অপরের মত, পরামর্শ, ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের প্রতি ইসলাম সবসময় শ্রদ্ধাশীল। গঠনমূলক সমালোচনাকে ইসলাম সবসময় স্বাগত জানায়। ভিন্নমতের প্রতি ইসলামের আচরণ সহানুভূতিপূর্ণ কারণ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে সুষ্ঠু সমাজ গঠন ও পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সহিষ্ণুতা নিঃসন্দেহে মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এবং সামাজিক মূল্যবোধ নির্মাণের তাৎপর্যপূর্ণ বুনিয়াদ। অপরের কথা, বক্তব্য, মতামত, পরামর্শ ও জীবনাচার যতই বিরক্তিকর ও আপত্তিকর হোক না কেন তা সহ্য করার মত ধৈর্য ও স্থৈর্য যদি মানুষের মধ্যে না থাকে তা হলে সমাজে নৈরাজ্য, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে বাধ্য। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি বাধাগ্রস্থ হয় তাহলে আধিপত্যবাদ ও স্বৈরাচার সমাজ ও রাষ্ট্রে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
তাই যে জাতি যত বেশি সহনশীল ওই জাতি তত বেশি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও অগ্রসর। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন, আস্থা অর্জন ও সৌহার্দ্য সৃষ্টির জন্য পরমত সহিষ্ণুতার গুণ অপরিহার্য পূর্বশর্ত। পবিত্র কুরআন সহিষ্ণুতার মহৎ গুণটি অর্জনের জন্য জোরালো ভাষায় তাগিদ দিয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও মহান চার খলিফা নিজেদের জীবনে পরের মতামত ও বিশ্বাসের প্রতি নমনীয় ও সহানুভূতিপ্রবণ ছিলেন ইতিহাসে তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে এটা সঠিক তবে সেটাকে বল্গাহীন করেনি কারণ কোন উগ্র মতামত ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য যদি অপরের, দলের, জাতি, গোষ্ঠীর ও ধর্মের অনুভূতিকে আহত করে অথবা সমাজে ফিতনা-ফাসাদের জন্ম দেয় তাহলে তা বর্জনীয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তারা সত্যের আদেশ দেয় এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখে’ (সুরা আত-তাওবা: ৭১; আলে ইমরান: ১০৪)।
উপর্যুক্ত গুণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না। বর্ণিত আয়াতে কেবল উক্ত স্বাধীনতার গ্যারান্টিই নিশ্চিত করে না বরং এই স্বাধীনতাকে ব্যবহার করার পথ ও নির্দেশ করে দেয়। একজন মুসলমান মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কেবল সত্য ও কল্যাণের বিকাশে ব্যবহার করতে পারেন। অসত্য ও অন্যায় প্রচারে এই স্বাধীনতা ব্যবহৃত হতে পারে না কারণ এটা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা অন্যায়ের আদেশ দেয় এবং সত্য ও কল্যাণে বাধা দান করে’ (সুরা আত-তাওবা: ৬৭)। পবিত্র কুরআনে বনী ইসরাইলের পতনের অন্যতম কারণ নির্দেশ করে বলা হয়েছে, ‘তারা যেসব গর্হিত কাজ করতো তা হতে তারা একে অন্যকে বারণ করত না। তারা যা করতো তা কতই না নিকৃষ্ট’ (সুরা আল-মায়িদা: ৭৯)। মহানবী (সা.) বলেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা-ন্যায় কথা বলা উত্তম জিহাদ’ (মুসনদে আহমদ, শায়খ আবু বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২০)।
সমাজে মানুষের ওপর যদি কোনো শাসক নির্যাতন ও জুলুম চালায় তাহলে সে জালিম ও স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার এবং ক্ষুব্ধ মতামত ব্যক্ত করার জন্য ইসলাম জনগণকে অধিকার দিয়েছে। জালিমের জুলুম চোখ বুঝে সহ্য করা যাবে না; জোরালো ভাষায় এর প্রতিবাদ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না তবে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে’ (সুরা আন-নিসা: ১৪৮)।
মন্দ কথা নিতান্ত গর্হিত কাজ কিন্তু জুলুম যখন সীমা লঙ্ঘন করে; ধৈর্যের বাধ যখন ভেঙে যায়; অস্থির অবস্থায় মুখ থেকে জালিমের বিরুদ্ধে যদি কোন বিরূপ মন্তব্য বেরিয়ে আসে তাহলে আল্লাহ নির্দেশিত উন্নত নৈতিক চরিত্রের শিক্ষা সত্তে¡ও শেষ অবস্থায় তা ক্ষমারযোগ্য। মজলুমের এটা অধিকার যে জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখে উচ্চারণ করবে—এটা করতে গিয়ে যদি ভাবাবেগে শালীন ও পরিশীলিত বক্তব্য রাখতে অক্ষম হয় তাহলে তাকে আল্লাহর নিকট এই জন্য কোন জবাবদিহি করতে হবে না (মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, বুনিয়াদী হুকুক, পৃ.২৬৬)।
পরিশেষে আমরা একথা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ইসলাম সবসময় সহিষ্ণু মনোভাব প্রদর্শন করেছে। কারণ সহনশীলতার অভাবে মত প্রকাশ বাধাগ্রস্থ হলে সুষ্ঠু সমাজ বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বিবেকের স্বাধীনতা না থাকলে ব্যক্তি হয়ে পড়ে স্থানু, নিষ্পন্দ ও নির্জীব। চিন্তার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বিবেকের স্বাধীনতা সুশীল সমাজের ও সভ্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব স্বাধীনতা ব্যক্তির সহজাত অধিকার (Natural Rights)। ইসলামে রয়েছে এইসব অধিকারের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণ ব্যক্তির পাঁচটি অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে অপরদিকে ইসলাম মানুষের সতেরটি অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা তন্মধ্যে অন্যতম। ইসলাম ব্যক্তির অধিকারের (Rights) পাশাপাশি নৈতিক বাধ্যবাধকতাকেও (Obligation) সমান গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম মানুষের অধিকার রক্ষার সবচেয়ে বড় ঝান্ডাবাহী।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন