জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১০ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের পাহাড়ি উপত্যকা

আফগানিস্তানের মাটির নিচে দুর্লভ ‘গুপ্তধন’

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

ক্রমাগত ৩০ বছর যুদ্ধ, সংঘাত, অস্থিরতা ও দুর্নীতির ফলে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। খাদ্য সংকটের মুখে ১ কোটি ৪০ লাখ আফগান নাগরিক। দারিদ্র্যের হার বেড়েই চলেছে। গত তিন বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো খরা দেখা দিয়েছে, এতে ৪০ শতাংশের বেশি ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, ব্যাংকে তারল্যসংকট প্রকট, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখ লাখ আফগান। বিশ্বখাদ্য সংস্থার মতে ৩৪টি প্রদেশের সবগুলোতে ৯৩ শতাংশ পরিবারের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য নেই। গড়পরতা আফগান নাগরিকের দৈনিক উপার্জন ২ ডলারের বেশি নয়। পুষ্টিহীনতায় ভুগছে ৫ বছরের নিচের অর্ধেক শিশু। আসন্ন মওসুমে শীত পড়ার সাথে সাথেই আফগানিস্তানের রাস্তাঘাটগুলো তুষারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এর আগেই খাবারের মজুদ গড়ে তুলতে হবে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশত্যাগ করার সময় এক হেলিকপ্টার ও চারটি গাড়িভর্তি নগদ অর্থ নিয়ে গেছেন। তাজিকিস্তানে আফগান রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জহির আগবার অভিযোগ করে বলেন, ‘সাবেক প্রেসিডেন্ট সাথে করে যে অর্থ নিয়ে গেছেন তার পরিমাণ ১৬ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার।’ এর দুটো কারণ হতে পারে। প্রথমত রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ। এখন তিনি আরব আমিরাতে থাকলেও একসময় হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হবেন সপরিবারে। সেদেশে তার নাগরিকত্ব রয়েছে। দ্বিতীয়ত রাজকোষ শুন্য করে দেওয়া। যাতে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে বেসামাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। মানবসৃষ্ট এই মানবিক বিপর্যয়ের জন্য মূলত দায়ী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক বাহিনী। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন যে মন্তব্য করেন তা বেশ উল্লেখযোগ্য, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখলের প্রথম দিন থেকে সেনা প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত আফগান জনগণের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। কোন উস্কানি ছাড়া সামরিক হস্তক্ষেপ এবং নিজের মূল্যবোধ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যে কী পরিণতি হতে পারে, গত দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তনে যা করেছে সেটি এর বড় উদাহরণ। ক্রমাগত যুদ্ধ ও অস্থিরতার ফলে মাথাপিছু আয় ৫১০ ডলার থেকে বাড়েনি। দেশটিতে কাঙ্খিত পরিমাণের শিল্পায়ন হয়নি। সাম্ররাজ্যবাদী ও আগ্রাসী শক্তি আফগানিস্তানকে স্বনির্ভর হতে দেইনি। বিদেশি সাহায্যের ওপর দেশকে নির্ভরশীল করে ফেলা হয়। দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন দাউদ খান, নুর মুহাম্মদ তারাকি, হাফিজুল্লাহ আমিন, বাবরাক কামাল, নাজিবুল্লাহ, হামিদ কারজাই ও আশরাফ গনি। অনেকে নির্মম পন্থায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রতিপক্ষের হাতে।

কাতারে তালেবানদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক ও চুক্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সৈন্য ও নাগরিকদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯৫০ কোটি ডলারের সম্পদ আটক করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে তালেবানরা সরকার গঠন করলেও নিজ দেশের প্রায় হাজার কোটি ডলারের তহবিল হাতে পাচ্ছেন না। এসব অর্থ নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও ঘোষণা দিয়েছে তারা আফগানিস্তানকে যে হাফ মিলিয়ন ডলার দেয়ার কথা ছিল সেটা তারা বাতিল করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মনোভাবও একই রকম। মার্কিন সৈন্যদের কাবুল ত্যাগের আগে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইক মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন, যদি তালেবান দেশটি দখল করে নেয় এবং শরিয়া আইন প্রবর্তন করে, তবে আমরা এক পয়সাও দেব না। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় প্রতিরোধে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের আহ্বানে সম্প্রতি আফগানিস্তানের জন্য সহযোগিতা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কনফারেন্সটিতে জাতিসংঘ, রেডক্রস ও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই অর্থ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ব্যয় করা হবে। এতদিন বৈরী বহিঃশক্তি সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে আফগানিস্তানকে দুর্বল বানিয়েছে, এখন হাতে নিয়েছে অর্থনৈতিক অস্ত্র। যাতে ইসলামি আমিরাত আফগানিস্তান মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারে। তালেবানের বিরুদ্ধে সরব কিছু যুদ্ধবাজ গ্রুপকে সহায়তা দিয়ে আফগানিস্তানে একটি অস্থিতিশীল আবহ জিইয়ে রাখতে পারে সাম্ররাজ্যবাদী শক্তি। এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তির সাহায্যের গতি রুদ্ধ বা উদ্যোগ থিতিয়ে আসলেও আফগানিস্তানের বড় ধরনের ক্ষতি হবে না। হলেও সাময়িক। আফগানরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ যোদ্ধাজাতি। ক্ষুধা, দরিদ্রতা, অভাব ও বারুদের গন্ধ সেদেশের জনগণের নিত্যসাথী। আফগানিস্তানকে একা ভাবা ঠিক হবে না। পাশে দাঁড়িয়েছে চীন, পাকিস্তান ও রাশিয়া। আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার একমাস আগে, তালেবান বাহিনীর প্রতিনিধিদের সফরের আমন্ত্রণ জানায় চীন। বন্দর নগরী তিয়ানজিনে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে তালেবান প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করে দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় বেইজিং থেকে। তালেবানও মনে করে দেশ পুনর্গঠন এবং বিনিয়োগে চীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইতোমধ্যে চীন ৩ কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থমূল্যের খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া প্রাথমিকভাবে ৩০ লাখ ডোজ করোনাভাইরাস টিকা দেবে চীন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আফগানিস্তানকে সহায়তার জন্য পাকিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তুর্কমিনিস্তানের প্রতি আহ্বান জানান। এই দেশগুলো আফগানিস্তানের প্রতিবেশী এবং চীনের মিত্র হিসেবে পরিচিত। চীনের অর্থায়নে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে নির্মীয়মাণ একহাজার কোটি ডলারের গোয়াদার বন্দর, ভূ-রাজনীতি এবং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের দিক বিবেচনায় চীনের এখানে কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। ইউরেশিয়া অঞ্চল হল চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের প্রধান শরিক। এছাড়া ওয়াখান করিডোর হয়ে স্থলপথে আফগানিস্তানের ওপর দিয়ে ইরান যাওয়ার পরিকল্পনাও আছে চীনের।

তালেবান যদি ১৪টি এথনিক গ্রুপ সমন্বয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন ও পরিচালনায় সফলতা দেখাতে পারে, রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা, সুশাসন ও জননিরাপত্তা ফিরে আসে তবে এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের উত্তোলনযোগ্য যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এগুলোর প্রযুক্তিভিত্তিক সদ্ব্যবহার করার পথ খুলে যাবে। বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসতে আগ্রহী হবেন। তালেবান শাসিত আফগানিস্তান অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মিলনস্থল পার্বত্য এই দেশটিতে খনিজ সম্পদ আফগান অর্থনীতির মেরুদণ্ডে পরিণত হতে পারে আগামী দিনগুলোতে। ২০২০ সালে একটি সাময়িকীতে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) কর্মকর্তা সাইদ মিরজাদ বলেন, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি যদি কয়েক বছরের জন্য শান্ত থাকে, আর এ সময়ে যদি দেশটিতে খনিজ উত্তোলন ব্যবস্থার উন্নতি করা যায়, তাহলে আফগানিস্তান এক দশকের মধ্যে এই অঞ্চলের অন্যতম ধনী দেশে পরিণত হবে। মার্কিন দখলদারিত্বের সময় আফগানিস্তানে প্রতিবছর ১ বিলিয়ন ডলারের খনিজ উত্তোলন করা হত। তবে এই অর্থের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই চলে যেত দুর্নীতিবাজদের দ্বারা গঠিত সিন্ডিকেটের পকেটে। যে কোন মূল্যে তালেবানকে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে। দুষ্প্রাপ্য খনিজ উত্তোলনে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উন্নয়নের অভিজ্ঞতাও আছে চীনের। তালেবান নেতৃত্ব নিশ্চয় চীনের সহায়তা নিতে পিছপা হবে না। চীনও এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করবে না। বৈদেশিক বিনিয়োগকারী ছাড়া আফগানদের পক্ষে একা খনিজসম্পদ আহরণে দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে।

সোভিয়েত ও মার্কিন আক্রমণ এবং তৎপরবর্তী গৃহযুদ্ধের কারণে আফগানিস্তান বিপুল খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। বহু শতাব্দী ধরে আফগানিস্তান দুষ্প্রাপ্য ও অর্ধ-দুষ্প্রাপ্য মৃত্তিকা ও পাথরের একটি উৎসস্থল, যাদের মধ্যে আছে নীলকান্তমণি, চুনি, নীলা, কপার, পান্না, স্ক্যানডিয়াম, ইউটিরিয়াম। কাবুলের ২৫ মাইল দক্ষিণে লগার প্রদেশের মেস এয়াংক খনিতে প্রায় ৬০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কপার মজুদ আছে বলে অনুমান করা হয়। লিজ নিলেও চীন এখানে উত্তোলন শুরু করতে পারেনি নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে। তবে চীন এই মজুদ কোনোভাবে হাতছাড়া করবে না। বৈশ্বিক কপার চাহিদার অর্ধেক এখন তাদের (প্রথম আলো, ১৩ জুলাই ২০২১)। ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপসংস্থার তথ্য মতে, উত্তর আফগানিস্তানে গড়ে ২৯০ শত কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত খনিজ তেল ও ১৫.৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ আছে। আফগানিস্তানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লিথিয়াম রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংস্থা পেন্টাগনের একটি অভ্যন্তরীণ পত্রে বলা হয় যে আফগানিস্তান লিথিয়ামের সৌদি আরবে পরিণত হতে পারে। দূষণহীন যান চলাচলের ব্যাটারি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারির জন্য আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত খনিজ লিথিয়াম মৌল। প্রকৃতিতে দুর্লভ এবং খনি থেকে সেই মৌলের নিষ্কাশনের পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। আর এই খনিজের খনি রয়েছে আফগানিস্তানের মাটির নিচে। এছাড়াও দেশটিতে তামা, সোনা, কয়লা, লোহার আকরিক এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ আছে। হেলমান্দ প্রদেশের খানাশিন এলাকার কার্বোনাটাইট শিলাতে ১ কোটি মেট্রিক টনের মত দুর্লভ ধাতু রয়েছে। আফগানিস্তানের সরকারী কর্মকর্তারা অনুমান করেন যে দেশটির ৩০% অব্যবহৃত খনিজ সম্পদের মূল্য কমপক্ষে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (দি নিউইয়র্ক টাইমস, ১৭ জুন ২০১০)

ইকোলজিক্যাল ফিউচার্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রড শুনোভার জানিয়েছেন, ‘মাটির তলায় কী পরিমাণ ‘গুপ্তধন’ রয়েছে আফগানিস্তানে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের গতিতে রাশ টানতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে সার্বিকভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি পথে নামাতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্য জরুরি লিথিয়াম, তামা, অ্যালুমিনিয়াম ও নিওডিয়াম মৌল। খনিজ লিথিয়াম সবচেয়ে বেশি মজুত রয়েছে এখন লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায়। মার্কিন সরকারের হিসাব বলছে, আফগানিস্তানের লিথিয়ামের পরিমাণ বলিভিয়াকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্বে লিথিয়াম, কোবাল্ট ও নিকেলের মতো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মৌলগুলোর সরবরাহে রয়েছে যে প্রথম তিনটি দেশ (মোট ৭৫ শতাংশ)-চীন, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তানের খনিজভাণ্ডার পাল্লা দিতে পারে তাদের সঙ্গেও। শুধু তাই নয়, একুশ শতকের অর্থনীতির জন্য যেসব ধাতব সম্পদ প্রয়োজন, তার প্রাচুর্য রয়েছে দেশটিতে। এই খনিজগুলো ব্যবহার করে এক দশকের মধ্যেই এশিয়ার এই অঞ্চলের ধনীতম দেশ হয়ে উঠতে পারে আফগানিস্তান’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, অনলাইন ভার্সন, ১৯ আগস্ট ২০২১)

তালেবান সরকারকে মুসলিম বিশ্বসহ গোটা দুনিয়ার সাথে কানেক্টিভিটি বাড়াতে হবে। আধুনিক বিশ্বে একলা চল নীতি অচল। ইসলামের বিধি বিধানের আওতায় অবস্থান করে তালেবানকে উদারতা দেখাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন বিবেচনায় রাখতে হবে। শরিয়াহ আইনে দেশ চলবে, এমন ঘোষণা তালেবান দিয়েছে। পুরো আফগানিস্তানের জনগণ ব্যক্তি ও পারিবারিক পরিসরে শরিয়াহ আইন মেনে চলতে অভ্যস্ত। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শরিয়াহ আইনের বাস্তবায়নে যদি তালেবান ভুল করে বসে অথবা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে গোটা দুনিয়ায় একটি বিরূপ বার্তা যাবে। আফগান জনগণের ধর্ম, সংস্কৃতি ও উত্তরাধিকার ঐতিহ্যের আলোকে দেশ পরিচালিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রভাব অস্বীকার করার জো নেই। পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইলে ১৪টি জাতিগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত আফগানিস্তানের জনগণ তা মানবে না। ন্যায়বিচার, সামাজিক নিরাপত্তা, সুশাসন, নারীশিক্ষা, সংখ্যালঘুর অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখতে হবে অগ্রাধিকারভিত্তিতে। বিভিন্ন দেশ বিশেষত মুসলিম দেশগুলোর সাথে আফগানিস্তান বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে পারে। এতে প্রচুর অর্থ হাতে আসবে। কৃষি ও কৃষি থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশটির অর্থনীতির মূল ভিত্তি। প্রতিবেশী পাকিস্তান, ভারত ও আরব আমিরাতসহ আরও কয়েকটি দেশ তাদের বড় বাণিজ্যিক সহযোগী। ভারতের রফতানি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ আফগানিস্তানের সঙ্গে। ২০১৯-২০ মেয়াদে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ভারত থেকে রপ্তানির মূল্য প্রায় ১০০ কোটি ডলার। ভারতে আফগানিস্তানের রপ্তানি প্রায় ৫০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। দেশের শুকনো ফলের মোট চাহিদার ৮৫ শতাংশ মেটায় আফগানিস্তান। বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সামান্য পরিমাণে বাণিজ্য রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৬ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয় আফগানিস্তানে, যার বেশিরভাগই ওষুধ, মেডিক্যাল সরঞ্জাম, সবজি, টেক্সটাইল ফাইবার, সুতা, পোশাক, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে দেশটি থেকে বাংলাদেশে দুই কোটি ডলার মূল্যের বাদাম, ফল, বস্ত্র শিল্পের উপাদান, প্লাস্টিক ও রাবারজাত পণ্য আমদানি করা হয়।

এক কথায় বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতা কমিয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইলে তালেবানকে আরও দায়িত্বশীল, চৌকস ও কুশলী ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজেদের মধ্যে শিলীভূত ঐক্যের বন্ধন তৈরি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে তালেবানকে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। এই প্রথম পুরো আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান। পাখতুন, তাজিক, উজবেকসহ নানা জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য থেকে উৎসারিত তালেবান জাতীয় সংহতির প্রতীক হয়ে ওঠতে পারে। সময়ের আবর্তে আফগান জাতি অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াবে সে শক্তিমত্তা, ঐশ্বর্য ও সামর্থ্য তাদের আছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ