প্রকৃত ইলম অর্জনের চার মূলনীতি
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
পূর্বপ্রকাশিতের পর
আমার কাজ:
মোটকথা, প্রতিদিন হাতে একটি লাকড়ি নিতাম, মাথার ওপর ভিক্ষুকের মতো কাপড়ের পুঁটলি নিতাম। কাগজ ইত্যাদি আস্তিনে রেখে তাঁর দরজায় গিয়ে খোদা বহুত সাদে বাবা বলে আওয়াজ দিতাম। সেখানে এভাবেই ভিক্ষার প্রথা ছিল। তিনি তাশরীফ আনতেন। আর তিনি আমাকে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে কখনো দুইটি কখনো তিনটি হাদীস বা আরও বেশি হাদীস বর্ণনা করতেন। (সবর ওয়া ইস্তিকামত কে পায়কর, পৃ. ১৮১-৮২)
প্রিয়ছাত্র বন্ধুরা! লক্ষ্য করুন, বাকী ইবনে মাখলাদের উচ্চ সাহসিকতা ও উচ্চ আকাক্সক্ষা। সহস্র মাইল হেঁটে সফর করেছেন। এবং ভিখারির বেশে ১৩ বছর পর্যন্ত হাদীস অর্জন করেছেন। তাঁর এই উচ্চ সাহসিকতার কারণে সদা-সর্বদা পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের আসলাফদেরকে উম্মতের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন এবং আমাদেরকে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন।
চার. আদব-শিষ্টাচার:
ধারাবাহিক মেহনত ও উচ্চ সর্বোচ্চ মনোবলের সাথে উস্তাজ, কিতাব এবং ইলমের উপকরণের আদব বজায় রাখা একান্ত কর্তব্য। ইমাম তাবারী (রহ.) বলেন, تواضعوا لمن تعلمون منه যার কাছ থেকে ইলম অর্জন করবে তার সাথে বিনয় ও আদবের সাথে পেশ হবে। হযরত থানভী (রহ.) বলেন, যে পরিমাণ উস্তাদের সাথে মুহাব্বত ও ভালোবাসা হবে ওই পরিমাণ ইলমের মধ্যে বরকত হবে। এটি হলো আল্লাহ তাআলার আদত-অভ্যাস। উস্তাদ সন্তুষ্ট না থাকলে ইলম আসবে না। (ইসলাহে ইনকিলাবে উম্মত) হযরত থানভী (রহ.) এটিও লিখেছেন যে, উস্তাদের সম্মান তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত। যে তাতে অলসতা করবে সে মুত্তাকি হতে পারবে না। অথচ তাকওয়া বৃদ্ধি পাওয়াটা ইলম বৃদ্ধি পাওয়ার সবব।
শিক্ষকদের সম্মান:
প্রত্যেক ছাত্রের জন্য জরুরি যে, সে নিজের শিক্ষক মহোদয়কে অত্যন্ত সম্মান করবে। হযরত মুগীরা (রাযি.) বলেন, আমরা শিক্ষককে এভাবে ভয় করতাম যেমনটি মানুষ বাদশাকে করে থাকে। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যার কাছ থেকে ইলম অর্জন করবে তার সাথে বিনয়ী হবে।
- নিজের শায়খকে সবচেয়ে শীর্ষ মনে করবে। হযরত ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর বাণী, যে উস্তাদের হক আদায় করে না সে কখনো কামিয়াব হবে না।
- সদা উস্তাদের সন্তুষ্টির প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এত বেশি তাঁর পাশে বসেও থাকবে না যেন তাঁর কষ্ট হয়।
- নিজের কর্মকাণ্ড ও পড়াশোনার ব্যাপারে উস্তাদের সাথে পরামর্শ করবে।
- লজ্জায় বা অহংকারের বশীভূত হয়ে নিজের সমবয়সী বা বয়সে ছোট উস্তাদ থেকে ইলম অর্জন থেকে কখনো বিরত থাকবে না। হযরত আসমায়ী (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার লাঞ্ছনা সহ্য করবে না, সে পুরো জীবন লাঞ্ছনা বহন করবে।
- উস্তাদের কঠোরতা সহ্য করবে। (এগুলো আওজাযুল মাসালিকের ভূমিকা থেকে খুব সংক্ষেপে সংকলন করা হয়েছে)
- অত্যন্ত প্রসিদ্ধ অতি প্রয়োজনীয় বাণী, উস্তাদের অসম্মানি দ্বারা ইলমের বরকত থেকে সদা মাহরুম ও বঞ্চিত থাকে। (আপ বীতি: 2/৪৬)
- আল্লাহ তাআলার চিরাচরিত নিয়ম হলো, শিক্ষক মহোদয়কে অসম্মানকারী ব্যক্তি কখনো ইলম দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। যেখানেই কোনো শাস্ত্র পণ্ডিত শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো নীতিমালা লিখেন সেখানে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেন। মুহাদ্দিসীনে কেরাম শিক্ষার্থীদের শিষ্টাচার পৃথক অধ্যায় রচনা করেছেন, যা আজওযা যুল মাসালিকের ভূমিকায় বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে ও এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। ইমাম গাযালী (রহ.) ইয়াহইয়াউল উলুম গ্রন্থে সবিস্তার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেন, শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরি যে, শিক্ষকের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দেয়া, এবং বিলকুল সেভাবে আনুগত্য করবে যেমন কোনো রোগী সদয় ডাক্তারের আনুগত্য স্বীকার করে থাকেন। হযরত আলী গ বলেন, যিনি আমাকে একটি শব্দ শিক্ষা দিয়েছেন আমি তাঁর দাসে পরিণত হলাম। তিনি চাইলে আমাকে বিক্রি করতে পারেন, আবার চাইলে দাস হিসেবে ব্যবহারও করতে পারেন। (ইয়াহইয়াউল ঊলুম, পৃ. ৬০)
- আমার অভিজ্ঞতা হলো, সাধারণ ইংরেজি শিক্ষায় বা জাগতিক শিক্ষায়ও যদি কেউ আপন শিক্ষকের সম্মান ও হক আদায় করেন তিনিও উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি করতে পারেন। বড় বড় পদে সমাসীন হতে পারেন। যে উদ্দেশ্যে তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন তা পরিপূর্ণভাবে ভোগ করতে পারেন এবং যারা পাঠ্যকালীন সময়ে শিক্ষকদের সাথে অহংকার ও গর্বের অচারণ করবে পরবর্তীতে ডিগ্রি অর্জন করেও তাদেরকে সুপারিশের জন্য বিভিন্নজনের দারস্থ হতে হয়। কোথাও কোনো চাকরি পেলেও আপদ-বিপদ লেগেই থাকে। মোটকথা, জ্ঞান যতই হোক না কেন, ওই শাস্ত্রের শিক্ষকমণ্ডলীকে আদব ও সম্মান জানানো ব্যতীত তা দ্বারা উপকৃত হতে পারবে না। তাঁদের বিরোধিতার তো প্রশ্নই আসে না। (ইয়াহইয়াউল ঊলুম: পৃ. ৬১)
- আদাবুদ দুনিয়া ওয়াদ দীন কিতাবে লিখা আছে, শিক্ষার্থীর জন্য উস্তাদকে তোশামোদ করা এবং তাঁর সামনে বিনয়ী হওয়া জরুরি। যদি এই দুইটি কাজ করো, তাহলে উপকৃত হবে। যদি তা পরিত্যাগ করো তাহলে বঞ্চিত হবে। লেখক বলেন, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির অনেক উপকরণ রয়েছে, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো শিক্ষক মহোদয়ের জন্য দোয়া করা। যত বেশি দোয়া করবে তত বেশি স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পাবে। (আদাবুদ দুনিয়া ওয়াদ দীন, পৃ. ২২) দারুল উলুম দেওবন্দের এক ফারেগ স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির কৌশল জানতে চাইলেন, তখন বলেছেন, আপনার সাথে নিজের প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকমণ্ডলীর সাথে যে গভীর সম্পর্ক তাও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার একটি উপকরণ। ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-ইলমের মহাসাগরের মালিক হয়েছেন তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্য থেকে একটি গুরুত্বর্পূণ কারণ হলো, তিনি পুরো জীবনে কখনো নিজের উস্তাদের ঘরের দিকে পা প্রসারিত করেননি। এবং সে দিকে পা দিয়ে কখনো ঘুমাননি। আজকের সমাজ খুবই শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে শায়খ মাদানী (রহ.)-কে স্মরণ করে। তাঁর ইলম ও ফয়জের ধারা অব্যাহতভাবে চলছে। আজ এক সাহেব বলেন, গুজরানোয়ালুতে জামীয়তু শায়খিল ইসলাম দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপানো হচ্ছে। এসব কিছুর কারণ হলো, শায়খ মাদানী (রহ.) নিজের উস্তাদ শায়খুল হিন্দ (রহ.)-এর খেদমত করেছেন। এবং তাঁর সাথে মাল্টার বন্দিশালায় গিয়েছিলেন এবং তাঁর সাথে ছিলেন। সম্ভাব্য সব খেদমত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। (পৃ. ৮১) লেখক বলেন, ইলম অর্জন করতে যদি তিনটি বস্তুর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয় তখন টাট্কা ইলমী যোগ্যতা এবং রূহানী উন্নতির সমৃদ্ধি সাধিত হবে।
১. শিক্ষকের আদব-শিষ্টাচার ২. মসজিদ ও দরসেগাহের আদব ৩. কিতাবের আদব। (পৃ. ১৪১) তিনি বলেন, আদব হলো অন্তরের অবস্থা এবং গোপন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাই ইলম অর্জন করা অবস্থায় শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ উস্তাদের মুহাব্বত অন্তরের মণিকোঠায় স্থান দেবে। তাঁদেরকে মনে-প্রাণে ভালোবাসবে। অথবা এমন কাজ এবং একান্ত মুহাব্বতের প্রকাশ ঘটিয়ে শিক্ষকের অন্তর জয় করবে এবং শিক্ষকের প্রিয় হয়ে যাবে। কিন্তু প্রথম অবস্থা তথা, নিজের উস্তাদের সাথে ইশক-মুহাব্বত এবং ভালোবাসায় দিওয়ানা ও পাগল হওয়া পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। দ্বিতীয় অবস্থাটি অত্যধিক উপকারী। এমন শিক্ষার্থীরা ইলম অর্জন করতে সক্ষম হয়। এবং তাদের ফয়েজও বেশি ছড়ায়। তিনি বলেন, মাতা-পিতার খেদমত করলে হায়াতে বরকত হয়। এবং শিক্ষকদেও খেদমত করলে ইলমে বরকত হয়। উদ্দেশ্য হল, এসব খেদমতের নিজস্ব একেকটি প্রভাব রয়েছে। চিনির নিজস্ব স্বাদ আছে, গুড়ের আছে পৃথক মিষ্টান্নতা এবং মিষ্টির নির্দিষ্ট মজা আছে। যে কোনো খাদ্য বস্তুতে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তার এই প্রভাব ও ফলাফল তাকে নিবিষ্ঠ করে রাখে। সুতরাং মাতা-পিতার খেদমত দ্বারা হায়াত বৃদ্ধি পায় আর শিক্ষকের খেদমত দ্বারা ইলম বৃদ্ধি পায় এবং ইলমের খেদমতের প্রভাব এবং ফলাফল হল মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। (পৃ. ২৫৯) পড়ার জন্য যদি শিক্ষক ধরপাকড় করে তা মন্দ মনে না করা। চেহারায় তার কোনো ভাঁজ যেন না পড়ে এবং বিরক্তিও প্রকাশ করবে না। কেননা তা দ্বারা শিক্ষকের অন্তরে খঠকা লেগে যায়। এবং উপকারের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়। এটি অন্তরের প্রশান্তি ও যোগসূত্রের ওপর নির্ভরশীল। উল্লিখিত উভয় অবস্থায় এই দুই বস্তু নেই। অনেক বড় ও দ্রু উপকারের চাবিকাঠি হলো, যার কাছ থেকে উপকৃত হতে চাই, (সৃষ্টি হোক বা স্রষ্টা) তাঁর সামনে নিজেকে বিলুপ্ত করে দিতে হবে। এবং নিজের সিদ্ধান্ত ও সেচ্ছাচারিতা পরিপূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে হবে। অতঃপর দেখবে কত বেশি উপকার হচ্ছে। এটি অনেক বড় কামাল। যদি কোনো মাসআলায় শিক্ষকের ব্যাখ্যা মনঃপূত না হয় তখন কিছুক্ষণ উপকার হচ্ছে মনে করে হাসিমুখে নিজেই ব্যাখ্যা চিন্তা করবে। তার পরও যদি বুঝে না আসে তখন চুপ থাকবে। এবং মনে মনে বলবে এই বিষয়টি ‘তাহক্বীক’ ও গবেষণা করব। পরবর্তীতে কিতাব বা বড় বড় ওলামায়ে কেরাম থেকে তাহক্বীক করবে। যদি নিজের সিদ্ধান্ত শুদ্ধ হয় এবং উস্তাদ যদি সত্যসন্ধানী হন তখন ওই কিতাব বা বড় আলেমের তাহক্বীক তাঁর সামনে পেশ করবে। যদি উস্তাদের তাহক্বীক বিশুদ্ধ হয় তখন নিজের ভুলের স্বীকার করবে, বলবে হযরত! আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক, আর আমি ভুলের শিকার হয়েছি। শিক্ষকের বিপরীত হঠকারিতা ও হঠধর্মী এবং মুনাজারা ও বিতর্কের অবতারণা কখনো করবে না। অর্থাৎ চোখ রাঙা করবে না, কথাবার্তায় রেগে যাবে না এবং কপালে ভাঁজ ফেলবে না। কারণ বড়দের সামনে এমন করা বেআদবী ও ধৃষ্টতা প্রদর্শনের শামিল। (পৃ. ৪৮-৪৯) তালেবে ইলমের কাছ থেকে যদি শিক্ষকের সাথে বেআদবী, নাফরমানী, অথবা কষ্টদায়ক কোনো আচরণ হয়ে যায়, তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে নিজের ত্রুটি স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নেবে। শব্দের অর্থের সাথে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাও অপারগতা, বিনয় ও লজ্জা প্রকাশ পেতে হবে। যেনতেন লোকদেখানো ক্ষমা চাওয়া যেন না হয়। অন্তরে যদি লজ্জাবোধ হয় তখন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। যদি এটিও না হয় তখন অন্তত কৃত্রিমতা হলেও অবলম্বন করবে। আসল না হলে, অন্তত নকল হলেও করবে। কিন্তু দেরি করবে না। কেননা উস্তাদ যদি দুনিয়াদার হন, তখন দেরি করার দ্বারা তাঁর অন্তরে মলিনতা বৃদ্ধি পাবে, তাতে তোমার ক্ষতি হবে। আর যদি দীনদার হন, তখন মলিনতা ইত্যাদিকে নিজের অন্তরে স্থান দেবেন না।
কেননা তাঁর লক্ষ্য থাকবে, আয়নার মতো অন্তর সদা যেন আয়নার মতোই থাকে। দুঃখ-কষ্টের যাতনা দ্বারা অন্তরকে আহত হতে দেবে না। কেননা তরিকতের মধ্যে অন্তরে শত্রæতা ও হিংসা রাখা কুফরি। কিন্তু স্বভাবজাত কষ্ট এসেই যায়। এবং এটিই তালেবে ইলমের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কেননা এই অবস্থায় অন্তরের প্রশান্তি থাকে না। আর অন্তরের প্রশান্তি ছাড়া উপকৃত হওয়া যায় না এবং দেরী করার মধ্যে আরেকটি ক্ষতি হলো, যত দেরি হবে তত বাঁধা এসে যাবে। (পৃ. ৫১-৫২)
হযরত আকদাস মুফতি রশীদ আহমদ (রহ.)-এর বাণী:
ইলমী যোগ্যতা সাতটি বস্তুর ওপর নির্ভরশীল। ১. অন্তর ২. স্মৃতিশক্তি ৩. মেহনত-প্রচেষ্টা ৪. ইলমের উপকরণ, কিতাব, খাতা, কলম এবং টেবিল ইত্যাদি। ৫. শিক্ষকের সম্মান ৬. দোয়া ৭. নিষিদ্ধ বস্তু পরিত্যাগ করা। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু হলো, নিষিদ্ধ বস্তু পরিত্যাগ করা। কেননা ইলমে দীন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং অনেক বড় নেয়ামত এবং তা এতবড় দৌলত যে, কেবলমাত্র তাকেই প্রদান করা হয়, যে তাঁর প্রত্যেক অবাধ্যতা পরিত্যাগ করে তাঁর সাথে মহাব্বত ও ভালোবাসার প্রমাণ পেশ করবে। (জাওয়াহেরুর রশীদ: 1/১২১)
হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর শিষ্টাচার ও সম্মান প্রদর্শন:
হযরতজী আসাতেজায়ে কিরামের সাথে যতটুকু সম্পর্ক রেখেছিলেন অন্য কারো সাথে এতটুকু সম্পর্ক ছিল না। এতটুকু বলা যায় যে, তাঁর মধ্যে শিক্ষকমণ্ডলীর ‘ইশক’ ছিল। তাই তিনি বলতেন, আমি পড়ার সময় এত বেশি মেহনত করিনি। যা কিছু আল্লাহ তাআলা দান করেছেন তা আসাতেজায়ে কেরাম ও বুযুর্গদের সাথে সদ্ব্যবহার ও মুহাব্বতের সম্পর্ক রাখার কারণেই দান করেছেন। আল-হামদু লিল্লাহ! আমি বলতে পারি যে, আমি কখনো কোনো বুযুর্গকে এক মিনিটের জন্যও অসন্তুষ্ট করিনি। আজো আমার অন্তরে বুযুর্গদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা যত আছে হয়তো কারো অন্তরে এত ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই।
শায়খুল আদব হযরত মাওলানা ই’জাজ আলী (রহ.):
শায়খুল আদব হযরত মাওলানা ই‘জাজ আলী (রহ.) সম্পর্কে অনেকেই বলেছেন, কোনো বিষয় জানতে হলে বা কোনো কিতাবের পাঠ আয়ত্ব করতে হলে নিজের উস্তাদ আল্লামা আনওয়ার শাহ্ কাশ্মিরী (রহ.)-এর ঘরের দরজায় গিয়ে বসে যেতেন। যখন তিনি ঘর থেকে বাইরে যেতেন তখন তা জেনে নিতেন। এটি তার নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল। (আদাবুল মুতাআল্লিমীন, পৃ. ২৭)
হযরত মাওলানা মুনাজের হাসান গিলানী (রহ.):
হযরত মাওলানা মুনাজের হাসান গিলানী (রহ.) আপন শিক্ষকমণ্ডলীকে খুবই ভালোবাসতেন। কঠিন থেকে কঠিন মুহূর্তেও তাঁদের আদেশের বিপরীত করার সাহস দেখাতেন না এবং অজুহাতও তালাশ করতেন না। বরং তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়নের জন্য উপস্থিত হতেন। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের হাত থেকে দেশ স্বাধীন হলো। এর বদৌলতে একটি মুসলিম রাষ্ট্র পৃথিবীর মুখ দেখল। পাকিস্তান নামে নাম করণ করা হলো। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাব্বির আহমদ ওসমানী (রহ.) ইসলামী সংবিধান চালু করার প্রয়াস চালান। এই ইসলামী সংবিধান রচনা করার জন্য অনেক ওলামায়ে কেরামকে করাচিতে জমায়েত করার জন্য চেষ্টা করেন। সেখানে হযরত মাওলানা গিলানী (রহ.)-এর নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন কার অবস্থা বেশি অনুকূলে ছিল না, কিন্তু শিক্ষক মহোদয়ের আদেশের বিপরীত কোনো অজুহাত তালাশ করার সুযোগ নেই। বরং সাথে সাথে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। স্বয়ং মাওলানা সাহেব আল্লামা সুলাইমান নদভী (রহ.)-কে লিখেন, আপনি অংশগ্রহণ করছেন না শুনে আমিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম করাচি যাব না। কিন্তু মাওলানা ওসমানী সাহেবের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক ফোন ও চিঠির কারণে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাকেই শ্রেয় মনে করছি। তাঁর শিষ্য হয়ে আমার অন্তর আমাকে ব্যতিক্রম করার অনুমতি দেয়নি। (হায়াতে গিলানী, পৃ. ২৯৪)
শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল হক (রহ.)-এর ঘটনা:
১. পৃথিবীর অভিজ্ঞতা হলো, কেবলমাত্র কিতাব পড়ে কেউ ইলমের প্রকৃত ফলাফল লাভ বা পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে না, বরং এর জন্য কামিল মুর্শিদের দারস্থ হতে হয়। এবং শিক্ষকের আদব, সম্মানের প্রতি সদা দৃষ্টি রাখতে হবে। বেআদবী ফুয়ুজাত-বরকত হাসিলের পথে বড় প্রতিবন্ধক। হযরত শায়খুল হাদীস (রহ.)-এর অন্তরে শিক্ষকমণ্ডলীর ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং খেদমতের আবেগ সর্বোচ্চভাবে পাওয়া যায়। তাদের খেদমতকে গৌরবের বস্তু মনে করতেন। যদিও তার সহপাঠিরা এ সুযোগকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। যেমন শায়খ (রহ.) নিজেই উল্লেখ করেন, আমি স্বয়ং দেওবন্দে ছিলাম। তালেবে ইলমীর যমানায় হযরত মাদানী (রহ.)-এর নিকট কখনো কখনো খেদমতের জন্য গমন করতাম এবং পা টিপতাম। কিছু কিছু সাথীরা হাসত এবং বলত, এ তো তোষামোদ করছে। কিন্তু এই বুর্যুগদেও নেক তাওয়াজ্জুর ফলাফল হলো, আমার মতো অধম থেকেও আল্লাহ তাআলা কিছু না কিছু দীনের খেদমত নিয়েছেন এবং আরও তাওফীক দিচ্ছেন। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন এমন সাথীও আছে, যারা বর্তমানে এ রাস্তা পরিত্যাগ করেছে। অতএব ইলমের পুরোটা আদবই আদব। দীনের আদব, শিক্ষকের আদব এবং ইলমের আদব। (মাহনামায়ে আল-হক, হযরত মাওলানা আবদুল হক নম্বর: পৃ. ৩৩৪)
ইলমের উপকরণ, কাগজ, কলম, কালির আদব এবং মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রহ.)-এর অবস্থা:
হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রহ.) একদিন বাথরুমে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। ভেতরে গিয়ে দেখতে পেলেন, আংটির কোনায় এক ফোটা কালি লেগে আছে, যা সাধারণত লেখার সময় গতি দেখার জন্য লাগানো হয়। হঠাৎ ভীত হয়ে বাইরে বের হয়ে গেলেন। ধুয়ার পর পুনরায় তাশরীফ নিলেন। তিনি বলেন, এই ফোটার সাথে ইলমের একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ জন্য তা নিয়ে হাম্মামে যাওয়া বেআদবী বোঝা যায়। এটি ছিল হযরতের আদব। যার বরকতে আল্লাহ তাআলা তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। বর্তমানে পত্রপত্রিকায় কুরআনের আয়াত, হাদীস, আল্লাহর নাম থাকা সত্ত্বে অলি-গলি, ডাস্টবিন, যত্রতত্রে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় দেখা যায়, নাউযুবিল্লাহ। বর্তমান বিশ্ব এই ধ্বংস ও দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার মধ্যে বেআদবীর বড় ভূমিকা রয়েছে। (মাজালিসে হাকিমুল উম্মত, পৃ. ২৮১-২৮২)
শব্দ ও অক্ষরের সম্মান:
একটি চামড়ার থলে ছিল। কোনো একনিষ্ঠ খাদিম তা তৈরি করেছেন। ওই চামড়ার মধ্যে ‘মুহাম্মদ আশরাফ আলী’ লেখা ছিল। হযরত থানভী (রহ.) তা এত বেশি সম্মান করতেন যে, যতটুকু সম্ভব নিচে বা যত্রতত্র রাখতেন না। (হুসনুল আযীয: ৪/৩২)
কিতাবের সম্মান:
বর্তমানে মানুষের স্বভাবের মধ্যে আদব বিলকুল নেই। মাওলানা আহমদ আলী সাহারানপূরী (রহ.) লিখেছেন যে, ছাত্রদের জন্য বড় নিন্দনীয় বিষয় হলো, বাম হাতে দীনী কিতাব ও ডান হাতে জুতো নেয়া। কেননা তা আদবের পরিপন্থী এবং বাহ্যত জুতাকে দীনী কিতাবাদীর ওপর প্রাধান্য দেওয়া। (আল-ইফাযাতুল ইয়াওমিয়া: ৯/৩২৫)
কালির সম্মান:
একটি খামে কালি পড়ে গিয়েছিল। সেখানে লিখে দিয়েছিল যে, ‘অনিচ্ছাকৃত কালি পড়ে গিয়েছে।’ কারণ বর্ণনা করেছেন, যেন এমন ধারণা না হয় যে, অবহেলা করে ফেলেছে, যা অসম্মানের অন্তর্ভুক্ত। (আল-ফসল লিল ওসলি) যদি পৃথিবীতে ইজ্জত ও আল্লাহ তাআলাকে সন্তষ্টির প্রত্যাশী হও তাহলে নিজের মধ্যে এই গুণগুলো সৃষ্টি করতে হবে।
১. ইখলাস,
২. অনর্থক কাজ থেকে বেঁচে থাকা,
৩. ইলম অনুপাতে আমল,
৪. সুন্দর চরিত্রকে জীবনের আবশ্যকীয় অংশ বানিয়ে নেয়া।
৫. বিনয় ও নম্রতা নিজের মধ্যে সৃষ্টি করা,
৬. সময়ের মূল্য দেয়া
৭. খেলাধুলা এবং ঘোরাফেরায় নিজের সময় বিনষ্ট করা থেকে মুক্ত থাকা,
৮. রাত-দিন ধারাবাহিকভাবে একেকটি করে মেহনত চালিয়ে যাওয়া,
৯. অধ্যয়নের আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং দীনী কিতাবাদী খুব বেশি অধ্যয়ন করা এবং নিজেকে অধ্যয়নে অভ্যস্ত কওে তোলা, যেন অধ্যয়ন ছাড়া মন স্বস্তি না পায়।
১০. তাকবীরে উলার সাথে নামাযের ইহতিমাম করা। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ১৭ বছর ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর দরসে ফজরের পূর্বে উপস্থিত হতেন। কখনো তাকবীরে উলা ছুটে যেত না। ইমাম আ’মাশ (রহ.)-এর ৭০ বছর পর্যন্ত তাকবীরে উলা ছোটেনি। এরা সকলে আমাদের জন্য আদর্শ।
১১. শিক্ষক, কিতাব, ইলমের উপকরণ এবং মসজিদের খুবই সম্মান করা। ইলমে নাফের আদবের মধ্যে মসজিদের আদবও অন্তর্ভুক্ত। মসজিদে কথা বলার কারণে ইলম থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়।
১২. দৃষ্টিকে হিফাজত করা। কুদৃষ্টির কারণে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়।
১৩. গোনাহ থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত থাকা। কেননা ইলমের নূর গোনাহের কারণে অর্জিত হতে পারে না।
১৪. মিথ্যা কথা থেকে বেঁচে থাকা, কেননা তা কবীরা গোনাহ।
১৫. সদা দরসে উপস্থিত থাকা। কেননা একদিনের অনুপস্থিতিও দরসের বরকত নষ্ট করে দেয়।
১৬. দোয়ার গুরুত্ব দেওয়া। কেননা দোয়ার কারণে রাস্তা খুলে যায়। বিশেষত দোয়ায়ে মাসুরা মুখস্ত করা। কেননা তা আল্লাহর নিকট দ্রুত কবুল হয়।
১৭. সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার ইহতিমাম করা। কেননা তা বরকতের সময়। দুই-চার রাকআত তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করা, অতঃপর পাঠ মুখস্ত করা, ইনশাআল্লাহ অনেক উত্তম কাজ, খুব দ্রুত ইয়াদ হবে।
১৮. বাজারে ঘোরাফেরা না করা। কেননা তাতে মানুষের ওপর শয়তানের প্রভাব বিস্তৃত হয়। যেহেতু বাজার হলো শয়তানের আড্ডা খানা।
১৯. পড়ার সাথে সাথে নিজেকে লেখায় অভ্যস্ত করা। আরবী, বাংলা, উর্দূতে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার অনুশীলন করা। যেন ইলম মানুষের নিকট পৌঁছানো সম্ভব হয়, বিশেষত বর্তমান যুগে তার প্রয়োজন অনেক বেশি।
২০. নাহু, সরফ, ফিকহ, উসূলে ফিকহ প্রভৃতি শাস্ত্রের প্রাথমিক ছাত্ররা বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেবে। এবং সমাপনী ছাত্ররা ফিকহ, হাদীস এবং তাফসীরের প্রতি বিশেষ যত্নবান হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ইলমে নাফে এবং আমলে সালেহের পরিপূর্ণ প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ার তাওফীক দান করুন এবং আল্লাহ তাআলা আমাদের পূর্বসূরি ওলামায়ে কেরামকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমাদের সকলের জন্য ইলমকে নাজাতের উছিলা বানান, যেন তা আমাদের সপক্ষে দলিল হয়, বিপক্ষে নয়। আমীন, ইয়া রব্বাল আলামীন।
ঘোষণা
(সমস্যা নিয়ে আর নয় অস্থিরতা, সমাধানই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা)
শিক্ষার্থী বন্ধুরা, আপনাদের সহযোগিতা ও দিক-নির্দেশনার লক্ষ্যে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার মুখপাত্র, ইসলামী গবেষণা ও সৃজনশীল সাহিত্য পত্রিকা মাসিক আত-তাওহীদে নিয়মিত বিভাগ ‘শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পমার্শ’ চালু করা হয়েছে। উক্ত বিভাগে একদিকে থাকবে আপনাদের জন্য নিয়মিত দিক-নির্দেশনামূলক প্রবন্ধ। অপরদিকে থাকবে আপনাদের সমস্যা-সমধান নিয়ে শিক্ষা পরামর্শ।
অতএব এখন থেকে সমস্যা নিয়ে আর নয় অস্থিরতা, সমাধানই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা’ শ্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাবো উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে। সুতরাং শিক্ষা বিষয়ক যে কোন সমস্যা আমাদের নিকট লিখুন এবং টেনশানমুক্ত জীবন গড়ুন। আমরা আপনার সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকবো এবং অতিদ্রুত সময়ে যথার্থ সমাধান পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহই তাওফীকদাতা।
যোগাযোগের ঠিকানা
বিভাগীয় সম্পাদক
শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগ, মাসিক আত-তাওহীদ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
ই-মেইল: hmsalimuddin22@gamil.com