ইমরান নাজির
আল্লাহ তাআলা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম নবী ছিলেন পৃথিবীতে মানবকুলের প্রথম অধিবাসী আমাদের আদিপিতা বাবা হযরত আদম (আ.) এবং সর্বশেষ নবী ছিলেন মানবতার মুক্তির দূত সাইয়িদুল আম্বিয়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মানবতার বন্ধু মুমিনের প্রাণাধিক প্রিয় ব্যক্তিত্ব জনাবে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। মানবজাতিকে সঠিকপথে পরিচালিত করার জন্য হেদায়েতের বাণী হিসেবে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁদের ওপর অবতীর্ণ হয় আসমানী কিতাব সমূহ। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ চারটি কিতাব হচ্ছে (১) তাওরাত, (২) যাবূর, (৩) ইনজিল ও (৪) কুরআন।
কুরআন যেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের প্রিয় নবী রহমতে দোআলম (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ সর্বশেষ আসমানী কিতাব। যেটি পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের শবে কদরের রজনীতে অবতীর্ণ হয়। এবং তা অবতীর্ণ হতে সময় লাগে দীর্ঘ তেইশ বছর। যা মানবজাতির প্রয়োজনার্থে এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাকুলের সরদার হযরত জিবরীল (আ.)-এর মাধ্যমে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ করেন।
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এই কুরআনের বিধান অনুযায়ীই তাঁর জীবনের যাবতীয় কার্য সম্পাদন করেন। এবং তাঁর সহচর সাহাবিদের ওপরও কুরআন শিক্ষার গুরু দায়িত্ব আরোপ করে তাঁদেরকে তা জানা ও বোঝার সুযোগ করে দেন। ফলে সাহাবায়ে কেরাম কুরআন শিক্ষা করে এবং তা জেনে ও বুঝে হয়ে উঠেন একেকজন অসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। এবং তারা তা জানা ও বোঝার কারণে সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারামের দিশা পান এবং সেই অনুযায়ী আমল করে তাঁদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন গঠন করেন। কিন্তু আজ বড়ই পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, আমরা মুসলমানরা শুধু কুরআন শিখার মধ্যেই ক্ষান্ত থাকি। কুরআন শিখার পর কুরআনকে তিলাওয়াত, জানা ও বোঝাও যে আমাদের ওপর অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব তা আমরা অনেকেই জানি না। জানলেও এ ব্যাপারে কোন গ্রাহ্য করি না। কুরআনের তেলাওয়াত শিক্ষা হয়ে গেলেই মনে করি কুরআনের প্রতি আমাদের দায়িত্ব শেষ। কিন্তু আসলে তা নয়। কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষা করা যেমন আমাদের ওপর ফরজ ঠিক তেমনিভাবে কুরআন জানা ও বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা একেবারেই উদাসীন। আল্লাহপ্রদত্ত এই ঐশী গ্রন্থকে আমরা মোটেও বোঝার চেষ্টা করি না। নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াতও আমরা বাদ দিয়েছি।
অথচ দুনিয়ার মানবরচিত সাধারণ শিক্ষা যেমন সাহিত্যের ছোট একটি গল্প বা কবিতা পড়তে গেলে কবির জীবনী বা লেখক পরিচিতি, পাঠ পরিচিতি, কবিতার প্রতিটি লাইনের ব্যাখ্যা ও সারমর্ম জানার জন্য আমরা কত ব্যাকুল হয়ে ওঠি! যা ইহলৌকিক শিক্ষা জীবনে আমাদের কিঞ্চিৎ পরিমাণ উপকারে আসে তাও যদি পরীক্ষার খাতায় সঠিকভাবে লিখতে পারি। না হলে নয়। কিন্তু যে কুরআন মানবজাতির হেদায়েতের জন্য মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অমূল্য এক মহা ঐশীগ্রন্থ, ইহ ও পরকালীন জীবনের মুক্তির পথ, সত্য-মিথ্যার পথ প্রদর্শনকারী, হালাল-হারাম চিহ্নিতকারী সেই মহা ঐশীগ্রন্থের কয়টি সূরা বা আয়াতের অর্থ, ভাবার্থ, ব্যাখ্যা, প্রেক্ষাপট ও শানে নুজুল আমাদের জানা আছে?
অথচ এই কুরআন সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন সর্বোত্তম বাণী, তা এমন একটি গ্রন্থ, যাতে বিভিন্ন বিষয় পূণ পূণ আলোচনা হয়েছে, তবু তা নিখাঁদ ভারসাম্যপূর্ণ। যারা তাদের মালিককে ভয় করে, এ বাণীতে তাদের লোম শিউরে ওঠে। অতঃপর আল্লাহর স্মরণে তাদের দেহ-মন বিগলিত হয়ে যায়।’ (আয-যুমার: ২৩)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে নূর ও স্পষ্ট কিতাব। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, এর মাধ্যমে তিনি তাদের দেখান শান্তি ও নিরাপত্তার পথ। আর নিজ ইচ্ছায় তাদের বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোতে এবং প্রদর্শন করেন সত্য সরল পথ।’ (আল-মায়েদা: ১৫-১৬) আর রাসূল (সা.) হাদীস শরীফের মধ্যে বলেছেন, ‘কুরআনের আহবান ও আলোচ্য বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করো, অবশ্যই তোমরা সাফল্য লাভ করবে।’ (বায়হাকী)
অতএব আমাদেরকে কুরআন শেখার ন্যায় তা বুঝতেও হবে এবং সেই অনুযায়ী আমল করে আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন গঠন করতে হবে। তবেই আমরা ইহকালীন জীবনে শান্তি ও পরকালীন জীবনে মুক্তি পেতে পারি।