বাবরী মসজিদ-রামমন্দির বিতর্ক ও গাযওয়ায়ে হিন্দ প্রসঙ্গ
আবিদুর রহমান তালুকদার
আল্লাহর ইবাদতের লক্ষ্যে নির্মিত ভূখণ্ডের সর্বোত্তম স্থাপনা হলো মসজিদ। ইসলাম-পূর্ব জাতিসমূহের উপাসনার জন্য মসজিদই ছিল একমাত্র স্থান। নির্ধারিত স্থানের বাইরে তাদের ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না। আল্লাহ তাআলা সর্বশেষ নবির জন্য সমগ্র পৃথিবীকে মসজিদে পরিণত করেছেন। এ উম্মতের প্রতি এটি আল্লাহর সবিশেষ অনুগ্রহ। এর ফলে উম্মতে মুহাম্মদি ভূখণ্ডের যে কোনো পবিত্র স্থানে নামায আদায় করার সুযোগ লাভ করে। মসজিদের আবাদ ও তত্ত্বাবধানের একচ্ছত্র অধিকার মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত। তবে যুগে যুগে অমুসলিমরা জোরপূর্বক মসজিদ দখল করেছে। আবার অনেকে করেছে ধ্বংস।
মক্কার পৌত্তলিক আদালত পৃথিবীর বুকে নির্মিত সর্বপ্রথম গৃহ বায়তুল্লাহ দখল করে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে। ‘আজ থেকে এখানে আল্লাহর একত্ববাদের পরিবর্তে গাইরুল্লাহর বহুত্ববাদী পূজা চলবে এবং তাওহিদে বিশ্বাসী কোনো মুসলিমের জন্য বায়তুল্লাহে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।’ আদালতের রায় বাস্তবায়নকারী মুশরিক সমাজপতিদের এ সিদ্ধান্তবলে পৌত্তলিকেরা কাবা অভ্যন্তরে গাইরুল্লাহর অসংখ্য মূর্তি স্থাপন করে এগুলোর উপাসনা শুরু করে। তারা বায়তুল্লাহর চারপাশে উলঙ্গ তাওয়াফ করতে লাগলো। মসজিদের ধ্বংসসাধন ও এতে মূর্তি স্থাপনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। বুখত নসর ও রোমান খ্রিস্টানেরা পৃথিবীর বুকে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাদ্দাস বারেবারে ধ্বংস করেছে। জবরদখলকারী অনেক অমুসলিম শক্তি বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করেছে। ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক কাবা ধ্বংসের ইতিহাস ও তার পরিণতি সর্বজনবিদিত। যুগে যুগে ইসলামের বৈরিশক্তি অনেক মসজিদে অগ্নিসংযোগ করেছে। ইবাদতগাহের ক্ষতিসাধন করেছে। ভেঙে চুরমার করেছে। মসজিদ ধ্বংস করা একটি গর্হিত কাজ ও নির্ঘাত পাপাচার। মসজিদে দখলদারিত্ব কায়েম করে গাইরুল্লাহর পূজা করা এর চেয়েও জঘন্যতম অপরাধ। সরাসরি মসজিদ ভাঙার পরিণতি নিজেদের ধ্বংসই তরান্বিত করে। আবরাহার হস্তিবাহিনীকে আবাবিল পাখি দ্বারা নিপাত করে আল্লাহর তাআলা তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার তাৎক্ষণিক প্রমাণ দেখিয়েছেন। তবে আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্মিত স্থানে গাইরুল্লাহর পূজা করার জাতীয় সিদ্ধান্ত পরাধীনতার অশনি সংকেত ও জাতিসত্তা বিলুপ্তির নিশ্চিত লক্ষণ।
ভারতের অযোধ্যা নগরীতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন শাহ বাবর কর্তৃক নির্মিত মসজিদটি বাবরী মসজিদ নামে খ্যাত। প্রায় পাঁচশত বছর পর্যন্ত এটি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে ছিল মুখরিত-প্রাণবন্ত। ভারতের আরএসএস ও বিজেপি রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষে সর্বপ্রথম এতে বিতর্কের সূচনা করে। অবশেষে আদালত থেকে মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের রায় আদায় করে নেয়। পাঁচ আগস্ট ২০২০ মন্দির নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। ভারত সরকারের হটকারী এ সিদ্ধান্তে খোদায়ি গযবের লেলিহান শিখায় পৃথিবী উত্তপ্ত হতে থাকে। তাবৎ মুসলিম বিশ্বের হৃদয়-মানসে ঘটে প্রচুর রক্তক্ষরণ। আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। সুপ্রতিষ্টিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তরের প্রতিকারে মুসলিম সমাজের করণীয় কী? মুসলিম বিশ্বের এমন ক্রান্তিকালে সমাধান দেয়ার অথরিটি কে? এ বিষয়ে পুরো জাতি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একমাত্র মুসলিম উম্মাহর খলিফার পক্ষেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব। তবে আবরাহা কর্তৃক বায়তুল্লাহ ধ্বংসের প্রাক্কালে কাবার মুতাওয়াল্লি আবদুল মুত্তালিবের বিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপটি ছিল মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্য শিক্ষণীয়। আবদুল মুত্তালিব ছিলেন কাবার মুতাওয়াল্লি ও তত্ত্বাবধায়ক। কুরাইশ বংশের পৌত্তলিক সমাজের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল খানায়ে কাবায়। তারা বায়তুল্লাহর অবকাঠামো অক্ষুণ্ন রেখেই তাতে মূর্তিপূজা করেছে। মসজিদ ভাঙা ও মন্দির গড়ার রাজনীতি তখনো তাদের মাথায় ঢোকেনি। বায়তুল্লাহর দখলদারিত্ব অন্যের হাতে চলে যাবে এমন চিন্তা তারা কখনো করেনি। মক্কার অলিন্দ-গলিতে মুশরিকদের ক্ষমতা ছিল অবাধ ও নির্ঝঞ্ঝাট। মক্কার উপকন্ঠে বহুত্ববাদ বিরোধী রাজনীতির কানা-ঘুষাও ছিল না।
অতীতকালে মসজিদের প্রতি মুশরিকদের ভক্তি-শ্রদ্ধায় কখনো ঘাটতি ছিল না। মন্দিরের প্রতিও ছিল না কোনো মুসলিমের বিবেদ-বিদ্বেষ। বাল্যকালে অনেক সনাতন ধর্মীয় নারীদের মসজিদ চত্বরে সিজদা করতে দেখেছি। এখনো অনেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু জনগোষ্টী মসজিদের প্রতি মাথানত করে কিংবা দু’হাত উঁচিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সাধারণ মুশরিকগণ পূর্বপুরুষের অনুকরণে মূর্তিপূজা করলেও মসজিদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ এখনো অটুট রয়েছে। মক্কার কাফেররা মনে করতো, কাবা তত্ত্বাবধানে তাদের অধিকার সর্বময় ও নিরঙ্কুশ। এ ক্ষেত্রে আবদুল মুত্তালিব ও কুরাইশ পৌত্তলিকদের ভূমিকা ছিল রক্ষকের। পক্ষান্তরে বাবরী মসজিদের ক্ষেত্রে মোদি-অমিত শাহ এর পদক্ষেপটি ছিল ভক্ষকের। ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত মসজিদসমূহে সরকারী তত্ত্বাবধান না থাকায় আদালতকে ব্যবহার করে তাতে আধিপত্য কায়েম করে। যা তাদের জন্য হিতে বিপরীত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মক্কার মূর্তিপূজারীরা আবরাহার আক্রমণ থেকে আল্লাহর কুদরতে নিস্তার পেলেও মসজিদে মূর্তি পূজার শাস্তি হিসেবে আরবে মুশরিক শাসনের পতন ঘটে। পরাধীনতার সেই অশনি সংকেত বাস্তবে রূপায়িত হয় মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে। আরব উপদ্বীপে চিরদিনের জন্য রচিত হয় পৌত্তলিকতার কবর। মক্কা বিজয়ের পর আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.) এর নেতৃত্বে মুসলমানগণ হজ পালন করেন। আমিরুল হজ আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.) রসূল (সা.)-এর পক্ষে দ্বীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন,
«أَلَا لَا يَحُجُّ بَعْدَ الْعَامِ مُشْرِكٌ، وَلَا يَطُوْفُ بِالْبَيْتِ عُرْيَانٌ».
‘পরের বছর থেকে কোনো মুশরিক মক্কায় হজ করতে পারবে না এবং মক্কা চত্বরে মুশরিকদের উলঙ্গ তাওয়াফও নিষিদ্ধ করা হলো।’ (সহীহ আল-বুখারী: ১৬২২)
রসূল (সা.) মৃত্যুর পূর্বক্ষণে আরব উপদ্বীপে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মের সহাবস্থান নিষিদ্ধের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করে বলেন,
«أَخْرِجُوا الْـمُشْرِكِيْنَ مِنْ جَزِيْرَةِ الْعَرَبِ».
‘আরব উপদ্বীপ থেকে মুশরিকদের বের করে দাও।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৩১৬৮)
আল্লাহ তাআলা মসজিদ তত্ত্বাবধানের একচ্ছত্র অধিকার মুসলমানদের হাতে অর্পণ করেন এবং মসজিদে হারামে অমুসলিমদের প্রবেশাধিকার রহিত করে বলেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اِنَّمَا الْمُشْرِكُوْنَ نَجَسٌ فَلَا يَقْرَبُوا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هٰذَاۚ ۰۰۲۸
‘হে ইমানদারগণ! মুশরিকগণ একটি অপবিত্র জাতি। এ বছরের পর তারা যেনো মসজিদে হারামের ধারে কাছেও না আসে।’ (আত-তাওবা: ২৮)
আল্লাহর নির্দেশ ও রসূল (সা.)-এর মনোকামনা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)-এর খিলাফতকালে পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়। দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রাযি.) মুশরিকদের পাশাপাশি ইহুদি-খ্রিস্টনিদেরও আরব উপদ্বীপ থেকে বিতাড়ন করেন। আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দীন ইসলামই আরব উপদ্বীপে স্বাধীনভাবে টিকে থাকবে। এটিই ছিল রসূল (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ আকাঙ্ক্ষা। ইসলামের জন্মভূমি মক্কা-মদিনায় ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের সহাবস্থান না থাকাই ছিল উম্মাতের প্রতি তার সর্বশেষ নির্দেশনা। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল আয়িশা (রাযি.)-এর বরাতে বর্ণনা করেন,
كَانَ آخِرُ مَا عَهِدَ رَسُوْلُ اللهِ ^ أَنْ قَالَ: «لَا يُتْرَكُ بِجَزِيْرَةِ الْعَرَبِ دِيْنَانِ».
‘উম্মতের প্রতি রসূল (সা.)-এর সর্বশেষ নির্দেশনা এই ছিল যে, আরব উপদ্বীপে দ্বি-ধর্মের উপস্থিতি মেনে নেয়া যায় না।’ (মুসনদে আহমদ: ২৬৩৫২)
মসজিদ ধ্বংসের চিরাচরিত শাস্তি প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ اَظْلَمُ مِمَّنْ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰهِ اَنْ يُّذْكَرَ فِيْهَا اسْمُهٗ وَ سَعٰى فِيْ خَرَابِهَا١ؕ اُولٰٓىِٕكَ مَا كَانَ لَهُمْ اَنْ يَّدْخُلُوْهَاۤ اِلَّا خَآىِٕفِيْنَ١ؕ۬ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَّلَهُمْ فِي الْاٰخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ۰۰۱۱۴
‘আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্মিত মসজিদে ইবাদত করার ক্ষেত্রে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাদের চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে? তাদের পরিণাম হলো, এক সময় তারা স্বদেশে সেই মসজিদে ভীত-সন্ত্রস্থ অবস্থায় প্রবেশ করবে। দুনিয়ার জীবনে তাদের জন্য রয়েছে অপমান আর পরকালে রয়েছে মহাশাস্তি।’ (আল-বাকারা: ১১৪)
মসজিদে আল্লাহর ইবাদত করতে বাধা সৃষ্টিকারীদের অবধারিত শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَمَا لَهُمْ اَلَّا يُعَذِّبَهُمُ اللّٰهُ وَهُمْ يَصُدُّوْنَ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَا كَانُوْۤا اَوْلِيَآءَهٗ١ؕ اِنْ اَوْلِيَآؤُهٗۤ اِلَّا الْمُتَّقُوْنَ وَلٰكِنَّ اَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ۰۰۳۴
‘যারা মসজিদে ইবাদতকারীদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা কেনো শাস্তি দিবেন না? তারা তো আল্লাহর বন্ধু নয়। মুত্তাকিরাই আল্লাহর একমাত্র প্রিয়জন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বুঝতে পারে না।’ (আল-আনফাল: ৩৪)
আল্লাহর ইবাদতের নিমিত্তে নির্মিত মসজিদে তারই ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
اِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَ يَصُدُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ الَّذِيْ جَعَلْنٰهُ لِلنَّاسِ سَوَآءَ ا۟لْعَاكِفُ فِيْهِ وَالْبَادِ١ؕ وَمَنْ يُّرِدْ فِيْهِ بِاِلْحَادٍۭ بِظُلْمٍ نُّذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ اَلِيْمٍؒ۰۰۲۵
‘যারা কুফরি করেছে এবং আল্লাহর পথে ও মসজিদে হারামে বাধার সৃষ্টি করে। যাতে আমি স্বাগত ও বহিরাগত সকলের জন্য সমঅধিকার দান করেছি। আর যারা এতে ধর্মদ্রোহী কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে, তাদেরকে আমি মর্মন্তুদ শাস্তি আস্বাদন করাবো।’ (আল-হজ: ২৫)
লক্ষণীয় বিষয় হলো, মসজিদে আল্লাহর ইবাদতে বাধা প্রদানকারী এবং মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনাকারীদের আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বড় জালিম বলে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলিম-অমুসলিম সকলের বিশ্বাস হলো জালিমের ইহকালিন শাস্তি অবধারিত। পরকালে অবিশ্বাসী তথা মক্কার মুশরিকদের জন্য এখানে যে ভয়াবহ শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে তা হলো, তারা স্বদেশে স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার ও কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলবে। মসজিদে হারামে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হবে। যেভাবে বর্তমানে বিভিন্ন স্বাধীন দেশের মুসলিম নাগরিকদের মসজিদে প্রবেশে বাধা প্রদান করছে। একসময় তারাও সে মসজিদে প্রবেশে ভয়-ভীতি ও বাধার মুখোমুখী হবে। ভারত হলো উপমহাদেশের সুপ্রিম পাওয়ার, আমেরিকার বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কথায় আছে, ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার কোনো শত্রুর প্রয়োজন নেই।’ পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন একটি স্বাধীন জাতি নিজ দেশের একটি এলাকায় প্রবেশে কীভাবে বাধাগ্রস্থ হতে পারে? বিষয়টি অনুধাবণ করতে আমাদেরকে অতীত ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে। চোখ বোলাতে হবে কুরাইশদের ইতিহাস ও মক্কা বিজয়ের প্রেক্ষাপটে।
রাসুল (সা.)-কে মসজিদে হারামে নামায আদায়ে বাধা প্রদান করার কারণে অথবা হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে সূরা আল-বাকারার ১১৪ আয়াতটি নাযিল হয়। মদিনার উপকণ্ঠে বিকাশমান সুপ্ত মুসলিম শক্তি তখনো অনেক চড়াই-উৎরাই পার করছে। মুহুর্মুহু বেজে উঠছে যুদ্ধের দামামা। প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে আরবের সম্মিলিত বিরোধী শক্তির মোকাবেলায়। কিন্তু বায়তুল্লাহর ওমরা করতে তাঁর নবিকে বাধা দেয়ার পরিণামে আল্লাহ তাআলা তাদের পতনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
তাফসীরকারকদের মতে, যে প্রেক্ষাপটেই আয়াতটি নাযিল হোক না কেনো। আয়াতের বিধান তথা স্বাধীনতা হারানোর শাস্তি মসজিদ ধ্বংস ও এতে মূর্তি স্থাপনের সঙ্গে জড়িত সকলের জন্য প্রযোজ্য। তদুপরি ভারতের সঙ্গে মুসলমানদের অবধারিত যুদ্ধ তথা ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ সম্পর্কে রাসুল (সা.) ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। যে যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় ও কাফেরদের পরাজয়ের সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
নাইম ইবনে হাম্মাদ আল-ফিতান গ্রন্থে সাফওয়ান ইবনে আমরের বরাতে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«يَغْزُو قَوْمٌ مِنْ أُمَّتِي الْـهِنْدَ، يَفْتَحُ اللهُ عَلَيْهِمْ حَتَّىٰ يَأْتُوْا بِمُلُوْكِ الْـهِنْدِ مَغْلُوْلِيْنَ فِي السَّلَاسِلِ، فَيَغْفِرُ اللهُ لَـهُمْ ذُنُوْبَهُمْ، فَيَنْصَرِفُوْنَ إِلَى الشَّامِ، فَيَجِدُوْنَ عِيْسَى ابْنَ مَرْيَمَ n بِالشَّامِ».
‘আমার উম্মতের একটি দল ভারতে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করবেন। আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দান করবেন এবং পাপসমূহ মার্জনা করবেন। এক পর্যায়ে তারা মুশরিক শাসকগোষ্টীকে গ্রেফতার করে শামে নিয়ে যাবেন। তখন ঈসা ইবনে মারয়াম (আ.)-কে শামে দেখতে পাবেন।’ (কিতাবুল ফিতান: ১২৩৬)
নাইম ইবনে হাম্মাদ আরও বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«يَبْعَثُ مَلِكٌ فِي بَيْتِ الْـمَقْدِسِ جَيْشًا إِلَى الْـهِنْدِ فَيَفْتَحُهَا، فَيَطَئُوا أَرْضَ الْـهِنْدِ، وَيَأْخُذُوْا كُنُوْزَهَا، فَيُصَيِّرُهُ ذَلِكَ الْـمَلِكُ حِلْيَةً لَبَيْتِ الْـمَقْدِسِ، وَيُقْدِمُ عَلَيْهِ ذَلِكَ الْـجَيْشُ بِمُلُوْكِ الْـهِنْدِ مُغَلَّلِينَ، وَيُفْتَحُ لَهُ مَا بَيْنَ الْـمَشْرِقِ وَالْـمَغْرِبِ، وَيَكُونُ مَقَامُهُمْ فِي الْـهِنْدِ إِلَىٰ خُرُوْجِ الدَّجَّالِ».
‘বায়তুল মুকাদ্দাসের একজন মুসলিম শাসক ভারত অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করবেন। এ অভিযানে তারা বিজয় লাভ করবেন। তারা সমগ্র ভারতের ধন-ভাণ্ডার আয়ত্ব করে তা দিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের শোভাবর্ধণ করবেন। মুসলিম বাহিনী ভারতের শাসকগোষ্টীকে বন্দি করবে। তারা পূর্ব-পশ্চিমে পরিচালিত সকল যুদ্ধেও বিজয় লাভ করবে। সময়টি হবে দাজ্জাল এর আগমনের পূর্বমুহূর্তে।’ (কিতাবুল ফিতান: ১২৩৫)
আল-কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াতসমূহ ও ফিতান সম্পর্কীয় হাদীস দ্বারা বাবরী মসজিদে নামায আদায়ে বাধা প্রদানকারী ও মসজিদের স্থলে মন্দির নির্মাণকারী ভারতের পতনের আভাস পাওয়া যায়। মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যৎবাণী ও বিশ্ব মানচিত্রের ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে ইমাম মাহদি, দাজ্জাল ও ঈসা (আ.)-এর আগমন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর পূর্বেই বিশ্ব মুসলিম গাযওয়ায়ে হিন্দে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।
লেখক: সভাপতি, জাগৃতি লেখক ফোরাম ও পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়