কাজী নজরুলের চেতনায় ইশকে রাসূল (সা.)
মোহাম্মদ শফিউল হক
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কলম সৈনিক, পরাধীন ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রথম প্রবক্তা, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতির ও বাংলা সাহিত্যের এক মহা সম্পদ। তিনি ছিলেন শক্তি আর ভক্তির এক সমন্বিত মহাপুরুষ। একদিকে শক্তির প্রকাশ ছিল দ্রোহ, অন্যদিকে ভক্তির নিবেদন ছিল প্রেম। মানবীয় পার্থিব প্রেমের ঊর্ধ্বে যে মহামানবিক অপার্থিব প্রেম, যে প্রেমে শুধু পরমের প্রতি আত্মসমর্পণের সম্পূর্ণ নিবেদন, নজরুল ছিলেন সে প্রেম দুনিয়ার মুয়াজ্জিন। ‘আমি আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি এবার মনের মাঠে’ খোদাপ্রেমের এ গান নজরুল গেয়েছিলেন। খোদার হাবিব, আমাদের নবী বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত, স্বাধীনতা মুক্তির সনদ হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর প্রতি যে বর্ণনাতীত ভালোবাসা, প্রেম ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তা আর কোন বাঙালি সাহিত্যিক দেখিয়ে যাননি। কি তাঁর গান, কি কবিতা সব জায়গায় তিনি রাসূলপ্রেমের এক দ্যূতি ছড়িয়েছেন। তিনি তাঁর সবকিছু নবীপ্রেমে সঁপে দিয়েছেন আর নিজেকে রাসূল (সা.) এর একজন বাধ্য শিষ্যরূপে আত্মপ্রকাশ করাতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। যা আজো কোটি মুসলমানদের মুখের কথা, প্রাণের কথা।
রাসূলের শানে নজরুল নিবেদন করেছেন তার কবিতার তোহফা, গজলের সুরে সুরে গেয়েছেন রাসূলের মুহব্বতের গীতমালা। রাসূল (সা.)-এর পৃথিবীতে আগমন কেন্দ্রিক গানে কবি লিখেছেন, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে/যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে।’ আরব জাহানের শুষ্ক মাটির স্বভাবগত কারণেই সেখানে সবুজ প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি হয় কম। মক্কানগরীর সেই মরু অঞ্চলে রাসূলের আগমনকে বিদ্রোহী কবি সৌরভপূর্ণ ফুটন্ত গোলাপের সাথে
তুলনা করেছেন। আর সেই ফুটন্ত গোলাপের খোশবু নিতে বিশ্বজাহানে প্রতিযোগিতা এবং কাড়াকাড়ি যেন শুরু হয়েছে। চাঁদ-সুরুজ, গ্রহ-তারা, নীল আকাশ, বৃক্ষলতা, বেহেশতের হুর-পরী তথা বিশ্বজাহানের সকল মাখলুক সেই ফুলের খোশবু নিতে মাতোয়ারা। যেমনটি কবি বলেন, ‘সাহারাতে ফুটল রে ফুল/রঙিন গুলে লালা।/সেই ফুলেরই খোশবুতে/আজ দুনিয়া মাতোয়ারা।’
কবি রাসূল (সা.)-এর শানে দরুদ পড়ে লিখেন, ‘উরজ্ য়্যামেন্ নজ্দ হেজাজ্ তাহামা ইরাক শাম/মেসের ওমান্ তিহারান-স্মরি’ কাহার বিরাট নাম,/পড়ে, ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম।’ কবি এখানে ইয়ামেন, নজদ, হিজাজ, ইরাক, ইরান, মিসর, ওমান ও তেহরানসহ বিশ্বব্যাপী রাসূল (সা.)-এর নাম মোবারক নিয়ে মানুষ কিরূপ শ্রদ্ধা ও পূর্ণভক্তি সহকারে উনার প্রতি দরুদ পড়েন তার উল্লেখ করেন। কবি আরও বলেন, ‘আমার সালাম পৌঁছে দিও নবীজীর রওজায়।’
নজরুল তাঁর কবিতায় রাসূল (সা.)-কে সৃষ্টিজগতের দম বা প্রাণ বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর ইনতিকালের পর মক্কা ও মদীনার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘মক্কা ও মদীনায় আজ শোকের অবধি নাই।/যেন রোজ-হাশরের ময়দান, সব উন্মাদ সম ছুটে!/কাঁপে ঘন ঘন কাবা, গেল গেল বুঝি সৃষ্টির দম টুটে!
কাজী নজরুল রাসূল (সা.)-কে আরবের উদিত সূর্য বলে উল্লেখ করে
তাঁর গুণগান গেয়েছেন। সূর্য যেমনি করে সমস্ত জগতকে আলো দেয় তেমনি রাসূল (সা.) সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে কল্যাণ ও রহমতের এক ঐশী আলো নিয়ে এসেছেন। কবির রচনায় এসেছে, ‘জেগে ওঠ তুই রে ভোরের পাখী, নিশি প্রভাতের কবি!/লোহিত সাগরে সিনান করিয়া উদিল আরব-রবি। তিনি আরও বলেন, ‘নহে আরবের, নহে এশিয়ার, বিশ্বে সে একদিন,/ধূলির ধরার জ্যোতিতে হ’ল গো বেহেশত জ্যোতিহীন!/কবি তাঁর অন্য কাব্যগ্রন্থে লিখেন, ‘উঠেছিল রবি আমাদের নবী, সে মহা-সৌরলোকে,/ওমর, একাকী তুমি পেয়েছিলে সে আলো তোমার চোখে!’
রাসূল (সা.)-কে আল্লাহপাক দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন সকল প্রকার ভেদাভেদ, হানাহানি-মারামারি ভুলিয়ে মানুষের মাঝে প্রেম-প্রীতি আর ভালবাসা কায়েম করার জন্য। তিনি এই ধরায় এসে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের এক বর্বর যুগের মানুষদের তৈরি করলেন পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে সোনার মানুষ রূপে। কবি তাই সেই তরুণ নবীর জয়গান গেয়ে বলেন, ‘দেখিতে দেখিতে তরুণ নবীর সাধনা-সেবায়/শত্রু মিত্র সকলে গলিল অজানা মায়ায়।’/‘মোহাম্মদের প্রভাবে সকলে হইল রাজী,/সত্যের নামে চলিবে না আর ফেরেব-বাজী!’
পথভোলা মানুষদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আখেরী নবী রাসূল (সা.)-কে পাপে নিমজ্জিত মানুষকে জাহান্নামের ভয়, জান্নাতের সুসংবাদ সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার বিধানকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য পাঠানো হয়। মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানবের মহান শিক্ষকের নিকট হতে সওদা নিয়ে পাপমুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে/এল নবীন সওদাগর/বদনসিব আয়, আয় গুনাহগার/নতুন করে সওদা কর।/ জীবন ভরে করলি লোকসান/ আজ হিসাব তার খতিয়ে নে/বিনি মূলে দেয় বিলিয়ে সে যে বেহেশতি নজর।’
কিয়ামতের দিন হাশরের মাঠে আল্লাহর অসহায় বান্দারা সকলেই নিজের মুক্তির জন্য ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করতে থাকবে। পাপ-পুণ্যের হিসাব দিয়ে মুক্তির সনদ নিতে হবে সেদিন সকল মানুষকে। পরপারের ভয়াবহতম এইদিনে রাসূল (সা.)-এর শাফায়াত ছাড়া মুক্তির বিকল্প কোনো পথ খোলা থাকবে না বান্দার জন্য। উক্ত গানের অপর অংশে সে কথাটিই বলছেন কবি নজরুল শাফায়াতের সাত রাজার ধন/কে নিবি আয় ত্বরা কর।/কিয়ামতের বাজারে ভাই/মুনাফা যে চাও বহুৎ/এই ব্যাপারির হও খরিদ্দার/লও রে ইহার সীলমোহর।’
কিশোরকালে রাসূল (সা.) বাণিজ্য উপলক্ষ্যে চাচা আবু তালেবের সাথে সিরিয়া গমন করলে সেখানকার একজন খ্রিস্টান পাদরি নজরে আসে যে রাসূল (সা.)-কে তপ্ত রৌদ্রালোকের মাঝে এক খণ্ড মেঘ ছায়া দিয়ে চলছে। নবী প্রেমিক কবি তাঁর মনোজগতের কল্পনায় দেখতে পাচ্ছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এ মহামানবকে শুধু মেঘই নয় বরং বিজলি তাঁর গলার মালা হয়ে এবং পূর্ণিমার চাঁদ তাঁর মাথার মুকুট হয়ে শোভাবর্ধন ও ধন্য হতে চায়। হেরা হতে হেলে দোলে-এ গানের শেষ অংশে কবি উল্লেখ করেছেন এভাবে ‘আসমানে মেঘ চলে ছায়া দিতে/পাহাড়ের আছুগলে ঝরণার পানিতে/বিজলি চায় মালা হতে/পূর্ণিমার চাঁদ তাঁর মুকুট হতে চায়।’
কবি নজরুল নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করতেন যদি রাসূলের পায়ের একটু পরশও পেতেন। রাসূল (সা.) এর প্রতি কবির অকৃত্রিম ভক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়, এই গানে, ‘আমি যদি আরব হতাম মদীনার পথ/সেই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হযরত।’ নবীর নাম কবি যতই স্মরণ করেন মনের প্রশান্তি ততই বাড়ে। এই তৃপ্তির শেষ নেই, অফুরন্ত। তিনি ব্যাকুল হয়ে প্রিয়তমের নাম জগতে থাকেন। এ গানের শেষ অংশে পরম প্রভুর নিকট আকুতি জানিয়েছেন সদা সর্বদা বিশ্বনবীর নাম যেন তাঁর হৃদয়পটে অম্লান থাকে। যেমন- ‘মুহম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে/নামে এত মধু আছে কে জনিত আগে।/………/ঐ নামে মুসাফির রাহি চাই না তখত শাহানশাহী/নিত্য ও নাম ইয়া ইলাহি/যেন হৃদে জাগে।’
কবি নজরুলের আরও একটি বিখ্যাত গান ‘তাওহীদেরই মুরশিদ আমার মুহম্মদের নাম, ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি খোদার কালাম।’ এ গানে কবির রাসূলপ্রেম সহজ ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য রাসূল (সা.)-এর দেখানো পথই একমাত্র পথ।
কবির চঞ্চল চিত্ত আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় মদীনার প্রকৃতির সাথে সখ্য গড়ে মদীনার মাটি, বায়ু, আকাশ-বাতাসকে মনের গভীর বন্ধন থেকে জিজ্ঞেস করছেন আল্লাহর এই প্রিয় বন্ধুটি মদীনার কোন কোন জায়গায় বিচরণ করেছেন? বিমোহিত নয়নে সে জায়গাগুলো দেখতে চান তিনি। কবি তাঁর এই গানে বলেন, “আরে ও মদীনা বলতে পারিস কোন সে পথে তোর/খেলত ধুলামাটি নিয়ে মা ফাতেমা মোর।/… … …/মা আয়শা মোর নবীজীর পা ধোয়াতেন যেথা/দেখিয়ে দে সে বেহেশত আমায় রাখ রে আমার কথা।/… … …/কোন্ পাহাড়ের ঝর্ণা তীরে মেষ চড়াতেন নবী/কোন্ পথ দিয়ে রে যেতেন হেথায় আমার আল আরাবি/তুই কাঁদিস কোথায় বুকে ধরে সেই নবীজির গোর।’
কবি তার কবিতায় রাসূল (সা.)-কে কখনো তার নয়ন-মণি, কখনো গলার মালা, আবার কখনো চোখের অশ্রুর সাথে তুলনা করে কবি মনের আকুল কাকুতি-মিনতি প্রকাশ করেছেন। কবি মনে করেন যে, রাসূল (সা.)ই তার সবকিছু। এমনকি কবি মানবজাতির বহুল আকাঙ্ক্ষিত বেহেশতের আশাও ছেড়ে দিয়েছেন যদি পান সেই মহান প্রেমাস্পদ রাসূল (সা.)-কে। যেমন কবির ভাষায়: ‘মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি মোহাম্মদ নাম জপমালা।/মোহাম্মদ নাম শিরে ধরি, মোহাম্মদ নাম গলায় পরি,/মোহাম্মদ মোর অশ্রু-চোখের ব্যথার সাথি শান্তি শোকের,/চাইনে বেহেশত্ যদি ও নাম জপ্তে সদা পাই নিরালা।’
কবি মনে করেন রাসূল (সা.) ছাড়া অন্য কেউ বেহেশতের সঠিক পথ দেখাতে পারবে না। একমাত্র সহজ-সরল ও সত্যের পথ মানবজাতিকে দেখানোর জন্যই যেন তিনি পরম সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এ ধরাধামে আগমন করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইয়া মোহাম্মদ, বেহেশত হতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও।’ পৃথিবীতে মহান আল্লাহর ঘর বলতে মক্কা নগরীর পবিত্র কাবা শরীফকে বুঝানো হয়ে থাকে। আর হজ্জ ও হজ্জের মৌসুম ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়েও সমগ্র পৃথিবী থেকে দলে দলে মুসলমানরা এই ঘর তাওয়াফসহ পবিত্র জায়গাটি কেন্দ্র করে পুণ্য হাসিলের নিমিত্তে ছুটে আসে। জীবনের একটি পরম আকাকাঙ্ক্ষা থাকে কাবার পথে যাওয়ার। কবির মনেও ছিল এইরকম এক সুপ্ত বাসনা। আর তিনি প্রিয় নবীজী (সা.)-এর কাছেই প্রকাশ করলেন তাঁর এই গহীন ইচ্ছা। তিনি বলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! মোরে রাহ্ দেখাও সেই কাবার।’
মুসলিম জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য গান ও কবিতায় রাসূল (সা.)-এর প্রতি তাঁর হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা প্রকাশমান। আট বছরের শিশু বয়সে মসজিদে চাকরি নেয়ার মাধ্যমে রাসূলের প্রতি তার যে দরদের শুরু হয়েছিল বাকরুদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তা চালু ছিল। বিভিন্ন সময়ে মনোভাবে বঞ্চনার শিকার হলেও কবি তাঁর আদর্শ হতে বিচ্যুত হননি কখনো। সাহিত্য ও কবিতাচর্চার বর্তমান সময়ে নজরুলের মতো আল্লাহ ও রাসূলপ্রেমিক একজন লেখকের বড় বেশি প্রয়োজন।