জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল্লামা পালনপুরী (রহ.): কাছ থেকে দেখা কিছু স্মৃতি ও অনুভূতি

যুবাইর হানীফ

 

(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

খতমে বুখারী প্রথা

হযরতুল উস্তাদ যখন দেখলেন যে সবদিকে খতমে বুখারী নামে বিশাল বিশাল ইজলাস হচ্ছে, অনুষ্ঠান হচ্ছে৷ শত শত মানুষ বাইর থেকে এসে ভীড় জমাচ্ছে৷ দিন তারিখ ঠিক করে পূর্ব থেকে ঘোষণা করে বেড়াচ্ছে৷ ওয়াকফ দেওবন্দ, সাহরানপুরসহ বিভিন্ন বড় বড় মাদরাসায় এ প্রথা চালু হতে যাচ্ছে তখন হযরত ফতওয়া দিলেন আমাদের মাদরাসাগুলোতে এটা যেভাবে বেড়ে চলেছে তা বিদআতের রূপ নিতে যাচ্ছে৷ এভাবে করলে আমাদের দেওবন্দিয়ত মিটে যাবে৷ এরপর দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে মুরব্বি আকাবিরগণ বিষয়টি নিয়ে সবাইকে বারণ করেন যেন এমন না করা হয়৷ অনেক মাদরাসা এ কাজ থেকে ফিরে আসে৷ আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন৷ দারুল উলুম দেওবন্দে খতমে বুখারী নামে কোনো দিন নেই৷ বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান নেই৷ স্বাভাবিকভাবে দরস শেষ হয়৷ আমাদের বছর এক কাণ্ড ঘটেছে৷ হযতুল উস্তাদ যখন জানতে পারলেন যে, বুখারী কোনো দিন শেষ হবে সে দিনের জন্যে অনেক বাইরের মানুষ অপেক্ষায় থাকে৷ অন্যান্য জামায়াত ও মাদরাসার তালিবে ইলম ভাইয়েরা এসে ভীড় জমাবে৷ হুযুর স্পষ্ট করে বলে দিলেন, বুখারী যেকোনো একদিন হঠাৎ করেই শেষ হবে৷ হয়েছেও তাই৷ আমাদের বছর একদিন ইশার পর দরস করতে আসলেন৷ কিতাব শেষ হতে এখনও প্রায় ২০-২২ পৃষ্ঠা বাকি৷ আমরা ভাবলাম না আজ শেষ করবে না৷ পরে দেখি রাত ১২ টা বেজে যাচ্ছে তখনও পড়াচ্ছেন৷ পৃষ্ঠা আছে আর মাত্র ৬-৭ টা৷ কিন্তু হুযুর নিজে নিজে ইবারত পড়ছেন ও তাকরীর করছেন৷ তখন বুঝতে পারি যে, আজ বুখারী খতম করবেন৷ অবশেষে ২৯ রজব ১৪৩৮ রাত ১২:৫৫ মিনিটে সহীহ বুখারী শেষ করেন৷

শোকসভা 

শোকসভার ব্যাপারে হযরত খুব কঠোর ছিলেন৷ স্পষ্টভাবে নিষেধ করতেন৷ বলতেন এটা কিছুদিন পর বিদআতে রূপ নেবে৷ যেভাবে এই শোকসভা বলো আলোচনা সভা বলো এসব দেওবন্দিয়ত নয়৷ এগুলো বেরেলভীদের কাজ৷ তারা এমন করে৷ এ থেকে আস্তে আস্তে আকাবিরদের শরীয়তের সীমা পার হয়ে সম্মান দেওয়া আরম্ভ করবে৷ হযরত বলতেন, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির জন্যে শোক প্রকাশ করার অনুমতি আছে৷ কাছের, দূরের সকলেই শোক প্রকাশ করতে পারে৷ কিন্তু তাকে কেন্দ্র জলসা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ফিকরে শরীয়তের খেলাফ৷ সুনানে ইবনে মাজাহর হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ أَبِيْ أَوْفَىٰ، قَالَ: «نَهَىٰ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ‌عَنِ ‌الْـمَرَاثِيْ» (رواه ابن ماجه: 1592).

এ হাদীস দিয়ে হুযুর দলীল পেশ করেন৷ তা ছাড়া এসব মজলিসে অতিরঞ্জন হয়৷ যা কাম্য নয়৷ আর আর হাদীসে যে,

«اذْكُرُوْا مَحَاسِنَ مَوْتَاكُمْ» (رواه أبو داود: 4900).

তা থেকে উদ্দেশ্য হল, কোনো প্রসঙ্গে মৃতব্যক্তির আলোচনা এলে তার ভালো দিকগুলো বর্ণনা করা৷ মন্দদিকগুলো থেকে বিরত থাকা৷ জলসা করা এর দ্বারা প্রমাণিত নয়৷ দারুল উলুম দেওবন্দের ফতওয়াও এমন৷ তাযিয়াতী জলসা শরীয়সম্মত নয়৷ (দেখুন ফতওয়া: 244-74T/B=05/1440)

জীবনের শেষ সময়ে এসে ১৪৩৮ হিজরীতে যখন কারী তাইয়িব (রহ.) ছেলে হযরত সালেম কাসেমী (রহ.) ইন্তিকাল করেন তখন দারুল উলুম ওয়াকফ শোকসভা করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন হুযুর এ বিষয়ে তাদের নিষেধ করেন, দেওবন্দও নিষেধ করে৷ কর্তৃপক্ষ আমলে না নিলে হযরতুল উস্তাদ তখন (جلسہ تعزیت کا شرعی حکم) নামে কিতাবটি রচনা করেন৷ এটি তাঁর জীবনের সর্বশেষ রচিত কিতাব৷

দেওবন্দিয়ত কী?

২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ (শনিবার)৷ শশমাহী পরীক্ষার পর দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম দরস শুরু হয়৷ হযরতুল উস্তাদ পালনপুরী (রহ.)দরসে এসে বন্ধের কারগুজারি শোনাচ্ছিলেন৷ একপর্যায়ে বললেন, আমি বন্ধে ওমরায় গিয়েছিলাম৷ এই সফরে জেদ্দায় দারুল উলুমের ফোযালাদের উদ্দেশ্যে একটি মজলিসের ব্যবস্থা করা হয়৷ সেখানে আমাকে দুটি বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়৷ দ্বিতীয় বিষয়বস্তুর সারমর্ম ছিলো:

دیوبندیت کیا ہے

দেওবন্দিয়ত কী?

আমি তাদের সামনে এ বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছি তা হল নিম্নরূপ দেওবন্দিয়ত তিনটি বস্তুর নাম:

  1. إمحاء بدعت (বিদআত দূরীকরণ): বিদআত কাকে বলে, কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়, এমন বিষয়কে দীন মনে করাকে বিদআত বলে৷ সহীহ বুখারীতে আম্মাজান আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَائِشَةَ i، قَالَتْ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ».

রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে কেউ আমাদের এ দীনের ভেতর নতুন কিছু আবিষ্কার করবে, যা আমাদের দীনের বিষয় না, তা নিক্ষেপ যোগ্য, ভ্রান্ত৷’ (সহীহ বুখারী: ২৬৯৭)

  1. إحيائے سنت (নববি আদর্শকে জিন্দা করা): অবহেলিত সুন্নাতকে কীভাবে সতেজ করা করা যায়৷ প্রচার প্রসার করা যায় তার ফিকির করা৷
  2. تلقئ دین من السلف (সাহাবা, তাবিয়ীন, তবে তাবিয়ীনের অনুসৃত পথ গ্রহণ করা): আর এখানে সালাফ থেকে উদ্দেশ্য হলো কুরুনে সালাসাহ৷ বাকি এর জন্যে শর্ত হলো নির্ভরযোগ্য উস্তাদ থেকে শিক্ষা করা৷ বেলা সনদধারী উস্তাদের শিক্ষা গ্রহণযোগ্য নয়৷ আমাদের ইলমের যে সিলসিলা রয়েছে সে সিলসিলার সাথে থেকে পড়াশোনা করা৷ নিজে নিজে পড়ে ইলম অর্জনকারী কখনও দেওবন্দী হতে পারে না৷

হযরতুল উস্তাদ বলেন, আমার মামা [যিনি ঢাবলে কাশ্মীরী (রহ.)-এর শেষ বছরের ছাত্র ছিলেন], তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, সাঈদ! আযহার আর দেওবন্দের মাঝে পার্থক্য কী? তখন হযরত বলেন, এটা তো হাতি আর পিপড়ার মাঝে পার্থক্য জিজ্ঞাসা করার মতো৷ কারণ কোথায় আযহার! কোথায় দেওবন্দ!

আযহারে ছাত্র সংখ্যা ৮০,০০০ হাজার আর দেওবন্দে ৪,০০০ হাজার৷ আযহার প্রতিষ্ঠা হয় ৯৭০ ইংরেজিতে আজ থেকে প্রায় ১১শ বছর পূর্বে আর দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা হয় মাত্র ১৫০ বছর চলছে৷

হুযুর বলেন দেওবন্দ হলো একটা মিশন-আন্দোলনের নাম, গতানুগতিক কোনো প্রতিষ্ঠান না৷ আর আযহার হলো শুধু একটা জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র৷ দারুল উলুমের খেদমত পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, মাসাজিদ, মাকাতিব, মাদারিসে এ দেওবন্দের ছাত্র পাওয়া যাবে কিন্তু আযহারী ফুযালাদের খেদমত অনেকটা কম৷ দীনী কাজে দেওবন্দের ফুযালাদের ন্যায় তাদেরকে পাওয়া যাবে না৷ মোট কথা, দেওবন্দিয়ত আল্লাহ প্রদত্ত একটি খাঁটি মিশন, যাতে দুনিয়ার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই৷ শুধু লিল্লাহিয়াত উদ্দেশ্য৷

বর্তমান সময় দেওবন্দিয়তের নামে অনেক বেরলভী কর্মকাণ্ড আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে৷ হুযুর এগুলোর কঠিন সমালোচনা করতেন৷ বিশেষভাবে তাসাউফের নামে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি, কবরে নেমপ্লেট লাগানোর রসম, কবরে মুরাকাবা করা, ধ্যানে মগ্ন থাকা, কবরের একদম নিকটে গিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা, মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে যিয়ারত করা, আকাবিরদের বেরলভীদের মতো সম্মান দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচনা করে বলতেন,

دیوبندیت اور بدعتیوں کے درمیان صرف ایک بالشت کا فرق رہ گیا ہے۔ جب کہ یہ چیزیں قرآن و حدیث سے ثابت نہیں ہے تو پھر مسلک دیوبند کے داعیان ان حرکتوں کا ارتکاب کس طرح کرسکتے ہیں؟

আরও বলতেন,

 اب دیوبندی بريلویوں کی گود میں جا کے بیٹھا ہے۔

হযরতুল উস্তাদের ফিকির ছিল দেওবন্দী এটা কোনো ফেরকা বা পৃথক দল নয় বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ভিন্ন নাম৷ যেকোনো ব্যক্তি বিদআত, রুসুমাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে খালেস সুন্নতের অনুসরণ করবে সে দেওবন্দী৷ আহলে সুন্নাতের মূল ভিত্তি হচ্ছে, কুরআন-সুন্নাত ও তিন সোনালি যুগ (সাহাবা, তাবিয়ীন, তবে তাবিয়ীন)-এর আমলের ওপর৷ যে সমস্ত কাজ কুরআন-সুন্নাতে নেই, কুরুনে সালাসাতেও নেই বরং পরবর্তীতে আবিস্কৃত তা বিদআত৷ (যদি ইবাদত বা শরীয়ত মনে করে করা হয়) কিতাবাদিতে কোনো ফিকহী মাসালা যদি সরাসরি হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে সে মাসআলা পরিত্যাজ্য৷ (ইলমী খুতবাত দ্রষ্টব্য)

সাইড বিজনেস

একজন আলেমের মূল কাজের ময়দান হবে তালীম, তাসনীফ, দাওয়াত৷ এ তিন কাজের যেকোনো এক কাজ করার পাশাপাশি সাইড বিজনেস করা চাই৷ খণ্ডকালীন ব্যবসা৷ দরসের পাশাপাশি কোনো হালাল ব্যবসায় সময় দেওয়া, শেখা৷ আমাদের আলেমদের মাঝে এর খুব অভাব! আমরা যদি এ অঙ্গনের হালাল পদ্ধতি জাতিকে না শেখাই, এ ময়দানে না নামি, তাহলে মানুষ শেখবে কীভাবে৷ তা ছাড়া মাদরাসার যে অজিফা তা দিয়ে চলা মুশকিল হয়ে যায়৷ পরে মাদরাসার খেয়ানত করে বসে৷ মাদরাসার টাকা পয়সা অজান্তে নিজের পকেটে চলে যায়৷ এ ক্ষেত্রে হুযুর সুন্দর পরামর্শ দিতেন। বলতেন, আলেম সরাসরি কর্মস্থলে না থেকে কোনো সৎ মানুষের সাথে শরীক হবে৷ সে ব্যবসায় শো হবে৷ আলেম লভ্যাংশ পাবে আনুপাতিক হারে৷ অথবা সরাসরি নিজে শো হওয়া যেতে পারে৷ দরসের বাইরের সময়ে ফাঁকে ফাঁকে সে ব্যবসাতে কিছু সময় দেওয়া হল৷ ব্যবসা করতে কোনো লজ্জা নেই৷ নবীগণ, সাহাবে কেরামের অনেকের পেশা ছিল ব্যবসা৷ এখন আমরা ব্যবসা করতে লজ্জা করি৷ যা এটি আমাদের দুর্বলতা৷ কাটিয়ে উঠা উচিৎ৷

হুযুর নিজে ব্যবসায় পা রাখেন যেভাবে

হযরতুল উস্তাদ ব্যবসার প্রসঙ্গ আসলে দরসে কিংবা মজলিসে বলতেন, আমি যখন দেওবন্দে নিয়োগ হই৷ তখন শুরুর দিকে ব্যবসার ফিকির করি৷ প্রথম প্রথম আমি তখন কাগজের ব্যবসা করতাম৷ সাইড বিজনেস হিসেবে৷ প্রতি বৃহস্পতিবার দেওবন্দ থেকে দিল্লী যেতাম ট্রেনে৷ গিয়ে কিতাব ছাপার যে কাগজগুলো হয় ওগুলো নিয়ে আসতাম৷ সারা সপ্তাহ ওগুলো বিক্রি করতাম৷ এরপর সামনের সপ্তাহ আবার যেতাম৷ এভাবে ব্যবসায় একটু লাভ হতে থাকে৷ পরিবারও চলতে থাকে৷ একসময় আল্লাহ বরকত দিয়ে দেন৷ মাকতাবা করার স্বপ্ন দেখি৷ তখন সিদ্ধান্ত নেই মাকতাবা করার৷ তোমরা বর্তমানে যে মাকতাবায়ে হিজায দেখছ এটি সেই সাইড বিজনেসেরই ফসল৷ হযরত যে বছর দেওবন্দে প্রথম শিক্ষক হন তখন থেকে কয়েক বছর খাদেম ছিলেন বর্তমান মাদানি নগর মাদরাসার উস্তাদ হযরত উমর ফারুক সন্ধিপী (হাফি.)৷ হযরতুল উস্তাদের মৃত্যুর পর এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, হুযুর জীবনের শুরুতে অনেক কষ্ট করেছেন৷ আমি হুযুরের খাদেম ছিলাম৷ মাসে যে বেতন পেতেন সব আমাকে দিয়ে দিতেন৷ প্রতি মাসের শুরুতে কতগুলো চাল, ডাল লাগবে তা বলে দিতেন৷ আমি মাসিক বাজার করে নিয়ে আসতাম৷ অনেকসময় এমন হত মাস শেষে হিমশিম খেয়ে যেত হত৷ কিন্তু যখন সাইড বিজনেস আরম্ভ করেছেন তখন থেকে বরকত হতে শুরু করে৷

হজ পালন

যখন আল্লাহ তাআলা ব্যবসায় বরকত দান করলেন৷ আর্থিক স্বচ্চলতা এলো৷ হযরত হজ করার ইচ্ছে করলেন৷ পরিবারসহ সর্বপ্রথম নদীপথে হজ করেন৷ সর্বপ্রথম ১৪০০ হিজরী মোতাবেক ১৯৮০ ইংরেজিতে পরিবারসহ নদীপথে জাহাজে করে সফর করেন এবং ফরজ হজ আদায় করেন। এরপর আরও কয়েকবার বাইতুল্লাহ যিয়ারত করেন৷ ১৪০৬ হিজরীতে আফ্রিকা থেকে দ্বিতীয়বার হজ আদায় করেন। এ দ্বিতীয় হজ নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে বদলি হজ হিসেবে আদায় করেছিলেন। ১৪১০ হিজরী মোতাবেক ১৯৯০ ইংরেজিতে সউদীর হজ মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে তৃতীয়বার হজ আদায় করেন। এছাড়া আরও অনেক হজ-ওমরা দ্বারা ধন্য হয়েছেন।

জীবনের সকল বেতন ফেরত দেন

প্রথম হজ থেকে আসার পর ব্যবসায়, সম্পদে আরও বরকত হয়৷ তখন মাদরাসা থেকে গৃহীত সব বেতন না নেওয়ার ইচ্ছে করেন তাই ১৪২৩ সনে তিনি হজ করে আসার পর দারুল উলুম থেকে মাসিক বেতন নেওয়া বন্ধ করে দেনহযরতুল উস্তাদ ১৩৮২ হিজরীতে দারুল উলুম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদীস পরবর্তী দুই বছর দারুল ইফতায় সময় দেয়ার পর ১৩৮৪ সনে গুজরাটের দারুল উলুম আশরাফিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান১৩৯৩ হিজরী পর্যন্ত দীর্ঘ বছর সেখানে সুনামের সাথে খেদমত করেন এরপর থেকে আমৃত্যু প্রায় ৪৮ বছর দারুল উলুম দেওবন্দে মুদাররিস ছিলেন উপরন্তু জামিয়া আশরাফিয়া রান্দীর মাদরাসায় খেদমতের নয় বছরে গৃহীত বেতনের পরিমাণ ছিল ২৩২৫০ রুপি এবং ১৩৯৩ হিজরী থেকে ১৪২৩ সন পর্যন্ত ত্রিশ বছর দারুল উলুম থেকে গৃহীত বেতনের পরিমাণ ছিল ৯৪৯৮০৪.৭৫ রুপি৷ সমস্ত বেতন তিনি পরিশোধ করে দেন! (মাসিক আরমুগান; পালনপুরী সংখ্যা, জুন 2020)

ভাইদের শিক্ষাদান

১০ মুহররম ১৩৯৯ হিজরী আশুরার দিন সম্মানিতা মাকে হারান এবং যিলকদ ১৪১৩ হিজরীতে বাবাকেও হারান৷ মাতা-পিতাকে হারানোর পরিবারের পুরো জিম্মাদারী হযরতের ওপর এসে যায়৷ মোট সদস্য নয় জন৷ আপন চার ভাই ও এক মা শরীক ভাই এবং চারজন আপন বোন ছিল। মা-শরিক ভাইয়ের নাম আহমদ। যিনি তাঁর থেকে বড় ছিলেন আর আপন ভাই বোনদের মাঝে হযরত ছিলেন বড়। ভাই যথাক্রমে আবদুর রহমান, মৌলভী আবদুল মজিদ, মুহাম্মদ আমিন ও মাওলানা হাবিবুর রহমান। তিনি যখন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শিক্ষার্জন করে ফারেগ হন, তখন আবদুর রহমানের বয়স ছিল ১৫ থেকে বেশি। মাওলানা আমিন পালনপুরী ও আবদুল মজিদ তখন মক্তবে পড়তেন৷ এজন্য প্রথমেই আমিন পালনপুরী (হাফি.) নিজের সাথে দেওবন্দ নিয়ে যান, একবছর পর ভাই আবদুল মজিদকেও কাছে ডাকেন। ফতওয়া প্রদানের অনুশীলনের সাথে সাথে দুই ভাইকেও তিনি পড়াতেন।

সন্তানদের শিক্ষাদান

হযরতুল উস্তাদের মামা শ্বশুর হাফেজ মৌলভী হাবিবুর রহমান (রহ.)-এর বড় মেয়ের সাথে ১৩৮৪ হিজরীর শেষ দিকে সম্পন্ন হয়। হযরতুল উস্তাদের সম্মানিতা স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত শাকেরা, সাবেরা, আবেদা ও জাহেদা একজন নারী৷

বিয়ের পর ঘরের কাজ আনজামের সাথে সাথে হযরতুল উস্তাদের কাছে কুরআন মুখস্ত করেন। তিনি নিজের সমস্ত ছেলে-মেয়েদের হেফজের শিক্ষিকা ছিলেন। নিজের হিফয সম্পন্ন করার পর নিজের সমস্ত ছেলে-মেয়েদেরকেও পবিত্র কুরআন হিফয করান। সর্বমোট ১১ ছেলে, দুই মেয়ে এবং দুই পুত্রবধূ৷ সকলেই হাফেজ-হাফেজা৷ পুরো ফ্যামেলির সবাই কুরআনের পাখি৷ সবাইকে দীনদার বানিয়েছেন।

তালিবে ইলমদের নিয়ে হযরত বলতেন

হযরত বলতেন, আমাদের তালিবে ইলম হওয়াও একটি জিম্মাদারি৷ তালিবে ইলম হওয়া হিসেবে প্রত্যেক তালিবের জিম্মাদারি তিনটি:

ہمارے طالب علم ہونا بھی ایک ذمہ داری ہے۔ طالب علم ہونے سے طالب علم کی تین ذمہ داریاں ہیں۔

  1. আজকে যে সবক হবে তা পূর্বে মুতালাআ করে আসা৷ তথা সামনের সবক মুতালাআ করে আসা৷
  2. সবকে নিয়মিত উপস্থিত থাকা৷ দরসে সবক ভালোভাবে বুঝার প্রতি মনোযোগি হওয়া৷ বুঝে না আসলে উস্তাদের পেছনে পেছনে লেগে তা হৃদয়ঙ্গম করা৷
  3. সবক ইয়াদ করা ও ইয়াদ রাখা৷ পূর্বের সবকগুলো ইয়াদ করা ও রাখা৷ এমন যেন না হয় যে একবার ইয়াদ করলাম, ভুলে গেলাম৷

যদি কেউ এই তিনকাজ যথাযথভাবে আদায় করে তার ইলমের জিম্মাদারী আমি নিলাম৷ সে এগুলো পূর্ণ করার দ্বারা মুমিন হবে৷ অন্যথায় «لَا ‌إِيْمَانَ ‌لِـمَنْ ‌لَا ‌أَمَانَةَ ‌لَهُ»-এর আওতায় পড়বে৷ আরও বলতেন,

بہت افسوس کی بات یہ ہے کہ بہت کم طلبہ سامنے دیکھ کر آتے ہیں ہاں إلا ما شاء الله۔ اور سبق یاد ہونے سے خوش بھی نہیں ہوتے ہیں اور سمجھ میں نہ آنے سے افسوس بھی نہ کرتے ہیں۔

অর্থাৎ অনেক আফসোস হয় যে অনেক তালিবুল ইলম সামনের সবক দেখে আসে না৷ তবে কিছু সাথী ব্যতিক্রম এবং সবক ইয়াদের কারণে খুশি হয় না৷ না বুঝার কারণে কোনো আফসোসও করে না৷

শেষ দরসে একটা প্রশ্ন তার উত্তর

দারুল উলুম দেওবন্দের শেষদরসে পালনপুরী (রহ.) ছাত্রদের একটা প্রশ্ন করে কিছু কথা বলতেন৷ হুযুর বলতেন, আমারা দারুল উলুম দেওবন্দে যখন শেষ সবক পড়াই তখন ছাত্রদেরকে একটি প্রশ্ন করে থাকি৷ হে মৌলভীরা! তোমাদেরকে কে পড়িয়েছে? কেউ উত্তরে বলে, আমার আব্বা পড়িয়েছেন৷ কেউ বলে, উস্তাদরা পড়িয়েছেন৷

তখন আমি তাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করি যে, উস্তাদরা কিভাবে পড়িয়েছে? তাদের তো মুহতামিম মাসিক অজিফা-ভাতা দেন সে জন্যে তারা এখানে একত্রিত হয়ে ছাত্রদের পড়ান৷ যদি মুহতামিম তাদের অজিফা না দিত তাহলে কীভাবে পড়াত, তারা এখানে কি একত্রিত হতো? হতো না৷ হয়তো তারা অন্য কোনো কাজ করে জীবিকা উপার্জন করত৷

তখন ছাত্ররা উত্তরে বলে, জি জি, আমাদের মুহতামিম সাহেব হুজুর পড়িয়েছেন৷ তখন আমি তাদের বলি, মুহতামিম কিভাবে পড়াবেন? তিনি তো মানুষদের থেকে চাঁদা উসুল করে সেগুলোর মাধ্যমে উস্তাদ ও জিম্মাদারদের মাসিক অজিফা আদায় করে থাকেন৷ আর উস্তাদরা তোমাদের পড়িয়ে থাকেন৷ মানুষ মাদরাসায় ৫, ৫/১০, ১০ পয়সা দিয়ে থাকে সেগুলো একত্রিত করে মাদরাসা চালান হয়৷ যদি তারা চাঁদা না দিত মুহতামিম সাহেব তোমাদের কীভাবে পড়াতেন? উস্তাদের অজিফা কোত্থেকে দিতেন!

এখন ছাত্ররা চিন্তায় পড়ে যায়! তখন আমি বলি, দেখো! বাস্তবে তোমাদের পড়িয়েছে মিল্লাত (তথা সাধারণ মুসলমান)৷ মিল্লাতে ইসলামিয়া তোমাদের পড়িয়েছে৷ তাদের পয়সা জমা করে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তাদের দানে মুহতামিম উস্তাদের এখানে সমবেত করে রাখতে সক্ষম হয়েছেন৷ সে দান থেকে তাদের অজিফা দিচ্ছেন৷ এভাবে শিক্ষা-দীক্ষার একটা ব্যবস্থা হয়েছে৷ তোমাদেরও পড়ার সুযোগ হয়েছে৷ সুতরাং তোমাদের পড়িয়েছে সাধারণ মুসলমানগণ৷

এখন দেখার বিষয় হল, তোমরা মিল্লাতের জন্য কতটুকু অর্জন করেছো? ফারেগ হয়ে কওমকে কী দেবে? কাওমের জন্য নিজেকে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত করলে? মিল্লাত যেমন তোমাদের দীন শিখিয়েছে৷ তদ্রূপ তোমরা যদি মিল্লাতের খেদমত করো (যেকোনো লাইনে চাই সেটা মসজিদ হোক, মক্তব হোক, মদরাসা হোক) তাহলে তুমি কাওমের নাম উজ্বল করলে৷

দেখো! খেদমতের জন্যে কোনো নির্ধারিত বিষয় বা পথ নেই যে, এটাই করতে হবে৷ এটা না করলে চলবে না এমন নয়৷ যেকোনো দীনী খেদমত করতে পারো৷ তাহলেই তোমার পড়া সার্থক৷

যদি তুমি কোনোই খেদমত করলে না কিন্তু যা পড়েছো তা সংরক্ষণ করেছো তাহলে তুমি পুত তথা সেই সন্তানের মতো যে নিজের অর্জন বাকি রেখেছে কিন্তু পিতার কোনো ক্ষতি করেনি৷

যদি তুমি এমন হও যে, যা পড়েছো তাও সমরক্ষণ করোনি, ইলমের চাহিদা মতো চলোনি বরং নফসের চাহিদা মতো চলেছো৷ নামায পড়া ছেড়ে দিলে, চুপে চুপে বিড়ি পান করো৷ গিবত করো৷ এটা করো, ওটা করো৷ কেমন যেন তুমি আলিমের শান কী সেটাও বুঝো না বা জানো কিন্তু মানো না৷ তাহলে তুমি মিল্লাতের লাখ লাখ পয়সা খেয়ে, মাদরাসায় পড়ে কাপুরুষের পরিচয় দিল৷ তথা সে সন্তানের মতো যে তার বাপ-দাদার নাম বদ নাম করে৷ তোমাকে মিল্লাত লাখ টাকা খরচ করে পড়িয়েছে তুমি তার মূল্য দিতে জানোনি৷ উল্টো খেয়ানত করেছো৷

সুতরাং আমার প্রিয় ছাত্ররা! কমচে কম অন্তত তোমার নিজের খেয়াল তো করবে৷ তোমার বড়দেরকে অনুসরণ করে চলবে!

মূল জিম্মাদারি তো এটা যে, মিল্লাত এতোদিন তোমাদের তৈরি করেছেন এখন তোমরা মিল্লাতকে তৈরি করো৷

هَلْ جَزَآءُ الْاِحْسَانِ اِلَّا الْاِحْسَانُۚ۰۰۶۰

সাধারণ মানুষ আমাদের ওপর ইহসান করেছে আমাদেরও জরুরি হল আমরা তাদের সাথে ইহসানের ব্যবহার করব৷ তা হবে যে ইলম শিখেছি তা প্রচার প্রসারের মাধ্যমে৷

আরও বলতেন, যাদের যোগ্যতা তৈরি হয়ে গেছে তারা এখন থেকে জীবনের দ্বিতীয় ইকরা শুরু করো৷ প্রথম ইকরার সময় আট বছর তথা মাদরাসার নির্ধারিত নেসাব৷ আর দ্বিতীয় ইকরার কোনো সময় নেই৷ ফারাগাতের পর থেকে শুরু হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত চলবে৷ মৃত্যুর মাধ্যমে সে ইকরা শেষ হবে৷

যদি প্রথম ইকরাতে তোমার যোগ্যতা তৈরি না হয় তাহলে মিল্লাতের খেদমত করার আরও অনেক রাস্তা রয়েছে যেকোনো একটাতে লেগে যাও৷ তাবলীগে বের হও৷ মাদরাসা, মক্তবে বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষার খেদমত করো৷ যে পরিবেশে তুমি থাকো ওই পরিবেশে মহল্লাবাসীকে দীনদার বানাও৷ এ ছাড়াও ভিবিন্নভাবে দীনের খেদমত করা সম্ভব৷ যেকোনোটাতে লেগে যেতে পারো৷ আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দিন৷

দারুল উলুমে সর্বশেষ দেখা

দেওবন্দে হযরতুল উস্তাদের সাথে সর্বশেষ দেখা ও মুলাকাত হয় ২৭ শাবান ১৪৩৯ হিজরী সে দিন হযরত লন্ডনের উদ্দেশ্যে সফরে বের হবেন৷ আগের দিন জানতে পেরে সকালে দেখা করতে যাই৷ অন্য সাথীরাও দেখা করতে যায়৷ হুযুরের বাসায় গিয়ে দেখি হুযুর দাড়িতে কলপ লাগাচ্ছেন৷ সে দিন হুযুরকে খুব খুব কাছ থেকে দেখেছি৷

হুযুর জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এসেছো? বললাম, দেখা করতে৷ হুযুর মুলাকাত করলেন৷ নসিহত হিসেবে কিছু কথা বললেন,

  1. দেশে গিয়ে ইনহিমাকের সাথে খেদমত ও মুতালাআয় লেগে যাবে৷
  2. নিম্নশ্রেণির কিতাব নিতে কখনও কুন্ঠাবোধ করবা না৷ নিচের দিক থেকে ধীরে ধীরে উপরে কিতাব নেবে৷

কথাগুলো বলতে বলতে হুযুর বিদায় দিলেন৷ চলে আসলাম৷ একদিকে একবুক আনন্দ৷ অন্যদিকে একবুক বেদনা৷ এর কয়েকদিন পর দেওবন্দ ছেড়ে চলে যাব৷ হযরতুল উস্তাদকেও আর পাবো না৷ হুযুরের মজলিস আর হবে না৷ বাসায় যেতে পারব না৷ সব মিলিয়ে একটা ভার ভার কাজ করছিল সে দিন৷

জীবনের শেষ দিনগুলো

তিনি ১৪৪১ হিজরী রজবের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ অসুস্থতা ছিল, কথা বলতে বলতে আর বলতে পারতেন না হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেত যবান৷

বুখারী শরীফের শেষ দরসেও এমন হয়েছে৷ পরে দরস শেষ করে উস্তাদে মুহতারম তার ছেলেকে নিয়ে মুম্বাই চলে যান৷ আল-হামদু লিল্লাহ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন৷ যাবানের সমস্যা দূর হয়েছিল৷ মুম্বাইতে রমজানে রাতে তারাবীহর পর বয়ান করতেন৷ আমরা নিয়মিত শুনতাম৷ প্রতিদিন রাত বাংলাদেশ টাইম ১০:৫৫ শুরু হয়ে ১২টা বা সাড়ে বারোটায় শেষ হত৷ সূরা ফাতিহার তাফসীর দিয়ে শুরু করেছিলেন৷ মুম্বাইয়ে হুযুরের মেয়ের বাসায় মজলিস হত৷ আমরা দেশ থেকে অডিও লাইভ শুনতাম৷ ১৫ রমজান পর্যন্ত নিয়মিত মজলিস হয়েছে৷ ১৬ রমজান হয়নি৷ ১৭ রমজান শুনছি হুযুর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ একটু ভালো যাচ্ছিল হঠাৎ বেড়ে গিয়ে ফুসফুসে পানি জমে গিয়েছিল৷

দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম (হাফি.) বলেন, এ সময় তাঁর ছেলের সাথে যোগাযোগ চলছিল৷ মৃত্যুর আগের রাত সন্ধার সময়ও কথা হয়৷ শেষরাতেও কথা হয়৷ ২৫ রমজান ১৪৪১ হিজরীর সকাল সাড়ে ছয়টা ফোন আসল মুফতি সাহেব আর নেই৷ এদুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন৷

তাঁর ইন্তিকালে অনেক অপূর্ণতা অনুভব হচ্ছে৷ দারুল উলুম দেওবন্দের জন্যে ইন্তিকালের দিক থেকে বিগত দুই-তিন বছর অনেক দুঃখ-কষ্টের জামানা৷ অনেক বড় বড় হাস্তিকে আমরা হারালাম৷ মাওলানা আবদুর রহিম বাস্তবী (রহ.), মাওলানা রিয়াসত আলী বিজনূরী (রহ.), শায়খে সানী মাওলানা আবদুল হক আজমী (রহ.), মাওলানা জামালুদ্দীন রাহ, মাওলানা জামিল আহমদ সিকরটভী (রহ.) ইন্তিকাল করে আল্লাহর প্রিয় হয়ে গেছেন৷ সবশেষে এখন হযরত মুফতি সাঈদ আহমদ (রহ.)ও আল্লাহ প্রিয় হয়ে গেলেন৷

যে যাওয়ার তিনি চলে যান৷ কিন্তু তার পেছনে যারা থেকে যায় তাদের কিছু জিম্মাদারি তৈরি হয়ে যায়৷ এ সূত্রে আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবেদন করা প্রয়োজন যে আমাদের মাঝে প্রথম স্তরের উস্তাদের মাঝে একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকে কখনও কখনও সেই প্রতিযোগিতায় অনুচিত কথা-বার্তাও হয়ে যায় যেগুলোকে জায়েয ও সঠিক বলা যায় না৷ যাওয়ার ব্যক্তি তো চলে গেলেন৷ আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করি, আমাদের যবান যদি তাঁর বিপক্ষে কোনো কথা বলে থাকে যেন তিনি তা ক্ষমা করে দেন এবং ওগুলোকে তার নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম বানান৷ আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব দোয়ায়ে মাগফিরাত ও ইসালে সাওয়ার করি৷ এ দোয়াও করি, আল্লাহ যেন বুজর্গদের আমানত দারুল উলুম দেওবন্দকে হেফাজত করেন৷ দারুল উলুমকে হযরত মুফতি সাহবের নিমাল বদল দান করেন৷ যাতে তালিম ও তরবিয়ের এ কাজ এভাবে চলতে থাকে৷ আমরা যারা তাঁর পেছনে থেকে গিয়েছি বয়সের দিক থেকে কয়েক বছরের ব্যবধান মাত্র৷ আমারও সত্তর বছরের অধিক বয়স হয়ে গেল, আল্লাহ যেন খাতিমা বিল খায়র করে সে কামনা করছি৷ এবং যতদিন দারুল উলুমের খেদমত নসিবে লেখা আছে ইখলাসের সাথে সঠিক পথে কাজ করার তাওফীক দান করেন৷

দাফন 

মঙ্গলবার ২৫ রমজান ১৪৪১ হিজরী = ১৯ মে ২০২০ ইংরেজি ভোর সাড়ে ছয়ডার দিকে মুম্বাইতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রফিকে আলার ডাকে লাব্বাইক বলে নশ্বর জগৎ থেকে শাশ্বত জগতে পাড়ি জমান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউ মুম্বাইতে আওশিরার মুসিলম কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়৷

হযরতুল উস্তাদ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দারুল উলুম দেওবন্দের যে পদগুলোতে ছিলেন এসবগুলো পদের জন্যে এতজন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷

  1. সদরুল মুদাররিসীন,
  2. শায়খুল হাদীস,
  3. মজলিসে শুরার সদর,
  4. তাহাফফুযে খতমে নুবুওয়াতের প্রধান ও
  5. সকল উস্তাদের আশ্রয়স্থল৷

এসবগুলো মর্যাদার অধিকারী ছিলেন তিনি৷

বিশ্বব্যাপী শোক প্রকাশ

উস্তাদে মরহুম (রহ.)-এর ইন্তিকালে বিশ্বব্যাপী বরেণ্য ওলামায়ে কেরামের শোক প্রকাশ করেছেন তার দুয়েকটা নিম্নে পদত্ত হল:

এক. শায়খুল ইসলাম মুফতি তকী ওসমানী (রহ.)

আস-সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

হযরত মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.)-এর মৃত্যুর সংবাদ শুনে খুব মর্মাহত হলাম৷ ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন৷

দীর্ঘ দিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন৷ পাশাপাশি সুস্থতার খবরও পেয়ে আসছিলাম৷ আশান্বিত ছিলাম পূর্ণ সুস্থতার৷ কিন্তু আফসোস মৃত্যু সংবাদ পেলাম! আল্লাহ তাঁকে উচ্চ স্থান দান করুন৷ সকল খেদমত কবুল করুন৷ এবং পৃথিবীর সকল মুহিব্বিন, আত্মীয় স্বজনকে ধৈর্য ধারণ করার তাওফীক দিন এবং তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন৷ অনুগ্রহ করে যদি তাঁর ছেলে কাসিম আহমদ সাহেবের নাম্বার যদি আমাকে কেউ ব্যবস্থা করে দেন৷ যাতে আমি নিজের সমবেদনা জানাতে পারি৷ অনেক কষ্ট অনুভব হচ্ছে৷ আল্লাহ তাআলা সবাইকে ধৈর্য ধারণ ও উত্তম বিনিময় দান করুন৷ আমিন৷

দুই. শায়খুল হাদীস মুফতি যার ওলী খান

দারুল উলুমের শায়খুল হাদীস মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.) ইন্তিকাল করেছেন৷ বড় মাপের আলিম ছিলেন৷ বেশ মূল্যবান কিছু কিতাবের লিখক ছিলেন তিনি৷

اللهم اغفرله وارحمه وارفع درجاته في أعلى العليين. اللهم ثقل له في ميزانه وتقبل له حسناته وأعف عنه زلاته وخطيئته وجميع سيئاته وارزقه شفاعة محمد ﷺ يوم القيامة مقبولة ومبرور.

ربنا اغفرلنا ولإخواننا الذين سبقونا بالإيمان ولا تجعل غلا للذين آمنوا ربنا إنك روؤف رحيم.

صلى الله تعالىٰ خير حافظا وهم أرحم الراحمين. الله أكبر الله أكبر ولله الحمد.

হযরতুল উস্তাদের জীবন ও রেখে ইলমি সম্পদ থেকে আমাদের সকলকে উপকৃত হওয়া তওকিক দান করুন৷ আল্লাহ তাআলা জান্নাতের সুউচ্চ মকাম নসিব করুন৷

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ