আল্লামা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.)
দেওবন্দিয়ত কী? তার আলোচানা পাল্টা আলোচনার যেন শেষ নেই। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আলোচনায় আসে বারবার। গত কয়েক দিন আগে উম্মুল মাদারিসখ্যাত ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিসীন হযরত আল্লামা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী দাওরা হাদীসের দরসে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওবন্দিয়ত বিষয়ে আলোচনা করেন। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
হযরত পালনপুরি বলেন, ‘আজ কাল অনেক আলেম জানে না, এমনকি দারুল উলুম দেওবন্দ পড়ুয়ারাও জানে না যে দেওবন্দিয়ত কী? শুনে রাখো, দেওবন্দ তো এক শহরের নাম। সবাই জানে কিন্তু দেওবন্দিয়ত কী আমাদের জানতে হবে।
তিন বস্তুর নাম দেওবন্দিয়ত
এক. ইহয়ায়ে সুন্নাত। তথা সুন্নাত জীবন্ত করণ।
দুই. ইমহাউল বিদআ। যাবতীয় বিদআতের মূলোৎপটন।
তিন. তালাক্কি আনিস সালাফ। সালাফে সালেহিন থেকে (দীনের বিষয়) গ্রহণ করা।
ইহয়ায়ে সুন্নাত
শিরক-বিদআতের উর্বর স্থান উপমহাদেশে তাওহীদ-সুন্নাহর পুনর্জীবনে আসলাফ-আকাবিররা প্রতিষ্ঠিত করেন ‘দেওবন্দিয়ত মিশন’ এবং এ দেওবন্দিয়তে না আছে বাড়াবাড়ি না আছে শিথিলতা। কুরআন-সুন্নাহর মোতাবিক যা হবে তাই দেওবন্দিয়ত, কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কিছুরই স্থান নেই দেওবন্দিয়তে।
ফিকহের মাসায়েল যা সুন্নাহ অনুযায়ী তারই নাম দেওবন্দিয়ত, এজন্য ফিকহের কত মাসায়েল উলামায়ে দেওবন্দ গ্রহণ করেনি। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী হওয়ার কারণে।
ইমহাউল বিদআ
বিদআতের মূলোৎপটন। দেওবন্দিয়তে কোন ধরণের বিদআত-কুসংস্কারের জায়গা নেই। ‘মধ্যপন্থায় থেকে আকাবিররা বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিদআতের আস্ফালন ভেঙে দিতে সক্ষম হোন, কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে আজ আবারো দুই তৃতীয়াংশ বিদআতে গ্রাস হতে চলছে। আমাদের এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
জেনে রাখো! দেওবন্দিয়তের তাসাউফে কুরআন-হাদীস বিরোধী কিছুই নেই। আমাদের আগে নির্ধারণ করতে হবে আমাদের তাসাউফ কার তাসাউফ? হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলান কাসেম নানুতাবী, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীদের না অমুক অমুকের?
হযরত কাসেম নানুতাবী, রশীদ আহমদ গঙ্গুহী হলে দেওবন্দি তাসাউফে কোনো ধরণের অভিযোগ উত্তাপিত হবে না। আর যদি বলি, অমুক-অমুকের তাসাউফ দেওবন্দী তাসাউফ, তাহলে হাজারো অভিযোগ আসবে। যা নিজেদের কিতাবে লেখা আছে। এর জবাব আমাদের দিতে হবে।
তবে অবশ্য আমাদের তাসাউফ হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতাবী, মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গুহীর তাসাউফ। তাঁদের তাসাউফে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কিছুই ছিল না। এটিই দেওবন্দী তাসাউফ।
দেওবন্দ ও বেরলভীদের মাঝে তাসাউফে কী পার্থক্য আছে?
দেওবন্দিয়ত ও বেরলভিয়াতের মধ্য পার্থক্যকারী কয়েকটি মূল বিষয়াদির মধ্য একটি হল ‘তাসাউফ।’ ওরা পীর-মুরীদীকে ফরজ মনে করে, তা তাদের বিনাপুঁজির ব্যবসা পীরকেই মুক্তির মাধ্যম মনে করে। কিন্তু দেওবন্দিরা শুধু ‘মুসতাহাব’ মনে করে। কিন্তু আজ তাসাউফের ক্ষেত্রে অনেক দেওবন্দি দেওবন্দিয়তে নেই। এক্ষেত্রে তারা বেরলভীদের কোলে ওঠে বসে আছে। আজীব, আজ খেলাফত ও মুরীদ বাড়ানোর ধান্ধায়। পীররা দেশ-বিদেশে চাঁদা কালেকশন করে মুরীদদের ফ্রি খাওয়ান, যাতে মুরীদ সংখ্যা বাড়ে! অথচ আমাদের আকাবিররা কখনো ফ্রিতে খাওয়াননি। নিজের ইসলাহ করবে, পীর খাওয়াবে? তা কেমনে?
থানবী (রহ.)-এর খানকায় ১২ মাস লোক থাকত। নিজে খানাপিনার ব্যবস্থা করেননি বরং নিজের পকেটের খেয়ে লোক ইসলাহ করতে আসত। এমনি ‘খিলাফত’ নিয়েও আজ বাড়াবাড়ি চলছে, ভালো মানের এজেন্ট দেখে খিলাফত দেওয়া হয় এবং একই স্লোগান ‘অমুক অমুক সাহেবের খলীফা’ এমনকি অনেকে আমার কাছে মুলাকাতের জন্য আসে। সাথে নিয়ে আসে কাউকে। পরিচয়কারী হিশাবে, সে বলল, তিনি অমুক সাহেবের খলীফা। কিন্তু কোথাকার ফারেগ ইত্যাদি বলে পরিচয়দান করে না। এর মানে কী? অথচ আমাদের আকাবির কাসেম নানুতাবী (রহ.) কাউকে খেলাফত দেননি, রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.) মাত্র ৩/৪ জনকেই খেলাফত দেন। কিন্তু আজ! আকাবিররা কোনো তালেবে ইলমকে বাইয়াত করেননি, কিন্তু আজ মুরীদসংখ্যা বাড়াতে তা অহরহ করা হচ্ছে।
মাযার: দেওবন্দিয়ত ও বেরেওলভিয়াত
দেওবন্দিয়তকে বেরলভীদের থেকে পার্থক্যকারী আরেকটি বিষয় হচ্ছে ‘মাযার।’ ওরা মাযারকেই সবকিছু মনে করে। আউলিয়ায়ে কেরামের পুঁজা করে, সাজদা করে, মানত করে, কবর পাকা করে ইত্যাদি। কিন্তু দেওবন্দিয়তে এসব কিছুই নেই।
আমি যখন দেওবন্দ থেকে পড়া শোনা শেষ করে যাই, কাসিমী কবরস্তানে কোনো কবরে ‘নেমপ্লেট’ ছিল না। কিন্তু ৪/৫ বছর পর যখন উস্তাদ হয়ে আসি, তখন কয়েকটি কবরে প্লেট লেগে যায়। ধীরে ধীরে বহু কবরে লেগে যায়। আজ যত বড় হযরত, তত বড় প্লেট, ধীরে ধীরে আর নতুন কবরের স্থান থাকবে না!
বেরেলীরা সাজদা করে, আমরা মাথা নত করি। অতিশীঘ্রই মাথা জমিনে লাগতে শুরু করবে। আজ হাজারও লোক শুধু মাযারে মাযারে চলছে!
আমার কাছে অনেক আসে, জিজ্ঞাসা করি কেন আসলেন? বলে, যিয়ারতে। বলি, যাও মাযারে, এখানে কী? যিয়ারত তো হয় মৃতদের। জীবিতদের হয় তো মুলাকাত। হাদীসে যে আছে, কবর যিয়ারতে মৃত্যুভয় সৃষ্টি হয়।
এর দ্বারা উদ্দেশ্য বাপ-দাদা আত্নীয়দের কবর যিয়ারত করা। পীর-আওলিয়াদের নয়। নিজের বাপ-দাদার কবরে গেলে তো মৃত্যুভয় হয়। চিন্তাশীল হবে ওই আমার বাবা, দাদা, মা, ভাই শুয়ে আছে, আমিও তো এখানে আসতে হবে। কিন্তু প্রচলিত পীর-ওলীদের কবরে মৃত্যুভয় দূরের কথা, হাসি-আড্ডা ছাড়া আর কী!
একবার মাওলানা সাইয়িদ আসআদ মাদানী কুদ্দিসা সিররুহু আমাকে নিয়ে ‘আজমীর’ গেলেন, আমাকে বললেন, সেখানের অবস্থা দেখে কিছুই বলবেন না। গিয়ে আমরা কিছু সুরা-কালাম পড়লাম। আমি ৫ মিনিট পড়ে আর বরদাস্ত করতে পারিনি। সম্মুখেই লোক সাজদা করছে! কিন্তু মাওলানা নীরব তিলাওয়াত করছেন।
বললাম, মাওলানা ‘ইবনে তায়মিয়া যা বলেছেন, এজন্যই তো’? জবাবে বলেন, ‘বাল হুয়া আশাদ্দু মিনহু।’ আমাদের আকাবিররা মাযারে গিয়ে দূর থেকে কিছু তিলাওয়াত করে আসতেন। কিন্তু আজকের অবস্থা তো খুবই করুণ। কবর যিয়ারতে হাত তুলে দুআ করতে নেই। যদি করতে হয়, কিবলামুখী হয়ে কর।
আমার উস্তাদ আল্লামা ইবরাহীম বলইয়াভী (রহ.)। আমি তাঁর খাদেম ছিলাম। মাঝে মধ্যে বলতেন, চল সাঈদ হযরতুল উস্তাদের (মাদানী) যিয়ারত করে আসি। যেতাম তো হযরত কাসেমী কবরস্তানের গেইটে দাঁড়িয়ে কিছু তিলাওয়াত করে ফিরে আসতেন।
কেন সামনে বাড়েন না? একদিন জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘সাঈদ! উস্তাদজির কাছে যেতে আমার ভয় লাগে।’ একথা তো লোক দেখানো। যেমনি হাতির দেখানোর দাঁত আলাদা। খাওয়ার আলাদা। আসল কারণ হল যিয়ারতের নিয়ম এটাই।
মঞ্জুর নু’মানীর বাণী
হযরত মাওলানা মঞ্জুর নু’মানী (রহ.) (সাবেক সদস্য, মজলিসে শুরা দারুল উলুম দেওবন্দ) যিনি প্রস্তাব দিয়ে আমাকে দেওবন্দে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। গভীর সম্পর্ক ছিল। যিনি সারাটা জীবন বেরেলীদের মুখোশ উন্মোচনে নিজেকে বিলীন করেছিলেন এবং বেরলভী উর্বর ‘রায়বেরেলী’ থেকে মাসিক পত্রিকা ‘আল-ফুরকান’ বের করতেন। আমাকে বলেছিলেন, এখন দেওবন্দ ও বেরেলীদের মধ্য মাত্র আধা হাত পার্থক্য রয়ে গেছে। অতিশীঘ্রই তাও থাকবে না। আমি বলব, এখন কিছু কিছু দেওবন্দি বেরলভীদের একেবারে কাছাকাছি চলে গেছে। তাই দীনের ব্যাপারে খুব সতর্ক হও। প্রকৃত দেওবন্দী হও।
মজলিসে শুরার আবেদন
আমাকে দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিশে শুরা ২বার প্রস্তাব দিয়েছে যে অন্যরা দূরের কথা দারুল উলুমের ফাজিলরাও জানে না যে ‘দেওবন্দিয়ত’ কী? অতএব আপনি এই মর্মে কিতাব লিখুন। আমি অপারগতা করি যে বর্তমানে আমি ‘তাফসীরে হেদায়াতুল কুরআন’ লিখছি। শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য বিষয়ে লিখতে পারব না।
তাদেরকে এ জবাব দিই কিন্তু হাতির দেখানোর দাঁত কিছু, খাওয়ার কিছু! যদি লিখি তাহলে সবাই আমার বিরোধী হয়ে যাবে। তবে ‘লিখব, মরার আগে ছাপব না, যেমনি আবুল কালাম আজাদ পাক-ভারত পৃথকতার নেপথ্যে বিষয়ে বই লিখে ২৫ বছর পর পাবলিশ করতে ওসিয়ত করে ছিলেন। আমিও লিখব, সন্তানদের ওসিয়ত করেছি, যেন মরার পরে ছাপানো হয়।
তালাক্কি মিনাস সালাফ
শুনে রাখ! সালাফ মানে ‘সাহাবা, তাবেঈন ও তবে তাবেঈন। বাকি সবাই খালাফ। অর্থাৎ সালাফ থেকে ক্যাচ বা গ্রহণ করা। যেমনি বল মাটিতে পড়ার আগে ক্যাচ করলে ময়লামুক্ত থাকে। পড়ে গেলে ময়লাযুক্ত হয়ে হাতও ময়লাটে হয়।
তেমনি সালাফদের থেকে যে ঘটনাবলি ময়লামুক্ত সহীহ সনদে আমাদের পর্যন্ত পৌছেছে তাই দলীল। তাই মানার যোগ্য। বাকি সব মশলা মিশ্রিত, মানার যোগ্য নয়। বাকি অলি-বুযুর্গদের যত ঘটনাবলি এর ৫০% বানোয়াট। বাকি ৫০% লবণ-মসলা মিশ্রিতকরা। শুনে রাখ! ঘটনাবলি দ্বারা আকায়ীদ প্রমাণিত হয় না, বরং আকায়িদ নষ্ট হয়। অতএব তোমাদের দেওবন্দিয়ত বুঝে, পড়ে গিয়ে বিদআত-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
সকল সাহাবী নবী (সা.)-এর হাতে ইসলাহী বায়আত হননি। যারা হয়েছেন হাদীসে তাঁদের নামের সাথে উল্লেখ করা আছে। পীর-মুরীদী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে তুহফাতুল কারী ১ম খণ্ড পড়ুন।
উপমহাদেশের মাযার নামক পুঁজামণ্ডপের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী ও তাঁর ৪ সন্তানের কবরও রেহাই পায়নি। এমনকি সেখানের বিশাল কবরস্তানে কোনো জায়গা নেই সবই পাকা। আমি যখন যাই অবস্থা দেখে কাঁদতে থাকি!
এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন, আল-খায়রুল কাসীর শরহে ফাওজুল কবীরের শুরুতে, হযরতুল উস্তাদ মুফতি আমীন পালনপুরী (দা. বা.)-এর লিখিত।
الأجوبة الفاضلة للأسئلة العشرة الكاملة للإمام عبد الحي اللكنو ي رحمه الله تعالى. طبع بتحقيق الشيخ عبد الفتاح أبي غدة الحلبي رحمه الله تعالى من الحلب السوريا.
দেওবন্দিয়ত কী? আরও দেখতে পারেন,
علماء ہند کا شاندار ماضی، میاں صاحب ديوبندی اور جواہرات فاروقی ، شہید ملت ضیاء الرحمن فاروقی علیہما الرحمۃ
সংকলক: ওবায়দুল্লাহ আসআদ