আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া
الحمد لله وكفىٰ، وسلام علىٰ عباده الذين اصطفىٰ، أما بعد! قال الله تبارك: [فَاذْكُرُوْنِيْۤ۠ اَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوْا لِيْ وَلَا تَكْفُرُوْنِؒ۰۰۱۵۲] {البقرة: 152}.
মুহতারম! আমি আপনাদের সামনে তেলাওয়াতকৃত আয়াত নিয়ে সামান্য আলোচনা করতে চাই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَاذْكُرُوْنِيْۤ۠ اَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوْا لِيْ وَلَا تَكْفُرُوْنِؒ۰۰۱۵۲
‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং আমার অবাধ্য হও না।’[1]
মূলত আমাদের কওমি মাদরাসাসমূহ প্রতিষ্ঠার একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের মাঝে সম্পর্ক গড়ে তোলা। আমরা অবশ্যই অবগত আছিযে, প্রত্যেক জিনিস নিজে নিজে অস্তিত্ব লাভ করেনি; বরং তার জন্য রয়েছে একজন স্রষ্টা। তিনি হলেন আল্লাহ। কিন্তু অনেকেই স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। তাই তাদের সাথে আমাদের পূর্বপুরুষগণ মুনাযারা করেছেন এবং আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমাণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ইতিহাসের কিতাবাদিতে উল্লেখ আছে। এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণে ইমাম আযম (রহ.)-এর ঐতিহাসিক টকশো
একদিন অবিশ্বাসী গোষ্ঠী মুসলিমদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলো যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই। পক্ষান্তরে মুসলিমগণ স্রষ্টার অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাসী। একপর্যায়ে বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী মুসলিম-অমুসলিম উভয় পক্ষ উপস্থিত হলো ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ব্যতীত। তাই তারা বিজয়ের ধ্বনিতে মুখরিত। বিজয়ের আহ্লাদে উল্লাসিত ও উদ্ভাসিত। যেন তারা বিজয়ী চাদরে আচ্ছাদিত। এ বিলম্বের কারণে তাদের অবস্থা আরও জয়জয়কার।
অপর দিকে মুসলিমরা ভারাক্রান্ত হৃদয়-মনে হতাশ হয়েবসে আছে। তাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে পরাজয়ের ধ্বনি। যেন তারা হাবুডুবু খাচ্ছে গভীর সমুদ্রে, যেখান থেকে তাদেরকে উদ্ধার করার মতো কেউ নেই। কী আর করার! এভাবে চলতে লাগলো। হঠাৎ আগমন ঘটলসেই প্রত্যাশিত ও প্রতিক্ষিত ব্যক্তিত্বের। তিনি হলেন, সময়ের সেরা কিংবদন্তি আলেম ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.)। তখনই মুসলমানদের হৃদয়ে আল্লাহর শুকর ও কৃতজ্ঞতার সঞ্চার হলো এবং সকলেই বলে উঠলো, আল-হামদু লিল্লাহ। তারা যেন আকাশের তারকারাজি স্পর্শ করে ধন্য হলো।
অতঃপর সে কিংবদন্তি আলেমকে মঞ্চে দাঁড় করানো হলো। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার উপস্থিতি এত দেরিতে কেন? তিনি বললেন, একটু শান্ত হোন। আমি সব খুলে বলছি। কী এমন ঘটনা! তিনি বললেন যে, আসলে আমি সময় হাতে রেখেইবাড়ি থেকে রওনা দিলাম। তবে মাঝ পথে চোখে পড়ল একটি বড় নদী, যা অতিক্রম করার সামর্থ্য আমার নেই। মজার ব্যাপার হলো, আপনা আপনি একটি গাছ নৌকায় রূপান্তরিত হয়ে পানিতে ভাসতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে তো আমি খুশিতে আত্মহারা। অতঃপর আমি তাতে আরোহন করে কোনোমতেই নদী পার করলাম। তা শুনে সবাই একসাথে বলে উঠল অসম্ভব! অসম্ভব! এটা কোনো কথা হলো?
তখনই তিনি সেই সুযোগে চিৎকার করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠলেন, শোনো! শোনো! হে অবিশ্বাসী সম্প্রদায়! যদি একটি মাত্র গাছ এমনি এমনি কোনো কর্ম সম্পাদন করতে অক্ষম হয়, আর বিষয়টি যদি কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি মেনে নিতে না পারে, তো তোমাদের অন্তরে এ রকম এক নোংরা বিশ্বাস কীভাবে স্থান পেলো যে, সমগ্র পৃথিবী আপনাআপনি অস্তিত্বে আসলো? পৃথিবী পরিচালনা এমনি এমনি হয়? এটা মূর্খতার চূড়ান্ত পর্যায় নয় কি?
শেষ হলো টকশো। এবার ফলাফলের পালা। তাদের দাবিই সত্য প্রমাণিত হলো। মুসলিমরা ফিরে পেল তাদের মহত্ব, মর্যাদা ও সম্মান। অবিশ্বাসী সম্প্রদায় হয়ে গেল হতভম্ব! বদলে গেলো বিজয়ের ধ্বনি পরাজয়ের ধ্বনিতে। আফসোসের হাত মাথায় রেখে ফিরে গেল নিজ নিজ বাড়ি-গৃহে। এভাবে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে বিজয় দান করেন। এখনো কি বুঝে আসলো না? অথচ প্রতিটি জিনিসপত্র প্রমাণ করে তার অস্তিত্বকে। কবি বলেন,
برگ درختان سبز در نظر ہوشیار
ہر ورق دفتریست معرفتِ کردگار
সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করুন এতে মানুষের কল্যাণ নিহিত
এতক্ষণআমরা স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। তাতে আমরা অবগত হলাম, আল্লাহই আমাদের স্রষ্টা ও পরিচালক। সে আল্লাহই বলেন,
فَاذْكُرُوْنِيْۤ۠ اَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوْا لِيْ وَلَا تَكْفُرُوْنِؒ۰۰۱۵۲[2]
তাহলে অবশ্যই আমাদের কর্তব্য হলো, সর্বদা তাকে স্মরণ করা। এতেই আমাদের কল্যাণ নিহিত। কেননা তিনি ওই সময় আমাদেরকে স্মরণ করবেন। এককথায় বান্দার স্মরণে আল্লাহ, যখন আল্লাহর স্মরণে বান্দা। তবে আল্লাহর পরিচয় পঞ্চইন্দ্রীয় দ্বারা লাভ করা যায় না। তাহলে তাঁকে কীভাবে স্মরণ করা যায়? তিনি নিজেই বলেন,
اِنَّ فِيْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ وَاخْتِلَافِ الَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَاٰيٰتٍ لِّاُولِي الْاَلْبَابِۚۙ۰۰۱۹۰
‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের পরিবর্তনে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন।’[3]
প্রিয়বন্ধুগণ!
নিঃশ্বাস চালু থাকার কারণে যদি আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের ভেতরে রুহ বিদ্যমান। এত বড় পাহাড় পর্বত নদী সাগর দ্বারা আমরা কেন আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে পারবো না? আল্লাহকে স্মরণ করতে পারবো না। যিকরের মাধ্যমে মুমিনের অন্তর প্রশান্ত হয়। আমি আগে বলেছি চোখে আল্লাহকে দেখা যায় না। যেহেতু তিনি অদৃশ্য। তবে তিনি আমাদেরকে রুহ দিয়েছেন। যার দরুন তারপরিচয় অর্জন করা সম্ভব। যদি রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তখন আমি নবীর দেয়া জবাব প্রদান করব, যা তাকে আল্লাহ শিখিয়েছেন। চিনেন তিনি কেমন নবী? আমরা তাকে চিনতে পারিনি।
প্রিয় ভাইয়েরা!
রুহ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلِ الرُّوْحُ مِنْ اَمْرِ رَبِّيْ ۰۰۸۵
‘রুহ হলো আল্লাহর নির্দেশিত একটি পাখি।’[4]
এটি নিশ্চিন্ত হয় যিকরের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
اَلَا بِذِكْرِ اللّٰهِ تَطْمَىِٕنُّ الْقُلُوْبُؕ۰۰۲۸
‘শুনো, আল্লাহর যিকর দ্বারাই অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।’[5]
আল্লাহর যিকির তো বিভিন্নভাবে করা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- কুরআন তেলাওয়াত করা। রসুল(সা.) বলেন, «أَفْضَلُ الذِّكْرِ تِلَاوَةُ الْقُرْآنِ فِي الصَّلَاةِ» অর্থাৎ সর্বোত্তম যিকর কুরআন তেলাওয়াত। কুরআন শরীফ হলো রসুলের জীবন্ত মুযিজা। এজন্য সবাই বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করবেন।
- আল্লাহ আল্লাহ যিকর। এটা হল ইসমে আযম।
কুরআন কতই না স্পষ্ট ও চমৎকার ভাষায় বর্ণনা করেছে, তার দয়া সহনশীলতা, সহানুভূতি, ও মহানুভবতার কথা। তাছাড়া, তার দেয়া রিযিক দিয়ে আমাদের বেড়ে উঠা। অবশেষে আমরা মানতে বাধ্য যে আমাদের জীবনের পুরো ইতিহাসই তার দয়া। তবুও আমরা প্রতিটা সেকেন্ড অতিবাহিত করছি তার অবাধ্যতায়। আমরা কতই না অকৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাআলা আমাদের বুঝার তওফিক দান করেন। আমিন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
আলোচক: মুহতামিম, দারুল উলুম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম
অনুলিখন: খুবাইব নূর
জামায়াতে দুয়াম
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
মানুষের অভ্যন্তরীণ রোগব্যাধি ও তার চিকিৎসা
(পৃ. ১০, ৩য় কলামের পর)
এগুলো হলো রুহানি ব্যাধি, শরীরের কোনো অংশ রোগ আক্রান্ত হলে যেমন নাকি আমরা এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে যাই তেমনি রুহানি রোগের চিকিৎসার জন্যও রুহানি চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তার চিকিৎসা হলো আল্লাহ তাআলার যিকর ও তার ইবাদত বেশি বেশি করে করা। আল্লামা থানবী রহমতুল্লাহি আলাই বলেছেন দিনে 24 হাজার বার আল্লাহ যিকর করা চাই।এই আল্লাহ শব্দ হলো সারা পৃথিবীর রুহ। কারণ রসুল (সা.) বলেছেন,
«لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّىٰ لَا يُقَالَ فِي الْأَرْضِ: اللهُ اللهُ».[6]
বর্তমান দেখা যায় যুবক করা অনেক বেশি লাফালাফি, নাচানাচি ও দৌড়াদৌড়ি করে। অথচ তাদের কোনো হুশ নেই। আরে ভাই এটা কত দিন দুই বছর, চার বছর, পাঁচ বছর, এরপর কি? আপনাকে তো আল্লাহ তাআলার কাছে যেতেই হবে তাই আসুন আল্লাহর কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আত্মশুদ্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
অনুলিখন: হামিদুল্লাহ
জামায়াতে দুয়াম
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
[1] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৫২
[2] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৫২
[3] আল-কুরআন, সুরা আলে ইমরান, ৩:১৯০
[4] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৫২
[5] আল-কুরআন, সুরা আর-রা’দ, 13:২৮
[6] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪ হি. = ১৯৫৫ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৩১, হাদীস: ১৪৮