আবিদুর রহমান তালুকদার
উল্লিখিত শিরোনামটি একটি হাদীসের অংশবিশেষ। যা শামের ভৌগোলিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য নিরুপণ করে। হাদীসটি নিম্নরূপ:
«رَأَيْتُ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِيْ عَمُوْدًا أَبْيَضَ كَأَنَّهُ لُؤْلُؤَةٌ تَحْمِلُهُ الْـمَلَائِكَةُ قُلْتُ: مَا تَحْمِلُوْنَ؟ قَالَ: عَمُوْدُ الْإِسْلَامِ أَمَرَنَا أَنَ نَضَعَهُ بِالشَّامِ».
‘মিরাজের রাতে আমি মুক্তোর ন্যায় স্বেত-শুভ্র কিছু খুঁটি দেখতে পেলাম। যা ফেরেশতারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাঁদেরকে প্রশ্ন করলাম, আপনারা কী নিয়ে যাচ্ছেন? তারা জবাব দিলেন, ইসলামের খুঁটি। আমাদেরকে এটি শামে স্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’[1]
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন,
«أَلَا وَإِنَّ الْإِيْمَانَ حِيْنَ تَقَعُ الْفِتَنُ بِالشَّامِ».
‘জেনে রেখো, ফিতনার যুগে ঈমান থকেবে শামে।’
ইমাম হায়সামী (মৃ. ৮০৭ হি.) বলেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ও ইমাম তাবরানী (রহ.)[2] হাদীসটি বর্ণনা করেন। তবে ইমাম আহমদের রেওয়ায়েতে যেসব বর্ণনাকারী রয়েছেন, তারা সকলেই সহীহ হাদীসের রাবী।[3]
ইমাম তাবরানী (রহ.) বর্ণনা করেন,
«رَأَيْتُ فِي الْـمَنَامِ أَنَّهُمْ أَخَذُوْا عَمُوْدَ الْكِتَابِ فَعَمَدُوْا بِهِ إِلَى الشَّامِ، فَإِذَا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ فَالْأَمْنُ بِالشَّامِ».
‘আমি স্বপ্নে দেখলাম, ফেরেশতাগণ ঈমানের খুঁটি শামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফিতনা-ফাসাদের সময় আমান বা নিরাপত্তা থকেবে শামে।’[4]
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় শাফিয়ী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ ইমাম ইজ্জুদ্দীন ইবনে আবদুস সালাম (৫৭৭-৬৬০ হি.) বলেন, দীনের মধ্যে যখন ফিতনা-ফাসাদ ঢুকে পড়বে, শামের অধিবাসীগণ সব ধরনের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। তারা থাকবে ঈমানের ওপর অটল-অবিচল। আবার ফিতনা যখন দীন ব্যতীত অন্য ক্ষেত্রে হবে, তখন শামের অধিবাসীগণ ঈমান ও তার দাবি অনুযায়ী আমল করতে থাকবে।[5]
শাম পৃথিবীর বরকতময় স্থান
পৃথিবীর একটি পূণ্যময় ভূখণ্ডের নাম শাম। আল-কুরআনে এটিকে পবিত্র ভূমি (الْأَرْضُ الْـمُقَدَّسَةُ) ও বরকতময় স্থান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মিরাজের বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন,
سُبْحٰنَ الَّذِيْۤ اَسْرٰى بِعَبْدِهٖ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَى الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا الَّذِيْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ ؕ ۰۰۱
‘আমি সেই সত্তার পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত রাত্রিকালীন ভ্রমণ করিয়েছেন। যার চারপাশে আমি বরকত দান করেছি।’[6]
ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্দান ও লেবানন নিয়ে গঠিত অঞ্চলকে তৎকালীন সময়ে শাম বলা হতো। শামের বরকতপূর্ণ সীমানা সম্পর্কে ইবনে আসাকির (রহ.) তাবিয়ী আবুল আগয়াস (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন,
وأخْرَجَ ابْنُ عَساكِرَ، عَنْ أبِي الأغْيَسِ، وكانَ قَدْ أدْرَكَ أصْحابَ النَّبِيِّ ﷺ، أنَّهُ سُئِلَ عَنِ البَرَكَةِ الَّتِي بُورِكَ في الشّامِ أيْنَ مَبْلَغُ حَدِّهِ؟ قالَ: أوَّلُ حُدُودِهِ عَرِيشُ مِصْرَ، والـحَدُّ الآخَرُ طَرَفُ الثَّنِيَّةِ، والـحَدُّ الآخَرُ الفُراتُ، والـحَدُّ الآخَرُ جَبَلٌ فِيهِ قَبْرُ هُودٍ النَّبِيِّ n.
‘তার সীমানা হলো মিসরের তাঁবু থেকে তার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত এবং ইউফ্রেটিস নদী (ফোরাত) থেকে হযরত হূদ (আ.)-এর কবরসংবলিত পাহাড় পর্যন্ত।’[7]
শামের চতুর্সীমানর বর্ণনায় ইবনে আশূরা (রহ.) বলেন,
والْأَرْضِ أَرْضُ الشَّامِ وَهِيَ الْأَرْضُ الْـمُقَدَّسَةُ وَهِيَ تَبْتَدِئُ مِنَ السَّوَاحِلِ الشَّرْقِيَّةِ الشَّمَالِيَّةِ لِلْبَحْرِ الْأَحْمَرِ وَتَنْتَهِيْ إِلَىٰ سَوَاحِلِ بَحْرِ الرُّوْمِ وَهُوَ الْبَحْرُ الْـمُتَوَسِّطُ وَإِلَىٰ حُدُوْدِ الْعِرَاقِ وَحُدُوْدِ بِلَادِ الْعَرَبِ وَحُدُوْدِ بِلَادِ التُّرْكِ.
‘শাম হলো পৃথিবীর পবিত্রতম ভূমি। এটি লোহিত সাগরের উত্তর-পূর্ব উপকূল থেকে ভূমধ্য সাগরের তীর পর্যন্ত এবং আরব ও ইরাক সীমান্ত থেকে তুরস্ক পর্যন্ত।’[8]
পৃথিবীকে আবাদযোগ্য করার প্রক্রিয়া শুরু হয় মক্কা থেকে। বায়তুল্লাহ হলো এ ভূখণ্ডে নির্মিত প্রথম স্থাপনা। মানবমুক্তির সর্বশেষ সনদের গোড়াপত্তন হয় মক্কায়। বিস্তার লাভ করে মদীনায়। বিজয়ের এ ধারা পূর্ণতা লাভ করবে শামে। শেষ যুগে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে মুসলমানগণ শামে হিজরত করবে। ইমাম মাহদী ও ঈসা (আ.)-এর দারুল খেলাফত হবে ফিলিস্তিনে। আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ও হাদীসের বিবিধ গ্রন্থে শামের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। শেষ যুগে ফিতনা-ফাসাদের বিস্তারের সময় এটি হবে ইসলামের কেল্লা ও দীনের খুঁটি। একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বরকতময় ভূমি (بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ ؕ ۰۰۱) বলে শামের কথা উল্লেখ করেছেন। ফেরআউনের কবল থেকে বনি ইসরাইলের মুক্তি প্রসঙ্গে আল-কুরআনের ভাষ্য হলো:
وَاَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِيْنَ كَانُوْا يُسْتَضْعَفُوْنَ۠ مَشَارِقَ الْاَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِيْ بٰرَكْنَا فِيْهَاؕ ۰۰۱۳۷
‘পৃথিবীর প্রাচ্যে-প্রতীচ্যের একটি দুর্বল জাতিকে আমি বরকতময় ভূমির উত্তরাধিকার দান করেছি।’[9]
নমরুদের অত্যাচার থেকে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মুক্তি বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَنَجَّيْنٰهُ وَلُوْطًا اِلَى الْاَرْضِ الَّتِيْ بٰرَكْنَا فِيْهَا لِلْعٰلَمِيْنَ۰۰۷۱
‘আমি হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত লুত (আ.)-কে মুক্তি দিয়েছি বরকতপূর্ণ ভূমিতে।’[10]
সাবা সম্প্রদায়ের বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ الْقُرَى الَّتِيْ بٰرَكْنَا فِيْهَا قُرًى ظَاهِرَةً ؕ ۰۰۱۸
‘তাদের এবং বরকতময় ভূখণ্ডের মাঝে এমন কিছু জনপদ স্থাপন করেছি, যেগুলো পরস্পর সংযুক্ত ও পরিচিত।’[11]
শেষ যুগে মুসলমানগণ শামে হিজরত করবে
ইমাম ইবনে তায়মিয়া (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, ইসলামের প্রথমিক যুগে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের যে ফযীলত ছিল, শেষ যুগে শামে হিজরতের মাধ্যমেও অনুরূপ ফযীলত লাভ করবে।[12]
ইমাম আবু দাউদ (রহ.) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন,
«سَتَكُوْنُ هِجْرَةٌ بَعْدَ هِجْرَةٍ، فَخِيَارُ أَهْلِ الْأَرْضِ أَلْزَمُهُمْ مُهَاجَرَ إِبْرَاهِيْمَ، وَيَبْقَىٰ فِي الْأَرْضِ شِرَارُ أَهْلِهَا تَلْفِظُهُمْ أَرْضُوْهُمْ، تَقْذَرُهُمْ نَفْسُ اللهِ، وَتَحْشُرُهُمُ النَّارُ مَعَ الْقِرَدَةِ وَالْـخَنَازِيْرِ».
‘মদীনায় হিজরত সম্পন্ন হওয়ার পর আর একটি হিজরত সংঘটিত হবে। তখন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শ্রেষ্ট মুসলমান হবে যারা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর হিজরতের স্থান আঁকড়ে ধরবে। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে নিকৃষ্ট মুসলমানগণ অবস্থান করবে। পৃথিবী তাদেরকে নিজ ভূগর্ভ থেকে বের করে দিতে চাইবে, আল্লাহর নিকট তারা হবে ধিকৃত। একটি আগুন তাদেরকে বানর ও শুকরের সঙ্গে জমায়েত করে দেব।’[13]
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী আল-কারী (মৃ. ১০১৪ হি.) বলেন,
وَالْـمَعْنَىٰ سَتَكُونُ هِجْرَةٌ إِلَى الشَّامِ بَعْدَ هِجْرَةٍ كَانَتْ إِلَى الْـمَدِيْنَةِ. قَالَ التُّوْرِبِشْتِيُّ: وَذَلِكَ حِيْنَ تَكْثُرُ الْفِتَنُ، وَيَقِلُّ الْقَائِمُوْنَ بِأَمْرِ اللهِ فِي الْبِلَادِ، وَيَسْتَوْلِي الْكَفَرَةُ الطُّغَاةُ عَلَىٰ بِلَادِ الْإِسْلَامِ، وَيَبْقَى الشَّامُ تَسُوْمُهَا الْعَسَاكِرُ الْإِسْلَامِيَّةُ مَنْصُوْرَةً عَلَىٰ مَنْ نَاوَأَهُمْ ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْـحَقِّ حَتَّىٰ يُقَاتِلُوا الدَّجَّالَ، فَالْـمُهَاجِرُ إِلَيْهَا حِيْنَئِذٍ فَازَ بِدِيْنِهِ مُلْتَجِئٌ إِلَيْهَا لِإِصْلَاحِ آخِرَتِهِ، يَكْثُرُ سَوَادُ عِبَادِ اللهِ الصَّالِـحِيْنَ الْقَائِمِينَ بِأَمْرِ اللهِ تَعَالَىٰ.
‘মদীনায় হিজরতের পর শামের দিকে আর একটি হিজরত সংঘটিত হবে। তূরবিশতী (রহ.) বলেন, এটি হবে ফিতনার বিস্তৃতির সময়। যখন মুসলিম বিশ্বে দীনের ওপর অটল মুমিনের সংখ্যা কমে যাবে। অমুসলিম বিশ্ব ইসলামি রাষ্ট্রসমূহে দখলদারিত্ব কায়েম করবে। ইসলামি বাহিনী শামে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। তারা বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে দাজ্জালকে হত্যা করা পর্যন্ত বিজয়ী শক্তি হিসেবে টিকে থাকবে। এ সময়ে যারা সেখানে হিজরত করবে, দীন রক্ষা ও পরকালের সংশোধনের জন্য হিজরতকারী হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহর দীনের ওপর অটল-অবিচল নেককার বান্দাদের বিশাল একটি দল সেখানে অবস্থান করবে।’[14]
ইমাম হাকিম (রহ.) বর্ণনা করেন,
«يَأْتِيْ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يَبْقَىٰ فِيْهِ مُؤْمِنٌ إِلَّا لَـحِقَ بِالشَّامِ».
‘মানুষের সামনে এমন একটি সময় আসবে, যখন পৃথিবীর সকল মুসলমান শামে হিজরত করবে।’[15]
পৃথিবীর শ্রেষ্ট ভূমি শাম
মানবসৃষ্টির অভ্যুদয়কাল থেকেই শাম একটি তাৎপর্যমণ্ডিত স্থান। হাজারো নবী-রসুলের পরশধন্য এ পবিত্র ভূখণ্ড। হযরত ইবরাহীম (আ.)সহ অনেক নবীর হিজরতের স্থান হলো ফিলিস্তিন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। এখান থেকেই মিরাজের সূচনা হয়। এখানে রয়েছে মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসা। এই মসজিদ ছিল অতীতকালের সকল নবী-রসুলের কেবলা। ইমাম তাবরানী (রহ.) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হাওয়ালা আল-আযদী (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ حَوَالَةَ الْأَزْدِيِّ، أَنَّهُ قَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ خِرْ لِيْ بَلَدًا أَكُوْنُ فِيْهِ فَلَوْ عَلِمْتُ أَنَّكَ تَبْقَىٰ لَـمِ اخْتَرْ عَلَىٰ قُرْبِكَ قَالَ: «عَلَيْكَ بِالشَّامِ ثَلَاثًا»، فَلَمَّا رَأَى النَّبِيُّ ﷺ كَرَاهِيَتَهُ إِيَّاهَا قَالَ: «هَلْ تَدْرِيْ مَا يَقُوْلُ اللهُ فِي الشَّامِ إِنَّ اللهَ يَقُوْلُ: «يَا شَامُ أَنْتِ صَفْوَتِيْ مِنْ بِلَادِيْ أُدْخِلُ فِيْكِ خَيْرَتِيْ مِنْ عِبَادِيْ, أَنْتِ سَوْطُ نِقْمَتِيْ وَسَوْطُ عَذَابِيْ, أَنْتِ الَّذِيْ لَا تُبْقِيْ وَلَا تَذَرْ, {أَنْتِ الْأَنْدَرُ} وَإِلَيْكِ {عَلَيْكِ} الْـمَحْشَرُ», وَرَأَيْتُ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِيْ عَمُوْدًا أَبْيَضَ كَأَنَّهُ لُؤْلُؤَةٌ تَحْمِلُهُ الْـمَلَائِكَةُ قُلْتُ: «مَا تَحْمِلُوْنَ؟» قَالَ: عَمُوْدُ الْإِسْلَامِ أَمَرَنَا أَنَ نَضَعَهُ بِالشَّامِ وَبَيْنَا أَنَا نَائِمٌ إِذْ رَأَيْتُ الْكِتَابَ اخْتُلِسَ مِنْ تَحْتِ وِسَادَتِيْ, فَظَنَنْتُ أَنَّ اللهَ قَدْ تَخَلَّىٰ مِنْ أَهْلِ الْأَرْضِ فَأَتْبَعْتُهُ بَصَرِي فَإِذَا هُوَ نُورٌ بَيْنَ يَدَيَّ حَتَّىٰ وُضِعَ بِالشَّامِ, فَمَنْ أَبَىٰ فَلْيَلْحَقْ بِيَمَنِهِ {وَلْيَسْتَقِ} مِنْ غُدُرِهِ , فَإِنَّ اللهَ قَدْ تَكَفَّلَ لِيْ بِالشَّامِ.
‘আমার বসবাসের জন্য একটি দেশ নির্বাচন করুন। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি অবশ্যই শামে বসবাস করবে। তিনি বাক্যটি তিনবার উচ্চারণ করেন। শামে বসবাস করতে তার অনীহা দেখে রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি কী জানো, শাম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কী বলেছেন? আল্লাহ তাআলা বলেন, হে শাম! সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে তুমি আমার নিকট সর্বশ্রেষ্ট দেশ। আমার শ্রেষ্ট বান্দাদের তোমার মধ্যে প্রবেশ করাব। তুমি হলে আমার প্রতিশোধ ও শাস্তির চাবুক। তোমার মাধ্যমে এমন শাস্তি আরোপ হবে, যা কোনো অভিশপ্ত স্থান অবশিষ্ট থাকবে না এবং কোনো অপরাধীকে ছাড় দেওয়া হবে না। তোমার পৃষ্টদেশেই হবে হাশরের মাঠ। মিরাজের রাতে আমি মুক্তোর ন্যায় স্বেত-শুভ্র কিছু খুঁটি দেখতে পেয়েছি, যা ফেরেশতারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাদেরকে প্রশ্ন করলাম, আপনারা কী নিয়ে যাচ্ছেন? তারা উত্তর দিলেন, ইসলামের খুঁটি। আমাদেরকে এটি শামে স্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেলাম, আমার বালিশের নিচ থেকে কেউ আল-কুরআন ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করলাম, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা পৃথিবীবাসীর জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি দেখলাম, এটি আমার সামনে একটি উজ্জ্বল আলোর আকারে প্রকাশ পেয়েছে। একপর্যায়ে এটিকে শামে স্থাপন করা হলো। শামে অবস্থান করার সুযোগ যার হবে না, সে যেনো ইয়েমেনে হলেও বসবাস করে এবং সেখানকার কূপ থেকে পানি পান করে। কেননা আল্লাহ তাআলা নিজেই শামের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।’ [16]
হযরত আবদুল্লাব ইবনে হাওয়ালা (রাযি.) থেকে বর্ণিত,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ حَوَالَةَ h، كُنَّا عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ فَشَكَوْنَا إِلَيْهِ الْعِرْيَ وَالْفَقْرَ وَقِلَّةَ الشَيْءِ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «أَبْشِرُوْا فَوَاللهِ لِأَنَّا مِنْ كَثْرَةِ الشَّيْءِ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ مِنْ قِلَّتِهِ،
وَاللهِ لَا يَزَالُ هَذَا الْأَمْرُ فِيْكُمْ حَتَّىٰ يَفْتَحِ اللهُ b أَرْضَ فَارِسٍ وَأَرْضَ الرُّوْمِ وَأَرْضَ حِمْيَرَ، وَحَتَّىٰ تَكُوْنُوْا أَجْنَادًا ثَلَاثَةً: جُنْدًا بِالشَّامِ وَجُنْدًا بِالْعِرَاقِ وَجُنْدًا بِالْيَمَنِ وَحَتَّىٰ يُعْطَى الرَّجُلُ الْـمِائَةَ فَيَسْخَطَهَا».
قَالَ ابْنُ حَوَالَةَ: قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! اخْتَرْ لِيْ إِنْ أَدْرَكَنِيْ ذَلِكَ؟ قَالَ: «إِنِّيْ أَخْتَارُ لَكَ الشَّامَ، فَإِنَّهُ صَفْوَةُ اللهِ b مِنْ بِلَادِهِ وَإِلَيْهِ يُحْشَرُ صَفْوَتُهُ مِنْ عِبَادِهِ، يَا أَهْلَ الْيَمَنِ عَلَيْكُمْ بِالشَّامِ فَإِنَّ صَفْوَةَ اللهِ b مِنْ أَرْضِهِ الشَّامُ أَلَا فَمَنْ أَبَىٰ فَلْيُسْقَ مِنْ غُدُرِ الْيَمَنِ (جمع غدير الماء)، فَإِنَّ اللهَ b قَدْ تَكَفَّلَ بِالشَّامِ وَأَهْلِهِ».
‘আমরা একদিন রসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট বস্ত্রহীনতা, অভাব ও জীবনোপকরণের স্বল্পতার অভিযোগ করলাম। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। আমি তোমাদের ক্ষেত্রে স্বল্পতার চেয়েও প্রাচুর্যকে বেশি ভয় করি। আল্লাহর কসম! ইসলামের ক্রমোন্নতির ধারায় আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য পারস্য, রোম ও হিময়ারের বিজয় দান করবেন। এক সময় তোমাদের তিনটি বাহিনী থাকবে। একটি শামে। দ্বিতীয়টি ইরাকে। তৃতীয়টি ইয়েমেনে। এক সময় শতভাগ অধিকার লাভ করেও অনেক মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারবে না।’ ইবনে হাওয়ালা বলেন, হে আল্লাহর রসুল! এমন পরিস্থিতিতে আমার বসবাসের জন্য একটি দেশ নির্বাচন করুন। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমার জন্য আমি শাম দেশটি পছন্দ করলাম। এটি হলো আল্লাহর নিকট সর্বশ্রেষ্ট দেশ। এখানেই আল্লাহর শ্রেষ্ট বান্দাগণ একত্রিত হবেন। হে ইয়েমেনবাসীগণ! তোমাদেরও শাম দেশটি পছন্দ করা উচিত। এটি আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম দেশ। যে ব্যক্তি শামে বসবাস করতে চাইবে না, সে যেনো ইয়েমেনের কূপের পানি হলেও পান করে। কেননা আল্লাহ তাআলা শাম ও শামের অধিবাসীদের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছেন।’’[17]
শামের জন্য রসুলুল্লাহ (সা.)–এর দোয়া
শামের উপর্যুক্ত তাৎপর্য ও মাহাত্ম্যের কারণে রসুলুল্লাহ (সা.) দেশটির জন্য দোয়া করেন। যা এ অঞ্চলের গুরুত্ব ও ফযীলত আরও বর্ধিত করেন। ইমাম তিরমিযী ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
«اللّٰهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْ شَامِنَا، اللّٰهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْ يَمَنِنَا». قَالُوْا: وَفِي نَجْدِنَا. فَقَالَ: «اللّٰهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْ شَامِنَا، وَبَارِكْ لَنَا فِيْ يَمَنِنَا». قَالُوْا: وَفِيْ نَجْدِنَا. قَالَ: «هُنَالِكَ الزَّلَازِلُ وَالْفِتَنُ، وَبِهَا، أَوْ قَالَ: مِنْهَا يَخْرُجُ قَرْنُ الشَّيْطَانِ».
‘হে আল্লাহ! আমাদের শামে বরকত দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের ইয়েমেনে বরকত দান করুন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমাদের নাজদের জন্যও দোয়া করুন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের শামে বরকত দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের ইয়েমেনে বরকত দান করুন।’ সাহাবায়ে কেরাম আবার বললেন, আমাদের নাজদের জন্যও দোয়া করুন। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘সেখানে ভূমিকম্প ও ফিতনা-ফ্যাসাদ বিস্তার লাভ করবে এবং সেখান থেকে শয়তানের শিং বের হবে।’[18]
হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: «لَا تَزَالُ عِصَابَةٌ مِنْ أُمَّتِيْ يُقَاتِلُوْنَ عَلَىٰ أَبْوَابِ دِمَشْقَ، وَمَا حَوْلَهُ وَعَلَىٰ أَبْوَابِ بَيْتِ الْـمَقْدِسِ وَمَا حَوْلَهُ، لَا يَضُرُّهُمْ خُذْلَانُ مَنْ خَذَلَـهُمْ ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْـحَقِّ إِلَىٰ أَنْ تَقُوْمَ السَّاعَةُ».
‘আমার উম্মতের একটি দল দামেস্কের ফটকে অথবা তার আশেপাশে, বায়তুল মুকাদ্দাসের গেইটে অথবা তার চারপাশে জিহাদ করতে থাকবে। দুর্বৃত্তদের কোনো প্রকার চক্রান্ত তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। তারা কিয়ামত পর্যন্ত সত্যের ওপর অবিচল থাকবে।’[19]
হযরত আসমা বিনতে য়াযিদ (রাযি.) বর্ণনা করেন,
أَنَّ أَبَا ذَرٍّ الْغِفَارِيَّ كَانَ يَخْدُمُ النَّبِيَّ ﷺ فَإِذَا فَرَغَ مِنْ خِدْمَتِهِ، آوَىٰ إِلَى الْـمَسْجِدِ، فَكَانَ هُوَ بَيْتُهُ، يَضْطَجِعُ فِيْهِ، فَدَخَلَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الْـمَسْجِدَ لَيْلَةً، فَوَجَدَ أَبَا ذَرٍّ نَائِمًا مُنْجَدِلًا فِي الْـمَسْجِدِ، فَنَكَتَهُ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ بِرِجْلِهِ حَتَّىٰ اسْتَوَىٰ جَالِسًا، فَقَالَ لَهُ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «أَلَا أَرَاكَ نَائِمًا»؟ قَالَ: أَبُوْ ذَرٍّ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، فَأَيْنَ أَنَامُ، هَلْ لِيْ مِنْ بَيْتٍ غَيْرُهُ؟ فَجَلَسَ إِلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فَقَالَ لَهُ: «كَيْفَ أَنْتَ إِذَا أَخْرَجُوكَ مِنْهُ»؟ قَالَ: إِذَنْ أَلْـحَقَ بِالشَّامِ، فَإِنَّ الشَّامَ أَرْضُ الْـهِجْرَةِ، وَأَرْضُ الْـمَحْشَرِ، وَأَرْضُ الْأَنْبِيَاءِ، فَأَكُوْنُ رَجُلًا مِنْ أَهْلِهَا، قَالَ لَهُ: «كَيْفَ أَنْتَ إِذَا أَخْرَجُوكَ مِنَ الشَّامِ»؟ قَالَ: إِذَنْ أَرْجِعَ إِلَيْهِ، فَيَكُونَ هُوَ بَيْتِي وَمَنْزِلِي، قَالَ: «فَكَيْفَ أَنْتَ إِذَا أَخْرَجُوكَ مِنْهُ الثَّانِيَةَ»؟ قَالَ: إِذَنْ آخُذَ سَيْفِيْ، فَأُقَاتِلَ عَنِّيْ حَتَّىٰ أَمُوْتَ، قَالَ: فَكَشَّرَ إِلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ، فَأَثْبَتَهُ بِيَدِهِ، قَالَ: «أَدُلُّكَ عَلَىٰ خَيْرٍ مِنْ ذَلِكَ»؟ قَالَ: بَلَىٰ، بِأَبِيْ أَنْتَ وَأُمِّيْ يَا نَبِيَّ اللهِ، قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «تَنْقَادُ لَـهُمْ حَيْثُ قَادُوكَ، وَتَنْسَاقُ لَـهُمْ حَيْثُ سَاقُوْكَ حَتَّىٰ تَلْقَانِيْ، وَأَنْتَ عَلَىٰ ذَلِكَ».
‘হযরত আবু যর আল-গিফারী (রাযি.) রসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমত করতেন। খেদমত শেষে মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করতেন এবং নিজ গৃহের মতো সেখানে শুয়ে থাকতেন। একদিন রসুলুল্লাহ (সা.) রাত্রিবেলায় মসজিদে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন, আবু যর গিফারী (রাযি.) ক্লান্ত হয়ে মসজিদে ঘুমিয়ে আছেন। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে পা দিয়ে গুঁতো মারলেন। গুঁতো খেয়ে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বললেন, ‘ঘুমিয়ে আছো কেনো?’ আবু যর গিফারী (রাযি.) বললেন, আমি কোথায় ঘুমাবো? এছাড়া কী আমার অন্য কোনো ঘর আছে? এবার রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর নিকট বসলেন। তাকে বললেন, ‘তোমাকে এ মসজিদ থেকে বের করে দিলে কী করবে?’ আবু যর গিফারী উত্তর দিলেন, আমি শাম চলে যাবো। কেননা শাম হলো হিজরতের স্থান, হাশরের মাঠ এবং নবী-রসুলদের বাসস্থান। সুতরাং আমিও সেখানকার অধিবাসী হবো। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমাকে শাম থেকেও বের করে দিলে কী করবে?’ আবু যর গিফারী (রাযি.) উত্তর দিলেন, আমি আবার ফিরে আসবো। একমাত্র এটিই হবে আমার বসবাসের জায়গা। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমাকে পুনরায় বের করে দিলে কী করবে?’ আবু যর গিফারী (রাযি.) উত্তর দিলেন, তখন আমি অস্ত্র ধারণ করবো এবং আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। এ জবাব শুনে রসুলুল্লাহ (সা.) দাঁত দেখিয়ে হাঁসলেন এবং নিজ হাতে তাকে মজবুত করে ধরলেন। অতপর বললেন, ‘আমি কী তোমাকে এরচেয়ে উত্তম কিছুর দিশা দেবো?’ আবু যর গিফারী (রাযি.) বললেন, অবশ্যই। আপনার জন্য আমার মাতা-পিতা উৎসর্গিত হোক। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া পর্যন্ত তারা তোমাকে যেখানে নিয়ে যেতে চায় তুমি সেখানে চলে যাবে।’’[20]
মুসলমানদের বিজয়ী দল থাকবে শামে
মুসলমানদের একটি জামায়াত কিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী বেশে বিরাজমান থাকবে। শেষ যুগে এটি শামে জিহাদ করে ইমাম মাহদীর আগমনের প্রেক্ষাপট রচনা করবে। আল্লাহর ফেরেশতাগণ সে দেশের ওপর নিজেদের ডানা বিছিয়ে রেখেছে। হযরত আবুদ দারদা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
«أَهْلُ الشَّامِ وَأَزْوَاجُهُمْ وَذَرَارِيُّهِمْ وَعَبِيْدُهُمْ وَإِمَاؤُهُمْ إِلَىٰ مُنْتَهَى الْـجَزِيْرَةِ مُرَابِطُوْنَ، فَمَنْ نَزَلَ مَدِيْنَةً مِنَ الشَّامِ، فَهُوَ فِيْ رِبَاطٍ، أَوْ ثَغْرٍ
مِنَ الثُّغُوْرِ، فَهُوَ مُجَاهِدٌ».
‘শামের অধিবাসী, তাদের স্ত্রী-পরিজন ও দাস-দাসীগণ আরব উপদ্বীপের শেষপ্রান্তে জিহাদরত থাকবে। এ দেশের যেকোনো শহরে অবস্থান করলে জিহাদরত আছে বলে গণ্য হবে।’[21]
হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন,
«إِذَا وَقَعَتِ الْـمَلَاحِمُ خَرَجَ بَعْثٌ مِنْ دِمَشْقَ مِنَ الْـمَوَالِيْ هُمْ أَكْرَمُ الْعَرَبِ فَرَسًا, وَأَجْوَدُهُمْ سِلَاحًا, يُؤَيِّدُ اللهُ بِهِمُ الدِّيْنَ».
‘যখন পৃথিবীময় প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হবে, আল্লাহ তাআলা দামেস্কের মাওয়ালী (মুক্ত কৃতদাস) শ্রেণি থেকে একটি বাহিনী প্রেরণ করবেন। যারা হবে আরবের শ্রেষ্ট যোদ্ধা ও উন্নতমানের অস্ত্রসজ্জিত। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা এ দীনের সহযোগিতা গ্রহণ করবেন।’[22]
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) হযরত সালামা ইবনে নুফাইল (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
«لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِيْ ظَاهِرِيْنَ عَلَى النَّاسِ، يَزْيِغُ اللهُ قُلُوْبَ أَقْوَامٍ، فَيُقَاتِلُوْنَهُمْ، وَيَرْزُقُهُمُ اللهُ مِنْهُمْ، حَتَّىٰ يَأْتِيَ أَمْرُ اللهِ b وَهُمْ عَلَىٰ ذَلِكَ، أَلَا إِنَّ عُقْرَ دَارِ الْـمُؤْمِنِيْنَ الشَّامُ، وَالْـخَيْلُ مَعْقُوْدٌ فِيْ نَوَاصِيهَا الْـخَيْرُ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ».
‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা বিজয়ীরূপে অধিষ্টিত থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যুদ্ধরত দলসমূহের মনোবল শক্ত করবে। তাদের মাধ্যমে অন্যান্য দলসমূহকে রিযিক দান করবেন। আল্লাহর ফায়সালা আসা পর্যন্ত তারা এ অবস্থায় থাকবে। শাম হলো মুমিনদের বসবাসের উন্নত স্থান। কিয়ামত পর্যন্ত সে দেশের ঘোড়াসমূহের ললাটে কল্যাণ বিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’[23]
আলাউদ্দীন আলী আল-মুত্তাকী (৮৮৫-৯৭৫ হি.) হযরত যায়দ ইবন সাবিত (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন,
عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ، قَالَ: بَيْنَمَا نَحْنُ حَوْلَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ نُؤَلِّفُ الْقُرْآنَ مِنَ الرِّقَاعِ إِذْ قَالَ: «طُوْبَىٰ لِلشَّامِ»، قِيْلَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ وَلِـمَ ذَاكَ وَلِـمَ ذَاكَ؟ قَالَ: «إِنَّ مَلَائِكَةَ الرَّحْمٰنِ بَاسِطَةٌ أَجْنِحَتَهَا عَلَيْهَا».
‘একদিন আমরা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আল-কুরআন সংকলনে নিয়োজিত ছিলাম। হঠাৎ তিনি ইরশাদ করেন, ‘শামের জন্য সুসংবাদ!’ একজন সাহাবী প্রশ্ন করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! এটি কী কারণে? তিনি উত্তর দিলেন, আল্লাহর ফেরেশতাগণ সে দেশের ওপর নিজেদের ডানা বিছিয়ে রেখেছে।’’[24]
মুআবিয়া ইবনে কুররা তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ قُرَّةَ، عَنْ أَبِيْهِ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «إِذَا فَسَدَ أَهْلُ الشَّامِ فَلَا خَيْرَ فِيْكُمْ، لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِيْ مَنْصُورِيْنَ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَـهُمْ حَتَّىٰ تَقُوْمَ السَّاعَةُ».
‘শামের অধিবাসীগণ ধ্বংসের মুখোমুখী হলে তোমাদের মধ্যে কোনো কল্যাণ অবশিষ্ট থাকবে না। আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সর্বদা বিজয়ী থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’[25]
শামের ফযীলতসংবলিত উল্লিখিত হাদীসসমূহ সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের অভিমত হলো, এখানে কিছু হাদীস সহীহ, কিছু হাদীস হাসান, আর কিছু যয়িফ। এ হাদীসমসমূহ সাহাবায়ে কেরামের একটি বিশাল জামায়াত থেকে বর্ণিত হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, শামের ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত হাদীসসমূহ তাওয়াতুর (تواتر)-এর পর্যায়ে উন্নীত। এ সংক্রান্ত ন্যূনতম বিশটি সহীহ হাদীস রয়েছে। ইমাম আল-মুনযিরী (রহ.) ১২টি সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছেন। অতএব আমরা এ সিদ্ধান্তে উপণীত হতে পারি যে, শামের ফযীলত সংক্রান্ত যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে দোষ-ত্রুটি (طعن) অন্বেষণের কোনো সুযোগ নেই।[26]
লেখক: পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[1] আত-তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়িয়ীন, মুআস্সিসাতুর রিসালা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত-তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৫ হি. = ১৯৮৪), খ. ১, পৃ. 345, হাদীস: 601
[2] (ক) আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত-তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৩৬, পৃ. ৬২, হাদীস: ২১৭৩৩; (খ) আত-তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়িয়ীন, খ. ২, পৃ. ২৮৮, হাদীস: ১৩৫৭
[3] আল-হায়সামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ওয়া মানবাউল ফাওয়ায়িদ, মাকতাবাতুল কুদসী, কায়রো, মিসর (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৪ হি. = ১৯৯৪ খ্রি.), খ. 10, পৃ. 57, হাদীস: 16640
[4] আত-তাবারানী, আল-মু’জামুল আওসাত, দারুল হারামইন লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, কায়রো, মিসর (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৫ হি. = ১৯৯৫ খ্রি.), খ. 3, পৃ. 117, হাদীস: 2689
[5] আবুল আশবাল হাসান আয-যুহায়রী, আল-আরদুল মুকাদ্দাসা ফী যাওয়িল কিতাব ওয়া সুন্নাহ, www.islamweb.net প্রকাশিত, পৃ. ১১
[6] আল-কুরআনুল করীম, সুরা আল-ইসরা, ১৭:১
[7] ইবনে আসাকির, তারীখু দিমাশক, দারুল ফিকর লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, দামেস্ক, সিরিয়া (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৫ হি. = ১৯৯৫ খ্রি.), খ. 1, পৃ. 196
[8] ইবনে আশূরা, আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর, আদ-দারুত তিউনিসিয়া লিন-নাশর, তিউনিস, তিউনিসিয়া (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৪ হি. = ১৯৮৪ খ্রি.), খ. ৯, পৃ. ৭৭
[9] আল-কুরআনুল করীম, সুরা আল-আ’রাফ, ৭:১৩৭
[10] আল-কুরআনুল করীম, সুরা আল-আম্বিয়া, ২১:৭১
[11] আল-কুরআনুল করীম, সুরা সাবা, ৩৪:১৮
[12] ইবনে তায়মিয়া, মানাকিবু আহলিশ শাম, পৃ. ৪০
[13] আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. 3, পৃ. 4, হাদীস: 2482
[14] মোল্লা আলী আল-কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ শরহু মিশকাতিল মাসাবীহ, দারুল ফিকর লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০২ খ্রি.), খ. ৯, পৃ. ৪০৪০
[15] আল-হাকিম, আল-মুসতাদরাক আলাস সহীহাঈন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১১ হি. = ১৯৯০ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ৫০৪, হাদীস: ৮৪১৩
[16] আত-তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়িয়ীন, খ. ১, পৃ. 345, হাদীস: 601
[17] ইবনে আসাকির, তারীখু দিমাশক, দারুল ফিকর লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, দামেস্ক, সিরিয়া (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৫ হি. = ১৯৯৫ খ্রি.), খ. 1, পৃ. ৭৫
[18] আত-তিরমিযী, আল-জামিউস সহীহ = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৩৯৫ হি. = ১৯৭৫ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ৭৩৩, হাদীস: ৩৯৫৩
[19] আবু ইয়া’লা, আল–মুসনাদ, দারুল মামূন লিত-তুরাস, দামেস্ক, সিরিয়া (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৪ হি. = ১৯৮৪ খ্রি.), খ. ১১, পৃ. ৩০২, হাদীস: ৬৪১৭
[20] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, খ. ৪৫, পৃ. ৫৬৮-৫৬৯, হাদীস: ২৭৫৮৮
[21] আল-হায়সামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ওয়া মানবাউল ফাওয়ায়িদ, খ. 10, পৃ. ৬০, হাদীস: 166৬১
[22] আত-তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়িয়ীন, খ. ২, পৃ. ৪১৪, হাদীস: ১৬০৭
[23] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, খ. ২৮, পৃ. ১৬৫-১৬৬, হাদীস: ১৬৯৬৫
[24] (ক) আলী আল-মুত্তাকী, কনযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফআল, মুআস্সিসাতুর রিসালা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত-তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (পঞ্চম সংস্করণ: ১৪০১ হি. = ১৯৮১ খ্রি.), খ. ১০, পৃ. ১৭৬, হাদীস: ২৮৯১৭; (খ) ইবনে আবু শায়বা, আল-মুসান্নাফ ফিল আহাদীস ওয়াল আসার, মাকতাবাতুর রাশাদ লিন-নাশর ওয়াত তাওযী’, রিয়াদ, সউদী আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৯ হি. = ১৯৮৯ খ্রি.), খ. ১৪, পৃ. ১৫২, হাদীস: ৩৮২০৮
[25] আত-তিরমিযী, আল-জামিউস সহীহ = আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ৪৮৫৩, হাদীস: ২১৯২