জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাদশাহ হারুনুর রশিদের নামে হযরত ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর গুরুত্বপূর্ণ পত্র

বাদশাহ হারুনুর রশিদের নামে হযরত ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর গুরুত্বপূর্ণ পত্র

কে. এস. সিদ্দিকী

 

হযরত ইমাম কাজী আবু ইউসুফ (রহ.) ছিলেন ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমামে আযম আবু হানিফা (রহ.) এর প্রধান শিষ্য। ফিকাহ শাস্ত্র প্রণয়ন ও সংকলনে তাঁর অতুলনীয় অবদান রয়েছে। তাঁর নির্ভুল ও সঠিক চিন্তাধারা সম্পর্কে এইটুকু বলা যথেষ্ট যে, ফিকাহ সংক্রান্ত বহু ব্যাপারে স্বীয় ওস্তাদ হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সাথে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর মতানৈক্য ঘটলেও পরিশেষে তাঁর ওস্তাদের অভিমতই গৃহীত হয় ও প্রচলিত হয়। হযতর ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) আব্বাসীয় আমলে প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি নির্ভয়ে ও বিনাদ্বিধায় বাদশাহকে সৎ ও মূল্যবান পরামর্শ দিতে সংকোচবোধ করতেন না। বাদশাহও তাঁর উপদেষ্টা ও মন্ত্রীবর্গকে তিনি সাধারণ ভুল-ত্রুটির জন্যও সতর্ক করে দিতেন। এর এক বিরল দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায় বাদশাহ হারুনুর রশিদের নামে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর লেখা এক পত্রে। ইমাম সাহেবের সত্যবাদিতা ও সাহসিকতার উদাহরণ ইতিহাসে এই পত্রখানার গুরুত্ব অপরিসীম। এই ঐতিহাসিক পত্রে ইমাম সাহেব বাদশাহকে জনসেবার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে এবং আল্লাহর দরবারে জন সাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাকেই যে জওয়াবদিহি করতে হবে সে সম্পর্কে খলিফাকে সতর্ক করে দেন। ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ্যের উপদেশ দান করে ইমাম আবু ইউসুফ সাহেব (রহ.) ন্যায় ও সত্য প্রচারের যে আদর্শ স্থাপন করেছেন জগতের ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাদশাহর নামে লেখা ইমাম সাহেবের পত্র খানার মর্ম এই;

“হামদ সালাতের পর!

আল্লাহ তাআলা আমাদের আমীরুল মোমিনীনকে দীর্ঘায়ূ দান করুন। আমীরুল মুমিনীন! আপনাকে ভুললে চলবে না যে, আল্লাহ তাআলা আপনাকে তার সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণ ও হেফাযতের সৌভাগ্যবান করেছেন। আপনি তাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং তারা আপনার প্রজা। এমতাবস্থায় আপনাকে অহংকারী হলে চলবে না। আপনি শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে মহাপরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। আপনি যদি নিষ্ঠা ও সততার সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে থাকেন, আল্লাহ তাআলা আপনাকে এ জন্য অফুরন্ত কল্যাণ দান করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন যে, আল্লাহর শাস্তিও অতি কঠোর।

আপনি সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে সমাসীন। স্মরণ রাখবেন, ভিত্তি ছাড়া কোনো ইমারতই কায়েম থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের জাঁকজমকপূর্ণ অট্টালিকার ভিত্তি যদি ‘তাকওয়া’ বা শুদ্ধ চরিত্রতার উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তার কোনো নিদর্শন বাকী থাকে না। আমি আপনাকে উপদেশ দান করছি যে, সর্বদা নিজের অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখবেন এবং এই কাজে অবহেলা করে স্বয়ং নিজের ও প্রজা সাধারণের ধ্বংসের সামগ্রী সংগ্রহ করবেন না। সেই কাজই সঠিক, যার পশ্চাতে আল্লাহকে ভয় করার অনুপ্রেরণা নিহিত থাকে।

আল্লাহর ভয়ের পর প্রয়োজন হচ্ছে এই যে, আপনি নিজেই দায়িত্বাবলি নিয়মানুবর্তিতা ও পরিশ্রমের সাথে পালন করতে থাকুন এবং কখনও কোনো প্রয়োজনীয় কাজ আগামী দিনের জন্য রেখে দেবেন না। কেননা তাতে কাজের গুরুত্ব কমে যায় এবং কে বলতে পারে, উক্ত কাজ সমাধা করার জন্য আগামীকাল পর্যন্ত আপনি জীবিত থাকবেন কিনা। আপনি প্রজাদের সেবা এবং তাদের সুখ-শান্তির জন্য যে মুহূর্তটি ব্যয় করবেন তা নফল ইবাদত বন্দেগী অপেক্ষাও উত্তম বলে গণ্য হবে। যে শাসনকর্তার দ্বারা তার প্রজারা সুখি জীবন যাপন ও শান্তি ভোগ করবে, কেয়ামতের দিন সেই শাসনকর্তাই অধিক সৌভাগ্যবান বিবেচিত হবে।

স্মরণ রাখবেন, প্রজারা তাদের শাসনকর্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। আপনি যদি সৎ ও সঠিক পথে না থাকেন তাহলে প্রজারাও ঠিক পথে থাকবে না, তারাও বিপথগামী হয়ে পড়বে। তাই শরীয়ত বিরোধী সকল মোহ-আকর্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, ক্রোধ নিবারণ করবেন, জগতটাই ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু পরকাল একটি অনাবিল সত্য। যে সকল বিষয় পারলৌকিক স্বার্থাবলির সাথে সংশ্লিষ্ট সেগুলোকে পার্থিব স্বার্থের সাথে জড়িত বিষয়গুলোর উপর অগ্রাধিকার দান করবেন।

স্বজনপ্রীতি হতে নিজেকে পবিত্র রাখবেন। একজন সুবিচারক ও ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্তার দৃষ্টিতে আপন-পরে কোনো ভেদাভেদ থাকা উচিত নয়, তার কাছে সবাই সমান, তিনি যেন এ কথা চিন্তা না করেন যে, কে কার আত্মীয়, কে বন্ধু বা পর। বরং তাকে সব সময় এটাই ভাবতে হবে যে, কে যোগ্য-উপযুক্ত ব্যক্তি। সত্য কথা বলতে কখনও ইতস্তত করা উচিত নয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) যে কাজের আদেশ দান করেছেন তার যতই বিরোধিতা করা হোক না কেন, অত্যন্ত সাহিসকতার সাথে সেই কাজ সমাধা করতে যত্মবান হওয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখে, আল্লাহ তাআলা তার হেফাযতের দায়িত্ব বহন করেন। কেয়ামতের দিবসের জন্য এখন হতে প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। মৃত্যু এমন একটি কঠিন পথ, যা একদিন অবশ্যই আপনাকে অতিক্রম করতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে, চাই সে ধনী হোক, আর দরিদ্র হোক এক দিন না এক দিন এই পথে চলতে হবেই। মৃত্যুর পর এমন একটি স্থান পাওয়া যাবে, যেখানে বড় বড় বীর পাহালোয়ানরাও আতঙ্কিত হয়ে উঠবে। কুখ্যাত অত্যাচারীও সে দিন বোবা বনে যাবে। মানুষের অন্তরে উক্ত স্থানের ভয় এতই ভয়ানক আকার ধারণ করবে যে, অনুতাপ অনুশোচনায় মাথা নমিত হয়ে যাবে। সেখানে উপস্থিত হওয়া অত্যন্ত কঠিন, অতি কষ্টকর এবং কেয়ামতের দিন এক ভয়ানক ও মারাত্মকরূপ ধারণ করবে।

পবিত্র কোরআনে কেয়ামতের যে অবস্থা বর্ণিত হয়েছে, তার প্রতি বিশেষভাবে চিন্তা ভাবনা করবেন। আল্লাহ তাআলা সে দিন সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। প্রাপ্য শাস্তি কোনো প্রকার হৃাস করা হবে না এবং পাপীর কোনো অনুতাপ সে দিন কোনো ফল দেবে না। দিবারাত্রির ক্রমবিবর্তন পরিবর্তন কেয়ামতের দিনকে তরান্বিত ও অতি নিকটবর্তী করছে। দিবা শেষে রাত্রির আগমন হয়, আবার দিন যায় রাত্রির আগমন ঘটে এটাই চিরন্তন বিধান। প্রত্যেক নতুন জিনিস পুরাতন রূপ ধারণ করে। আল্লাহ তাআলাকে সর্বদা ভয় করতে থাকবেন, আর সেই দিনের কথা স্মরণ করবেন।

আপনি যখন আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবেন তখন সর্বাগ্রে আপনাকে স্বীয় আমলের জবাবদিহি করতে হবে এবং আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে তার আমলের প্রতিদান ও শাস্তিপূর্ণ ন্যায়বিচারের সাথে প্রদান করবেন।

আমীরুল মোমেনীন! আমি দোয়া করি, কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে আপনাকে যেন এমন অবস্থায় পেশ করা না হয় যে, আপনার আঁচল অন্যায়-অবিচার ও জুলুমের দায়ে কলঙ্কিত হবে এবং আপনি এই দুর্নামের ভাগী হবেন। স্মরণ রাখবেন, সেই দিন কোনো পারিবারিক, বংশগত বা পার্থিব মর্যাদা মানুষের কোনো কাজে আসবে না। সে দিন কোনো লোকের চেহারা বা গঠনপ্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি রাখা হবে না, দৃষ্টি রাখা হবে তার আমল ও কর্মমূহের প্রতি।

আল্লাহ তাআলা আপনাকে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। তিনি আপনাকে শাসনক্ষমতা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যেই দান করেছেন। আপনাকে সে দিন জিজ্ঞাসা করা হবে যেই উদ্দেশ্যে আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা আপনি কতটুকু পালন করেছেন এবং সেই উদ্দেশ্যে আপনাকে রাষ্ট্রপরিচালনার আসন দান করা হয়েছিল, আপনি কতটুকু যোগ্যতার সাথে তা পালন করেছেন। কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আপনাকে প্রশ্ন করবেন, তার উত্তরের জন্য আপনাকে এখন থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে। শাসনভার আপনার উপর অর্পিত হওয়ার দরুন আপনার দায়িত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে। নবী কারীম (সা.) বলেছেন যে, ‘কেয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি এই চারটি প্রশ্নের উত্তর দানের পূর্বে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে পারবে না: ১. কীভাবে পার্থিব জীবন শেষ করেছ? ২. যৌবনকাল কীভাবে কাটিয়েছো? ৩. ধন-সম্পদ কী উপায়ে অর্জন করেছ এবং ৪.তা কী কাজে ব্যয় করেছ?

আমীরুল মোমেনীন! আমি আপনাকে উপদেশ দান করছি যে, আল্লাহ তাআলা আপনাকে যে সকল দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সেগুলো সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সাথে পালন করবেন এবং আপনাকে যেসব বিষয়ের ‘আমীন’ (রক্ষক) করা হয়েছে, সেগুলোতে আপনি খেয়ানত করবেন না। আপনি যদি আমানতের হেফাযত না করেন তা হলে আপনার চোখে আবরণ পড়ে যাবে, কিছুই দেখতে পাবেন না। আপনার অন্তর হতে সত্য ও অসত্যের পার্থক্য তুলে নেওয়া হবে, আপনি আল্লাহর দয়া করুণা হতে বঞ্চিত হয়ে যাবেন। আপনার অন্তর যখন পাপ কাজের দিকে ধাবিত হয়  তখন কঠোরভাবে তার মোকাবেলা করবেন। আল্লাহর ক্রোধকে ভয় করবেন এবং তার শরণাপন্ন হবেন যেন আপনি বাদশাহের আসনে অধিষ্ঠিত থেকে স্বীয় কর্তব্যাবলি পালন করবেন এবং সেগুলোতে যেন কোনো প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি না ঘটে। আর সে সকল লোকের দাবি-দাওয়া ও স্বার্থ পূরণ এবং জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা আপনার দায়িত্ব, তা পালন করতে অবহেলা করবেন না। সরকারি কাজে ত্রুটি প্রদর্শনের শাস্তি এতই কঠিন যে, তা কল্পনা করতেও শরীরে শিহরণ জাগে। আপনি যদি প্রজা সাধারণকে ভুলে যান, তারাও আপনাকে ভুলে যাবে।

আমীরুল মুমিনীন! প্রজাদের সেবা এবং তাদের দাবি-দাওয়া ও প্রাপ্যের প্রতি তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখা ছাড়াও আপনার একটি বড় মহৎ কাজ হচ্ছে এই যে, ‘জবানকে’ আল্লাহ তাআলার স্মরণে লিপ্ত রাখবেন এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠ করবেন। তিনিই সেই সত্য নবী, যার সাথে আত্মীয়তার সম্বন্ধ থাকায় আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে এবং তারই বদৌলতে আপনাকে ‘খলিফা’ বলা হয়।

মহানবী (সা.)-এর পূত-পবিত্র জীবন আমাদের জন্য উত্তম আদর্শস্বরূপ| আল্লাহর প্রদত্ত আইন-কানুন এতই প্রশস্ত, এতই ব্যাপক এবং এতই পূর্ণাঙ্গ যে, সে অনুযায়ী আমল করা হলে জগত হতে জুলুম, অত্যাচার ও অন্যায়-অবিচার সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং জগত সত্য ও ন্যায়ের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠবে।

আমীরুল মোমিনীন! আমি আপনাকে উপদেশ দান করছি যে, আপনি রাষ্ট্র পরিচালনায় শরীয়তের আইন-কানুন প্রবর্তন করতে সচেষ্ট হবেন এবং তার প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করবেন। আল্লাহর নির্ধারিত ‘হুদুদ’ (সীমা) কায়েম করবেন এবং বান্দার ‘হুকুক’ (অধিকার) সমূহের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দান করবেন। আর ভূমি মালিকদের অধিকার রক্ষা করতে ভুল করবেন না এবং মহানবী (সা.) ও তার সাহাবীগণের মাধ্যমে যে সকল নিয়ম-পদ্ধতি ও আইন-কানুন আমাদের নিকট এসে পৌঁছেছে, সেগুলোকে প্রবর্তিত ও চালু রাখবেন।

আমীরুল মুমিনীন! স্মরণ রাখবেন, হযরত রাসূলে করীম (সা.)-এর ‘সুরত’ ও ‘আসার’-কে উজ্জীবিত রাখাই হবে সর্বোত্তম কাজ।”

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ