বুধবার-২১শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হীনমন্যতা ও ইসলামের নির্দেশনা

হীনমন্যতা ইসলামের নির্দেশনা

খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ

 

বর্তমান সময়ে মানুষের দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা ও চিত্তচাঞ্চল্যের মাত্রা অতীত পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গেছে বলেই মনে করা হয়। আমাদের পর্যবেক্ষণে এ দাবি বাস্তবতার বেশ কাছাকাছি। এ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ডিপ্রেশনের পাশাপাশি সমানতালে বেড়ে চলেছে হীনমন্যতা। এটা উক্ত অবস্থার সহায়ক একটি মানসিক সমস্যা। কোনো রোগের কারণ উদ্ঘাটন করা না গেলে তা নিরাময় কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে। আজকের আলোচনার প্রসঙ্গ হীনমন্যতাবোধ। এটা মানুষের আত্মবিশ্বাসের প্রাসাদ ধ্বসিয়ে দেওয়ার সঙ্গে তার জীবনীশক্তির ক্ষয় তরান্বিত করে।

কুরআন সবার আগে মানুষের পরিষ্কার করলো যে, আকার-আকৃতি বিচারে প্রত্যেক জনই সবচাইতে সেরা ও সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ নমুনা। ঘোষণা করা হয়েছে,

وَصَوَّرَكُمْ فَاَحْسَنَ صُوَرَكُمْ١ۚ وَاِلَيْهِ الْمَصِيْرُ۰۰۳

‘আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টির সবচাইতে সুন্দর আকৃতিতে বানিয়েছেন এবং আখেরে তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।’ (আত-তাগাবুন: ৩)

এই আয়াতে মানুষের শারিরিক অপূর্ণতা ও দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে আরেকটি আয়াত দেখুন যেখানে বংশগত কৌলিন্য ও জাতপাতের শ্রেণিবিভাজন সম্পর্কে চমৎকারভাবে বলা হচ্ছে,

يٰۤاَيُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثٰى وَ جَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًا وَّقَبَآىِٕلَ لِتَعَارَفُوْا١ؕ اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللّٰهِ اَتْقٰىكُمْ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ۰۰۱۳

‘আমি তোমাদেরকে নারী ও পুরুষরূপে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বর্ণ ও বংশগত ভিন্নতায় একারণে বিন্যাস করেছি যাতে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো কিন্তু আল্লাহর কাছে সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি সেই যে বেশি পরহেযগার। আর এটা জেনে রাখো যে, আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বাধিক পরিজ্ঞাত আর সবচেয়ে বেশি অবহিত।’ (আল-হুজুরাত: ১৩)

মানুষকে গোত্র ও গোষ্ঠীতে আলাদা করা হয়েছে যেন সহজেই একে অপরকে চিনতে এবং পরিচিতসহ ডাকতে পারে। তবে এর অর্থ কখনোই এমন নয় যে, এক গোত্রের লোকেরা নিজেদেরকে অপর গোত্রের চাইতে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করবে।

এই সুরার তের b¤^i আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে,

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّنْ قَوْمٍ عَسٰۤى اَنْ يَّكُوْنُوْا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَآءٌ مِّنْ نِّسَآءٍ عَسٰۤى اَنْ يَّكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ١ۚ وَلَا تَلْمِزُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوْا بِالْاَلْقَابِ١ؕ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوْقُ بَعْدَ الْاِيْمَانِ١ۚ وَمَنْ لَّمْ يَتُبْ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الظّٰلِمُوْنَ۰۰۱۱

‘হে বিশ্বাসীগণ! কোনো সম্প্রদায় যেন অন্য সম্প্রদায়কে তাচ্ছিল্য না করে কোনো নারী যেন অন্যকে নিজের চাইতে হীন ভেবে তাকে অপমান না করে এবং অন্যের নামকে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উচ্চারণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ঈমান আনার পর এরূপ কাজ অত্যন্ত নিকৃষ্ট। যদি তোমরা এরূপ কাজ থেকে তওবা না করো তবে জেনে রাখো, তবে তোমরা জালিমদের তালিকাভুক্ত হবে।’ (আল-হুজুরাত: ১১)

মুসলমানের পক্ষে অন্যকে নিকৃষ্ট ভাবার কোনোরূপ বৈধতা নেই। একইভাবে নিজেকেও অন্যের চাইতে নিকৃষ্ট মনে করার অনুমতি দেওয়া হয় নি। আল্লাহর কাছে সৎকর্মপরায়ণ সেই কুৎসিত মুসলমানটি সুদর্শন অসৎ মুসলমান ব্যক্তির চাইতে শ্রেষ্ঠ। এই তাৎপর্যপূর্ণ মূলনীতিকে পৃথিবীর ইতিহাসে শীর্ষ ম্যাগনাকার্টা অর্থাৎ বিদায় হজের ভাষণে এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘কোনো আরবির জন্য অনারবের ওপর, কোনো শ্বেতাঙ্গের জন্য কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, মানুষ কেবল কর্মগুণেই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারে। আর মনে রেখো, তোমরা সকলেই আদমের সন্তান আর তিনি মাটির তৈরি।’

তিনি এই নির্দেশনা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। কৃষ্ণাঙ্গ দাসের সঙ্গে আরবের শীর্ষ অভিজাত গোত্র বুন হাশিমের মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। অথচ আরবের রক্তেই প্রবল কৌলিন্যবোধ মিশে আছে! হীনমন্যতার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিংসাকে ইসলাম নিন্দা করেছে। এমনকি কুরআন মাজীদে হিংসুকদের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে,

وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ اِذَا حَسَدَؒ۰۰۵

‘আর হিংসুকে অনিষ্ট থেকে (আশ্রয় প্রার্থনা করছি) যখন সে হিংসা করে।’ (আল-ফালাক: ৫)

সম্পদের অহমিকায় মাটিতে যাদের পা পড়ে না আর ক্ষমতার তাপে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে তাদের এই শ্রেয়বোধকে ইসলাম নাকচ করে দেয়। তারা যখন অর্থবিত্ত কিংবা ক্ষমতা হারায় তাদের অবস্থার স্বরূপ পবিত্র কুরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে,

لِّكَيْلَا تَاْسَوْا عَلٰى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوْا بِمَاۤ اٰتٰىكُمْ١ؕ وَ اللّٰهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرِۙ۰۰۲۳

‘যা পেয়েছো এটার জন্য অহঙ্কার করো না আর যা হারিয়েছো এ জন্য পস্তাবে না কারণ কোনো দাম্ভিক লোককে পছন্দ করেন না।’ (আল-হাদীদ: ২৩)

লক্ষ্য করুন, মানসিক কষ্ট দূর করার জন্য কুরআন মজীদ এমন লক্ষ্যভেদী অব্যর্থ ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে যা চলে গেছে তার জন্য আফসোস নয় এবং যা অর্জিত হয়েছে তার জন্য অহঙ্কার নয়। এই সংক্ষিপ্ত মূলনীতিটা যদি মগজে স্থাপন করে নেওয়া যায় তাহলে পৃথিবীর কোনো বিপদই মানুষকে অস্থির করে তুলবে না, কোনো দুশ্চিন্তা কাবু করতে পারবে না।

মানুষকে তার নাম ধরেই বারবার ডাকা হয়; প্রত্যেক ব্যক্তির নাম তার ব্যক্তিত্বেরও প্রতীক হয়ে থাকে। নামের মধ্যে যদি অহংবোধ অথবা হীনমন্যতা লুকিয়ে থাকে তবে ইসলাম সে-ধরনের নামও অপছন্দ করেছে।

হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) মন্দ নামগুলো পরিবর্তন করে দিতেন।’ (সুনানে তিরমিযী)

হাদীসে এই ধরনের বহু বর্ণনা পাওয়া যায়; অপছন্দনীয় নাম হওয়ার কারণে অনেকের নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। যার নাম বারা ছিলো তাকে জয়নাব এবং আসিয়াকে জমিলায় বদলে দেওয়া হয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাযি.) বর্ণনা করেন যে, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, সেই ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলমান যার শারীরিক ও মৌখিক আচরণে কারও আক্রান্ত হবার আশঙ্কা থাকে না আর প্রকৃত মুহাজির সেই ব্যক্তি যিনি আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয় পরিত্যাগ করে।

বিশ্বনবী (সা.) মানুষের ব্যক্তিত্বকে সম্মানিত করেছেন। মানুষের নৈতিক চরিত্র ও ভালো কাজের কারণে মহিমান্বিত ও সম্মানের অধিকারী হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছেন। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও প্রাইভেসির ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিতে গিয়ে নিষিদ্ধ করেছেন একে অপরের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি, অনুমতি ব্যতিরেকে কারও চিঠি খুলে পড়া এবং অনুপস্থিতিতে গীবত-পরচর্চার মতো বিষয়গুলো। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে আত্মম্ভরিতা, আত্মতুষ্টিজনিক বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেন নি। প্রত্যেকজন মানুষকে নিজের ভুল স্বীকারের জন্য সাহস দিয়েছেন, নিজেকে শোধরে নিয়ে অপরকেও সংশোধনের আন্তরিক হবার তাগিদ দিতে ভুলেননি। তিনি ঘোষণা করেছেন, মানুষ যতক্ষণ অপর ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে সক্রিয় থাকবে আল্লাহও তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত রাখবেন। অসুস্থ ব্যক্তির শুশ্রুষা, খোঁজ-খবর নেওয়া এবং মৃত মুসলমানের জানাযায় শরীক হবার মধ্যদিয়ে সমতার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। ইসলাম গ্রহণের পর, ইসলামে হৃদয়ের মাঝে জায়গা দেওয়ার পর কোনো মুসলমান হীনমন্যতায় ভুগতে পারেন না; তার জন্য এটার অনুমতি নেই।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ