জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল্লামা পালনপুরী (রহ.): কাছ থেকে দেখা কিছু স্মৃতি ও অনুভূতি

যুবাইর হানীফ

(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

রচনাবলি

تفسير هداية القرآن

এটি হযরতের জীবনের শেষ দিকের শাহকার তাসনীফগুলোর একটি৷ হযরতুল উস্তাজ আছরের পর মাজলিসে বলতেন, আমার মৃত্যুর পূর্বে এখন ফিকির হল কুরআনের উপর কিছু কাজ করা৷ অন্যান্য ফনের উপর তো কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছে৷ তাফসীরের উপর কাজ করার ইচ্ছে৷ সে প্রেরণা থেকে হেদায়াতুল কুরআন লিখা৷

৩০ তম পারা ও ১-৯ পারা পর্যন্ত হযরত মাওলানা মুহাম্মদ উসমান কাশিফ আল-হাশিমী রাজুপুরী (রহ.) লিখেছেন। কিতাবটি মোট আট খণ্ডে। দুই খণ্ড ছাড়া বাকি সব তাঁর লেখা। অবশ্য হাশেমি (রহ.)-এর লিখিত দুই খণ্ডও তিনি আবার দেখেছেন৷

رحمة الله الواسعة شرح حجة الله البالغة

এটি হযরতের শ্রেষ্ঠ কিতাবগুলোর একটি। এর দ্বারা তিনি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছেন, যা বিশাল কলেবরে ৫ খণ্ডে প্রকাশিত। এছাড়াও জনসাধারণদের জন্য আলাদা করে কামিল বুরহানে এলাহি নামে ৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয় এবং মূল কিতাব টীকা-টিপ্পনীসহ দুই খণ্ডে দারু ইবনে কাসীর, বৈরুত থেকে মুদ্রিত হয়।

فيض المنعم شرح مقدمة مسلم

হযরতের মুসলিম শরীফের মুকাদ্দিমার শরহ ফয়যুল মুনঈম থেকে কে আছে উপকৃত হয় না৷ খুবই চমৎকার একটি শরহ৷ সংক্ষিপ্ত তবে জামে৷

إيضاح المسلم

হুজুর শুধু মুকাদ্দিমার ব্যাখ্যা লিখেই ক্ষান্ত হন নি৷ মুসলিম শরীফেরও ২৫০ পৃষ্ঠা ব্যাপী এক শরহ লিখেন ইযাহুল মুসলিম নামে৷ যেখানে কিতাবুল ঈমান ও কিতাবুত্বহারাতের আলোচনা রয়েছে৷

تحفة القارئ شرح اردو صحيح البخاري

যা উস্তাদে মুহতারমের দরসে পদত্ত তাকরীর সংকলন। এ কিতাবের ব্যাপারে আছরের পর হুজুরের বাসার মাজলিসে আমাদের বলেন, একবার আমেরিকান কিছু সাথী দারুল উলূমে ভর্তি হওয়ার পর আমার দরসের রেকর্ড করতে থাকে৷ বছর শেষে যখন তারা দেশে চলে যাবে তখন আমার সাথে দেখা করতে এসে রেকর্ডগুলো সংরক্ষণ রাখার কথা বলে৷ আমি তাদেরকে সেগুলো সংরক্ষণ রাখার অনুমতি দেইনি৷ কারণ দরসে বিভিন্ন ধরণের কথাবার্তা এসে যায় যা অন্য কেউ শোনার মতো নয়৷ তাই পরের বছর আমি ভাই হুসাইনকে বছরের শুরু থেকে রেকর্ড করার জন্যে বলি৷ আমিও প্রস্তুতি গ্রহণ করি রেকর্ড করার জন্য৷ এক বছর পূর্ণ রেকর্ড করার পর তা কম্পোজ করে হুসাইন ভাই আমার নিকট আসে আমি তা দ্বিতীয়বার দেখে প্রকাশের উপযোগী হলে লাইব্রেরীতে দিয়ে দেই৷ পরে তা প্রকাশিত হয়৷ ১২ খণ্ডে মুদ্রিত। ইমাম বুখারী (রহ.)-এর সূক্ষ্মতা বুঝতে এই ব্যাখ্যাগ্রন্থ অত্যন্ত গুরুত্ববহ।

تحفة الألمعي شرح اردو سنن الترمذي

যা আট খণ্ডে প্রকাশিত৷ খবুই মুল্যবান শরহ৷ তিরমিযী বুঝার জন্যে মাযহাবের আদিল্লা, মূল মাযহাব কী ইত্যাদির সহজ, সরল আলোচনা রয়েছে৷ এই কিতাবের প্রকাশও রেকর্ডের মাধ্যমেই হয়৷

العون الكبير

যা আল-ফওযুল কবীরের ব্যাখ্যাগ্রন্থ। তিনি মূল বই আল-ফওযুল কবীরের জদীদ তা’রীবও (আরবি অনুবাদ) করেছেন। দারুল উলুম দেওবন্দসহ অন্যান্য মাদরাসায় এখন এ অনুবাদই পড়ানো হয়।

এছাড়া ফয়যুল মুনঈম, মাবাদিল ফালসাফা, মুঈনুল ফালসাফা, মিফতাহুত তাহজিব, আসানে মানতিক, আসানে সরফ, মাহফুযাত, আপ কেইসে ফতওয়া দেঁ, কিয়া মুক্তাদি পর ফাতিহা ওয়াজেব হে,  ইলমি খুতবাত, হায়াতে ইমাম আবু দাউদ, মাশাহির মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কেরাম আওর তাযকিরায়ে রাবিয়ানে কুতুবে হাদীস, হায়াতে ইমাম তাহাওয়ী, ইসলাম তাগায়উর পজির দুনিয়ে মে, নুবুওয়াত নে ইনসান কু কিয়া দিয়া, দাঁড়হি আওর আম্বিয়া কি সুন্নাতেঁ, হুরমাতে মুসাহারাত, তাসহিল আদিল্লায়ে কামিলা, হাওয়াশী ও আনাভীন ইযাহুল আদিল্লা, হাওয়াশী ইমদাদুল ফতওয়া (প্রথম খণ্ড), জুবদাতুত তাহাওয়ীসহ সর্বমোট চল্লিশের ঊর্ধ্বে তাঁর রচনাবলি দেশ-বিদেশে সমাদৃত। সবগুলো কিতাব হুযুরের নিজস্ব কুতুবখানা মাকতাবায়ে হিজায, দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত৷

মসনদে হাদীস

বর্তমান সময়ে দারুল উলুম দেওবন্দ নয়, বরং পুরো উপমহাদেশের মসনদে হাদীসে হযরতুল উস্তাদের মেসাল পাওয়া মুশকিল৷

এর বাস্তবতা কতটুকু তার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন হযরতুল উস্তাদ মাওলানা আরশাদ মাদানী (হাফি.) তিনি হযরত (রহ.)-এর মৃত্যুর পর এক শোকবার্তায় বলেন,

اگر یہ کہا جائے کہ دار العلوم کے مسند حدیث کے امتیاز کو انہوں نے قائم رکھا تھا تو اس میں کوئی مبالغہ نہ ہوگا۔

যদি বলা হয় যে, দারুল উলুম দেওবন্দের মসনদে হাদীসের অনন্য বৈশিষ্ট্য তিনি বাকি রেখেছিলেন, তাহলে তাতে সীমালঙ্ঘন হবে না।

দারুল উলুম দেওবন্দের বর্তমান মুহতামিম সাহেব (হাফি.) বলেন, মুফতি সাহেব দেওবন্দের প্রবীন উস্তাদদের একজন৷ ১৩৯৩, ৯৪, ৯৫ হিজরী তাঁর দেওবন্দে খেদমতের শুরুর জামানা৷ প্রায় ৪৮ বছর দেওবন্দের উস্তাদ ছিলেন৷ প্রাথমিক উস্তাদ থেকে তারাক্কি হতে হতে বর্তমানের শায়খুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিসীনে এসে পৌঁছান৷ তাঁর বুখারী শরীফের দরস বিশেষ গুণে গুণান্বিত ছিল৷ মাদরাসাগুলোতে স্বাভাবিক ভাবে হাদীসের কিতাবগুলো বিশেষ করে বুখারী শরীফ পড়ানোর যে পদ্ধতি চলে আসছে তা  হচ্ছে, বছরের শুরুর অংশে তাকরীর করা হয় তাফসীলের সাথে৷ পরে বছর শেষে যখন কিতাব শেষ করার সময় হয় তখন রেওয়াতান (শুধু হাদীস পড়া) পড়ে শেষ করে দেওয়া হয়৷ কিন্তু মুফতি সাঈদ (রহ.)-এর দরস পুরো বছর একধরণের ছিল৷ মুখতাসার বিশ্লেষণসহ পূর্ণ কিতাব পড়াতেন।

হযরতের দরস

দারুল উলুমের দরসের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, সকাল বেলায় ফজরের এক ঘণ্টা পর থেকে শুরু করে দুপুর সোয়া এগারটায় শেষ হয়৷ বিকাল বেলায় জোহরের নামাযের পর থেকে আছর আযান পর্যন্ত৷ দাওরায়ে হাদীসে পালনপুরী (রহ.)-এর দরস ছিল সকাল বেলার সর্বশেষ দরস৷ যার দরুন হুযুর বছরের শুরুতে এলান করে দিতেন যে, আমার সবকের সময় মাদরাসার স্বাভবিক নিয়মের চেয়ে একটু ভিন্ন হবে৷ মাদরাসার নেযাম, দশটা থেকে শুরু করে এগারটার ভেতরে শেষ হওয়া কিন্তু আমার দরস  হবে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত৷ নিয়ম হবে এমন যে, মৌসুমের ব্যবধানে আমার দরসের সময় যখন থেকে আরম্ভ হবে এরপর থেকে ৩০ মিনিট বিরতি থাকবে৷ যাতে করে তোমাদের কারো কোনো প্রয়োজন বা নাস্তার জরুরত থাকলে সেরে আসতে পারো৷ আমি এরপর আসব৷ বরাবর দুই ঘণ্টা পড়াবো৷ মৌসুমভেদে কখনও সাড়ে দশটায়, কখনো ১০:৪৫ মিনিটে শুরু হবে৷ শেষ হবে ১২টা কিংবা সাড়ে বারোটায়৷ সে হিসেবে হযরতুল উস্তাদের দরস শীতকালে প্রতিদিন সকাল সাড়ে দশটায়, গরমকালে পৌনে এগারটায় শুরু হতো৷ সাড়ে বারোটায় শেষ হতো৷ মাঝে মাঝে বৃহস্পতিবার ও বিরয়ানির দিন ভিন্ন ছিল, বিরয়ানির দিন বলতেন,

جاؤ! آج بریانی ہے، گرم گرم بریانی کھاؤ۔

দরসের সময় হুযুর ঠিক সময়ে এসো পৌঁছাতেন৷ সর্বোচ্চ কখনও দেরি হলে দশ মিনিট৷

আমাদের বছর দেশি-বিদেশি কিছু সাথী ভাইয়েরা মুরব্বি উস্তাদদেরকে দরসে যাতায়াত ও আনা-নেওয়া করার জন্যে একটি প্রাইভেট কার ব্যবস্থা করেন৷ সে গাড়ি করে নির্ধারিত ছাত্র গিয়ে হুযুরকে নিয়ে আসতেন৷ বেশিরভাগ সময় বর্তমান সদরে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ মাহমুদ মাদানী সাহেবের ছেলে ভাই হুসাইন ড্রাইভ করে নিয়ে আসতেন৷

গাড়ি এসে থামত মাসজিদে রশিদের সামনে যেখানে বর্তমানে ঠাণ্ডা ফ্রিজিং পানির ব্যবস্থা রয়েছে৷ সেখানে হুযুর কুলি করতেন৷ কুলি করে এসে সরাসরি দারুল হাদীসে প্রবেশ করতেন৷ আমাদের বছর দারুল হাদীস দুই জায়গায় ছিল৷ প্রথমে কুরবানী পর্যন্ত ছিল বর্তমান শায়খুল হিন্দ লাইব্রেরী ও দারুল হাদীস ভবনের আন্ডার গ্রাউন্ডে৷ যা মূলত দারুল ইমতিহান (পরীক্ষার হল রুম)৷ আন্ডার গ্রাউন্ডে বেশ কিছু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে প্রবেশ করতে হত৷ মুরব্বি উস্তাদগণের অতগুলো সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশ করা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল বিধায় কুরবানীর পর দারুল হাদীস মসজিদে রশীদের আন্ডার গ্রাউন্ডে স্থানান্তরিত করা হয়৷ যা পূর্ব থেকে অস্থায়ী দারুল হাদীস হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে৷ এরপর থেকে বছরের শেষ হওয়া পর্যন্ত এখানেই দরস হয়৷

হযরতুল উস্তাদ গাড়ি থেকে নেমে কুলি করে দরসগাহর দিকে পাঁয়ে হেঁটে আসতেন৷ তখন ধবধবে নিসফে সাক সাদা জুব্বা, সাদা পাগড়ি, সাদা পায়জামা পরিহিত জিবালুল ইলম হাস্তিকে দেখে মনে হত কোনো ফেরেশতা আসছে৷ হাতে লাঠি নিয়ে ধীরে ধীরে চলতেন৷ সে দৃশ্য দেখে নিয়মিত আনন্দ অনুভব করতাম৷

দরসে প্রবেশের নিয়ম ছিল হুযুর দারুল হাদীসে প্রবেশের পূর্বে সকল তালিবে ইলম ভাইকে প্রবেশ করতে হবে৷ হুযুর মসনদে হাদীসে উপস্থিত হওয়ার পর কাউকে দরসে প্রবেশ করতে দেখলে রাগ করতেন৷ এটা খুব অপছন্দ করতেন৷ অনেক সময় এমন দেখলে দরজা বন্ধ করে দিতে বলতেন৷ তাই ছাত্ররা সানন্দে আগ থেকে দরসে তাড়াতাড়ি এসে উপস্থিত হত৷ গরমকালে পুরো দরসে এসি চলত৷ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছিল পুরো দারুল হাদীস৷ যার কারণে দুই ঘণ্টা লাগাতার বসে থাকতেও বিরক্তি অনুভব হতো না৷

দরসের সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য

জীবনের শেষ দিকে বেশ কিছু বছর হযরতুল উস্তাদের জিম্মায় শুধু সহীহুল বুখারী ছিল৷ হুযুরের দরসে নিজে ইবারত পড়া, উপস্থাপন করা, মাসআলার বিশ্লেষণ করা যেভাবে দেখেছি তা যে কাউকেই মুগ্ধ করবে৷ হুযুরের দরসের বৈশিষ্ট্য বলে শেষ করা মুশকিল৷ তার কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিম্নে প্রদত্ত হলো:

  1. হযরতুল উস্তাদ বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক নিয়মে তাকরীর করতেন৷ প্রথম দিনের দরসের তাকরীর যেমন সময় নিয়ে করতেন, বছরের শেষ দিনের তাকরীরও তেমন সময় নিয়ে করতেন৷ বরাবর ছিল৷ বেশ কম হতো না৷ তাকরীর ছাড়া হাদীস কমই যেতো৷ প্রত্যেক হাদীসেই কম বেশ তাকরীর করতেন৷
  2. হুযুর বছরের শুরুর দিকে প্রথম কয়েকদিন কিতাব শুরু করতেন না বরং কিছু মুকাদ্দিমাত ও ইবতেদায়ী বিষয়ে তাফসীলি আলোচনা করতেন৷ তারপর কিতাব শুরু করতেন৷
  3. হযরতুল উস্তাদ দরসে একজন সফল উস্তাদ ছিলেন৷ দুর্বল থেকে দুর্বল ছাত্রও দরস সহজে আয়ত্ত করতে পারত৷ কোনো কঠিনই মনে হতো না৷ সহজ থেকে সহজতর করে উপস্থাপন করা তাঁর অন্যতম অভ্যাস ছিল৷
  4. নিজে নিজেই ইবারত পড়তেন৷ নিজেই তাকরীর করতেন৷ ছাত্রদের দিয়ে ইবারত পড়াতেন না৷ বলতেন- এখনকার ছাত্ররা ভালো করে ইবারত পড়তে পারে না৷ ভুল করে৷ ভুল হাদীসে রাসূলের সাথে বেআদবী তাই আমি নিজেই পড়ি৷ হযরতের ইবারতের রেকর্ড এখনও আমার নিকট আছে৷ বারবার শুনি৷ যতো শুনি ততোই ভালো লাগে৷
  5. অত্যন্ত কঠিন থেকে কঠিন স্থান হযরতুল উস্তাদ সহজ থেকে সহজে বুঝিয়ে দিতেন৷ মনে হতো কোনো কঠিনই না৷ একদম পান্তা ভাতের মত গেলা সহজ৷
  6. প্রত্যেক মাসআলাতে গোপন হেকমত বর্ণনা করতেন৷ যা খুব সূক্ষ্ম হতো, কিন্তু এ ধরণের গভীর ও কঠিন বিষয়কে এভাবে বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করতেন যা সব স্তরের তালিব ইলম সমানভাবে বুঝত৷
  7. আধুনিক মাসালায়ে হযরতের নিজস্ব ও অন্যান্য মুআসির আলিমদের মত বর্ণনা করে বিশ্লেষণ করতেন৷ হুযুরের আমল কী তাও জানিয়ে দিতেন৷ তাতে একটু কার্পণ্য করতেন না৷
  8. নিজস্ব মত বর্ণনার পরে বলতেন,

یہ میری ذاتی رائی ہے۔ پسند ہو تو لو، ورنہ دیوار پر مار دو۔

এটি আমার নিজস্ব মত৷ পছন্দ হলে গ্রহণ করো৷ না হয় দেয়ালে নিক্ষেপ করো৷ এটা হযরতের অত্যন্ত বিনয় ও সরলতার পরিচয়৷

  1. বাবের সকল হাদীসকে সামনে রেখে পটভূমি বর্ণনা করে মাসআলার চুলচেরা নিখুঁত বিশ্লেষণ করতেন৷
  2. উস্তাদে মুহতারমের দরস ইজতিহাদানা আন্দাযের ছিল৷ মুকাল্লিদানা আন্দাযের নয়৷ যা কিতাবে পেয়েছেন বলে দিয়েছেন এমন নয় বরং যা পেয়েছেন তার মধ্যে তারতীব দিয়ে কোনটা নেওয়ার, কোনটা না নেওয়ার তা বলতেন৷ যার মাধ্যমে ছাত্ররা বিশ্লেষণ কেমন হতে হয় তার কিছু ধারণা পেত৷ যা পরবর্তীতে ছাত্রের জন্যে অনেক বড় তুহফা হয়ে থাকত৷ এ বিষয়ে মনযুর মেঙ্গল (হাফি.) বিস্তারিত আলোচনা করেছেন৷ ইউটিউব থেকে তা শুনে নেওয়া যেতে পারে৷
  3. হাদীসের পরস্পর মতবিরোধকে তিনি উসুলের আলোকে হল করতেন৷ কোনো উসুলের মাধ্যমে এ বিশ্লেষণ করা হয়েছে সাথে সাথে তাও বলে দিতেন৷

হযরতুল উস্তাদের নিজস্ব কিছু ইসতিলাহাত

হাদীসের বিশাল ভাণ্ডার হল করার, বুঝানোর ও যেহেনকে নিকটতম করার জন্যে হযরতুল উস্তাদ কিছু পরিভাষা ব্যবহার করতেন৷ মাঝে মাঝে সেগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করতেন৷

  1. حدیث و سنت میں فرق،
  2. تشریع کے وقت کی ترخیص،
  3. واقعات کے متعلقات کا اختلاف،
  4. ناقص کو ناقص کی طرح کامل فرض کرنا،
  5. استدلال خفی۔

যে কারণে হযরতের দরস ছাত্রদের প্রিয় ছিল

হযরতের দরস ছাত্রদের নিকট বেশ প্রিয় ও মাকবুল ছিল৷ এর কারণ দুটি৷ একদিকে হযরতের ইলমি গভীরতা, বিষয়বস্তুর নিখুঁত বিশ্লেষণে সফল অনন্য ব্যক্তি৷ অন্যদিকে হযরতের চমৎকার বাচনভঙ্গি ও অভিনব আন্দাজ যে কারো কঠিন থেকে কঠিন মাসআলা বুঝতে সহায়ক হতো৷ এজন্যই ছাত্ররা অনেক বড় বড় মাসআলা ও কঠিন কঠিন বিষয় আত্মস্থ করতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতো না৷ হুযুর অত্যন্ত মুখতাসার ও সুন্দর তারতীব দিয়ে উপস্থাপন করতেন৷ যা ছাত্রদের মনঃপূত হত৷

হযরতের বেশিরভাগ দৃষ্টি থাকতো ছাত্রদের মাআসালা বের করার পদ্ধতি ও দলিলাদির সূক্ষ্মতার প্রতি৷ যার মাধ্যমে ছাত্ররা তাদের সুপ্তমেধা ও যোগ্যতাকে তীক্ষ্ণ করতে সক্ষম হয় যা তাদের পরবর্তী জীবনে কাজে লাগাতে পারে৷ এ জন্যেই দেখা যায় হুযুরের খাছ ছাত্র যারা, তারা এমন সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী হন৷

হযরতের সময়

হযরতের নিকট সময়ের গুরুত্ব খুব বেশি ছিল৷ এক মিনিট সময়ও হুযুরকে নষ্ট করতে দেখা যেত না৷ ছাত্র জামানায় সাহারানপুর থেকে দেওবন্দে আসার পর হযরতের জীবনে নতুন বিপ্লব ঘটেছে৷ আমূল পরিবর্তন এসেছে৷

কারো সাথে আড্ডা, গল্প-গুজব করে সময় কাটাতেন না কখনও৷ মাদরাসায় দরসের সময় শুধু দরস দিতেন৷ দরস শেষে সিধে বাসায় চলে যেতেন৷ তালীম, তাসনীফ, মুতালাআয় সময় কাটাতেন৷ সারাজীবন এইভাবে সময় কাটান৷

দৈনন্দিনের পুরো সময় ভাগ করা ছিল৷ মেহমান ও ছাত্রদের জন্যে শুধু আসরের পর সময়টুকু বরাদ্ধ ছিল৷ এ সামান্য৷ সময়েই হযরত মেহমানদের সাথে মুলাকাত করতেন৷ ছাত্রদের কোনো প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর দিতেন৷ মজলিস করতেন৷

এ সময় ছাড়া সাধারণত দেখা করার সুযোগ নেই৷ তবে মেহমানদের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন ছিল৷ হযরত যখন দরসের জন্যে গাড়ি থেকে নেমে কুলি করতে যেতেন; তখন মেহমানদের কেউ কেউ দেখা করতে পারতেন৷

বিশেষ মেহমান হলে তাদের হয়তো বিশেষ সময় দিতেন৷ যেমন আমাদের বছর মারকাযুদ্দাওয়ার আমিনুত তালীম হযরতুল উস্তাদ আবদুল মালেক (হাফি.) গিয়েছিলেন, মালিবাগের হযরত জাফর আহমদ (হাফি.) ও মাদানী নগর মাদরাসার মুহতামিম হযরত ফয়যুল্লাহ (হাফি.) গিয়েছিলেন৷ সবাইকে মাগরিবের পর বিশেষ সময় দিয়েছেন৷

দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম হযরতুল উস্তাদের সময়ের ব্যাপারে বলেন, তাঁর অনেক বড় একটি বৈশিষ্ট্য তো এ ছিল যে, সময়ের মূল্যয়ন তার নিকট খুব বেশি ছিল৷ একসাথে বসে কথা-বার্তা বলা, আড্ডা বা মজলিস তার এখানে হতো না৷ শুধু আসরের নামাযের পর তার ওখানে ছাত্রদের উপস্থিত হওয়ার ও মেহমানদের মুলাকাতের অনুমতি ছিল৷ বাকি পূর্ণ সময় তিনি মুতালাআ, তাসনীফ ও ইলমি ব্যস্ততায় কাটাতেন৷ সবসময় কোনো না কোনো ইলমি কাজে ব্যস্ত থাকতেন৷ এক কাজ থেকে ফারেগ হলে অন্য কাজে মনোযোগী হতেন৷

হযরত ঈদের দিন পর্যন্ত মুতালাআ ও লেখালেখির কাজে ব্যস্ত থাকতেন৷ তিনি ঈদের নামায পড়েই বাসায় এসে মুতালায় বসে যেতেন৷ কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন যে, মুতালাআয় আমার ঈদের আনন্দ অনুভব হয়৷

জীবন শেষ করেছেন ইলমি নিমগ্নতা ও একাগ্রতায়৷শেষ সময়েও হযরত নিজে নিজে লিখতেন৷ যখনি যেতাম হযরত কোনো ইলমি কাজে মাশগুল থাকতেন৷

গভমেন্ট লেখালেখির জন্য অ্যাওয়ার্ড দেয়

ভারতে একটা সিস্টেম চালু আছে, দেশের যারা ভালো ও প্রসিদ্ধ লেখক তাদেরকে গভমেন্টের পক্ষ থেকে প্রতিমাসে একটা নির্ধারিত ভাতা দেওয়া হয়৷ চাই সে লেখক যেকোনো ধর্মাবলম্বী হোক৷ হযরতুল উস্তাদকে মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পূর্ব থেকে গভমেন্ট সে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়৷ এরপর থেকে একটা সম্মানী ভাতা প্রদান করা হত৷ প্রতিমাসে ৫০ হাজার রুপি করে হযরতকে সম্মানী দেওয়া হত৷ আমাদের হুযুর সে কাহানি শুনিয়েছেন৷

হযরতের মজলিস

দেওবন্দে একটি সুন্দর নিযাম রয়েছে যে, আসরের পর বিভিন্ন আসাতিযায়ে কেরামের মজলিস হয়৷ ছাত্ররা সেখানে উপস্থিত হয়৷ কোনো কোনো উস্তাদের সাপ্তাহিক মজলিস হয়৷ কারো কারো দৈনিক হয়৷

হযরতুল উস্তাদেরও মজলিস হত৷ প্রতিদিন নিয়মিত আসরের পরে মজলিস হত৷ মজলিসে বেশিরভাগ আমাদের বাংলাদেশি সাথী ভাইয়েরা থাকত৷ ইন্ডিয়ান সাথীরা তুলনামূলক কমই থাকত৷ তবে কখনও কখনও ইন্ডিয়ান সাথীরাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ থাকত৷

আমরা যারা বাংলাদেশি সাথী ছিলাম তারা এসব মজলিসকে গনিমত মনে করে লুপে নিতাম৷ খুব আগ্রহ নিয়ে সবাই উপস্থিত হতাম মজলিসগুলোতে৷ কারণ স্বদেশের উস্তাদগণ দেওবন্দের উস্তাদদের সেই মজলিসগুলো বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতেন৷ দেশে উস্তাদদের থেকে শুনে শুনে মজলিসগুলোর প্রতি একরকম ঐশী মহব্বত তৈরি হয়ে যায়৷ যার ফলে দেখা যায় দেওবন্দে বাঙালি সাথীরা খুঁজে খুঁজে আগ্রহ, উদ্দীপনার সাথে মজলিসগুলোতে শরিক হয়৷

হযরতুল উস্তাদ বর্তমান বাসার দক্ষিণ পাশে নিজের জন্যে একটি কামরা রেখেছিলেন৷ সেখানেই থাকতেন৷ মুতালাআর স্থান, মেহমান খানা সবই ওই কামরাটাই৷ সাদাসিধে একটা রুম৷ কোনো জাঁকজমক নেই৷ কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা ছিল৷

পুরো পরিবার উত্তর দিকে৷ হুযুরের কামরা দক্ষিণ দিকে৷ এ কামরায় মজলিস হত৷ মজলিসের সময় ছিল প্রতিদিন আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত৷ সেখানে ছাত্র, মেহমান সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল৷ রুমটা ছিল খুবই সংকীর্ণ ছোট্ট একটা রুম৷ আরামে বসতে চাইলে হয়তো ১০-১৫জন বসা যাবে৷ কিন্তু ছাত্রদের ভীড়ে দেখা যেত ৩০-৩৫ জনও হয়ে গেছে৷ ঠাসাঠাসি করে বসতে হতো৷ অনেকে জায়গা না পেয়ে ফিরে আসতে হতো৷ আমিও দুয়েকবার ফিরে এসেছি৷ কারণ দরজার বাইরে বসা হুযুরের পক্ষ থেকে নিষেধ ছিল৷

আমি নামায পড়তাম সাধারণত হুযুরের বাড়ির দরজার পূর্বে রাস্তায় অবস্থিত মাসজিদটিতে৷ নামায শেষ করেই হুযুরের বাড়ির দরজায় গেইটের সামনে উপস্থিত হয়ে যেতাম৷ অনেকে আবার হুযুর যে মসজিদে নামায পড়েন ওখানে নামায পড়ে হুযুরের পেছনে পেছনে বাসায় আসত৷ বাসার উত্তর পশ্চিম কোণে একটি মসজিদ আছে সেখানে হুযুর নিয়মিত নামায পড়তেন৷ নামায শেষে হুযুর যখন মসজিদ থেকে বের হতেন তখন পেছনে সাথীদের মোটামুটি বড়সড় একটা বহর থাকত৷ হুযুর বাসার গেইট দিয়ে প্রবেশের পরই সাথীরা প্রবেশ করতে পারবে তাই হুযুরের পেছনে পেছনে সাথীদের একটি জামায়াত থাকত যেন দ্রুত প্রবেশ করা যায়৷ একে অন্যের সাথে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে কোনোরকম প্রবেশ করতে হতো৷ বসতে হতো খুব ছোট জায়গা নিয়ে৷ অনেকে দরজার চৌখাটের উপরেও বসত৷ হুযুর অনেক সময় নিষেধ করতেন৷ বাইরে কেউ বসলে চলে যেতে বলতেন৷

এসময় ছাত্রদের উপস্থিতির পাশাপাশি মেহমানদেরও উপস্থিতির সময়৷ মেহমানরা মুলাকাতের জন্যে এ সময়ে আসতেন৷ তাদের সাথে মুলাকাত, খবরাখবর নেওয়া ও ইলমি মুযাকারা হতো৷ সে মজলিসগুলোতে গভীরভাবে হুযুরকে অবলোকন করার চেষ্টা করতাম৷ কীভাবে হুযুর মুখমণ্ডল নাড়ছেন, কীভাবে কথা বলছেন৷ কীভাবে পান খাচ্ছেন৷ কীভাবে হেলান দিচ্ছেন৷ কীভাবে বসছেন সবই খেয়াল করতাম৷ তন্ময় হয়ে হুযুরের নসিহত, মুযাকারাগুলো শুতনাম৷ সবারই একই অবস্থা ছিল৷ তা ছাড়া হযরতুল উস্তাদ (রহ.)-এর দরসে কিতাব সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন করা ও পার্চা দেওয়া নিষেধ ছিল৷ দরসি, গায়রে দরসি কোনো ইলমি প্রশ্ন করতে হলে আসরের পর বাসার এ মজলিসে করতে হতো৷ তাই আমরা ছাত্ররা পত্রের মাধ্যমে লিখে প্রশ্ন করতাম৷ হুযুর উত্তর দিতেন৷ দরসের বাইরের বিষয়ের প্রশ্ন উম্মুক্ত ছিল৷ শুধু ফিকহী খাস কোনো মাসআলা জিজ্ঞাসা করলে তখন প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে বলতেন,

 یہ مسئلہ دار الافتاء کا ہے۔ جاؤ دار الافتاء میں پوچھو، یہ دار الافتاء تھوڑائی ہے۔

এটি দারুল ইফতার মাসআলা৷ যাও, দারুল ইফাতায় জিজ্ঞাসা করো, এটি দারুল ইফতা নয়।

হযরত প্রশ্নপত্রের ভাষা উরদু হওয়া পছন্দ করতেন৷লেখায় ভুল ও খত অসুন্দর হওয়া অপছন্দ করতেন৷ প্রশ্নপত্রে কেউ যদি উরদু নিয়ম-কানুন ভুল করে বসত তখন হযরত রেগে গিয়ে উত্তর দিতেন না৷একবার আমাদের দেশের এক সাথী তিন লাইনের একটা প্রশ্নে ৬-৭টা ভুল লেখে৷ পত্রটা হুযুর দেখে একপাশে রেখে দিয়ে বললেন,

بھائی یہ پرچہ جس نے دیا ہے، تمہیں اردو نہیں آتی۔ جاؤ پہلے اردو سیکھو، احاطہ مولسری میں عصر کے بعد اردو قواعد و خط سیکھو، میرے یہاں آنے کی ضرورت نہیں۔

আসরের পর এ মজলিসে হযরতুল উস্তাদ অনেক ইলমি বিষয়ে আলোচনা ও মুযাকারা করতেন৷ অনেক বড় বড় হাস্তিরাও এসময়ে এসে ইস্তিফাদা করতেন৷ ছাত্ররা যেমন আসত, উস্তাদগণও আসতেন৷ দারুল উলুম দেওবন্দের উস্তাদরাও এ সময়েই আসতেন, মজলিসে বসতেন৷ হুযুরের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মুযাকারা, মাশওয়ারা করতেন৷ হুযুর নিজের বিশাল ইলমি ঝুলি থেকে কাউকে মাহরুম করতেন না৷ সবাইকে ইস্তিফাদা করার সুযোগ দিতেন৷ আমাদের বছর মালিবাগের হযরত জাফর (হাফি.), ফরিদাবাদের মুফতি আবদুস সালাম (হাফি.) এবং মাদানী নগরের মুহতামিম হযরত ফয়যুল্লাহ (হাফি.)-এর মতো ব্যক্তিরাও এসময়ে মজলিসে হুযুরের সাথে সাক্ষাৎ করে ইস্তিফাদা করতে দেখেছি৷ অবশ্য তাঁদের কেউ কেউ মাগরিবের পরও সুযোগ পেয়েছেন হুযুরের সাথে একান্তে নির্জনে কথা বলার৷ মারকাযুদ দাওয়াহর আমিনতু তালীম, উস্তাদে মুহতারম হযরত আবদুল মালেক (হাফি.)-কেও মাগরিবের পর বিশেষভাবে সময় দিয়েছেন৷ পালনপুরী (রহ.) হযরত আবদুল মালেক (হাফি.)-কে ইস্তিকবালের জন্যে কামরা থেকে বের হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন৷ সাধারণত কখনও হুযুর কারো ইস্তিকবালের জন্য বের হন না৷ বিশেষ জলিলুল কদর ব্যক্তি হলে বের হন৷

হযরত নিজ দেশের খবরাখবরও নিতেন এসময়ে৷ লতিফা পছন্দ করতেন৷ দারুল উলুমের উস্তাদরা মজলিসে আসলে মাঝে মাঝে লতিফা শোনাতেন৷ বিশেষ করে দেওবন্দের উস্তাদ মুফতি ইশতিয়াক (হাফি.) (সিরাজীর শরহ তিরাযীর লিখক, দেওবন্দে আমার সিট তাঁর এরিয়ায় আসামী মনযিলে, ৯৩ নম্বর কারমায় ছিল) হযরতের খুব কাছের মানুষ ছিলেন৷ তিনি অনেক সময় লতিফা শোনাতেন৷ হুযুর কান পেতে শুনতেন৷ মাঝে মাঝে হুযুরও লতিফা বলতেন ও হাসাতেন৷ ছাত্ররা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনত৷

মোটকথা এ মজলিসটাতে দেওবন্দের ছাত্ররা খুব আনন্দে, আগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করত৷ দেওবন্দে অনেক উস্তাদের খাদেম হল বাঙালি সাথীরা৷ ইন্ডিয়ান সাথীরাও আছে৷ তবে বাঙালিরা খুব সহজে কাছে চলে যায়৷ খেদমত করতে জানে৷ কীভাবে মূল্যায়ন করতে হয় তা ভালোভাবে জানে, বুঝে৷ আমাদের বছর হযরতের মজলিসগুলোর মুযাকারা, নসিহতের অনেকটা অংশ লিখে রেখে সংরক্ষণ করেছেন বন্ধুবর ভাই সাঈদ আহমদ, তিনি বর্তমানে মারকাযুদ দাওয়াহ আল-ইসলামিয়া ঢাকায় উলুমুল হাদীস বিভাগে অধ্যয়ন করছেন৷ আল্লাহ তাকে জাযায়ে খায়ের দিন৷

অন্যান্য উস্তাদদের মজলিস

দেওবন্দে সাধারণত আসরের পর নিয়মিত মজলিস হত দুইজন উস্তাদের৷ একজন হযরতুল উস্তাদ মুফতি সাঈদ আহমদ (রহ.) অপরজন হলেন, দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাসিম নুমানী (হাফি.)-এর মজলিস৷ মুহতামিম সাহেবের মজলিস হত মসজিদে কদীমের উপরে দক্ষিণ পাশে দফতরে মুহাসাবির পাশে হযরতের যে কামরা রয়েছে ওখানে৷ এখনও সেখানে প্রতিদিন আসরের পর মজলিস হয়৷ আল্লাহ এ মজলিসকে জারি রাখুন৷ আমাদের সময় প্রতিদিন থানভী (রহ.)-এর কিতাব হুসনুল আযীয থেকে পড়া হত৷ হুযুর বিশ্লেষণ করতেন৷ উপস্থিত ছাত্র, উস্তাদ, মেহমান সকলেই উপকৃত হতেন৷ হযরত বাহরুল উলুম নেয়ামতুল্লাহ আজমী (হাফি.)-এর বিশেষ কোনো মজলিস হত না৷ তবে প্রতি দিন এশার পর হুযুরের বাসায় ছাত্রদের একটা ভীড় থাকত৷ এ সময়ে ছাত্ররা হুযুরের খেদমত করত৷ বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়িল জিজ্ঞাসা করত৷ ইলমি মুযাকারা করতেন৷ মিযাহী (হাসি) কথাবার্তাও বলেন৷

আর কিছু কিছু উস্তাদের মজলিস সপ্তাহে একদিন হত৷ যেমন ইফতার সদর হযরত হাবিবুর রহমান খাইরাবাদী (হাফি.)এর বাসায় প্রতি বৃহস্পতিবার৷ দারুল ইকামার প্রধান হযরত এর বাসায় প্রতি রোববার৷ মাহনামা দারুল উলুমের সম্পাদক হযরত সালমান বিজনূরী (হাফি.)-এর বাসায় প্রতি সোমবার৷ উলুমুল হাদীস বিভাগের উস্তাদ হযরত আবদুল্লাহ মারুফী সাহেবের বাসায় কিছুদিন আসরের পর দরস হয় পরে তা বন্ধ হয়ে যায়৷ তা ছাড়া সপ্তাহে একদিন তিনিও মজলিস করেন৷

মোবাইলে কল রিসিভ করা

সবসময় তিনি ইলমি কাজে ব্যস্ত থাকতেন৷ মোবাইলে কল করার নির্ধারিত সময় ছিল৷ আছর থেকে মাগরিব৷ এ সময়ে চাইলে যে কেউ ফোন করতে পারত৷ খবর নিতে পারত৷ হযরতুল উস্তাদ এ সময় যে কারো কল আসত ধরতেন৷ দেশ-বিদেশের সকলের কল রিসিভ করতেন৷ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, লন্ডন, আমেরিকা রাষ্ট্রগুলো থেকেও এ সময়ে কল আসত৷

জীবনের শেষের দিকে কানে একটু কম শুনতেন৷ জোরে বলা লাগত৷ মোবাইলে আওয়াজ ক্লিয়ার বা কম শোনা গেলে বলতেন,

آرے بھائی! زور سے بولو،آواز نہیں آرہی ہے۔

ভাই একটু জোরে বল৷ কথা শোনা যাচ্ছে না।

হযরতের মুআনাকা

হযরতকে দেখতাম মুআনাকা তাদের সাথেই করতেন যাদের সাথে খুব গভীর বেতাকাল্লুফ সম্পর্ক৷ আমাদের বছর একবার বাংলাদেশ থেকে মালিবাগের শায়খুল হাদীস হযরত জাফর আহমদ (হাফি.) ও তাঁর সাথে আরও একজন দেওবন্দ পড়ুয়া আলিম দেওবন্দ সফরে আসেন৷ পরদিন দরসের পূর্বমুহূর্তে হযরত পালনপুরী (রহ.) গাড়ি থেকে নেমে কুলি করে যখন দরসগাহে যাওয়ার জন্যে ফিরলেন তখন উভয়জন হযরতের নিকট দেখা করতে গেলেন৷ হযরতুল উস্তাদ মালিবাগের জাফর হুযুরকে দেখামাত্রই চিনে ফেললেন৷ মুসাফাহা করলেন৷ সাথে মুসাফাহার পর মুআনাকাও করলেন৷ কিন্তু অপরজন যিনি ছিলেন তার সাথে শুধু মুসাফাহা করেন৷ তিনি মুআনাকা করতে চাইলে হযরত করেন নি৷ তখন হযরত বললেন, মুআনাকা (কোলাকুলি) হল কারো সাথে মহব্বত প্রকাশের শেষ মাধ্যম৷ যার সাথে খুব গভীর সম্পর্ক থাকে কিংবা বেতাকাল্লুফ সম্পর্ক হবে তার সাথে মুআনাকা করা হয়৷ যাদের সাথে আমার বেতাকাল্লুফ বা খুব গভীর সম্পর্ক নেই, তাদের সাথে আমি মুআনাকা (কোলাকুলি) করি না৷ তোমার সাথে তো আমার গভীর সম্পর্ক তো পরের কথা৷ সাধারণ পরিচয়ের সম্পর্কও নেই৷ কীভাবে মুআনাকা করি? একথা বলে দরসে প্রবেশ করেন৷

নিযামের পাবন্দ

হযরতুল উস্তাদ পালনপুরী (রহ.) কানুনী ও উসুলী ছিলেন৷ কানুন ও উসুলের বাইরে কোনো কাজ করতেন না৷ নিযামের খুব পাবন্দ ছিলেন৷ দরসের ঠিক সময়ে এসে উপস্থিত৷ মাদরাসার কোনো প্রোগ্রাম ঠিক সময়ে এসে হাজির৷ আসরের পর মজলিস মাগরিব পর্যন্ত৷ মাগরিবের নিজের ইনফিরাদী তাসনীফে সময় দেন৷ সকাল নয়টার দিকে তাঁর এক নাতি হেদায়তুন্নাহব পড়ে৷ হুযুর প্রতিদিন ঠিক নয়টা বাজে তাকে পড়ান৷ কাউকে কোনো কথা বা সময় দিলে সে কথা বলা ও ঠিক সময়ে তাদের তলব করতেন৷

সফর

হযরতুল উস্তাদ দরস বাদ দিয়ে সফর করতেনই না বললে অতিরিক্ত হবে না৷ হুযুর নিজেই বলতেন, আমার নিকট সবচে গুরুত্ব হল দরসের৷ দরস বাদ দিয়ে আমি কোনো প্রোগ্রাম করি না৷ খুব কমই এমন হয়েছে৷ আমাদের সময় পুরো বছরে দুইবার দরস চলাকালীন সফর করেছেন৷ তিনি দিন মুম্বাইতে একদিন বাংলাদেশে৷ বাংলাদেশে হুযুরের বিশেষ ছাত্র হযরত মুফতি ইয়াহইয়া (হাফি.)-এর এযারপোর্ট মাসনা মাদরাসা উদ্বোধন করতে এসেছিলেন একদিনের সফরে৷ সে সফরে দেওবন্দ থেকে হুযুরের সফর সঙ্গী ছিলেন মালিবাগের শায়খুল হাদীস জাফর আহমদ (হাফি.)৷ তিনি ওই সময় দেওবন্দে সফরে আসেন৷ ঘটনাক্রমে হুযুরের সাথে একই দিন ফ্লাইট মিলে যায়৷ পালনপুরীকে বলে জাফর (হাফি.) সফরে একসাথে বের হওয়ার ইজাযত নিলেন৷ আমরা কয়েকজন সাথী প্রায় রাত বারোটার দিকে জাফর (হাফি.)-এর সব সামান নিয়ে পালনপুরী হুযুরের বাড়ির দরজার মাসজিদে দিয়ে আসি৷ কারণ ফজর পড়েই হযরতুল উস্তাদ সফরে বের হয়ে যাবেন সঙ্গে থাকবেন জাফর (হাফি.) তাই রাতেই সব ব্যবস্থা করে রাখতে হয়েছে৷ সেদিন রাতে পালনপুরী হুযুরের মসজিদেই খাবার গ্রহণ করি৷

ওই বছর সব মিলিয়ে চার, পাঁচ দিনের বেশি সফর করেছেন বলে মনে হয় না৷ কেউ হুযুরকে দাওয়াত করতে আসলে বলতেন আমি দরসের সবক চালু থাকার দিনগুলোতে সফর করি না৷ দাওয়াত দিতে চাইলে বন্ধে দিতে হবে৷ বন্ধে ভালো সফর করতেন৷ সফরে সবসময় সাথে কিতাব রাখেন৷ মুতালাআয় মাশগুল থাকতেন৷

একটি ঘটনা

দেওবন্দের উস্তাদ মাওলানা খুরশিদ আলম গিয়াওয়াবী বলেন,একবার পালনপুরী (রহ.) মুজাফফর নগর থেকে বাসযোগে দেওবন্দ আসছিলেন৷ আমরাও হযরতের সাথে ওই সফরে ছিলাম৷ হযরত পুরো সফর মুতালাআয় মাশগুল ছিলেন৷ যখন দেওবন্দ স্টেশন আসল, হযরত বাস থেকে নেমে কিতাবের থলেতে কিতাবটি রেখে থলেটি কাঁধে করে নিয়ে চলতে লাগলেন৷

হযরত যখনই সফর করতেন সাথে কিতাবের থলে থাকত৷ সেখানে কোনো তাকাল্লুফ থাকত না৷ আমাদের সমাজে তো এমনও মাঝে মাঝে দেখা যায় যে কিতাব নিয়ে পড়ছে অন্যকে দেখার জন্যে৷ হুযুরের মাঝে এসব কিছুই ছিল না৷

সালাম দিতেন সর্বাগ্রে

যেখানেই যেতেন যেকোনো মজলিস, সভা অনুষ্ঠানে যেতেন সর্বপ্রথম উপস্থিতদের সালাম দিতেন৷ দরসেও তার ব্যতিক্রম ছিল না৷ দরসে মসনদের সামনে এসে পৌঁছালে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে উচ্চস্বরে সালাম দিয়ে তারপর মসনদে বসতেন৷

অসরের পর মজলিসে শরীক হওয়ার জন্যে ছাত্ররা হুযুরের বাড়ির গেইটে ভীড় করত৷ হুযুর মাসজিদ থেকে আসার পূর্বে কেউ প্রবেশ করত না৷ গেইটে দাঁড়িয়ে থাকত৷ হুযুর এসে যখন গেইটের সামনে ছাত্রদের একটি জামায়াত দেখতেন সাথে সাথে সালাম দিতেন৷ ছাত্ররাও উত্তর নিত সানন্দে৷

মুসাফাহার দোয়া

হযরত মাসূর দোয়ার প্রতি খুব যত্নবান ছিলেন৷ কেউ দেখা করতে গিয়ে মুসাফাহা করতে হাত বাড়ালে বলতেন,

پہلے دعا پڑھ لو، پھر مصافحہ کر۔

প্রথমে দোয়া পড়ে নাও৷ তোমরা তো দোয়ার স্থানে বলো, কেমন আছেন? দোয়া আর পড়া হয় না৷ দেওবন্দে সর্বশেষ সাক্ষাতের দিন যে দিন লন্ডন সফরে বের হবেন সে দিন যারা দেখা করতে গিয়েছিল সবাইকে প্রথমে দোয়া পড়িয়েছেন তারপর মুসাফাহা করেছেন৷

নিজস্ব মতামত রায়

অনুরূপভাবে তিনি নতুন কোনো বিষয় আসলে প্রথমে কুরআন, সুন্নাহ ও ওই বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের লিখিত কিতাবাদি গভীরভাবে মুতালাআ করতেন (তাকাবুলী)৷ এরপর নিজস্ব মত গ্রহণ করতেন যদি গ্রহণ করার মত হয়৷ হযরত মতের দক্ষতা ও পাকাপুক্ততায় প্রসিদ্ধ ছিলেন৷ যে মত তিনি গ্রহণ করতেন বুঝে শুনে গ্রহণ করতেন৷ মজবুতির সাথে তার ওপর অবিচল থাকতেন৷ তাঁর মতের ওপর সবাই এক না হতে পারে কিন্তু এটা মানুষের একটা সৌন্দর্য যে, খুব জেনে বুঝেই কোনো মত গ্রহণ করবে এবং তার মতে যদি ওই রায় সহীহ মনে হয় তখন মজবুতির তার ওপর অবিচল থাকবে৷ উস্তাদে মুহতারম এমন ছিলেন৷ যেমন হাদীস সুন্নাহ নিয়ে ইখতিলাফের বিষয়ে মজবুত ছিলেন৷ যার বিস্তারিত তুহফাতুল কারীর মুকাদ্দিমায় দেখা যেতে পারে৷

উস্তাদে মুহতারম নিজস্ব মতের ব্যাপারে দরসে মাঝে মাঝে মাসআলার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যে সব ক্ষেত্রে হুযুরের ভিন্ন তাহকীক থাকত তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিতেন এবং সাথে সাথে সে ক্ষেত্রে হুযুরের আমল কী তাও বলে দিতেন৷ হুযুর বলতেন,

دیکھو! اس مسئلے میں میرا اختلاف ہے مگر میرا عمل دار الافتاء جو کہتا ہے اس پر ہے۔

আরও বলতেন,

میری کوئی رائی نہیں، رائی تو دار الافتاء کی ہوتی ہے، میں تھوڑائی دار الافتاء ہوں، میرا عمل دار الافتاء کے فتویٰ پر ہوتا ہے۔

অথচ হুযুরের বেশ কিছু মাসআলাতে নিজস্ব তাহকীক ছিল৷ কিন্তু আমল ছিল দারুল উলুম দেওবন্দের ফতওয়ার ওপর৷ এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি তাহকীক আর আমল একজিনিস হওয়া জরুরি নয়৷ তাহকীক মানেই ফতওয়া হয়ে যায় না৷ তাহকীক ভিন্ন হয়েও আমল অভিন্ন হতে পারে৷

যাদুর কারণে যবান বন্ধ হয়ে যাওয়া

আমাদের দাওরার বছর সাদ হাদা.ও তাবলীগ সংকটের বিষয়টি সামনে আসে৷ দারুল উলুম দেওবন্দে মসনদে হাদীসে যেসব উস্তাদগণ সাদ সাহেবের ভুলগুলো চোখে হাত দিয়ে ধরে দিতেন৷ কঠিন সমালোচনা করতেন তাদের অন্যতম ছিলেন হযরতুল উস্তাদ পালনপুরী (রহ.)৷ তিনি একদম স্পষ্ট করে খুলে খুলে বলতেন এটা গুমরাহি, এটা তাবলীগের উসুলের খেলাফ ইত্যাদি৷ সেই সময় হযরতকে দুইবার সেহের করে যবান বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়৷ হযরত দরসে এসে হাদীস পড়তে চাইলে হঠাৎ করে মধ্যখানে আটকে যান৷ পড়তেই পারেন না৷ এক শব্দও মুখ খুলতে পারেন না৷ আউযুবিল্লাহ পড়ে একটু শুরু করতে চান আবার আটকে যান৷ ছাত্ররা সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ হুযুর সবার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ কোনো কথা বলতে পারছেন না৷ এভাবে এক সপ্তাহ পর্যন্ত হুযুর খুব কষ্টে অতিবাহিত করেন৷ পরে হযরতের ছেলে মাওলানা হুসাইন সাহেব এটা যাদু বুঝতে পেরে মুদাব্বিরের খোঁজ নেন৷ পরে মুদাব্বিরের মাধ্যমে সেহের কাটানো দ্বারা যবান ঠিক হয়৷ এক সপ্তাহ পর আবার আগের মত যবান ফিরে পান৷ দরস করতে পারেন৷ এভাবে আরও একবার হয়৷ পরে আবার ঠিক হয়ে যায়৷ আল-হামদু লিল্লাহ।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ