জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রকৃত ইলম অর্জনের চার মূলনীতি

সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী

ইখলাস-নিষ্ঠা, ধারাবাহিক প্রচেষ্টা, উচ্চ মনোবল, আদব-শিষ্টাচার

প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, প্রকৃত ইলম অর্জনের চার মূলনীতি (ইখলাস-নিষ্ঠা, ধারাবাহিক প্রচেষ্টা, উচ্চ মনোবল, আদব-শিষ্টাচার) সম্পর্কে ভারতের একজন প্রসিদ্ধ আলেম, জামিয়া ইসলামিয়া এশাআতুল উলূম আক্কালকুয়ার সম্মানিত শিক্ষা পরিচালক, হযরত মাওলানা হুজাইফা উস্তানভী (হাফিজাহুল্লাহ) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটি দারুল উলূম দেওবন্দের মুখপাত্র ‘মাহনামায়ে দারুল উলূমে’ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখার গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং বিষয়ের প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য করে শিক্ষার্থীদের উপকারার্থে প্রবন্ধটির অনুবাদ করা হয়েছিল ২০১২ সালে। মাসিক আল-আবরার জুলাই-সেপ্টেম্বও ২০১২-এ ধারাবাহিকভাবে তিন কিস্তিতে প্রকাশ করেছিল। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য লেখাটি প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো। তাই এ সংখ্যা থেকে ধারাবাহিক লেখাটি প্রকাশিত হচ্ছে।—সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী

আল্লাহ তাআলার সেফাত ও বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে একটি হ লো, ইলম। আল্লাহর সত্তা চিরস্থায়ী, তাই তার সিফাতগুলোও চিরস্থায়ী। তার কিছু অংশ আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে দান করেছেন এবং তা দ্বারা মানবজাতিকে উৎকৃষ্ট করেছেন। বরং কারো কারো মতে এই ইলম মানবজাতিরই একমাত্র বৈশিষ্ট্য, তা ‘ইনসানের ফিতরত’ মানবপ্রকৃতির মধ্যে আমানত রাখা হয়েছে, এবং তা দ্বারা অন্য জাতি থেকে পার্থক্য সাধিত হয়। মানবজাতিকে এই ‘ইলম’ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করার উদ্দেশ্য হলো উত্তম চরিত্র, উন্নত বৈশিষ্ট্য, উৎকৃষ্ট আদর্শ সৃষ্টি করা। আল্লাহ তাআলার সত্তার মধ্যে সকল উত্তম বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় হয়েছে। তাই তার ইলম হলো ইলমে মুহীত (ব্যাপক ইলম)। আল্লাহ তাআলা এই সিফাতের বৈশিষ্ট্য মানবজাতির মধ্যে এজন্য রেখেছেন, যেন তারা تخلقوا بأخلاق الله (আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও) হাদীসের ওপর আমল করতে পারে। এবং বান্দা নিজের মধ্যেও পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। হযরত আদম (আ.)-কে যে সকল বৈশিষ্ট্য ও গুণ দান করা হয়েছে তার কারণও একমাত্র ‘ইলম’ই। সুতরাং ইলমের প্রাপ্য হলো, যত ইলম বেশি হবে মানুষ তত বেশি উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবে। নবীগণকে আল্লাহ তাআলা ‘ইলমে অহী’ দান করেছেন। তারা সকল মানুষের জন্য আদর্শ। সাহাবায়ে কেরামও ইলমে ইলাহী ও ইলমে নববীর অন্বেষণে মত্ত ছিলেন; তাই তাদের জীবনে আশ্চর্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাঁরাও আগামী প্রজন্মের জন্য আদর্শ। অতএব বোঝা যায়, ইলমে দীনের মধ্যে পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে অনেক ‘আহলে ইলম’ ওলামায়ে কেরামকেও করুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে দেখা যায়। আমরা এই দুর্দশার কারণ ও উপকরণ সমূহ নির্ণয় করার প্রয়াস পাব। শিক্ষার বর্তমান এই করুণ পরিস্থিতির জন্য নির্দিষ্ট কোনো এক শ্রেণিকে দায়ী করা যায় না। বরং গোটা উম্মত; একাকি বা সামগ্রিকভাবে সকল শ্রেণির মুসলমানকে এর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু অধিক যিম্মাদারি তোলাবা-ছাত্রদেরকে নিতে হবে। তাই আমরা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে সামান্য আলোচনা করছি।

১. ইখলাস-নিষ্ঠা:

সর্বপ্রথম কয়েকটি প্রশ্ন: এক. ইলমী অধঃপতনের কারণ কী? দুই. ছাত্ররা কেন মেহনত করে না? তিন. ইলম অনুপাতে জীবন কেন গড়ে না? চার. ওলামা-তোলাবারা কেন আখেরাতের ফিকির এবং উম্মতের দুঃখে দুঃখিত হয় না? এ সকল প্রশ্নেবর উত্তর নিমিষেই দেওয়া কি সম্ভব? আসুন আমরা আজ তার সামান্য আলোচনা করব। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, এই পৃথিবী ‘দারুল আসবাব’ তথা মাধ্যম দ্বারা অর্জিত হয়। এবং আল্লাহ তাআলা ‘মুসাববিবুল আসবাব’ সকল উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করে থাকেন। তাই ‘কিয়ামত সন্নিকটে, অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, মেহনতে কোনো উপকার হবে না’ এ ধরণের কথা আমাদের অন্তর থেকে মুছে দিতে হবে। উপায়-উপকরণের প্রতি বিশেষ মনোনিবেশ দেওয়া জরুরি। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন,  اِنَّ اللّٰهَ لَا يُضِيْعُ اَجْرَ الْمُحْسِنِيْنَۙ۰۰۱۲۰ (আল্লাহ তাআলা নিষ্ঠার সাথে মেহনতকারীদের মেহনত বিনষ্ট করেন না।)

এখন আপনি একটু চিন্তা করুন, ‘মুহসিনীন’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, ‘মুজতাহিদীন’ বা ‘আমিলীন’ বলেননি। অথবা ‘মুখায়য়ারীন’ ‘সায়ীন’ বা ‘শাগিলীন’ শব্দও প্রয়োগ করেননি। তার কারণ হলো, এই শব্দগুলোর মধ্য থেকে ‘ইহসান’ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবহ ও সর্বমর্মী। কেননা ইহসানের শাব্দিক অর্থ খুব ভালো করা, আর খুব ভালো করার জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা, কাজকর্ম, ব্যস্ততা ও কোশিশের প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় ‘ইহসান’ বলা হয়, ইখলাস ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর জন্য কোনো কাজ আঞ্জাম দেয়া। অতএব, মুহসিনীন মানে, খুব প্রচেষ্টার সাথে একান্ত মেহনত করে কেবলমাত্র আল্লাহকে রাজি করার উদ্দেশ্যে কাজ সম্পাদনকারী। আমরা নিজেদের শিক্ষা বিষয়ক কর্মকাণ্ডের ওপর একটু দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, বাস্তবে কী আমরা ‘মুহসিনীন’-এর অন্তর্ভুক্ত? আমরা কি মেহনত ও প্রচেষ্টা, কোশিশ ও একাগ্রতার মধ্যে লেগে আছি? আমাদের মধ্যে কি ইখলাস ও নিষ্ঠা কাজ করছে? এসব প্রশ্নের নীতিবাচক উত্তরই মিলবে। অধিকাংশ ছাত্রদের নিকট মেহনত ও একাগ্রতার অনুভূতিই নেই। যাদের যৎসামান্যও আছে তারা এই মেহনতের সাথে আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য; নিষ্ঠা, বিনয়, শিষ্টাচার, উত্তম চরিত্র, গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা ইত্যাদি থেকে বহুদূরেঅবস্থান করে। তাই, প্রিয় ছাত্রদের নিকট মিনতির সাথে আরজ করছি, আল্লাহর ওয়াস্তে অলসতাও অবহেলা ছেড়ে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে মেহ নত করে ইলম অর্জনে আত্মনিয়োগ করো। যেন দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হও। সাথে সাথে অহংকার, হিংসা, মিথ্যা কথা এবং মন্দ চরিত্র ও বেয়াদবী (কিতাবের সাথে হোক বা শিক্ষকের সাথে, দরসেগাহের সাথে হোক বা প্রতিষ্ঠানের সাথে) থেকে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে হবে। সারকথা: সর্বপ্রথম করণীয় হলো, ইলম অন্বেষণে ইখলাস বা নিষ্ঠা সৃষ্টি করার জন্য আমাদেরকে এই নিয়্যাতই করতে হবে, আমরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য ইলম অর্জন করছি। إنما الأعمال بالنيات (সকল আমলের নির্ভরশীলতা হলো নিয়তের ওপর)। তখন মেহনত-মুজাহাদার তাওফীকের রাস্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে খুলে যাবে। আমরা বছরের শুরু তেই এই নিয়্যাত করব যে, হে আল্লাহ আমাদের এখানে জমায়েত হওয়ার উদ্দেশ্য ইলম অর্জন করে তার ওপর আমল করা এবং আপনাকে সন্তুষ্ট করা।

২. ধারাবাহিক প্রচেষ্টা:

প্রিয় ছাত্রবন্ধুরা! আপনারা অবশ্যই সাহাবায়ে কিরামের জীবনী পড়েছেন বা শুনেছেন। তাদের জন্য কোনো যিম্মাদার ও পরিদর্শক ছিল না। কিন্তু নিষ্ঠা ছিল। তাই সদা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সান্নিধ্যে থেকে ইলম অর্জন করার তাওফীক প্রাপ্ত হতেন। আপনারা অবশ্যই ‘আসহাবুস সুফফার জীবনী পড়েছেন, তাঁর তো খাদ্য-বস্ত্র ছাড়াও মেহনতে লেগে থাকতেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) তাঁদের মধ্যে একজন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে কিভাবে চমকালেন? তাবেয়ীনের জীবনী অধ্যয়ন করুন, ওই যুগে না ছিল কোনো দরসেগাহ, না ছিল কোনো কামরা। আবাসিক হোস্টেলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পানাহারের জন্যও কোনো হোটেলের ইন্তিজাম ছিল না। এসবের ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে একাগ্রচিত্রে ইলম অর্জন করেছেন। তাঁদের এসব উৎসর্গের কারণে ইসলামের জ্ঞানভাণ্ডার কিতাবের পৃষ্ঠায় দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। তাঁরা যদি আমাদের মতো বিলাসী ও আরামপ্রিয় হতেন তাহলে অবশ্যই আজকের এই ইলমের ভাণ্ডার কখনো সংরক্ষিত হতো না। এসব ধর্মীয় কিতাবাদী ও দীনী মাদারিস সমূহের অস্তিত্ব দেখা যেত না। পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ ধর্মীয় বিষয়ে যত লিখেছেন অন্য কোনো ধর্মে এর নজির নেই। যেমন শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) একটি পৃথক কিতাব লিখেছেন, العلماء العذاب الذين اثروا العلم على الزواج অর্থাৎ ওই সকল ওলামায়ে কেরাম যারা ইলমের জন্য বিয়ে-শাদি পরিত্যাগ করেছেন। যাদের মধ্য থেকে প্রসিদ্ধ ওলামায়ে কেরাম হলেন, ১. হান্নবাদ ইবনে সারি কূফী মুহাদ্দিস ছিলেন। ২. আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরীর তবারী, মুফাসসির ছিলেন। ৩. আবু বকর ইবনুল আনবারী, নাহুবিদ ও মুফাসসির ছিলেন। ৪. আবু আলী আল-ফারেসী, উচ্চমানের নাহুবিদ ছিলেন। ৫. আবু বকর আন্দলুসী, মুহাদ্দিস ছিলেন। ৬. মাহমুদ ইবনে ওমর যমখশরী, মুফাসসির ছিলেন। ৭. মহিউদ্দীন যাকারিয়া আন-নববী, মুহাদ্দিস ছিলেন, এবং মুসলিম শরিফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকারক এবং অসংখ্য কিতাবের লিখক। ৮. আবুল হাসান ইবনু নফ্স দামাশক্বী। ৯. ইবনে তাইমিয়া হারানী, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুফাসসির এবং অসংখ্য কিতাবের লিখক। ১০. ইজদুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে জমায়া মিসরী, ফকীহ ও উসূলে ফিকহের ইমাম ছিলেন। ১১. মুহাম্মদ তোলোন, প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ ছিলেন। ১২. সুলাইমান ইবনে আমরুল জমীল, জালালাইন শরিফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার। ১৩. আবুল মায়ালী মাহমুদ শুকরী আলূসী, অনেক বড় সাহিত্যিক ছিলেন। ১৪. আবুল ওফা আল-আফগানী হিন্দি, ফকীহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন। এ ধরনের অগণিত মনীষী অতিবাহিত হয়েছেন। মহান আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে এ সকল মনীষীদেরকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তাঁরা নিজেদের ধন-সম্পদ, সময় ও জীবন এবং চাওয়া-পাওয়া সব কিছু ইলমের জন্য বিসর্জন দিয়েছেন। আজ আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে এই সম্মান দান করেছেন যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে গেল, অথচ এখনো মুসলমানরা তাঁদের নাম সম্মানের সাথে স্মরণ করেন এবং রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (আল্লাহ আপনার ওপর রহমত নাযিল করুন) বলে দোয়া করে। আমাদের পূর্বাপর ওলামায়ে কেরাম এত কষ্ট ও প্রচেষ্টা এবং মেহনত-মোজাহাদা করেছেন যে, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ জ-এর রচনা صفحات من صبر العلماء على شدائد العلم وتحصيله-এর ভূমিকায় লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, যদি আপনারা আমাদের ওলামায়ে কেরামের জীবন চরিত অনুসন্ধান করে অধ্যয়ন করেন তাহলে বুঝতে পারবেন, তাঁরা কেমন ছিলেন? এবং নিজেদেরকে কিভাবে গঠন করেছেন? তাঁরা তো এমন মানুষ ছিলেন, যাঁরা কেবল মাত্র ইলমের জন্য দূরদূরান্তের সফরে ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণার ওপর ধৈর্যধারণ করেছেন। রাতের বেলায় নিদ্রা ছেড়ে দিয়েছেন এবং নিজেদেরকে ভীষণ কষ্টে নিপতিত করেছেন। এমনকি ইতিহাস তাদের কুরবানীর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে অক্ষম। আমি, আমার লেখনীতে তাদের সকলের আলোচনা গ্রন্থিত করার ইচ্ছুক নই। বরং নমুনা স্বরূপ মুষ্টিমেয় কয়েক জনের কিছু ঘটনা উল্লেখ করব। কেননা তাঁদের কুরবানীর পরিমাণ এত বেশি যে, সবগুলো এখানে বর্ণনা করা দুষ্কর। ইলমের জন্য ধৈর্যের এমন বিস্ময়কর কাহিনী রয়েছে, যা মানুষের অন্তর গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সকল ঘটনাবলি শতভাগ বিশুদ্ধ। কেননা সনদের সাথে নির্ভরযোগ্য কিতাবাদী থেকে বর্ণিত। কিছু বিস্ময়কর কাহিনী আপনার সামনে পেশ করছি, যা আপনার বোধগম্য নাও হতে পারে। কিন্তু এত সহীহ ও সনদবিশিষ্ট বর্ণনা যা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি থেকে বর্ণিত যে, আপনাকে বিশুদ্ধ মানতেই হবে। যেমন অন্যতম মুহাদ্দিস ইমাম আবু দাউদ সুলাইমান ইবনুল আ’শআস আস-সাজাসতানী (রহ.) আপন কিতাব সূনানে আবি দাউদের ‘ক্ষেতের সদকা’ অধ্যায়ে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন যে, আমি মিসরের সফরে একটি মুরগি দেখেছি যে, তার দৈর্ঘ্য তের হাত এবং একটি বিশেষ ফল দেখলাম যে, তা কেটে উটের ওপর এভাবে বিছিয়ে দিয়েছে যে, তার এক অংশ উটের কুঁজের ডান পার্শে এবং অপর অংশ উটের কুঁজের বাম পার্শে বেষ্টন কওে আছে। কেউ কি তার সত্যায়ন করতে পারবে? কিন্তু এমন এক মুহাদ্দিস সাহেব তার বিবরণ দিচ্ছেন যার সততার ওপর উম্মতে মুসলিমার ‘ইজমা’ সংঘটিত হয়েছে। তাই অদ্ভুত মনে করে মেনে নিতে হবে। তেমনি একটি কাহিনী মুহাম্মদ ইবনে রাফে (রহ.) উল্লেখ করেন, যিনি ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযি, ইমাম নাসায়ী, আবু যুরআর মত শীর্ষ মুহাদ্দিসগণের উস্তাদ ও শায়খ ছিলেন। তিনি বলেন, আমি খচ্চর সমপরিমাণ একটি আঙুরের গুচ্ছ দেখেছি। অনুরূপ দশাধিক বিস্ময়কর কাহিনি শায়খ (রহ.) ভূমিকায় লিখেছেন। অতঃপর বলেছেন, যেমনি এসব কাহিনী আশ্চর্যজনক হওয়া সত্ত্বেও মেনে নিতে হয় যে, তা বিশুদ্ধ। তেমনি আমাদের পূর্বসূরি ওলামায়ে কেরাম ইলম অর্জন করতে গিয়ে যে সকল মুসিবতের সম্মুখীন হয়েছেন তার ওপর ধৈর্যধারণের  বিষ্ময়কর কাহিনীগুলোকেও মেনে নিতে হবে।’

ইলম অর্জন করতে গিয়ে পূর্বসূরিদের কুরবানীর কিছু নজির

ইসলাম সর্বপ্রথম ইলমেরই শিক্ষা দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা আদম ঐ-কে ইলম দান করেছেন। নবী করীম (সা.)-এর ওপর সর্ব প্র ম ইলমের ওহী নাযিল হয়েছে। তার প্রভাব এই হলো যে, উম্মতের সকল সদস্য ইলমের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ জ বলেন, আমাদের উত্তরসূরি ওলামায়ে কিরামের অধিকাংশ দারিদ্র্যের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু এই দারিদ্র্য তাদের ইলম অর্জনের জন্য কখনো প্রতিবন্ধক হতো না। তাঁরা কখনো কারো সামনে নিজেদের প্রয়োজন তথা অভাবের কথা প্রকাশ করতেন না। তাঁরা ইলমের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত ভয়ানক ও ধ্বংসাত্মক মুসিবত এবং বিপজ্জনক কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন এবং এমন ধৈর্য ও নিয়ন্ত্রণের প্রকাশ ঘটিয়েছেন যে, তাঁদের শক্তি ও সহনশীলতার সামনে স্বয়ং সবর অস্থির ও বেকরার হয়ে যায়। এই দারিদ্র্য নিয়ে তারা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও প্রশংসায় লিপ্ত থাকতেন। সদা কৃতজ্ঞতা তাদের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ছিল। তাঁদের কুরবানী তাঁদেরকে পৃথিবীতে আলোকিত করেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগন্তুক তালেবে ইলমের জন্য উত্তম আদর্শ স্থাপন করেছে। সবকিছু কেবলমাত্র কুরআন-সুন্নাহর খেদমত ও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য করেছিলেন। তাঁদের কুরবানী দ্বারা এ কথা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোজন ও সংকলন সবুজ-শ্যামল নদীর তীরে অথবা বৃক্ষের ছায়ায় বসে সম্পাদন করা অসম্ভব। বরং এই কাজটি কলিজার তাজা রক্তের বিনিময়ে সম্ভব হয়েছে। এর জন্য অসহনীয় প্রচণ্ড গরমের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। রাতারাতি মিটমিট বাতির নিচে রাত্রজাগরণ করতে হয়েছে। বরং ইলম অর্জন করার রাহে আপন প্রিয় জীবন উৎসর্গ করাকে কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার মনে করতেন না। আসুন, আমরা তাঁদের চেষ্টা-কোশিশ ও মেহনত-মোজাহাদার কিছু দৃষ্টান্ত আলোচনা করি, যেন এই রাস্তার ওপর চলা আমাদের জন্যও সহজ হয়ে যায়।

  1. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) যিনি মুফাসসিরে কুরআন নামে পরিচিত। তিনি কোনো মেহনত ও মোজাহাদা ছাড়া এমনিতেই পবিত্র কুরআনের বড় মুফাসসির হয়ে যাননি। বরং অত্যন্ত মেহনত ও কঠোর পরিশ্রমের পরই মুফাসসির হয়েছেন। তিনি নিজেই বর্ণনা দিচ্ছেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম থেকে জিজ্ঞাসা করতাম, এবং হাদীসের জ্ঞান অর্জন করতাম। আমি কখনো খবর পেতাম যে, অমুক সাহাবীর নিকট হাদীস রয়েছে, ঠিক তখন ই আমি তার বাড়িতে ছুটে যেতাম। সেখানে গিয়ে যদি জানতাম তিনি বিশ্রাম করছেন, তখন আমি চাদর গুটিয়ে তার দরজার সামনে শুয়ে যেতাম। দ্বিপ্রহরের উত্তপ্ত পরিবেশে ধূলিকণা উড়ে আমার ওপর এসে জড়ো হতো। ঘরের মালিক বের হয়ে আমাকে দেখলে আর্শ্চযান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, হে আল্লাহর রসূলের চাচাতো ভাই, আপনি কেন এসেছেন? আপনি কেন এত কষ্ট করেছেন? কাউকে পাঠিয়ে আমাকে কেন ডেকে পাঠাননি? আমি বলতাম, না জনাব, আমাকেই আসতে হবে, অতঃপর আমি তাঁর কাছ থেকে হাদীস জেনে নিতাম। (সবর ওয়া ইসতিকামাত, পৃ. ৫০)
  2. আবদুর রহমান ইবনে কাসেম জ যিনি ইমাম মালেক (রাহ.)-এর অন্যতম শীর্ষ ছিলেন। তিনি কিভাবে এতবড় ফক্বীহ ও মুহাদ্দিস হয়েছেন? কাজী আয়ায (রহ.) তারতীবুল মাদারিক গ্রন্থে আবদুর রহমান ইবনে কাসেম উতাকী (মৃত ১৯১ হি.) সম্পর্কে লিখেন, (স্মরণ রাখা চাই, তিনি ইমাম মালেক এবং লায়স প্রমুখের কৃতী ছাত্র ছিলেন) ইবনে কাসেম বলেন, আমি ইমাম মালেক (রহ.)-এর কাছে রাতের শেষভাগে অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছলাম। কখনো দুইটি, কখনো তিনটি আবার কখনো চারটি মাসআলা জিজ্ঞাসা করতাম। তখন মুহতারাম ইমাম সাহেবের স্বভাব খুবই শান্ত অনুভূত হতো। একদা তাঁর চৌকাঠে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছি। ইমাম মালেক (রহ.) নামাযের জন্য মসজিদে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। কিন্তু অধিক ঘুমের কারণে আমার কোনো খবর ছিল না। চোখ তখন ই খুলল যখন এক কৃষ্ণ দাসী আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, তোমার ‘মুনিব-মালিক’ চলে গেছেন, তিনি তোমার মতো গাফেল থাকেন না। আজ ৪৯ বছর ধরে তিনি সদা ইশার অজু দ্বারা ফজরের নামায আদায় করেন। এই কৃষ্ণ দাসী তাঁকে প্রায়শ ইমাম সাহেবের কাছে আনাগোনা করতে দেখে তাঁর দাস মনে করত।

ইমাম মালেক (রহ.)-এর সুহবত-সংশ্রবে ১৭ বছর:

ইবনে কাসেম বলেন, আমি ইমাম মালেক (রহ.)-এর সংশ্রবে ধারাবাহিকভাবে ১৭ বছর ছিলাম। কিন্তু এই সময়ে আমি কোনো প্রকারের ক্রয়-বিক্রয় করিনি। (বাজারের অলি-গলিতে ঘোরাফেরাকারী ছাত্রভাইরা একটু ভেবে দেখতে পারেন, তিনি সতের বছর পর্যন্ত কোনো ক্রয়-বিক্রয় করেননি)।

পিতা-পুত্রের সাক্ষাৎ:

তিনি বলেন, একদিন আমি তাঁর সুহবতে বসা ছিলাম। হঠাৎ পবিত্র হজব্রত পালনকারী মুখোশপরিহিত এক মিসরী যুবকের আগমন হলো, তিনি ইমাম মালেক (রহ.)-কে সালাম করে জিজ্ঞেস করেন, আপনাদের এখানে ইবনে কাসেম কে? লোকেরা আমার প্রতি ইঙ্গিত করেন। ওই ব্যক্তি আমার পার্শ্বে এসে আমার কপালে চুমু খেলেন। আমি তাতে এক অদ্ভুত সুগন্ধির অনুভব করলাম, কথা দ্বারা তার বিবরণ দেয়া যাবে না। বস্তুত সে ছিল আমার ছেলে। এই সুগন্ধি তার কাছ থেকে বের হচ্ছে। আমি যখন ঘর থেকে বের হলাম তখন সে মায়ের পেটে ছিল। আমি তার মাকে (যিনি আমার স্ত্রী হওয়ার সাথে সাথে আমার চাচাতো বোনও) বলে এসেছিলাম, আমি দীর্ঘদিনের জন্য যাচ্ছি। কখন ফিরব তা জানা নেই। তাই, তোমার জন্য অনুমতি আছে। যদি চাও আমার বিবাহে আবদ্ধ থাকবে, না হয় স্বাধীন হয়ে অন্যত্র চলে যেতে পারবে। কিন্তু ওই আল্লাহর বাঁদী স্বাধীন হওয়ার পরিবর্তে আমার বিবাহে আবদ্ধ থাকলেন। (সবর ওয়া ইস্তিকামত কে পায়কর, পৃ. ৫১-৫২)

৩. মুহাম্মদ ইবনে তাহের মুকাদ্দিসী (রহ.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, হাদীসের ইলম অর্জন করার জন্য প্রচণ্ড গরম ও তীব্র রোদের মধ্যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার কারণে বহুবার রক্ত প্রস্রাব করেছেন।

৪. আবু নসর সঞ্জরী (রহ.)-এর ইলম অর্জনের যমানা: হাফেজ যাহাবী (রহ.) তাযকারাতুল হুফফায গ্রন্থে আবু নসর সঞ্জরী (রহ.)-এর সম্পর্কে লিখেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে সাঈদ ইবনে হাতেম, আবু নসর সঞ্জরী (মৃত: ৪৪৪ হি.) হাদীস শাস্ত্রে ‘হাফেয’-এর মর্যাদা লাভ করেছেন। শুধু এটি নয়, বরং তিনি তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় হাফেজে হাদীস, ইমাম এবং সুন্নতের আলোকবর্তিকা ছিলেন। এই মহান ব্যক্তি হাদীসের জ্ঞান আহরণ করার জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সফর করতেন।

এক মহিলার প্রস্তাব:

আবু ইসহাক হব্বাল (রহ.) বলেন, আমি একদিন আবু নসর সঞ্জরী (রহ.)-এর সুহবতে বসা ছিলাম। কোনো আগন্তুক এসে দরজার কড়া নাড়ল। আমি দরজা খুলে দিলাম। তখন দেখলাম একজন মহিলা ঘরে প্রবেশ করল। সে একশত দিনারের একটি থলে বের করল এবং তা শায়খের সামনে রেখে বলল, এগুলো নিয়ে যেখানে ইচ্ছা খরচ করুন। শায়খ জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার উদ্দেশ্য কী?

তখন সে বলল, ‘আমি চাই, আপনি আমাকে বিয়ে করুন, যদিও আমার বিয়ে-শাদির কোনো প্রয়োজন নেই তবে এভাবে আপনার খেদমত করতে চাই’। তখন শায়খ বলেন, থলে নিয়ে এখান থেকে উঠে যাও। যখন সে চলে গেল, তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি আপন জন্মভূমি সিজিস্থান থেকে শুধুমাত্র ইলম অর্জন করার নিয়্যাতেই ঘর থেকে বের হয়েছি। এখন যদি আমি হই তাহলে আমি আর তালেবে ইলম কিভাবে রইলাম? আল্লাহ তাআলা ইলম অর্জনের যে ছওয়াব রেখেছেন তার ওপর আমি কখনো কোনো বস্তুকে প্রাধান্য দিতে পারি না। (সবর ওয়া ইস্তিকামত কে পায়কর, পৃ. ৪৪)

৫. হাফিয ইবনে মুনদা (রহ.) স্বদেশ থেকে বিশ বছর বয়সে ইলম অর্জন করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেন। এবং ধারাবাহিকভাবে ৪৫ বছর পর্যন্ত সফর করে ইলম অর্জন করেছেন। অতঃপর ৬৫ বছর বয়সে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। যখন ঘর থেকে বের হলেন, তখন মুখে একটি দাড়িও গজেনি। আর যখন প্রত্যাগমন করেন তখন চুল-দাড়ি সব সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু এত সময়ে কত ইলম অর্জন করেছেন? জাফর মুস্তাগফিরী বলেন, আমি হাফেজ আবু আব্দ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে মুন্দা (রহ.) থেকে এক সময় জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কত ইলম অর্জন করলেন? তখন তিনি বলেন, পাঁচ হাজার মণ পরিমাণ, আল্লাহু আকবার!।

৬. ইমাম শাবী ইবনে শুরাহিল কূফী হামদানী (রহ.)-একজন বড় মাপের মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁর কাছে কেউ জানতে চাইলেন, আপনি কিভাবে জ্ঞান অর্জন করেছেন? তখন তিনি বলেন, চারটি বিষয়কে আঁকড়ে ধরার কারণে।

  1. কখনো কোনো কিতাব বা খাতার ওপর ভরসা করিনি, বরং যা শুনেছি সব মুখস্থ করে নিয়েছি।
  2. ইলম অর্জনের জন্য দেশে দেশে সফর করেছি।
  3. জড় পদার্থের ন্যায় ধৈর্যধারণ করেছি, অর্থাৎ জড় পদার্থকে পানাহার দাও বা না দাও, সদা চুপ থাকে। আমিও তৃষ্ণা-ক্ষুধায় ধৈর্যধারণ করতাম।
  4. কাকের মতো সকাল সকাল ওঠে যেতাম, অর্থাৎ খুবই অল্প ঘুমাতাম। তাই আমি এই ইলমের অধিকারী হয়েছি।

তিন. সর্বোচ্চ মনোবল:

প্রিয় তালেবে ইলম বন্ধুরা! এগুলো ছিল আমাদের পূর্বসূরি ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টান্তহীন চেষ্টা ও মুজাহাদা। তাই বোঝা যায় ইলম অর্জন করার জন্য ধারাবাহিক মেহনত ও সর্বোচ্চ মনোবল প্রয়োজন। আল্লামা যুরনূজী (রহ.) বলেন, যদি খুবই মেহনত হলো কিন্তু উচ্চ মনোবল না থাকে তখনো বেশি ইলম অর্জন করা যাবে না। সাহস তো আছে তবে যদি মেহনত না থাকে তখনো ইলম অর্জন করা সম্ভব নয়। বর্তমানে আমাদের ছাত্রদের কাছে এই মহামারি ছড়িয়ে আছে যে, তাদের কাছে মেহনতের জযবা ও আবেগ নেই। যদি মেহনতের জযবা আসে তবে উচ্চ মনোবল নেই, অর্থাৎ কোনো কিতাবকে যখন মেহনতের পর বুঝে না আসে তখন জটিল মনে করে নিরাশ হয়ে পড়ে। এটি অনেক বড় ভুল। যেমন আমরা আমাদের আসলাফদেরও মেহনত-মোজাহাদার ওপর কয়েকটি বিস্ময়কর কাহিনী উল্লেখ করেছি তেমনি তাদের উচ্চ মনোবলের দু-একটি উদাহরণ নমুনা স্বরূপ পেশ করছি। ইমাম ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেন, আমি ছাত্রদের ওপর আর্শ্চযান্বিত, তারা তো নিজেরাই অবলোকন করছে যে, প্রত্যেক মূল্যবান বস্তু অর্জন করার জন্য উচ্চ মনোবল ও চেষ্টা-কোশিশের প্রয়োজন। কিন্তু ইলম সম্পর্কে তারা মনে করে তা এমনে এমনি অর্জিত হয়ে যাবে। এটি কী করে সম্ভব? যেহেতু ইলম হলো পৃথিবীর সকল বস্তুর চেয়ে বেশি মূল্যবান। একটু ভেবে দেখুন, তার জন্য কত সাহস ও মেহনতের প্রয়োজন! ধারাবাহিক মেহনত ও লাগাতার তাকরার এবং আরাম ও বিলাসিতা পরিত্যাগ করলেই ইলম অর্জিত হয়। একজন ফকীহ বলেন, আমি এক যুগ ধরে ‘হারিসা’ (আরবের এক প্রকার সুস্বাদু খাবার) খাওয়ার ইচ্ছা করেছিলাম, কিন্তু কখনো খেতে পারিনি। কেননা তখন ‘হারিসা’ বাজারে বিক্রি হতো। বাজারে গেলে দরস ছুটে যাবে, তাই যায়নি। কারণ কখনো আমি দরস পরিত্যাগ করাকে পছন্দ করতাম না। ইবনে কসীর (রহ.) বলেন, শরীরের আরামের সাথে ইলম অর্জন করা কখনো সম্ভব নয়। ইমাম মযানী (রহ.) বলেন, কেউ ইমাম শাফিয়ী (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি ইলম অর্জন করে কেমন তৃপ্তি পান? তিনি বলেন, যখন আমি কোনো নতুন জ্ঞানের দিক উম্মোচন করি, বা নতুন কোন ইলমী কথা শ্রবণ করি তখন আমি এত আনন্দিত হই এবং স্বাদ পাই, মনে চায় আমার শরীরের সকল অঙ্গেও যদি শ্রবণশক্তি থাকত তাহলে প্রত্যেক অঙ্গই এই স্বাদ গ্রহণ করত। অতঃপর কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি ইলমের প্রতি কী পরিমাণ লোভ করেন? আপনি কি এত পরিমাণ লোভ করেন যে পরিমাণ কোনো সম্পদ লোভী মানুষ সম্পদের প্রতি লোভী হয়ে থাকে? অতঃপর জিজ্ঞাসা করেন, আপনার ইলম অর্জন করার পদ্ধতি কী? তখন তিনি বলেন, ওই সন্তানহারা মায়ের মত যিনি তার সন্তানের তালাশে কোনো অনিষ্টের পরোয়া করে না। ইমাম শাবী (রহ.) বলেন, আমি ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে ইবরাহীম হারাবীর পাশে পঁচিশ বছর অবস্থান করেছি। ইলমে নাহুর ইমাম, খলীল ফরাহেদী (রহ.) বলেন, ওই সময়টি আমার জন্য খুবই কষ্টকর যে সময়টি আমি পানাহাওে ব্যয় করি। কেননা তাতে কোনো ইলম অর্জন করা যায় না। আম্মার ইবনে রজা (রহ.) বলেন, ত্রিশ বছর পর্যন্ত আমি নিজের হাতে খানা খেতে পারিনি। আমি হাদীস লিখতাম আর আমার বোন আমাকে লোকমা বানিয়ে খাইয়ে দিতেন।

বাকী ইবনে মাখলাদের বিস্ময়কর কাহিনী:

এটি এমন এক ইলম পাগলের ঘটনা যিনি সুদূর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সহস্র মাইল পায়ে হেঁটে সফর করেছেন। কেবল মাত্র এই উদ্দেশ্যে যে, সেখানে মুসলমানদের একজন প্রসিদ্ধ বড় আলেম আছেন, তার সুহবত-সান্নিধ্য অর্জন করা এবং তাঁর কাছ থেকে ইলমে হাদীস অর্জন করা। যখন তিনি সেখানে পৌঁছলেন তখন শুনতে পেলেন, সরকার কর্তৃক তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে যে, তিনি কাউকে শিক্ষা-দীক্ষা দিতে পারবেন না। এবং তাঁর সাথে দেখা-সাক্ষাৎও কেউ করতে পারবে না। কিন্তু এই লোক ইলমের পাগল ও প্রকৃত ইলম অর্জনকারী ছিলেন, তিনি ইলম অর্জনের এমন পন্থা অবলম্বন করেন যে, তার কল্পনা করাও সাধারণ মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য।

বাকী ইবনে মাখলাদের হেঁটে বাগদাদ সফর:

জ্ঞানের অঙ্গনের ঐতিহাসিক রচনা মানহাজে আহমদ ফি তারাজীমি আসহাবে ইমাম আহমদ গ্রন্থে ইমাম বাকী ইবনে মাখলাদ আন্দলুসী (রহ.)-এর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেন, হাফিযে হাদীস আবু আবদুর রহমান বাকী ইবনে মাখলাদ আন্দালুসী (রহ.) ২০১ হিজরীতে জন্মলাভ করেন, তিনি স্পেন থেকে বাগদাদ পর্যন্ত হেঁটে সফর করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের খেদমতে হাজির হয়ে ইলমে হাদীস অর্জন করা।

ভয়ানক সংবাদ:

স্বয়ং তিনি বলেন, যখন আমি বাগদাদেও কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন ওই পরীক্ষা ও বিপদের সংবাদ পেলাম যা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর ওপর চেপে বসে ছিল। এবং জানতে পারলাম তাঁর কাছ থেকে হাদীস শ্রবণ করা বা তাঁর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই সংবাদ পেয়ে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত হলাম। আমি সেখানেই থেমে গেলাম। আসবাবপত্র মুসাফিরখানার একটি কামরায় রেখে বাগদাদের একটি আজীমুশশান মসজিদে পৌঁছলাম। আমার ইচ্ছা ছিল যে, মানুষ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সম্পর্কে কী বলে তা খতিয়ে দেখা। এবং তাঁর সম্পর্কে কী কী অভিযোগ করছে? তা জেনে নেওয়া।

এক অপূর্ব দরস:

হঠাৎ সেখানে অত্যন্ত সুন্দর ও সুসজ্জিত দরস দেখলাম। এক ব্যক্তি হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনী আলোচনা করছেন। তিনি কাউকে দুর্বল ও কাউকে শক্তিশালী বলছেন। আমি আমার পাশে লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কে? ওই ব্যক্তি বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন! আমি তাঁর নিকটে একটি খালি জায়গা দেখে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, শায়খ আবু যাকারিয়া! আমি একজন বিদেশি লোক। আমার বাড়ি এখান থেকে অনেক দূওে অবস্থিত। আমি আপনার কাছ থেকে কিছু বিষয় জেনে নিতে চাই, আপনি দয়া করে আমাকে বঞ্চিত করবেন না। তিনি বলেন, কী বলতে চান? বলেন।

কয়েকটি প্রশ্ন:

আমি এমন অনেক মুহাদ্দিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম যাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি কাউকে ঠিক এবং কাউকে বেঠিক বলেছেন। পরিশেষে হিশাম ইবনে আম্মার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর সাথে আমি কয়েক দফা সাক্ষাৎ করেছি। তাঁর কাছ থেকে হাদীসের এক বিশাল ভাণ্ডার রপ্ত করেছি। তিনি তাঁর নাম শুনে বলেন, আবুল ওয়ালিদ হিশাম ইবনে আম্মার, দামেশকের অধিবাসী। অনেক বড় নামাযী এবং সিকা নির্ভরযোগ্য বরং তার চেয়েও ঊর্ধ্বে। আমি এতটুকু বলার পর পরই দরসের অন্যরা চিৎকার দিয়ে উঠল, জনাব সংক্ষিপ্ত করুন। অন্যদেরকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ দিন। আমি দাঁড়িয়ে আরজ করলাম, হযরত! আমি আহমদ ইবনে হাম্বল সম্পর্কে জানতে চাই। এ কথা শুনে ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুঈন আমার দিকে খুবই আর্শ্চযান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, আমার মতো লোকের পক্ষে আহমদ ইবনে হাম্বলের সমালোচনা করা সম্ভব নয়। তিনি তো মুসলমানদের ইমাম, তাদের স্বীকৃত আলেম, জ্ঞান ও গুণের অধিকারী এবং সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ঘরে:

তারপর সেখান থেকে চলে গেলাম এবং জিজ্ঞাসা করতে করতে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর ঘরে পৌঁছলাম। তাঁর দরজার কড়া নাড়লাম। তিনি তাশরীফ আনলেন এবং দরজা খুললেন, তিনি আমার প্রতি দৃষ্টি নিবিষ্ট করলেন। স্পষ্ট কথা আমি তাঁর নিকট একজন অপরিচিত লোক। তাই আমি তাঁকে বললাম, হযরত! আমি একজন বিদেশি লোক, এই শহরে প্রথম দফা এসেছি। হাদীসের অন্বেষণ করা উদ্দেশ্য এবং কেবলমাত্র আপনারই খেদমতে উপস্থিত হওয়ার জন্যই এই সফর। তিনি বলেন, ভেতরে এসো, যেন তোমাকে কেউ দেখতে না পায়।

প্রশ্নোত্তর:

আমি ভেতরে প্রবেশ করতেই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার বাড়ি কোথায়? আমি বললাম, সুদূর প্রাচ্যে। তিনি বলেন, আফ্রিকা? আমি বললাম, আরও অনেক দূরে। আফ্রিকা যেতে আমাদেরকে সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়। আমি আন্দলুসের বাসিন্দা। তিনি বলেন, বাস্তবেই কি তোমার দেশ অনেক দূরে? ঠিক আছে, তোমার উদ্দেশ্য পূরণ করতে যতটুকু সাধ্য-সহযোগিতা করাই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু কী করব? এখন তো বিপদে আছি। হয়ত তুমি জেনেছ। তিনি বলেন, হ্যাঁ। আমি এ ব্যাপারে শহরের নিকটে এসেই জানতে পারি।

আমি ভিক্ষুক হয়ে আসা-যাওয়া করব:

আমি বললাম, আবু আবদুল্লাহ! আমি প্রথম দফা এই শহরে এসেছি। আমাকে কেউ চেনে না। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি প্রতিদিন ফকীরের বেশে আপনার নিকট আসা-যাওয়া করব এবং দরজায় সেই আওয়াজই করব, যা তারা করে থাকে। আপনি তাশরীফ আনবেন। যদি প্রতিদিন একটি করে হাদীস শুনতে পারি তা আমার জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, ঠিক আছে। কিন্তু শর্ত হলো, তুমি মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারবে না। এবং অন্য কোনো মুহাদ্দিসগণের দরসেও যেতে পারবে না। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি তা মঞ্জুর করলাম।

চলবে

ঘোষণা

(সমস্যা নিয়ে আর নয় অস্থিরতা, সমাধানই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা)

শিক্ষার্থী বন্ধুরা, আপনাদের সহযোগিতা ও দিক-নির্দেশনার লক্ষ্যে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার মুখপাত্র, ইসলামী গবেষণা ও সৃজনশীল সাহিত্য পত্রিকা মাসিক আত-তাওহীদে নিয়মিত বিভাগ ‘শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পমার্শ’ চালু করা হয়েছে। উক্ত বিভাগে একদিকে থাকবে আপনাদের জন্য নিয়মিত দিক-নির্দেশনামূলক প্রবন্ধ। অপরদিকে থাকবে আপনাদের সমস্যা-সমধান নিয়ে শিক্ষা পরামর্শ।

অতএব এখন থেকে সমস্যা নিয়ে আর নয় অস্থিরতা, সমাধানই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা’ শ্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাবো উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে। সুতরাং শিক্ষা বিষয়ক যে কোন সমস্যা আমাদের নিকট লিখুন এবং টেনশানমুক্ত জীবন গড়ুন। আমরা আপনার সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকবো এবং অতিদ্রুত সময়ে যথার্থ সমাধান পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহই তাওফীকদাতা।

যোগাযোগের ঠিকানা

বিভাগীয় সম্পাদক

শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগ, মাসিক আত-তাওহীদ

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম

ই-মেইল: hmsalimuddin22@gamil.com

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ