবীদের ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার। একজন সাহাবী রসুল (সা.)-এর দরবারে এসেছিলেন, তারপর বললেন, আমাকে জিনা করার জন্য অনুমতি দিন। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে রাগ দেখালেন না। আস্তে করে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন, ‘দেখো তুমি যার সাথে জিনা করবে সে নিশ্চয়ই কোনো একজনের মা হবে, কারো স্ত্রী হবে, খালা হবে, কারো ফুফু হবে। তুমি কি চাও যে, কেউ তোমার মায়ের সাথে, কেউ তোমার স্ত্রীর সাথে, কেউ তোমার খালার সাথে, কেউ তোমার ফুফুর সাথে জিনা করুক? তুমি চাও?’ তখন তিনি বললেন, না আমি চাই না। তখন বললেন, ‘তাহলে তুমি কিভাবে পছন্দ করো অন্য একটি মহিলার সাথে জিনা করা?’ তখন যুবক নিজের ভুল বুঝতে পারলেন, তার বুকের ওপর হাত রেখে দোয়া করে দিলেন। এরপর থেকে কোনো দিন এরকম নির্লজ্জ খারাপ কাজের দিকে পা বাড়াননি।
আসলে যুবকদের জন্য এ ধরনের খারাপ কাজে এগিয়ে যাওয়াটা হতেই পারে কিন্তু দরকার যে এর থেকে বাঁচা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জারীর (রাযি.) বলেন, যখনই আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং আমি তাকে দেখেছি তখনই দেখেছি তার চেহারায় মুচকি হাসি।
হে যুবক! লক্ষ করো, হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাযি.) রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ! أَوْصِنِيْ। রসুলুল্লাহ (সা.) হযরত মুআয ইবনে জাবাল এবং আবু যার কে একই নসিহত পেশ করলেন। তখন রসুল (সা.) বললেন,
«اتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْـحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ».
‘তুমি যেখানেই থাক না কেন আল্লাহকে ভয় করো। খারাপ আমালের পর ভালো আমল করো। যা পাপকে মুছে ফেলবে। আর মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করো। কেননা আল্লাহ তাআলার কাছে কোনো কিছুই গায়েব নয়।’[2]
আফসোস আজকে মানুষ সিসি ক্যামেরাকে ভয় করছে। কারণ সিসি ক্যামেরার দ্বারা সবকিছু রেকর্ড হয়ে যায়। কিন্তু সর্বশক্তিই আল্লাহ তাআলা যিনি সবকিছুকে দেখেন তাকে ভয় করছে না। আর গুনাহ যদি হয়ে যায় তাহলে সাথে সাথে কোনো নেক আমল করা।
অনুরূপভাবে বিভিন্ন হাদীসে দেখা যায় যে, এক অজু থেকে আরেক অজু, এক জুমা থেকে আরেক জুমা, এক রমজান থেকে আরেক রমজান, এক ওমরা থেকে আরেক ওমরা পর্যন্ত সগীরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়, কিন্তু কবীরা গুনাহ মাফ হয় না। কবীরা গুনাহ মাফ হওয়ার জন্য তওবা করা শর্ত। এরপর রসুল (সা.) বলেছেন,
«وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ».
মানুষের সাথে উত্তম চরিত্র দিয়ে ব্যবহার করার জন্য বলছেন। আফসোস! আজকে অনেক যুবকদেরকে দেখি, তারা শক্তির অপাত্রে ব্যবহারের কারণে মানুষের ওপর হাত তুলতে দ্বিধাবোধ করে না। বয়োবৃদ্ধদেরকে যেমন ছোটদের ও তেমন। অথচ আমাদের উচিত বড়দের শ্রদ্ধা করা, আর ছোটদের স্নেহ করা। বয়োবৃদ্ধদেরকে দেখে শিক্ষা নেওয়া দরকার, তারা একদিন আমাদের চেয়ে শক্তিশালী ছিল কিন্তু আজকে তারা হুইল চেয়ারে বসে আছে। লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না।
মাশাআল্লাহ অনেক যুবক আছে যাদের মধ্যে অনেক ইবাদাতের আগ্রহ আছে। একবার তিনজন যুবক রসুল (সা.)-এর আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, রসুল (সা.) দরবারে আসলেন। তখন রসুল (সা.) তাঁর রাত-দিনের আমল খুলে বলেন, তখন তাঁরা চিন্তা করলেন, আল্লাহ তাআলা রসুল (সা.)-কে আগে-পরের সমস্ত গুনাহ থেকে নিষ্পাপ করেছেন।
আর যুবকরা হচ্ছে আমলের ক্ষেত্রে আগ্রহী। তখন একজন যুবক বলে উঠলো, আমি সারা রাত নামাজে কাটিয়ে দেবো। আরেকজন বলল, আমি পুরা দিন রোজা রাখব। আরেকজন বলল, আমি বিয়ে করব না।
তখন রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘না এমন করো না। কেননা আমি রাতে ঘুমাই, আবার কিছু অংশ নামাজ পড়ি, রোজা রাখি আবার মাঝেমধ্যে ছেড়ে দিই, আমি বিয়ে করি, কাজেই তোমরাও বিয়ে কর ‘
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাযি.) বলেন, হে আল্লাহর রসুল! আমাকে দিনে এক খতম কুরআন খতম করার অনুমতি দান করুন। তখন রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে পনেরো দিনে খতম করার অনুমতি দিলেন। তখন তিনি বললেন, আমি আরও কম সময়ে খতম করার সামর্থ্য রাখি। তখন রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ১০ দিনে এক খতম করার অনুমতি দিলেন। তিনি বললেন, আমি এর চেয়ে কম সময়ে খতম করার ক্ষমতা রাখি। তখন রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ৭ দিনে এক খতম করার অনুমতি দিলেন। তাই সাত দিনের চেয়ে কম সময়ে রমজান ছাড়া কুরআন খতম করা উচিত নয়।
সম্মানিত হাজিরীন!
আজকে যুবকদের পোশাক-আশাক দেখলে আশ্চর্য লাগে তারা ফিল্ম স্টারদের, খেলোয়াড়দের মতো করে পোশাক পরে। রসুল (সা.) একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাযি.)-এর শরীরে দুটি পোশাক দেখলেন। যেগুলো কাফেরের পোশাকের সাথে সাদৃশ্য রাখে। এ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ».
‘যে যাদের সাথে সাদৃশ্য রাখে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’[3]
দেখা যায়, অনেক ছেলেরা মেয়েদের মতো পোশাক পরিধান করে। মেয়েরা স্বর্ণালংকার ব্যবহার করে, ছেলেরাও মেয়েদের মতো স্বর্ণ ব্যবহার করে। এজন্য এগুলো পরিহার করা দরকার।
আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ব্যতীত কেয়ামতের ময়দানে কদম সামনে এগোতে পারবে না। তার মধ্যে «عَنْ شَبَابِهِ فِيْمَا أَبْلَاهُ» এটিও থাকবে।[4] এর অর্থ হচ্ছে, ‘যৌবনকাল সেটি কোনো কাজে ব্যয় করেছ।’[5]
আজকের যুবকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেলা অবহেলায় মূল্যবান সময় ব্যয় করে। রাস্তাঘাটে, শপিং মলে, সাগর পাড়ে, স্টেডিয়ামে, মোবাইলে, ফেসবুকে। আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করবেন, ‘যৌবনকাল কোথায় ব্যয় করেছ?’ পুরো হায়াতের হিসেবের মধ্যে যৌবনকাল চলে আসছে। এরপরেও কেন সেটির আলাদাভাবে হিসাব নেওয়া হবে? তাহলে আমাদের বোঝা দরকার এ সময়টা কেমন মূল্যবান। রসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন,
«اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: حَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شَغْلِكَ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَشَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ».
‘পাঁচটি জিনিস আসার পূর্বে পাঁচটি জিনিসের মূল্যায়ন করো। বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকালকে মূল্যায়ন করো।’
আজকে আমরা যারা বার্ধক্যের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছি, আমরা বুঝেছি যৌবনকালের কতইনা মূল্য। আজকে যৌবনকাল তো আমাদের হাতের নাগালেই আছে। বৃদ্ধ হলে লাঠি ধরে চলাফেরা করতে হবে, চারদিক দিয়ে রোগ আসতেই থাকবে তখন আফসোস ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। তখন বলবে, আমি তো এখন সামান্য সময় দাঁড়িয়ে ও নামাজ পড়তে পারছি না। আর যদি যৌবনকালে নামাজ পড়তাম তাহলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারতাম। এখন খিদে লাগলে ভোগ সহ্য করতে পারি না। এর আগেও কয়েক বেলাও না খেয়ে থাকতে পারতাম।
তিনি আরও বলেন, ‘অসুস্থতা আসার আগে সুস্থতার দাম দাও। অসচ্ছলতা আসার আগে স্বচ্ছলতার, ব্যস্ততা আসার আগে অবসরের দাম দাও, মৃত্যু আসার পূর্বে হায়াতের দাম দাও।’[6]
আমাদের জীবনের মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে যৌবনকাল। কেননা কেয়ামতের ময়দানে এ অধ্যায় থেকে প্রশ্ন করা হবে। কেননা এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ আমরা পরীক্ষার মধ্যে দেখি অনেক অধ্যায় থাকলেও প্রত্যেকবার কমন কমন অধ্যায় থেকে পরীক্ষার প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু আমরা এখন দুনিয়ার মোহের মধ্যে পড়ে গুনাহের মধ্যে লিপ্ত হয়ে গেছি।
আমাদের যুবকদের দেখি তারা নাচ-গানে, বিনোদনে, পার্কে এবং মোবাইলে বিভিন্ন স্ট্যাটাস দেওয়ার মধ্যে এমন কি অশ্লীল ছবি দেখার মধ্যে ব্যস্ত হয়ে গেছে। অথচ আমাদের আকাবিররা পুরো রমজান মাসের মধ্যে ৩০, ৫০ ও ৬০ বার কুরআন খতম করতেন। এটি কোনো অবিশ্বাস্য ব্যাপার নয়। কারণ আমরা দেখি ১০ ঘণ্টায় পুরো কুরআন খতমের সফটওয়্যার।
আর এখন ব্যাপারটা হয়ে গেছে উলটো আমাদের আকাবির ১০ ঘণ্টায় এক খতম কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। আজ এখনো অনেক যুবক আছে যারা দিনের মধ্যে কম হলেও ১০ ঘণ্টা মোবাইলে সময় দেয়। আমাদের উচিত আমাদের হাত, পা, কান, চোখ ও সমস্ত শরীরকে গুনাহ থেকে বাঁচানো। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন,
اِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ اُولٰٓىِٕكَ كَانَ عَنْهُ مَسْـُٔوْلًا۰۰۳۶
‘নিশ্চয়ই কর্ণ, দৃষ্টি, অন্তর সমস্ত কিছু সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করবেন।’[7]
তাই যুবসমাজই হল আমাদের বর্তমান, আমাদের ভবিষ্যৎ। যুবক হল দিনের মধ্যে দুপুরবেলা। আমরা দেখি যে, দিনের মধ্যে একদম সকালে কাজ শুরু হয় না। আর বিকেলের দিকে কাজের ব্যস্ততা কমে যায়। কিন্তু দুপুরে দ্রুতগতিতে কাজ হয়। ঠিক তদ্রূপ যুবকরাও সেই রকম দুপুর বেলার মতো।
মুহতারাম হাজিরীন!
বর্তমান দুনিয়ার প্রত্যেকেই চাই যে, তাদের কাজের মধ্যে যুবককে ব্যবহার করতে। আল্লাহ তাআলাও চান যে, যুবকরা তাঁর সাথে সম্পর্ক করুক। যুবক হচ্ছে সমাজের ভবিষ্যৎ। আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের আশার আলো। তারা যদি ঠিক হয় তাহলে এ সমাজ ঠিক থাকবে। আর তারা যদি খারাপ হয়ে যায় তাহলে সমাজ অধঃপতনের দিকে চলে যাবে। সমাজ দীন ধর্মহীন হয়ে পড়বে।
যৌবনকালকে দাম না দিয়ে কেউ বড় হতে পারেনি। বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি যে সময় ফুরানোর আগে সময়কে কাজে লাগায়।
হে যুবক! আপনার আব্বা আপনার দিকে চেয়ে আছেন। আমরা আপনার দিকে চেয়ে আছি। তাই আমি যুবকদের হাতে পায়ে ধরে বলব আমরা গান-বাজনা থেকে দূরে থাকি। কেননা গান-বাজনা শোনার দ্বারা অন্তর নষ্ট হয়ে যায়, অন্তর মরে যায়, ঈমান দুর্বল হয়ে যায়, আল্লাহ তাআলার থেকে সম্পর্ক দূরে হয়ে যায়। দিনের কথা শুনতে ভালো লাগে না, আলেম-ওলামাকে মহাব্বত লাগে না। এজন্যই তো নজর ইবনে হারেস মক্কার যুবকদেরকে আল্লাহর রসুলের কথা শোনা থেকে বিরত রাখার জন্য ইরান থেকে ব্যবসা করে ফিরে আসার সময় সোহরাব-রুস্তমের কল্পকাহিনিগুলো ক্রয় করে নিয়ে আসত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّشْتَرِيْ لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ١ۖۗ وَّيَتَّخِذَهَا هُزُوًا١ؕ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ۰۰۶
‘মানুষের মধ্য থেকে এমন কিছু মানুষও আছে যারা লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অনর্থক কথাবার্তা খরিদ করে আর তারা এগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।’[8]
এগুলো সব শয়তানি কাজকর্ম। কেননা যদি দিলের মধ্যে শয়তানি কথাবার্তা ও আচার-আচরণ জায়গা নিয়ে নেয়। তাহলে আল্লাহর কালাম ঢুকবে না। কেননা অন্ধকার আর আলো একসাথে একত্রিত হয় না। এজন্য কুরআনের আয়াত অনুযায়ী বর্তমান যুগের নাচ, গান, আড্ডা, সিনেমা ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপ এগুলো অন্তর্ভুক্ত হবে। তাই আমাদের উচিত বিশেষ করে প্রথমত মোবাইল ত্যাগ করা।
কেননা যারা মোবাইল বানিয়েছে তারা পর্যন্ত বলেছে যে, মোবাইলের দ্বারা মানুষ বিষণ্ণতার শিকার হয়। আমাদের উচিত ইসলামের জন্য যারা নিজেদের জান উৎসর্গ করেছেন বেশি বেশি তাদের ইতিহাস অধ্যায়ন করা। যেমন বীরে মাউনা যুদ্ধের মধ্যে প্রায় ৭০ জন যুবক সাহাবী শহীদ হয়েছেন। যুবক সাহাবী হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাযি.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.), হযরত উবাই ইবনে কাব (রাযি.) যার কুরআন রসুল (সা.) পর্যন্ত শুনতে চেয়েছেন।
আমি সম্মানিত যুবকদের ও অভিভাবকগণকে অনুরোধ করব, আপনারা যদি আপনাদের ছেলে-মেয়েদেরকে স্মার্ট ফোন দেন তাহলে তারা মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে যাবে। মোবাইলের মধ্যে যুবক-যুবতীরা অশ্লীল ছবি দেখবে। ফেইসবুক ইউজ করবে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোবাইলের স্ক্রিনের মধ্যে অশ্লীল ছবি চলে আসে। আর বাস্তবে অশ্লীল দেখলে যেরকম গুনাহ হয় তদ্রূপ মোবাইলে দেখলেও গুনাহ হয়। ফলে দিনের পর দিন গোনাহর দিকে ধাবিত হতে হতে তার অন্তরটি মরে যায়। তাই কমসে কম মোবাইল নিয়ে দিলেও বিয়ের পরে নিয়ে দেওয়া। তবে আসল কথা হচ্ছে মোবাইলের উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই হল বেশি। আর যদি আমি সেটিকে ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারি তাহলে সেটা অনেক ফলদায়ক হয়।
পরিশেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করি যাতে করে যুবকদের উদ্দেশ্যে যে কথাগুলো বলেছি সেগুলোর ওপর আল্লাহ তাআলা সবাইকে আমল করার তওফিক দান করুন। আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
অনুলিখন: মুহাম্মদ মোবারক হোসেন
শিক্ষার্থী, আরবি সাহিত্যবিভাগ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
[1] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৭, পৃ. ৩, হাদীস: ৫০৬৫
[2] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত-তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৩৫, পৃ. ৩১৮-৩১৯, হাদীস: ৩১৪০৩
[3] আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ৪৪, হাদীস: ৪০৩১
[4] আল-বাযযার, আল-মুসনাদ = আল-বাহরুয যাখ্খার, মাকতবাতুল উলুম ওয়াল হাকাম, মদীনা মুনাওয়ারা, সৌদি আরব (১৪০৪-১৪২৯ হি. = ১৯৮৮-২০০৯ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ২৬৬, হাদীস: ১৪৩৫
[5] আল-বাযযার, আল-মুসনাদ = আল-বাহরুয যাখ্খার, মাকতবাতুল উলুম ওয়াল হাকাম, মদীনা মুনাওয়ারা, সৌদি আরব (১৪০৪-১৪২৯ হি. = ১৯৮৮-২০০৯ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ২৬৬, হাদীস: ১৪৩৫
[6] ইবনে আবু শায়বা, আল-মুসান্নাফ ফিল আহাদীস ওয়াল আসার, মাকতাবাতুর রাশাদ লিন-নাশর ওয়াত তাওযী’, রিয়াদ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৯ হি. = ১৯৮৯ খ্রি.), খ. ৭, পৃ. ৭৭, হাদীস: ৩৪৩১৯
[7] আল-কুরআন, সুরা আল-ইসরা, ১৭:৩৬
[8] আল-কুরআন, সুরা লুকমান, ৩১:৬