ছাত্রজীবনের সঠিক মূল্যায়ন করে যোগ্যতা অর্জন করুন, আল্লাহ পাক কাজ নেবেন
মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.)
[মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.) ১৩১৪ হিজরী মোতাবেক ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের ‘দেওবন্দ’ নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর ‘মুহাম্মদ শফী’ নামটি ফকীহুন নফস আল্লামা মুফতী রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.) কর্তৃক প্রস্তাবিত। ১৩২৫ হিজরীতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। ১৩৩৬ হিজরীতে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ২১ বছর। ১৩৩৭ হিজরীতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৩৫০ হিজরীতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতীয়ে আযম তথা প্রধান মুফতীর পদে সমাসীন হন। দেশ বিভাগের পর তিনি তাঁর পিতৃভূমি দেওবন্দ ছেড়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখানে তিনি ১৩৭০ হিজরীতে দারুল উলুম করাচি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছোট-বড় প্রায় দেড়শতাধিক বই-পুস্তক রচনা করেছেন। তাঁর বিশ্বখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ ‘মাআরিফুল কুরআন’ বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই মহামনীষী ১৩৯৬ হিজরী সনের শাওয়াল মাসের ১০ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা দোআ করি, আল্লাহ তাআলা যেন তাঁর খেদমতগুলো কবুল করেন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সু-উচ্চ মাকাম দান করেন, আমীন।
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা! আজ আপনাদের সামনে এই মহান ব্যক্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ পেশ করছি, যা তিনি মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রদান করেছিলন। এটি মাসিক আল-কাউসার (নভেম্বর ২০১৪) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রদের জন্য অধিক উপযুক্ত মনে করে মাসিক আত-তাওহীদের শিক্ষার্থীদের পাতায় প্রকাশ করা হলো। মুফতী সাহেব (রহ.)-এর এ ভাষণে ছাত্রদের বহু প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। তাই এ সংখ্যায় অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তর সংযোজন করা হয়নি|—বিভাগীয় সম্পাদক]
মাসনূন খুতবার পর হযরতুল আল্লামা মুফতী শফী (রহ.) বলেন, আমি কী করব! নিয়ত তো ছিল প্রতি সপ্তাহেই আমি আমার তালিবুল ভাইদের নসীহত করব। কিন্তু রোগ-ব্যাধি এবং অন্যান্য চিন্তা ও পেরেশানি একের পর এক লেগেই আছে। একারণে গত তিন সপ্তাহ ধরে উপস্থিত হতে পারিনি। আজ অনেকদিন পর আপনাদের সাথে বসতে পেরেছি। لكل شيء آفة و للعلم آفات একথা শৈশবে কোথায় যেন শুনেছি। এখন স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। প্রতিবন্ধকতা তো সব কাজেই থাকে কিন্তু ইলমের পথে প্রতিবন্ধকতা থাকে সবচেয়ে বেশি। আজ সেসকল প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছি। মনে একটুও শান্তি নেই। সারাক্ষণ একটার পর একটা চিন্তা লেগেই থাকে।
সময়ের মূল্য উপলব্ধি করুন!
প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা! আমি সব সময় যে কথাটি বলে এসেছি এবং এখনো যে কথাটি বলতে চাচ্ছি তা হল, সময়ের মূল্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। সময় আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেআমত। এ নেআমত একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। সময় অতিবাহিত হচ্ছে। সময় প্রবাহিত হচ্ছে। আপনার দৃষ্টান্ত হল বরফ-বিক্রেতার মতো। বরফ বিক্রেতার মূলধন সারাক্ষণ নিঃশেষ হচ্ছে। জনৈক বুযুর্গ বলেন, বরফের দোকানে গিয়ে আমার সূরা আসরের হাকীকত বুঝে এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘সময়ের শপথ! নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।’ বুযুর্গ বলেন, মানুষ যে কীভাবে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, আমি বরফের দোকানে গিয়ে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখতে পেয়েছি। বরফ ব্যবসায়ীর মূলধন সারাক্ষণ গলে গলে শেষ হতে থাকে। কেউ কিছু কিনলেও শেষ হয়, না কিনলেও হয়। তবে যা বেচা হল, তার বিনিময়ে অর্থ আসে। আর যা বেচার আগেই গলে যায় তার বিনিময়ে কোনো অর্থ আসে না। মানুষের জীবন সম্পূর্ণই বরফের মত। প্রতি নিঃশ্বাসে একটি করে মুহূর্ত বিয়োগ হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে আমাদের জীবন ছোট হচ্ছে। মানুষ বলে বয়স বাড়ছে। মাশাআল্লাহ সত্তর বছর হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব কথা হল, যার যত বয়স বাড়ছে তার হায়াত তত কমছে। আমরা ছোট বেলায় একটি কবিতা পড়েছি,
غافل تجھے گھڑیاں يہ دیتا ہے منادی
گردوں نے گھڑی عمرکی اک اور گھٹا دی
‘হে উদাসীন! ঘড়ির কাটা তোমাকে ডেকে ডেকে বলছে। ঘড়ির প্রতিটি সেকেন্ড তোমার জীবন থেকে একেকটি মুহূর্তকে কমিয়ে দিচ্ছে।’ ঘড়িতে ঘণ্টা বেজেছে। এর অর্থ, তোমার জীবন থেকে আরো একটি ঘণ্টা কমে গেল।
মানুষের সফল ব্যবসা
আমি এখন যা বলছি, তা নিছক কোনো কবির কল্পনা নয়। এটি হাদীসের মর্ম। হাদীসের ছাত্ররাও এখানে আছে। তারা ভালো করেই জানে, হাদীস শরীফে এসেছে,
«كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو، فَبَائِعٌ نَفْسَهُ، فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا». رواه الترمذي وابن ماجه
প্রতিটি মানুষ যখন সকালে বের হয়, তখন সে ব্যবসায়ী হিসেবেই বের হয় এবং ব্যবসার জন্যই বের হয়। কিন্তু কিসের ব্যবসা? কাপড়ের ব্যবসা? না। খাবারের ব্যবসা? না। লোহা এবং তৈজস পত্রের ব্যবসা? না। বরং নিজের জীবনের ব্যবসা, নিজের শক্তি-সামর্থ্য, মেধা, সময় ও শ্রমের ব্যবসা। তোমরা নিজেদেরকে ব্যবসায় খাটিয়েছ। এই ব্যবসার ফলাফল কী? যদি ব্যবসায়ী সচেতন হয় তাহলে সে আখেরাতের আযাব থেকে নিজেকে বাঁচাবে। যখন সে ঘর থেকে বের হবে এই নিয়তে বের হবে যে, আমি একজন সফল ব্যবসায়ী হব এবং অবশ্যই কিছু উপার্জন করে নিয়ে আসব। আর প্রকৃত লাভ তো আখেরাতের লাভ। যদি সে আখেরাতের আযাব থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে তাহলে সে সফল। আর যদি বাঁচাতে না পারে তাহলে নাকাম, ব্যর্থ। হাদীসের শব্দ হল, «فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا» (হয়ত সে নিজেকে আযাদ করে নেবে অথবা ধ্বংস করে দেবে)। মানুষ যখন সকালে বের হয় তখন সে ব্যবসার পণ্য নিয়ে বের হয়। তার পণ্য হল তার জীবন। এই জীবন প্রতি মিনিটে প্রতি সেকেন্ডে ছোট হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে যৌবন দান করেছেন। সুস্থতা দান করেছেন। হাত-পা ও চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা ইত্যাদি সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ রেখেছেন। যদি এখনো এসবের মূল্য বুঝে না আসে তাহলে আমার অবস্থা নিয়ে একটু চিন্তা করুন।
যৌবনের মূল্যায়ন করুন!
আপনাদেরকে এখন যা বলব তা আমার মনের কথা। আমার হৃদয়ের বন্ধন তো আপনাদের সাথে। আপনারাই আমার শষ্যক্ষেত্র আমার আপনজন। আপনাদেরকে ঘিরে আমার জীবনের সমস্ত চাওয়া-পাওয়া। আমার মনে চায়, প্রতিদিন আপনাদের সাথে কথা বলি, সাক্ষাৎ করি। আপনাদের মনের কথা শুনি এবং আমার মনের কথা বলি। কিন্তু আমি অক্ষম। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। জীবনের সুযোগগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন আগের মত চলাফেরা করার শক্তি নেই। কখনো সুযোগ হয় কথা বলার, আবার কখনো সুযোগ হয় না। এখন আমি মাযূর হয়ে গেছি। আপনাদের প্রতি আমার আন্তরিক উপদেশ এটাই
من نہ كردم شما حذر بكنيم
অর্থাৎ আমরা কিছু করতে পারলাম না। তোমরা কিছু করার চেষ্টা কর। যদি আপনারা জীবনকে মূল্যায়ন না করেন, তা হলে একদিন ভুগতে হবে। সুতরাং সময়কে মূল্য দিন। কিছু করার, কিছু হওয়ার এখনই সময়। যৌবন হচ্ছে জীবনের বসন্তকাল। আল্লাহ আপনাদের এ যৌবন দান করেছেন। যদি ভালো হতে চান তাহলে মনে রাখবেন, ভালো হওয়ার এখনই সময়। আবার যারা খারাপ হয় তারা এই বয়সেই খারাপ হয়।
এখনই ভালো হওয়ার উপযুক্ত সময়
আমাদের অনেক তালিবুল ইলম উদাসীনতায় ডুবে আছে। তারা মনে করে, এখনও তো ছাত্র। ছাত্রজীবন স্বাধীন জীবন। কর্মজীবনে যখন প্রবেশ করব তখন সব করব। কিন্তু বাস্তব কথা হল, যে এখানে ঠিক হবে না, সে কোথাও ঠিক হবে না। আল্লাহ তাআলার কুদরতে তো সবকিছুই হতে পারে। আল্লাহ চাইলে সত্তর বছরের কাফেরকেও এক মুহূর্তে অলী বানিয়ে দিতে পারেন। আল্লাহর কুদরতকে অস্বীকার করা তো কুফরী। কিন্তু সুন্নাতুল্লাহ এই যে, ইলমের মুসাফিরদের জন্য ছাত্রজীবনই হচ্ছে ভালো কিংবা মন্দ হওয়ার সময়। আলিমে দীন হতে চান, মুহাক্কিক হতে চান- সব এই সময়ের মধ্যেই হতে হবে। আপনারা আমাকে টুকটাক যা কিছু করতে দেখেন সবই ছাত্রজীবনের মেহনতের বরকত। আল্লাহর শোকর ছাত্রজীবনে আমি কখনো সময় নষ্ট করিনি। আল-হামদু লিল্লাহ ছাত্রজীবনকে আমরা ইলম অর্জনের পেছনে ব্যয় করেছি। ছাত্রজীবনে আমাদের পার্থিব কোনো কিছু হাসিল করার চিন্তা ছিল না, সাংসারিক কোনো ঝামেলা ছিল না। কারো সাথে দোস্তি কিংবা দুশমনীও ছিল না। কোনো সভা-সমাবেশে যোগদানের ফিকিরও ছিল না। ছাত্রজীবনে কিতাব মুতালাআ করা ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজ ছিল না। আল-হামদু লিল্লাহ উস্তাদ জীবনে ছাত্রজীবনের সেই মেহনতের সুফল অনুভব করতে পেরেছি। ছাত্রজীবনের মেহনতের মাধ্যমে যে যোগ্যতা হয়েছিল, মুতালাআর দ্বারা যা আরো বেড়েছিল তা-ই এখনও আমার পুঁজি। আমার শিক্ষকতার জীবনে কিতাব দেখার প্রয়োজনীয়তা খুব কমই হয়েছে। কারণ ছাত্রজীবনে কিতাবের ওপর বেশ জোর দেয়া হয়েছিল। ফলে শিক্ষকজীবনে দরসী কিতাবে খুব বেশি সময় দিয়ে মুতালাআর প্রয়োজন হত না। হ্যাঁ, সাধারণ পড়াশোনা অনেক হত।
তো ভাই! আমি বলতে চাচ্ছিলাম, আপনাদের পড়াশোনার গোটা সময় এটা। যদি এই সময়কে কাজে না লাগান, তা হলে জীবনভর কাঁদতে হবে। তারপরও কোনো লাভ হবে না। যে সময় গত হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ আর এ জগতে সম্ভব নয়।
ফিরে আসি মূল আলোচনায়। আমি একটি আয়াত পড়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, আজকের মজলিসে অন্তত এই আয়াতের তাফসির স্পষ্ট হয়ে যাক। কিন্তু সময় অনেক চলে গেল। তোমাদের কি মনে আছে, আমি কী বলছিলাম? আমার স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কিছুই আর আগের মত মনে থাকে না। আমি এই আয়াতটি পাঠ করেছিলাম,
فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآىِٕفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوْا فِي الدِّيْنِ وَ لِيُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُوْنَؒ۰۰۱۲۲
এটা কুরআনের বালাগাতের পূর্ণাঙ্গতা যে, এই আয়াতে সবকিছু এসে গেছে। এই আয়াতে আমাদের পূর্ণ নেসাব এসে গেছে। একজন আলিম, একজন শিক্ষক ও একজন দায়ীর নেসাবে যিন্দেগী এবং মানযিল কী হবে, সবই এসে গেছে। একজন তালিবুল ইলম তার ছাত্রজীবনের শুরু থেকে নিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কীভাবে কাটাবে সব কিছুই রয়েছে এই আয়াতে।
আমাদের লক্ষ্য হলো দীনী প্রজ্ঞা অর্জন; এর শর্ত হলো একাগ্রতা
দীনী ইলমের উদ্দেশ্য কখনো শুধু পড়া নয়, বরং দীনী প্রজ্ঞা তথা ‘তাফাক্কুহ ফিদ্দীন’ অর্জন করা। কুরআনের দাবি হল, সর্বদা এমন জামায়াত থাকতে হবে যারা ‘তাফাক্কুহ ফিদ্দীন’ অর্জনের জন্য নিজেদের জীবনকে ওয়াকফ করে দেবে। এই জামায়াতকে মুজাহিদ ও গাযীদের জামায়াত থেকে পৃথক করে উল্লেখ করা হয়েছে। আপনারা জানেন, ذروة سنام الدين الجهاد অর্থাৎ জিহাদ হচ্ছে দীনের সর্বোচ্চ চূড়া। ইসলামে জিহাদের অনেক গুরুত্ব। জিহাদের সওয়াবের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু তালিবুল ইলমদের তা থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। কিছু লোক শুধু এই কাজের জন্য ফারেগ হয়ে যাবে। তারা আর কোনো কাজ করবে না। কারণ দীনী প্রজ্ঞাসম্পন্ন আলিমে দীন সকলেই এ ব্যাপারে একমত এবং অভিজ্ঞতাও একথার সাক্ষ্য দেয় যে, জিহাদ ও ইলমে দীনের দুটি ভিন্ন ভিন্ন চূড়া এবং দুটো কখনোই একসাথে আনজাম দেওয়া সম্ভব নয়। ইলম তো কেবল তখনই অর্জিত হতে পারে যখন এর সাথে অন্য কোনো ব্যস্ততা না থাকে। তালিবুল ইলমের অন্তর জুড়ে থাকবে শুধু ইলমের প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা। যখন সে নিজের সময়, শক্তি-সামর্থ্য, মেধা ও শ্রম পূর্ণরূপে ইলমের পেছনে ব্যয় করবে তখন হয়ত তার অল্প পরিমাণ ইলম অর্জিত হবে। হিদায়াগ্রন্থকারের শাগরিদ আল্লামা যারনুজী (রহ.) তালিমুল মুতাআল্লিম কিতাবে লিখেছেন,
العلم لا يعطيك بعضه حتىٰ تعطيه كلك.
‘তুমি যতক্ষণ না ইলমের জন্য তোমার সর্বস্ব দেবে, ইলম ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাকে কিছুই দেবে না।’
এই যখন অবস্থা, তখন তুমি যদি তোমার সকল সময় অন্যান্য কাজে খরচ করে ফেল তাহলে তুমি তো ইলমের ছায়াও দেখতে পাবে না। আল্লাহর ওয়াস্তে একটু চিন্তা করুন, আপনারা এই কাজের জন্যই এসেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের বিধানাবলী শেখা ও বোঝাই আপনাদের কাজ। আমি কুরআনের আয়াত পাঠ করে শোনাচ্ছি,
فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآىِٕفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوْا فِي الدِّيْنِ ؒ۰۰۱۲۲
‘প্রত্যেক বড় জামায়াত থেকে একদল লোক কেন বের হয় না দীনী প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য?’
মুজাহিদ ও গাযীদের জামায়াত থেকে আলাদা করে আপনাদেরকে এই কাজের জন্যই বের করা হয়েছে। অর্থাৎ মুজাহিদরা জিহাদে মশগুল থাকবে আর ছাত্ররা মগ্ন থাকবে পড়া-শোনায়। কারণ পড়া-লেখা ও অন্যান্য কাজ কখনো একসাথে চলতে পারে না। পড়া-লেখা এবং জিহাদও একসাথে চলতে পারে না। যদিও জিহাদ দীনের অনেক বড় কাজ, তারপরও পড়া-লেখা ও জিহাদ একসাথে চলতে পারে না। তাইতো আল্লাহ রাববুল আলামীন জিহাদকে ফরযে কিফায়া সাব্যস্ত করেছেন। প্রত্যেকের ওপর জরুরি করে দেননি। বরং একদল করলেই সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে।
ফরযে কেফায়ার হাকীকত
ফরযে কেফায়া হল এমন কাজ যা জরুরি বটে, কিন্তু সকলের একসাথে তাতে অংশগ্রহণ করা জরুরি নয়। এখানে কর্মবণ্টননীতি অবলম্বন করতে হয়। কেউ এই কাজ করবে, আর কেউ সেই কাজ করবে। যাবতীয় ফরযে কেফায়া কাজের সারকথা এটাই। ফরযে কেফায়া আপন জায়গায় অবশ্যই ফরয। কিন্তু তাই বলে যদি সকলেই সেই কাজে লেগে যায়, তাহলে দুনিয়ার অন্যান্য কাজ আঞ্জাম দেবে কারা? তাই কেউ জিহাদ করবে, কেউ দাওয়াতের কাজ করবে, কেউ ইলম শিখবে, কেউ ইলম শেখাবে অর্থাৎ বিভিন্নজন বিভিন্ন কাজে মশগুল থাকবে। এভাবে দীনের কাজগুলো সকলের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।
কোরআনে কারীমের ফায়সালা এটাই সাব্যস্ত করে যে, ছাত্রদেরকে জিহাদ থেকে পৃথক রাখা হবে। আল্লাহর ওয়াসতে একটু চিন্তা করুন। জিহাদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ তো ইসলামে নেই। ইসলামের পঞ্চম রুকন হচ্ছে জিহাদ। আর এই জিহাদ থেকে ছাত্রদেরকে পৃথক করে বলা হচ্ছে, তোমরা জিহাদে যেও না, বরং তোমরা ‘তাফাক্কুহ ফিদ্দীন’ অর্জন কর। কারণ নিজের সময় শক্তি সামর্থ্য পূর্ণরূপে ব্যয় করা ছাড়া তাফাক্কুহ অর্জিত হয় না।
তালিবুল ইলম এবং নফল নামায
এটি একটি স্বতসিদ্ধ কথা যে, ছাত্রজীবনে ছাত্ররা পড়া-লেখা ছাড়া আর কোনো কাজ করবে না। কাজ তো কাজ, তারা নফল যিকির-শোগল, যা খালেস ইবাদত আমাদের আকাবিরগণ তো ছাত্রদেরকে সেগুলো থেকেও দূরে রাখতেন। খুলাসাতুল ফাতাওয়া খুলে দেখুন খুলাসাতুল ফাতাওয়ার মুসান্নিফ হিদায়ার মুসান্নিফের সমসাময়িক ছিলেন, তাতে এই ইবারত লেখা আছে, كنا نضرب علىٰ أن نسبح التسبيح বেশি সম্ভব ইবারতটি এমনই হবে। অর্থাৎ ছাত্রযামানায় আমাদের উস্তাদগণ আমাদের খোঁজখবর নিতেন। যদি দেখতেন আমরা সালাতুত তাসবীহ পড়ছি, তা হলে আমাদেরকে প্রহার করতেন। সালাতুত তাসবীহ নামায কি কোনো গুনাহের কাজ? বরং অনেক বড় সওয়াবের কাজ। হাদীসে তার ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তালিবুল ইলমের জন্য সালাতুত তাসবীহ হল মুতালাআ।
তালিবুল ইলম এবং বায়আত গ্রহণ
হযরত গঙ্গুহী (রহ.) এবং আমাদের অন্যান্য আকাবিরগণ ছাত্র অবস্থায় কাউকে বাইআত করতেন না। ছাত্রদের কেউ বাইআত হতে চাইলে বলতেন, আগে পড়া-লেখা শেষ কর। কেননা পড়া-লেখা এবং যিকির-আযকার একসাথে হয় না। আমার নিজের কথাই বলি, আমি তখন হিদায়া পড়ি। শায়খুল হিন্দ (রহ.) রাজনীতির ময়দানে নেমে আসেন এবং ইংরেজদেরকে এদেশ থেকে খেদানোর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন আমি একদিন আরয করলাম, হযরত! আমাকে বাইআত করে নিন। হযরত বললেন, যখন ফারেগ হবে, তখন বাইআত করব। এটা আমার শৈশবের ঘটনা। এসকল আন্দোলন তখন পুরোপুরি বুঝতাম না। রেশমী রুমাল আন্দোলন এবং আরো কত কত আন্দোলন হল! সমগ্র ইসলামী বিশ্বকে শায়খুল হিন্দ (রহ.) এক করে ফেলেছিলেন। হিন্দুস্তান থেকে আফগানিস্তান এবং তুরস্ক পর্যন্ত সব দেশকে এক করে ফেলেছিলেন। সকল মুসলমানকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক প্লাটফর্মে দাঁড় করিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে এমন হয়েছিল যে যদি একযোগে হামলা করতেন তাহলে ইংরেজরা বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু এর আগেই বিশ্বাসঘাতকদের কারণে সব পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। এই বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের মুসলমানরাই করেছে। অবশেষে শায়খুল হিন্দ (রহ.) গ্রেফতার হলেন এবং চার বছর মাল্টায় বন্দী থাকলেন।
যাইহোক, আমি বলছিলাম, আমি যখন ছাত্রজীবনে হযরতের কাছে বাইআতের দরখাস্ত করলাম, হযরত আমাকে বাইআত করতে অস্বীকার করলেন। যখন মাল্টার বন্দীজীবন থেকে মুক্তি লাভ করলেন, তখন আবার বাইআত হওয়ার দরখাস্ত করলাম, আমি তখন পড়ালেখা সমাপ্ত করেছি এবং শিক্ষকতা করি, হযরত আমার দরখাস্ত কবুল করলেন। আমাদের আকাবিরদের অবস্থা এমনই ছিল। তারা নিজেরা সবকিছুই করতেন। কিন্তু ছাত্রদের জন্য কখনো ছাত্র অবস্থায় অন্য কোনো কাজে মশগুল হওয়াকে পছন্দ করতেন না। আমাকেও শায়খুল হিন্দ (রহ.) ছাত্র অবস্থায় বাইআত করেননি কিন্তু ফারাগাতের পর ঠিকই বাইআত করেছেন।
শায়খ ফরীদুদ্দীন গঞ্জেশকর (রহ.)-এর বাইআত হওয়ার ঘটনা
এটা এ যুগের কোনো ঘটনা নয়। এটি অনেক আগের ঘটনা। শায়খ ফরীদুদ্দীন (রহ.) অনেক বড় একজন আল্লাহঅলা ছিলেন। তিনি আমাদের চিশতিয়া সিলসিলার অনেক বড় একজন শায়েখ। তিনি মূলতানে পড়ালেখা করেছেন। মূলতান ইলমের শহর হিসেবে সবসময় প্রসিদ্ধ ছিল। একবার কুতুবে যামান হযরত বখতিয়ার কাকী (রহ.) মূলতান তাশরীফ আনেন। তাঁর আগমনের খবর শুনে ফরীদুদ্দীন (রহ.)-এর ইচ্ছা হল, তাঁর হাতে বাইআত হবেন এবং তিনি গিয়ে হযরত বখতিয়ার কাকী (রহ.)-কে তার ইচ্ছার কথা জানালেন। তখন হযরত বখতিয়ার কাকী (রহ.) জবাব দিলেন, তুমি আগে পড়া-লেখা সমাপ্ত কর। তারপর দিল্লী আস। আমি তোমাকে বাইআত করব। সুতরাং তিনি তাই করলেন। যখন পড়া-লেখা সমাপ্ত হল, তখন দিল্লী গিয়ে হযরত বখতিয়ার কাকী (রহ.)-এর হাতে বাইআত হলেন। বাইআত হওয়ার পর আল্লাহ তাকে কত উঁচু মাকাম দান করেছেন, তা তাঁর জীবনী পাঠকারী সকলের জানা আছে। আল্লাহ তাকে অনেক গুণ ও বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন। হযরত বখতিয়ার কাকী (রহ.)-এর যেসকল খলিফা রয়েছেন তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনিই।
বড়দের ছাত্রজীবন অধ্যয়ন করুন!
আপনারা বড়দের যে কারো জীবনী পাঠ করুন, দেখবেন ছাত্রজীবনে তার প্রধান ব্যস্ততা ছিল পড়া-লেখা। শায়খুল হিন্দ (রহ.) যখন মাল্টার কারাগারে বন্দী, তখন এক ইংরেজ তার কাছে গিয়েছিল তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করার জন্য। শায়খুল হিন্দ (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি কী কী পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন? শায়খুল হিন্দ (রহ.) একে একে সব পরিকল্পনা বলে দিলেন। কারণ তখন সবকিছুই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। ওই ইংরেজ অফিসার মাল্টা থেকে ফিরে এসে রিপোর্ট দিল যে, আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এই বৃদ্ধ লোকটি, যার গোটা জীবনই কেটেছে মাদরাসার চার দেয়ালের ভেতরে, যে কখনো রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেনি, জীবনের আশিটি বছর যে পড়া পড়ানোর মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছে, কখনো কোনো মন্ত্রী-এমপির সাথে সাক্ষাৎও করেনি, কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা কোনো রাষ্ট্রদূতের সাথে যার কখনো কোনো মতবিনিময় হয়নি, সে কীভাবে এমন ভয়াবহ নীলনকশা তৈরি করতে পারে! আর কয়টা দিন যদি তারা পেত তাহলে আমাদের পরাজয় ছিল সুনিশ্চিত।
সাধনা ও একাগ্রতার সুফল
তো শায়খুল হিন্দ (রহ.) এসকল কাজ করেছেন ছাত্রজীবন সমাপ্ত হওয়ার পর। ছাত্রজীবনে ছাত্রজীবনের হক আদায় করেছেন। তখন জানতেনও না, রাজনীতি কোন প্রাণীর নাম? এবং বাইরের দুনিয়ায় কী কী ঘটছে? তাছাড়া শায়খুল হিন্দ (রহ.) হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী (রহ.)-এর নিকট সফরে-হযরে সর্বাস্থায় ছিলেন। নানুতবী (রহ.)-এর মৃত্যুর পর হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.)-এর খেদমতে দু’বছর অতিবাহিত করেন। এ সব কাজ শেষ করার পর তিনি রাজনীতির ময়দানে অবতীর্ণ হন। তো ভাই! আল্লাহ তাআলা এই দীন এবং এই ইলমের মধ্যে এই যোগ্যতা রেখেছেন, যারা নিজেদেরকে ইলম চর্চায় মশগুল রাখবে, আল্লাহ তাদের জন্য রাস্তা খুলে দেবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَاؕ ۰۰۶۹
‘যারা পরিশ্রম করে আমার পথে, আমি অবশ্যই তাদেরকে পথ প্রদর্শন করব।’
তাই তো শায়খুল হিন্দ (রহ.)-কে ইমাম বানানো হয়েছে। অথচ শায়খুল হিন্দ (রহ.) সারা জীবনে ইতিপূর্বে কখনো রাজনীতি করেননি। বলতে পারবেন না রাজনীতি কাকে বলে? গোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন মাদরাসায় এবং খানকায়। কিন্তু যখন জিহাদের সময় এল, জিহাদের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করলেন এবং মানুষের সাথে মেলামেশা শুরু করলেন। তখন আল্লাহ তার জন্য রাস্তা খুলে দিলেন।
অনুবাদ: সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
আগামী সংখ্যায় সমাপ্য