জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা ইসলামকে হেফাজত করবেন

যাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা ইসলামকে হেফাজত করবেন

আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বোখারী (দা. বা.)

[বিগত পহেলা জানুয়ারি ২০২০  অনুষ্ঠিত হয় উম্মুল মাদারিসখ্যাত উপমহাদেশের প্রাচীনতম দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর ১২০ তম বার্ষিক দীনি মাহফিল। উক্ত মাহফিলে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বোখারী (হাফিযাহুল্লাহ) দীন ও ইসলামের হেফাজতের মাধ্যম এবং মাদরাসাসমূহের গুরুত্ব বিষয়ক জরুরি বক্তব্যটির চুম্বকাংশ মাসিক আত-তাওহীদ পাঠকের সমীপে পেশ করা হলো—সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী]

 

نَحْمُدُهُ وَنُصَلِّيْ عَلَىٰ رَسُوْلِهِ الْكَرِيْمِ، أَمَّا بَعْدُ! فَأَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ: [اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ۰۰۹] {الحجر: 9} صَدَقَ اللهُ الْعَظِيْمِ، وقال المحدث الكبير الشاه ولي الله الدهلوي بالأشعار:

يُؤيِّدُ دِيْنَ اللهِ فِيْ كُلِّ دَوْرَةٍ
عَصَائِبُ تَتْلُوْ مِثْلَهَا مِنْ عَصَائِبِ
فَمِنْهُمْ رِجَالٌ يَدْفَعُوْنَ عَدُوَّهُمْ
بِسُمْرِ الْقَنَا وَالْـمُرْهَفَاتِ الْقَوَاضِبِ
وَمِنْهُمْ رِجَالٌ يَغْلِبُونَ عَدُوَّهُمْ
بِأَقْوَىٰ دَلِيْلٍ مُفْحِمٍ لِلْمُغَاضِبِ
وَمِنْهُمْ رِجَالٌ بَيَّنُوْا شَرْعَ رَبِّنَا
وَمَا كَانَ فِيْهِ مِنْ حَرَامٍ وَوَاجِبِ
وَمِنْهُمْ رِجَالٌ يَدْرُسُوْنَ كِتَابَهُ
بِتَجْوِيْدِ تَرْتِيْلِ وَحِفْظِ مَرَاتِبِ
وَمِنْهُمْ رِجَالٌ فَسَّرُوهُ بِعِلْمِهِمْ
وَهُمْ عَلَّمُوْنَا مَا بِهِ مِنْ غَرَائِبِ
وَمِنْهُمْ رِجَالٌ بِالْـحَدِيْثِ تَوَلَّعُوْا
وَمَا كَانَ فِيهِ مِنْ صَحِيْحٍ وَذَاهِبِ
وَمِنْهُمْ رِجَالٌ مُخْلِصُوْنَ لِرَبِّهِمْ
بِأَنْفُسِهِمْ خُصْبُ الْبِلادِ الْأَجَادِبِ
وَمِنْهُمْ رِجَالٌ يُهْتَدَىٰ بِعِظَاتِهِمْ
قِيَامٌ إِلَىٰ دِيْنِ مِنَ اللهِ وَاصِبِ
عَلَى اللهِ رَبِّ النَّاسِ حُسْنُ جَزَاءِهِمْ
بِمَا لَا يُوَافِيْ عَدُّهُ ذِهْنَ حَاسِبِ

সম্মানিত উপস্থিতি! আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।’[1]

যদিও কুরআন মজীদের আগেও বহু আসমানি কিতাব নাজিল করা হয়েছিল, কিন্তু তা ছিল বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। তাই আল্লাহ তাআলা সেগুলোকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করার গ্যারান্টি দেননি। সেগুলোকে হেফাজত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যেমন সূরা আল-মায়িদায় বলা হয়েছে,

اِنَّاۤ اَنْزَلْنَا التَّوْرٰىةَ فِيْهَا هُدًى وَّنُوْرٌ١ۚ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّوْنَ الَّذِيْنَ اَسْلَمُوْا لِلَّذِيْنَ هَادُوْا وَالرَّبّٰنِيُّوْنَ وَالْاَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوْا مِنْ كِتٰبِ اللّٰهِ وَكَانُوْا عَلَيْهِ شُهَدَآءَۚ ۰۰۴۴

‘আমি তওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে হিদায়েত ও আলো রয়েছে। আল্লাহর আজ্ঞাবহ পয়গম্বর, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ইহুদিদেরকে ফয়সলা দিতেন। কেননা তাদেরকে এ খোদায়ি গ্রন্থের দেখাশোনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তাঁরা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন।’[2]

কিন্তু কুরআন মজীদ সর্বশেষ আসমানি কিতাব। কিয়ামতকাল পর্যন্ত এর কার্যকারিতা বলবৎ থাকবে। তাই আল্লাহ তাআলা এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত এর ভেতর কোনো রদবদলের সম্ভাবনা নেই।

এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদকে কীভাবে সংরক্ষণ করবেন? এবং ইসলামকে কীভাবে হেফাজত করবেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন, সাত প্রকারের মানুষ দ্বারা আল্লাহ তাআলা কুরআনকে হেফাজত করবেন। তিনি এর বিবরণ একটি আরবি কবিতায় চমৎকারভাবে দিয়েছেন।

উল্লেখ্য যে, ভারত উপমহাদেরশের সরকারি-বেসরকারি সকল ঘরানার আলেম-ওলামার, সকল মুহাদ্দিসের সনদ বা সূত্র পরম্পরা ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) পর্যন্ত পৌঁছতে হয়। তিনি ১১১৪ হিজরীর ১৪ শাওয়াল বুধবার দিল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১১৭৬ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। দিল্লির মাদরাসায়ে রাহীমিয়ার পাশে এবং মাওলানা আজাদ মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়। মূলত ভারত উপমহাদেশে হাদীসের চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) আরব বিশ্বে ভ্রমন করেন এবং শায়খ আবু তাহের মাদানী (রহ.)-এর কাছ থেকে ইলমে হাদীসের জ্ঞান অর্জন করেন। সিহাহ সিত্তা তথা বিশুদ্ধ হাদীসের ছয়টি কিতাবের জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর পুনরায় ভারত উপমহাদেশে ফিরে আসেন এবং হাদীসের পাঠদান আরম্ভ করেন। তাই তার মাধ্যমেই এ উপমহাদেশে হাদীস চর্চা পুনরায় আরম্ভ হয়। তিনিই দীনী মাদরাসাসমূহের গুরুত্ব ও অবদান উল্লেখ করে বলেন, এসব মাদরাসা থেকে সাত ধরনের লোক তৈরি হয়, যাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দীনের হিফাজতের কাজ করবেন।

يُؤيِّدُ دِيْنَ اللهِ فِيْ كُلِّ دَوْرَةٍ
عَصَائِبُ تَتْلُوْ مِثْلَهَا مِنْ عَصَائِبِ

প্রত্যেক যুগে আল্লাহর দীনকে আল্লাহ সাহায্য করবেন। আর দীনের সাহায্যের জন্য কিছু লোককে নির্বাচন করবেন। তারা মারা গেলে তাদের কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়ার জন্য আরও কিছু লোক আল্লাহ পাক সৃষ্টি করবেন। এভাবে সাতটি দলের মাধ্যমে আল্লাহ পাক ইসলামের হেফাজত করবেন। সাত দলের সাত কাজ। এই সাত দল যদি পৃথিবী থেকে চলে যায়, তাহলে আল্লাহ পাক অন্য সাত দল সৃষ্টি করবেন। এই দলগুলোকে স্মরণ রাখতে হবে।

ইসলামের হেফাজতকারী প্রথম দল হচ্ছে মুজাহিদীনের দল:

فَمِنْهُمْ رِجَالٌ يَدْفَعُوْنَ عَدُوَّهُمْ
بِسُمْرِ الْقَنَا وَالْـمُرْهَفَاتِ الْقَوَاضِبِ

যে দলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দীনের হেফাজত করবেন তাদের মধ্যে প্রথম দল হচ্ছে মুজাহিদীনের দল। তারা অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে, তলোয়ার-তরবারি নিয়ে বাতিলের মোকাবেলা করবেন, জিহাদ করবেন। জিহাদ একটি ফরজ বিধান। জিহাদকে অস্বীকার করলে ঈমান চলে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমানে জিহাদের অর্থ করা হয় জঙ্গিবাদ। আমি বলি, জিহাদ যদি জঙ্গিবাদ হয়, তাহলে জঙ্গিবাদকে কী বলা হবে?! আশ্চর্য! যারা বর্তমানে সারা বিশ্বে সন্ত্রাস চালাচ্ছে তারা জঙ্গিবাদী নয়, কিন্তু যারা কুরআন-হাদীস পড়ান তাদেরকে বলা হয় জঙ্গিবাদী।

আমেরিকান মহিলা সাংবাদিকের জামিয়া পটিয়া পরিদর্শন

বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা হলো ‘প্রথম আলো’। আমি এর নাম দিয়েছি, ‘প্রথম অন্ধকার’। কারণ সে পত্রিকা মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে অন্ধকার ছড়ায়। কিছুদিন পূর্বে সেখানে কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা হয় যে, পটিয়া-হাটহাজারীসহ কওমি মাদরাসায় জঙ্গিবাদী আছে। এমন সব মিথ্যা ও বনোয়াট সংবাদ প্রচার করা হয়। এর কিছুদিন পর আমেরিকা থেকে একটি প্রতিনিধিদল আমার কাছে আসে। আমি তখন দারুল হাদীস থেকে রুমে ফিরছিলাম।একজন ছাত্র এসে বলেন, হুজুর, আপনার রুমের সামনে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আমি রুমে আসলাম। দেখলাম, ওই আমেরিকান মহিলা বাংলাও বলতে পারেন। তিনি বলেন, আই এম ডকলাস। আমি তার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলাম। কারণ রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত হলো, মেহমানকে আপ্যায়ন করা। তিনি বিধর্মীদেরকেও আপ্যায়ন করেছেন। তাই আমিও তার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলাম। তিনি আমাকে বলেন, এখানে কি কোনো তালেবান আছে? আমি বললাম, এখানে ৫ হাজার তালেবান আছে! তিনি খুবই বিচলিত হলেন। তখন আমি বললাম, এখানে আফগানের কোনো তালেবান নেই। তালেবান মানে ছাত্র। ‘তালিবুন’ এক বচন। আর ‘তালেবান’ হলো বহুবচন। অর্থ হলো, ছাত্র।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তাদেরকে কী পড়ানো হয়? আমি বললাম, তাদেরকে তো অনেক কিতাব পড়ানো হয়। তবে এক নম্বরে ‘আল-কায়েদা’ পড়ানো হয়। তখন তিনি হতবাক হয়ে যান। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আল-কায়েদা’য় কী আছে? আমি বললাম, সেখানে ‘হরকত’ পড়ানো হয়। এরপর তিনি বলেন, এখানে কি ট্রেনিং হয়? আমি বললাম, হ্যাঁ, এখানে ট্রেনিং হয়। এখানে যারা শিক্ষকমণ্ডলী আছেন, তারা সকলেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তিনি বলেন, তারা কীসের ট্রেনিং নেন? তখন আমি বললাম, অনেক কিছুরই তো ট্রেনিং নেন। তবে সর্বপ্রথম লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহর ট্রেনিং নেন। মানুষকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে, পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এক নম্বর ট্রেনিংয়ের নাম হলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। তখন তিনি ‘পরে আবার আসবো’ বলে চলে যান।

অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, জিহাদকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বানানো হয়েছে। অথচ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে বন্ধ করার জন্যই জিহাদ করতে হয়। আল্লাহ পাক বলেন,

وَقَاتِلُوْهُمْ حَتّٰى لَا تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَّيَكُوْنَ الدِّيْنُ كُلُّهٗ لِلّٰهِ١ۚ فَاِنِ انْتَهَوْا فَاِنَّ اللّٰهَ بِمَا يَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ۰۰۳۹

‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ফিতনা শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ লক্ষ করেন।’[3]

ইসলামে জিহাদের সূচনা হয় মুসলমানরা মদীনায় হিজরত করার পর। মক্কার কাফিররা যখন মুসলমানদের ওপর হামলা করার জন্য মদীনায় এসে আক্রমণ করেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে জিহাদ করার অনুমতি প্রদান করেন। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ‘বদর যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়। মূলত এটি ছিলো, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ। ইসলামের দ্বিতীয় যুদ্ধ হলো, উহুদ যুদ্ধ। অতঃপর খন্দক যুদ্ধ ও আহযাব যুদ্ধ সংঘটিত হলো। এসব যুদ্ধ মদীনায় সংঘটিত হয়েছে। কাফিররা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করার জন্য এসেছে। মুসলমানরা তাদের ‍বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ‍তুলেছেন।

অতঃপর যখন দেখা গেলো যে, মক্কার কেন্দ্র থেকে এসে ইসলামকে নির্মূল করার জন্য বারবার চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন আল্লাহ পাক নির্দেশ দিলেন, তোমরা এখন গিয়ে মক্কা দখল করো। তাই রসুলুল্লাহ (সা.) মক্কায় অভিযান পরিচালনা করে বিজয় লাভ করেন।

এজন্য বলা হয়েছে যে, ইসলামের হিফাজতের জন্য যে দলগুলো কাজ করবে, এর মধ্যে অন্যতম হলো মুজাহিদীনের দল; যারা নিজেদের জান-মাল বিসর্জন দিয়ে ইসলামের হেফাজতের দায়িত্ব পালন করবেন।

ইসলামের হেফাজতকারী দ্বিতীয় দল হচ্ছে তার্কিক-মুনাযিরের দল:

وَمِنْهُمْ رِجَالٌ يَغْلِبُونَ عَدُوَّهُمْ
بِأَقْوَىٰ دَلِيْلٍ مُفْحِمٍ لِلْمُغَاضِبِ

যে দলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দীনের হেফাজত করবেন এর মধ্যে দ্বিতীয় দল হচ্ছে, মুনাযির-তার্কিকের দল। যারা ইসলামের পক্ষে বাতিলের সাথে মুনাযারা করবে এবং যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তাদেরকে পরাস্ত করবে। অনেক বাতিল ফেরকা আছে। সবগুলোর শিকড় হলো ইহুদিদের সাথে। যেমন- কাদিয়ানি একটি বড় বাতিল ফেরকা। ৫০টি রাষ্ট্রের রেডিও থেকে তাদের প্রচারণা চালানো হয়। তাদের মূলে আছে ইহুদি। আহলে হাদীস একটি বাতিল ফেরকা। তাদের গোড়াতে আছে শিয়া। আর শিয়াদের গোড়ায় আছে ইহুদি। এগুলো কিতাবে লেখা আছে। আহলে হাদীসরা হাদীসের নাম দিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। তাই, এসব বাতিলদের মোকাবেলা করার জন্য একদল লোক সবসময় তৈরি থাকতে হবে।

তারাবীহ নামাজের রাকআত

সংখ্যা নিয়ে বির্তক

আহলে হাদীসরা বলেন, তারাবীহ ২০ রাকআত পড়তে হবে না, আট রাকআত পড়লেই যথেষ্ট হবে। কারণ রসুলুল্লাহ (সা.) বিতরসহ ১১ রাকআতের চেয়ে বেশি পড়তেন না। যেমন বুখারী শরীফে এসেছে, হজরত আবু সালমা ইবনে আবদুর রহমান কর্তৃক বর্ণিত, তিনি হজরত আয়িশা (রাযি.)-এর দূরসম্পর্কীয় ভাগিনেয় হন। তিনি প্রায়শ মাসআলা হজরত আয়িশা (রাযি.)-এর নিকট জেনে নিতেন। তিনি একদিন হজরত আয়িশা (রাযি.)-কে বলেন, রসুল (সা.)-এর রমজানের রাতে কিভাবে নামাজ পড়তেন?

عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ، أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ i: كَيْفَ كَانَتْ صَلَاةُ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ فِيْ رَمَضَانَ؟

তার উত্তরে হজরত আয়িশা (রাযি.) বলেন, তিনি রমজান ও রমজান ছাড়া অন্যমাসেও ১১ রাকআত নামাজ পড়তেন। আট রাকআত নফল, তিন রাকআত ১১।

فَقَالَتْ: مَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يَزِيْدُ فِيْ رَمَضَانَ وَلَا فِيْ غَيْرِهِ عَلَىٰ إِحْدَىٰ عَشْرَةَ رَكْعَةً.

এখন একটু চিন্তা করুন, যে নামাজটি রমজান মাসসহ অন্য মাসেও পড়ে, তা কি তারাবীহ, না তাহাজ্জুদ?  অবশ্যই এটি তাহাজ্জুদের নামাজ। অতঃপর তিনি বলেন,

يُصَلِّيْ أَرْبَعًا، فَلَا تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُوْلِـهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّيْ أَرْبَعًا، فَلَا تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُوْلِـهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّيْ ثَلَاثًا.

চার রাকআত খুবই চমৎকার ও লম্বা করে পড়তেন। অতঃপর আরও চার রাকআত খুবই সুন্দর ও লম্বা করে পড়তেন। অতঃপর তিন রাকআত বিতরের নামাজ পড়তেন। এখন একটু ভেবে দেখুন তো, চার রাকআত কি তারাবীহর নামাজ হয়, না তাহাজ্জুদের নামাজ।

قَالَتْ عَائِشَةُ: فَقُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَتَنَامُ قَبْلَ أَنْ تُوتِرَ؟ فَقَالَ: يَا عَائِشَةُ، إِنَّ عَيْنَيَّ تَنَامَانِ وَلَا يَنَامُ قَلْبِيْ».

অতঃপর তিনি বলেন, আমি রসুল (সা.)-কে বললাম, হে আল্লাহর রসুল, আপনি বিতর না পড়ে ঘুমাচ্ছেন? (অথচ বিতর তো ওয়াজিব) তখন তিনি বলেন, আমার চক্ষু ঘুমায়, অন্তর ঘুমায় না।[4]

লক্ষ করুন, ঘুমের পরে যে নামাজ হয়, তা কি তারাবীহ নামাজ? না, কখনো না, এটি তো তাহাজ্জুদের নামাজই। সুতরাং তাহাজ্জুদের হাদীস দ্বারা তারাবীহ নামাজের দলিল দেওয়া মানুষকে বিভ্রান্ত করা, বৈ কিছু নয়।

তারাবীহ 20 রাকআত; ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্য

হজরত ওমর (রাযি.)-এর খিলাফতকালে সাহাবায়ে কেরামের একটি অধিবেশন করে সর্ব সম্মতিক্রমে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় যে, যেহেতু তারাবীহ নামাজ রসুল (সা.) ২০ রাকআত পড়েছেন, তাই তারবীহ নামাজ ২০ রাকআত পড়াই সুন্নত। তৎকালীন সময়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারী ছিলেন হজরত উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.)। হজরত ওমর (রাযি.) তাঁকে ডেকে বলেন, আপনি সাহাবায়ে কেরামদেরকে নিয়ে প্রত্যেকে দিন ২০ রাকআত তারাবীহ নামাজ আদায় করবেন। এই বিষয়ে সমস্ত সাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্য সংঘটিত হয়।[5]

رُوِيَ أَنَّ عُمَرَ h جَمَعَ أَصْحَابَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ فِيْ شَهْرِ رَمَضَانَ عَلَىٰ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ فَصَلَّىٰ بِهِمْ فِيْ كُلِّ لَيْلَةٍ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَلَـمْ يُنْكِرْ أَحَدٌ عَلَيْهِ فَيَكُوْنُ إجْمَاعًا مِنْهُمْ عَلَىٰ ذَلِكَ.

এটি হজরত ওমর (রাযি.) নিজের পক্ষ থেকে উদ্ভাবন করেননি, বরং রসুলের যুগ থেকে চলে আসছে। মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বা একটি হাদীসের কিতাব। সেখানে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে তিনি বলেন,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، «أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ كَانَ يُصَلِّيْ فِيْ رَمَضَانَ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً وَالْوِتْرَ».

‘রমজান মাসে রসুল (সা.) ২০ রাকআত তারাবীহ পড়তেন এবং বিতর পড়তেন।’[6]

আট রাকআতের পক্ষে যদি দলিল তালাশ করা হয় তখন তারা বলেন, বুখারী শরীফে আছে। আমি বুখারী শরীফ পাঠদানকালে লক্ষ করলাম, যে হাদীস দিয়ে তারা তারাবীহ ৮ রাকআত প্রমাণ করতে চান সেই হাদীসটি ইমাম বুখারী (রহ.) তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে এনেছেন। অর্থাৎ আট রাকআতের সেই হাদীস তারাবীহ নামাজের হাদীস নয়, এটি তাহাজ্জুদের হাদীস।

একটি রসাত্মক গল্প

একজন লোক অজু করছেন, মুখে পানি দিচ্ছেন। মুখে পানি দেওয়ার সময়  দুআ পড়ছেন, «اللّٰهُمَ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْـخُبُثِ وَالْـخَبَائِثِ» এটি তো পায়খানার দুআ!  তা এখানে?!  তখন অন্য এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করেন, ভাই, আপনি এ দুআ কোথায় পেয়েছেন? তখন সে বলল, হাদীসে আছে তো! তখন ওই ব্যক্তি তাকে বলল, ভাই হাদীসে আছে ঠিক, তবে আপনি ছিদ্র ভুলে গেছেন। এটা নিচের ছিদ্রের দুআ ছিল, উপরের ছিদ্রের দুআ নয়! …আট রাকআত হাদীসে আছে ঠিক, তবে এটি তাহাজ্জুদের ছিদ্রের হাদীস এটা তারাবীহর ছিদ্রের হাদীস নয়। তার কারণ হাদীস পাঠ করলেই স্পষ্ট বুঝা যায়।

তৃতীয় দল হচ্ছে, বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদানকারী কারীদের দল:

وَمِنْهُمْ رِجَالٌ يَدْرُسُوْنَ كِتَابَهُ
بِتَجْوِيْدِ تَرْتِيْلِ وَحِفْظِ مَرَاتِبِ

যে দলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দীনের হেফাজত করবেন তার মধ্যে তৃতীয় দল হচ্ছে, বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদানকারী কারী সাহেবানদের দল। যারা কুরআন শরীফ শিক্ষা দান করেন। বাংলাদেশের জনসংখ্যায় প্রায় ১৬ কোটি মুসলমান রয়েছে। সকল মুসলমানরা সব নামাজ না পড়লেও জুমার নামাজ ও ঈদের নামাজ তো অন্তত পড়ে থাকেন। সেখানে কুরআনের প্রয়োজন রয়েছে। তাদেরকে যে কুরআন শিক্ষা দিয়ে নামাজ পড়ার উপযুক্ত করেছেন, এটি নিঃসন্দেহে আলেম-ওলামার অবদান। কুরআন মজীদের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত যদি না হয়, তাহলে নামাজ পড়া সম্ভব হবে না। তেমনি বিপদে-আপদে কুরআন তিলাওয়াত আমাদের পার্থিব অনেক উপকারে আসে। তাই কুরআনের পাঠদানের মাধ্যমে একদল দীনের হেফাজতের যিম্মাদারি আদায় করবেন।

চতুর্থ দল হচ্ছে শরয়ী সমাধান প্রদানকারী মুফতীদের দল:

وَمِنْهُمْ رِجَالٌ بَيَّنُوْا شَرْعَ رَبِّنَا
وَمَا كَانَ فِيْهِ مِنْ حَرَامٍ وَوَاجِبِ

যে দলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দীনের হেফাজত করবেন এর মধ্যে চতুর্থ দল হচ্ছে মুফতী সাহেবের দল। প্রত্যেকটি মাসআলা হলো একেকটি ফতওয়া। দুই রাকআত নামাজে তো ৬০টি মাসআলা রয়েছে। অর্থাৎ ৬০টি ফতওয়া আছে। এ ফতওয়া কার কাছ থেকে জানবেন? বড় বড় মাদরাসায় দারুল ইফতা আছে। ফতওয়া শেখানোর জন্য বিভাগ খোলা হয়েছে। সেখান থেকে মুফতী তৈরি হয়। হালাল-হারাম বিষয়ে ফতওয়া পাওয়া যায়। এখন অনলাইনেও ফতওয়া দেওয়া হয়। অনলাইন-অফলাইন সর্বক্ষেত্রে মানব জীবনের শরয়ী সামাধানগুলো মুফতী সাহেবানরা প্রদান করে থাকেন। এজন্য ফিকহ ও ফতওয়ার কাজ করার জন্য এক দল মানুষের প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে মুফতীর ব্যবস্থা করবেন। তারা ফতওয়ার দায়িত্ব পালন করে যাবেন। কেউ ফতওয়া বন্ধ করতে চাইলেও আল্লাহ যদি না চান, তাহলে কখনো ফতওয়া বন্ধ করা সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে একজন বিচারক ফতওয়া নিষিদ্ধ করলেন। আলেম-ওলামারা সংগ্রাম করলেন। মুফতী সাহেবনারা সরকারের সাথে আলোচনা করলেন। আদালতে গিয়ে কথা বললেন। শেষপর্যন্ত সরকার বাধ্য হয়েছে যে, সেই ফতওয়া নিষিদ্ধের আইন বাতিল করতে। ফতওয়া নিষিদ্ধ করার কোনো সুযোগ বান্দার নেই। কারণ এক নম্বর মুফতী হলেন, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।

قُلِ اللّٰهُ يُفْتِيْكُمْ فِي الْكَلٰلَةِؕ ۰۰۱۷۶[7]

অতঃপর দুই নম্বর মুফতী হলেন, রসুলুল্লাহ (সা.)। অতঃপর উম্মতের অন্যান্য মুফতীগণ ফতওয়ার মাধ্যমে দীনের হেফাজত করেন।

স্কুলের হেড মাস্টারের আজব ফতওয়া!

মূলত ফতওয়া একটি জটিল কাজ। হজরত থানভী (রহ.) বলেন, আমার কাছে যে কোনো প্রশ্ন করতে পারো। তবে যদি কোনো বিষয়ে ফতওয়া জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন আমার ভয় লাগে। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় হলো, এখন কিছু মানুষ ফতওয়া দিতে ভয় করে না। ফতওয়াকে একটি মামুলি বিষয় মনে করে।

আমি যখন টাঙ্গাইলে ছিলাম, তখন এক হেড মাস্টার বলল, ফতওয়া তো আমিও দিতে পারি। আমি তাকে বললাম, আপনি কীভাবে ফতওয়া দেবেন? আপনি কি আলেম? তখন তিনি বলেন, না, আমি কোনো আলেম না। তবে আপনারা যে সমাধান দিতে পরেন না, আমি তারও সমাধান দিতে সক্ষম হয়েছি।

আমি বললাম, বিষয়টি একটু বিস্তারিত বলেন। তখন তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব তার স্ত্রীকে মা বলে সম্বোধন করেছেন। এখন আলেমরা কেউ ফতওয়া দিয়ে স্ত্রীকে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেননি। কিন্তু আমি স্ত্রী রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

আমি বললাম, তা কীভাবে? তখন তিনি বলেন, আমি উভয়জনকে উপস্থিত করলাম। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে তোমাকে কী বলেছে? তখন স্ত্রী বলল, সে আমাকে ‘মা’ বলেছে। তখন আমি বললাম, তাহলে তুমিও তাকে ‘আব্বু’ বলো। তখন স্ত্রী আমার সামনে স্বামীকে ‘আব্বু’ বলল। অতঃপর আমি বললাম, ঠিক আছে। এখন শোধ হয়ে গেলো। এখন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে আর কোনো অসুবিধা নেই। ‘লা হাওয়া ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহ’, এটি কি ফতওয়া হতে পারে? ….ফতওয়ার জন্য মুফতী হতে হবে। মুফতী সাহেবগণ গবেষণা করে ফতওয়া প্রদানের মাধ্যমে দীনের হেফাজতের দায়িত্ব পালন করেন।

চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দরী না

হলে তোমাকে তিন তালাক

খলীফা হারুনুর রশীদের এক মন্ত্রী ছিলেন। তিনি এক সুন্দরী রমণীকে বিবাহ করেন। একদা তিনি তার সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে বসে চা পান করছেন। হঠাৎ স্ত্রীকে সম্ভোধন করে বলেন, ‍তুমি তো আকাশের চন্দ্র থেকে বেশি সুন্দরী। তখন স্ত্রী বলেন, আমি সুন্দরী হতে পারি, কিন্তু আকাশের চন্দ্র থেকে বেশি সুন্দরী হতে পারি না। তখন তার খুব রাগ হলো। তিনি রাগের বশিভূত হয়ে বলেন, তুমি যদি আকাশের চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দরী না হও, তাহলে তোমাকে তিন তালাক। তখন স্ত্রী মনে করলো, আমি তো আর আকাশের চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দরী নয়। সুতরাং তালাক হয়ে গেছে। তাই সে তার কাছ থেকে পৃথক হয়ে গেলো। তখন মন্ত্রী খুব টেনশনে পড়ে গেলেন। সকালবেলা খলীফা হারুনুর রশীদ মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক আহবান করেন। সেখানে ওই মন্ত্রীও উপস্থিত হন। কিন্তু তিনি কোনো কথা-বার্তা বলছেন না। তখন খলীফা তার পেরেশানির কথা জিজ্ঞাসা করেন। তখন তিনি বলেন, গতরাতে আমি আমার স্ত্রীকে এমন বলেছি। তাতে আমার স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে। তখন খলীফা সকল মন্ত্রীকে কাছে ডেকে এ ব্যাপারে ফতওয়া চাইলেন। তালাক হয়েছে, না হয়নি? তারা বলেন, তালাক হয়ে গেছে। কারণ স্ত্রী তো আর চন্দ্র থেকে অধিক সুন্দরী হতে পারে না। খলীফা নামাজ-কালাম পড়ানোর জন্য একজন আলেম রাখতেন। সে সময় খলীফার কাছে ছিলেন, মাওলানা ঈসা। তিনি ছিলেন, ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর শাগরেদ। খলীফা এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার জন্য মাওলানা ঈসাকে ডাকলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করেলেন, এই মন্ত্রীর স্ত্রীর কি তালাক হয়েছে? তখন মাওলানা ঈসা বলেন, তালাক হয়নি। মন্ত্রীরা বলেন, তালাক হয়েছে। মাওলানা ঈসা বলেন, তালাক হয়নি। তাই মন্ত্রীরা খুবই ক্ষুদ্ধ হলেন। তারা বলেন, তালাক কেন হবে না? এটি আমাদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে। তার স্ত্রী কি চন্দ্র থেকেও অধিক সুন্দরী? মাওলানা ঈসা বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, তার স্ত্রী চন্দ্র থেকেও বেশি সুন্দরী। প্রমাণ কী? তখন তিনি বলেন,

لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ فِيْۤ اَحْسَنِ تَقْوِيْمٍٞ۰۰۴[8]

আল্লাহ বলেন, আমি মানুষকে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী বানিয়েছি। চন্দ্র থেকে সুন্দর। সূর্য থেকেও সুন্দর। সমস্ত মখলুক থেকে সুন্দর। সুতরাং তালাক পতিত হয়নি। তখন মন্ত্রীরা তাওবা করলেন, জীবনে আর কোনো দিন ফতওয়া দেবেন না। মন্ত্রীর কাজ কি ফতওয় দেওয়া? (উপস্থিত জনতা, না…)। আমাদের দেশের অনেক মন্ত্রীরা তো এমনও বলে থাকেন যে, রসুল (সা.) হাদীস শরীফে বলেছেন, لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِؒ۰۰۶।’[9] আশ্চর্য, কুরআন শরীফের আয়াতকে তারা হাদীস বলে থাকেন। এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। তাহলে তারা কীভাবে ফতওয়া দেবেন?

পঞ্চম দল হচ্ছে মুহাদ্দিসীনের দল:

وَمِنْهُمْ رِجَالٌ بِالْـحَدِيْثِ تَوَلَّعُوْا
وَمَا كَانَ فِيهِ مِنْ صَحِيْحٍ وَذَاهِبِ

যে দলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দীনের হেফাজত করবেন তম্মধ্যে পঞ্চম হলো, মুহাদ্দিসীনের দল। যাঁরা বুখারী শরীফ পড়ান, মুসলিম শরীফ পড়ান, সিহাহ সিত্তা পড়ান। হজরত সুফিয়ান সওরী (রহ.) বলেন, হাদীস এমন জিনিস, যা ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর থেকে নিয়ে আবারো ঘুমানো পর্যন্ত; মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে হাদীসের প্রয়োজন হয়। আমি মসজিদে প্রবেশ করছি, হাদীসে এ সম্পর্কে কী বলে? হাদীস বলে মসজিদে প্রবেশ করার সময়, «اللّٰهُمَ افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ» বলবে। আমি পায়খানায় প্রবেশ করছি, এ সম্পর্কে হাদীস কী বলে? হাদীস বলে, «اللّٰهُمَ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْـخُبُثِ وَالْـخَبَائِثِ» বলবে। এভাবে ঘুমানো পর্যন্ত হাদীসের প্রয়োজন হয়।

জিন সাহাবীর হাদীসের মাধ্যমে

শাহ আহলুল্লাহ (রহ.)-এর মুক্তি

হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-এর এক ভাই ছিলেন, শাহ আহলুল্লাহ (রহ.)। অনেক বড় বুর্যগ ছিলেন। মসজিদে থাকতেন। সেখানে বসে কিতাব দেখতেন আর কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন। হঠাৎ একদিন দেখলেন, একটি ছোট্ট সাপের বাচ্ছা তার সামনে আসা-যাওয়া করছে। তখন একটি চাকু দিয়ে সেই সাপের বাচ্চাকে দিখণ্ডিত করে দিলেন। যেন ডিস্টার্ব না করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখেন ওই সাপের বাচ্ছা আর বেঁচে নেই। মূলত সেটি সাপ ছিলো না, বরং জিন ছিলো। জিনরা এমনটি করে থাকে। কিছুক্ষণ পর একজন লোক এসে বলে, হুজুর! আপনাকে বাদশাহ সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি মনে করেছেন, হয়ত দিল্লির বাদশাহ ডেকেছেন। সেখান থেকে অল্প দূরেই দিল্লির বাদশাহ অবস্থান করছেন। তিনি হয়ত এখানে এসেছেন, তাই আমাকে ডেকেছেন। তাই তার পিছনে পিছনে গেলেন। কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেলেন, মাটির ভিতরে একটি রাস্তা দিয়ে চলছেন। আরও কিছুক্ষণ চলার পর দেখলেন, বিশাল এক দেশ। জিনদের দেশ। সেখানে একটি মঞ্চ সাজানো আছে। সেখানে বাদশাহ বসে আছেন। শাহ আহলুল্লাহ (রহ.)-কে সেই মঞ্চে বসালেন। বাদশাহর নিকট বিভিন্ন মামলা পেশ হচ্ছে। সর্ব শেষ একটি লাশ পেশ করা হলো। তারা দাবি করলো, শাহ আহলুল্লাহ (রহ.) আমাদের এ ভাইকে হত্যা করেছেন। শাহ আহলুল্লাহ (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, তিনি হত্যা করেছেন কি না? তিনি বলেন, না। আমি তাকে হত্যা করিনি। তখন তারা বলল, তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কোনো সাপকে হত্যা করেছেন কি না? তিনি বলেন, হ্যাঁ। একটি সাপ আমার সামনে আসা-যাওয়া করছিলো। আমি তা হত্যা করি। তখন তারা বলল, সেই সাপ হলো এই লাশ। অতঃপর বাদশাহ জল্লাদকে হুকুম দিলেন, যেন তাকে হত্যা করা হয়। এমন সময় একজন পাগড়ী পরিহিত লোক বাদশাহর পেছনে বসা ছিলেন। তিনি ছিলেন সাহাবী জিন। জিনদের বয়স বেশি হয়ে থাকে। জিন সাহাবী জীবিত ছিলেন। তিনি বলেন, এখন হত্যা করবেন না। আমি একটি হাদীস শুনাচ্ছি। এরপর আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

«مَنْ قُتِلَ فِيْ غَيْرِ زِيِّهِ فَدَمُهُ هَدَرٌ».

‘কোনো জিন যদি তার আসল রূপ ছাড়া ভিন্ন কোনো রূপে নিহত হন, তাহলে তার রক্তপণ নেওয়া যাবে না।’

এই সাপটি তো তার আসল রূপে নিহত হয়নি, তাহলে তার কিসাস-রক্তপণ নেওয়া যাবে না। তখন বাদশাহ শাহ আহলুল্লাহ (রহ.)-কে বেকসুর খালাস দিলেন এবং ইজ্জতের সাথে বিদায় দিলেন। শাহ আহলুল্লাহ (রহ.) বিদায় নেওয়ার সময় ওই সাহাবী জিনের সাথে মুসাফাহা করলেন। যেন তিনি তাবেয়ী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ফিরে এসে ঘটনাটি পরিবারের লোকদেরকে জনালেন। তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) জীবিত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর সন্তান শাহ আবদুল আজীজ (রহ.) জীবিত ছিলেন। তিনি এসে হজরত শাহ আহলুল্লাহ (রহ.)-এর সাথে মুসাফাহা করলেন, যেন তিনি তবে-তাবিয়ী হয়ে যান।

অতএব আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হাদীসের প্রয়োজন রয়েছে। তাই যুগে যুগে মুহাদ্দিসীনের মাধ্যমে আল্লাহ এ দীনের হেফাজতের কাজ নিবেন।

ষষ্ঠ দল হচ্ছে হক্কানী পীর-মুরশিদ:

وَمِنْهُمْ رِجَالٌ مُخْلِصُوْنَ لِرَبِّهِمْ
بِأَنْفُسِهِمْ خُصْبُ الْبِلادِ الْأَجَادِبِ

যে দলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দীনের হেফাজত করবেন তম্মধ্যে ষষ্ঠ দল হচ্ছে, হক্কানী পীর-মুরশিদ। আমাদের এই উপমহাদেশে হক্কানী পীর-মুরশিদগণ মেহনত করে দীনের প্রচার-প্রসার করেছেন। হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর হাতে 70 হাজার হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং এখানে তাঁর মুরীদ ছিলো প্রায় ৭ লাখ। এমন হক্কানী পীর-মুরশিদগণের তাওয়াজ্জুহ এবং দুআর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ দীন ধর্ম পেয়েছেন।

সপ্তম দল হচ্ছে, ওয়ায়েজ-বক্তা এবং দায়ীদের দল:

وَمِنْهُمْ رِجَالٌ يُهْتَدَىٰ بِعِظَاتِهِمْ
قِيَامٌ إِلَىٰ دِيْنِ مِنَ اللهِ وَاصِبِ

যে দলগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দীনের হেফাজত করবেন এর মধ্যে সপ্তম দল হচ্ছে, ওয়ায়েজ-বক্তা এবং দায়ীদের দল। যাঁরা বিরামহীন ওয়াজ ও নসীহতের মাধ্যমে মানুষকে দীনের পথে, ইসলামের পথে আহবান করেন। যাঁরা দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে মানুষকে হিদায়েতের পথে ডেকে থাকেন। ওয়াজ-নসিহতের এ ধারা রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তবে-তাবেয়ীনের যুগ অতিক্রম করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত আলেমদের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে। যদিও যুগ, স্বভাব ও পরিবেশের পরিবর্তনে এতে ব্যবস্থাপনাগত কিছু বৈচিত্র্য এসেছে। তবে বর্তমান পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে এবং থাকা অপরিহার্যও বটে।

এখন আমি আপনাদেরকে জিজ্ঞাসা করি, এই সাত প্রকারের লোক কোন প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়? মাদরাসা থেকে, না স্কুল-কলেজ থেকে? (উপস্থিত জনতা, মাদরাসা থেকে)। তাহলে এই সমস্ত মাদরাসার প্রয়োজন আছে? (উপস্থিত জনতা, আছে)। সেই মাদরাসাসমূহের প্রধান হলো, উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী। আল্লাহ পাক এ প্রতিষ্ঠানকে কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত রাখুন, আমীন।

সংকলন: সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি

লেখক-গবেষক ও শিক্ষক

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম

[1] আল-কুরআন, সূরা আলহিজর, ১৫:৯

[2] আল-কুরআন, সূরা আল-মায়িদা, ৫:৪৪

[3] আল-কুরআন, সূরা আল-আনফাল, ৮:৩৯

[4] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. 2, পৃ. 5৩, হাদীস: ১১47

[5] আল-কাসানী, বাদায়িউস সানায়ি ফী তারতীবিশ শারায়ি, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪০৬ হি. = ১৯৮৬ খ্রি.), বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ২৮৮

[6] ইবনে আবু শায়বা, আল-মুসান্নাফ ফিল আহাদীস ওয়াল আসার, মাকতাবাতুর রাশাদ লিন-নাশর ওয়াত তাওযী’, রিয়াদ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৯ হি. = ১৯৮৯ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১৬4, হাদীস: ৭৬92

[7] আল-কুরআন, সূরা আন-নিসা, ৪:১৭৬

[8] আল-কুরআন, সূরা আত-তীন, ৯৫:৪

[9] আল-কুরআন, সূরা আল-কাফিরূন, ১০৯:৬

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ