জামেয়া ওয়েবসাইট

শনিবার-৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চীনা গোয়েন্দা কর্মকর্তার তথ্য: উইঘুর মুসলিমদের ভয়াবহ নির্যাতন

শফিকুল ইসলাম শান্ত

 

চীন কীভাবে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালায় তার বর্ণনা দিলেন দেশটির এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। সিএনএনকে দেওয়া দীর্ঘ প্রায় তিন ঘণ্টার এক সাক্ষাৎকারে এসব নির্যাতনের বর্ণনা দেন ওই কর্মকর্তা। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের বাসিন্দা আবদুওয়ালি আইয়ুব (৪৮) পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। নিজের একটি কিন্ডারগার্টেনে ছোট বাচ্চাদের উইঘুর ভাষা শিক্ষা দেন তিনি।

আইয়ুবের অভিযোগ, ২০১৩ সালের ১৯ আগস্ট স্কুলের সামনে থেকে তাকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর কাশগর শহরের একটি ডিটেনশন সেন্টারে তার প্রথম রাত কাটে। এই স্কুলশিক্ষকের অভিযোগ, সেখানে কারারক্ষীদের নির্দেশে ১২ জন বন্দী তাকে গণহারে বলাৎকার করেছেন। নির্যাতনে বমি ও পায়খানা-প্রস্রাব করে দিলেও সারারাত ধরেই তার ওপর এমন পাশবিক নির্যাতন চলে।

নির্যাতনের শিকার আবদুওয়ালি আইয়ুব। গণমাধ্যমকে তিনি ছবি প্রকাশের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। ‘আইয়ুব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থজোগান দিচ্ছেন’, এমন স্বীকারোক্তি আদায়ে তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর বিশেষ শর্তে মুক্তি পান তিনি। এত বছর পরেও সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে বেড়ায় এই স্কুলশিক্ষককে। এদিকে বর্তমানে নেদারল্যান্ডসে বসবাস করছেন ওমির বেখিল। যার বাবা একজন কাজাখ এবং মা উইঘুর সম্প্রদায়ের। সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগে গত ২৬ মার্চ ২০১৭ সালে তাকে আটক করে চীনের নিরাপত্তা বাহিনী। স্বীকারোক্তি আদায়ে ক্যারামে সিটির একটি পুলিশ বেজমেন্টে তার ওপর টানা চারদিন নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বেখিল বলেন, এক ধরনের চেয়ারে (টাইগার চেয়ার) বসিয়ে তাদের পেটানো হতো। পা উপরে বেঁধে, মাথা নিচে ঝুলিয়ে দিয়ে উরু-নিতম্বে পিটিয়ে থেঁতলে দেওয়া হতো। পায়ে সবসময় পরিয়ে রাখা হতো মোটা ও ভারী শেকল। সেই সঙ্গে দুইহাত পেছনে একত্রিত করে আরেকটি শেকল দিয়ে বেঁধে সেভাবেই ঘুমাতে বাধ্য করা হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্দীদের প্রায় কয়েকদিন ঘুমাতেও দেওয়া হতো না। উইঘুর সম্প্রদায়ের এই মুসলিম ব্যবসায়ী বলেন, নির্যাতন ও দীর্ঘ আট মাস কারাভোগের ফলে তার শরীর কঙ্কালসার হয়ে যায়। নির্যাতনে পরিচিত কয়েকজনকে মারা যেতেও দেখেছেন তিনি। নিজে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন জানিয়ে বেখিল বলেন, ‘আমি একজন ধর্মভীরু মানুষ। এমন নির্যাতনের মধ্যেও আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের জোরেই আমি বেঁচে ফিরেছি। আর সেই বিশ্বাসই ছিলো আমার একমাত্র শক্তি।’

আইয়ুব ও বেখিল মাত্র দুটি চরিত্র, যারা জিনজিয়াংয়ে চীনা প্রশাসনের পদ্ধতিগত নির্যাতনের শিকার। প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা অন্তত ১৫ লাখেরও বেশি। যাদের মধ্যে কাউকে স্বেচ্ছাশ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে, আবার কারো ওপর শারীরিক-মানসিক, এমনকি যৌন নির্যাতনও চালানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বারবার অভিযোগ তোলা হলেও বরাবরই বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে দেশটির কমিউনিস্ট সরকার। তাদের পক্ষ থেকে এটাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে মুক্ত রাখতে পুনঃশিক্ষণ কর্মশালা বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে একজন চীনা গোয়ান্দা কর্মকর্তা যিনি নিজে একসময় এ ধরনের নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন তিনি বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া প্রায় তিন ঘণ্টার এক সাক্ষাৎকারে তিনি চীনের গোপন এ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন। বর্তমানে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইউরোপের একটি দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। চীনে তার পরিবারের বাকি সদস্যরা থাকায় তিনি তার নাম-পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেছেন। তবে তার নাম-পরিচয় এবং পদবি সম্পর্কে সিএএন তথ্য সংগ্রহ করে তার পরিচয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। প্রয়োজনে তা আদালতে দেখানো যাবে বলেও আশ্বস্ত করেছে সংবাদমাধ্যমটি।

তবে পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে এখানে তার নাম ‘ঝিয়াং’ হিসেবে ব্যবহার করা হলো। ঝিয়াং বলেন, ‘আমাদের গণহারে আটকের নির্দেশ থাকতো। বিশেষ করে সেটা রাতের বেলায়। কোনো এলাকায় যদি একশজন মানুষ থাকতো, আমাদের ওপর নির্দেশ থাকতে তাদের সবাইকে আটক করা এবং স্বীকারোক্তি আদায় করা। আমরা জানতাম, কোনো এলাকার সবাই বিচ্ছিন্নতাবাদে লিপ্ত হতে পারে না। কিন্তু আমরা কেবল নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন।

ঝিয়াং আরও জানান, ‘স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য প্রায় প্রতিটি বন্দীকে পেটানো হতো। বৃদ্ধ, নারী এমনকি ১৪ বছরের কিশোররাও এ ক্ষেত্রে বাদ পড়তো না।’ ঝিয়াং জানিয়েছন, চীনের নির্যাতন থেকে রেহাই পান না নারী-পুরুষ, কিশোর-বৃদ্ধরাও। নির্যাতনের ধরন বর্ণনা করতে গিয়ে ঝিয়াং বলেন, ‘স্বীকারোক্তি আদায়ে একেকজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য একেকটা পন্থা অবলম্বন করতেন। কেউ বন্দীকে পানিতে ডোবাতেন, কেউ ইলেকট্রিক শক দিতেন, কেউ বিবস্ত্র করে পেটাতেন, কেউ যৌন নির্যাতন করতেন, কেউ বা অন্য বন্দীদের দিয়ে বন্দীদের গণধর্ষণ-বলাৎকার করাতেন। এরপর স্বীকারোক্তি আদায় হলে পরবর্তী পর্যায়ে বন্দীদের ডিটেনশন ক্যাম্প বা কারাগারে রাখা হতো। যেখানে তাদের জোরপূর্বক স্বেচ্ছাশ্রমে বাধ্য করা হতো।’

গতবছরের সেপ্টেম্বরে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। যেখানে একজনকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের দৃশ্য বিশ্ববাসীর নজরে আসে। তবে ভিডিওর সত্যতার বিষয়ে সিএনএন নিশ্চিত হতে না পারলেও নির্যাতনের শিকার মানুষদের বর্ণনা ওই ভিডিওর সঙ্গে মিলে যায়।

ঝিয়াং জানান, ২০১৪ সালে উইঘুর মুসলিমদের দমনে চীন সরকার মূল ভূখণ্ড থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করে। অফিসারদের জানিয়ে দেওয়া হয়- উইঘুররা হলো ‘চীনের শত্রু’, তাই তাদের দমন করতে হবে। সেই লক্ষ্যে পূর্ব থেকে একটি তালিকা তৈরি করা থাকতো। তালিকা অনুযায়ী একেকদিন একেক এলাকায় অভিযান চালিয়ে উইঘুরদের আটক করা হতো। এর বাইরে গ্রাম প্রধানের মাধ্যমে আলোচনায় বসার কথা বলেও গণহারে গ্রেপ্তার করা হতো। আর এর ওপরেই নির্ভর করতো পুলিশের প্রমোশন। ঝিয়াং জানান, পুলিশে ১০ বছর চাকরি করেও প্রমোশন না পেলেও উইঘুর দমনে কাজ করায় স্বল্প সময়েই কয়েকবার প্রমোশন পেয়েছেন তিনি।

কিন্তু বর্তমানে ইউরোপে আশ্রয় নেওয়া এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় পুড়ছেন। তিনি জানান, ‘আমি অনেক নিরপরাধ মানুষকে আটক করেছি, তাদের সীমাহীন নির্যাতন করেছি। অতীতের সেই কৃতকর্ম এখন আমাকে ঘুমাতে দেয় না। আমি দুঃস্বপ্নের কারণে রাতে এক থেকে দুই ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারি না।’ যাদের নির্যাতন করা হয়েছে তাদের কারো সামনে পড়লে কী করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ঝিয়াং বলেন, ‘অনুতপ্ত হবো, পালিয়ে যাবো (ক্ষমা চাওয়ারও দুঃসাহস করবেন না) এবং প্রত্যাশা করব, এমনটা যেন আর কারো সঙ্গে না হয়।’

এদিকে আইয়ুব ও বেখিলও জানিয়েছেন নির্যাতন ও দুঃসহ যন্ত্রণায় তারাও ঘুমাতে পারেন না। কিন্তু যারা তাদের নির্যাতন করেছেন তাদের দোষ দিচ্ছেন না তারা। কারণ নির্যাতনের শিকার এই মানুষগুলো মনে করেন, পুলিশ ও কারারক্ষীরা কেবল নির্দেশ পালন করছেন। এ ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই। মূল অপরাধী চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং এর নীতি নির্ধারণ করা। তাদের নির্দেশেই নিরপরাধ মুসলিমদের ওপর এমন বিভৎস নির্যাতন চালানো হচ্ছে।

এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান গত জুনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে, জিনজিয়াংয়ে তথাকথিত গণহত্যার অভিযোগ একটি অপপ্রচার এবং সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ, যা গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়।’

সম্প্রতি জিনজিয়াং সরকারের কর্মকর্তারা একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। যেখানে একজন ব্যক্তিকে বন্দী বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যিনি বন্দী শিবিরে কোনো ধরনের নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেন এবং এ ধরনের অভিযোগকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেন। তবে তাকে এ ধরনের স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছিলো কি না অথবা কেউ যদি ‘নির্যাতন করা হচ্ছে’ এমন স্বীকারোক্তি দিতো তাহলে তাকে সংবাদ সম্মেলনে আনা হতো কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সমালোচকরা।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ