জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনায় করণীয় ও বর্জনীয়

করোনায় করণীয় বর্জনীয়

মাওলানা এরফান শাহ

করোনা ভাইরাসে করুণ অবস্থা! নার্ভাস বিশ্বব্যবস্থা! বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা! দেশে দেশে শাটডাউন তথা অচলাবস্থা! অনিশ্চিত জীবন যাত্রা। সর্বত্র উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা! থমকে গেছে পৃথিবী! অবাক সারা দুনিয়া! করোনাভাইরাস এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। সর্বদা একটিই ভাবনা, করোনা আর করোনা। জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত! পেশাজীবীরা ভীত-সন্ত্রস্ত! আর সরকার কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কি হতে চলেছে? কিভাবে এ মহামারী মোকাবেলা করবে, সে চিন্তায় দায়িত্বশীলদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। চীনের উহান শহর উৎপত্তি স্থল হলেও তা এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক রাষ্ট্র এ ভাইরাসে আক্রান্ত। রোগীর সংখ্যা লক্ষাধিক আর মৃতের সংখ্যা আট সহস্রাধিক! দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের অন্যতম কারণ, এটি সংক্রামক তথা ছোঁয়াচে ব্যাধি। এ রোগের ভ্যাকসিন তথা প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি, চেষ্টা চলছে।

বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, পরাশক্তিগুলো যদি শত্রুকে পরাস্ত করার জন্য ট্রাডিশনাল অস্ত্রের পরিবর্তে জীবাণু অস্ত্র তৈরির পিছনে পড়ে, তাহলে গবেষণাগারের সামান্য ভুল-ত্রুটি ও দুর্ঘটনা থেকে যে ভাইরাস তৈরি হবে তা মরণব্যাধির জন্ম দিয়ে গোটা মানবসভ্যতা ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠতে পারে। যে হুবেই প্রদেশ থেকে করোনা ভাইরাসের বিস্তার, সেখানেই এ গোপন জীবাণু গবেষণাগার রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদেরকে কোনো কোনো কর্মের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (আর-রুম: ৪১) পরাশক্তিগুলো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য যেভাবে যুদ্ধ ও মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু করেছে তাতে মহামারীতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে যুদ্ধবাজ ও দাঙ্গাবাজ রাষ্ট্রপ্রধানদের ক্ষমতার প্রতিযোগিতায়! ভিকটিমের আহাজারিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত! অথচ, পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, দেশে দেশে ক্ষমতার লড়াই, অহেতুক যুদ্ধ, অনর্থক দ্বন্দ্ব, নির্যাতন ও দমন-পীড়ন নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই! কোনো প্রতিবাদ নেই। নেই কোনো আলোচনা। বিশ্ব নীরবদর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছড়িয়ে পড়লে শত চেষ্টা করেও তা হয়তো প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে অযথা আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। মৃত্যু জীবনে একবারই আসে। কথায় বলে, ‘কপালের লিখন যায় না খণ্ডন।’ মৃত্যুর হাত থেকে কেউ বাচঁতে পারেনি এবং পারবেও না। মৃত্যু সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এসেছে, ‘বল, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পালাচ্ছ, তা অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবে।’ (আল-জুমুআ: ৮) অতএব নির্ধারিত মৃত্যুর ভয়ে বার বার মৃত্যুবরণ করা কখনো বিশ্বাসী ও বীরপুরুষের কাজ হতে পারে না।

আল্লাহ পাক এ ধরনের দুর্যোগ দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন। আল্লাহপাক বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে, ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ প্রদান কর।’ (আল-বাকারা: ১৫৫) মানুষ অন্য প্রাণীর মতো নয়। মানুষ আল্লাহর খলীফা তথা প্রতিনিধি। মানুষকে ভাবতে হবে বিশ্ব মানবতা নিয়ে। অপরের সুখে-দুঃখে নিজেকে উজাড় করে দিতে হবে। সৃষ্টির সেবায় আত্ননিয়োগ করতে না পারলে, মানুষ নামের মর্যাদা থাকে না। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষ একা বসবাস করতে পারে না। অতএব, নিজেকে আড়াল করার চিন্তা না করে বরং মানবিকতার পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে। আজ হোক আর কাল হোক একদিন এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চির বিদায় নিতে হবে। তবে দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের সেবা করে যদি যেতে পারি, তখনই হবে স্বার্থক বিদায়।

মহামারী থেকে পালিয়ে কি মৃত্যু থেকে বাঁচা সম্ভব? এজন্য হাদীসে নিজের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্য একটি কারণ এই যে, আক্রান্ত মানুষের সেবা করতে লোকের প্রয়োজন আছে। ভিন্ন এলাকা থেকে কেউ ঝুঁকি নিয়ে আসতে চাইবে না। এজন্য উপদ্রুত এলাকায় যারা সুস্থ আছেন, তাদের উচিত নিজেদের উজাড় করে অসুস্থদের সেবা করে যাওয়া। মানব সেবার মাধ্যমেই আমরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারি। তাই, করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক না ছড়িয়ে বরং দুর্যোগ মোকাবেলা করার মনোভাব নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ভয়কে জয় করতে হবে। সাহসিকতার সাথে এগিয়ে যেতে হবে।

মানবতার মুক্তিদূত মহামানব, আহমদ মুজতবা, মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) দেড় হাজার বছর পূর্বে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা কোথাও মহামারীর কোনো সংবাদ শোন, তাহলে তোমরা সেখানে প্রবেশ করিও না। আর যদি কোনো শহরে কেউ সেই মহামারীতে আক্রান্ত হয়, তাহলে তোমরা সেই শহর থেকে পলায়ন করিও না।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৫৩৯৬) সাহাবাদের যুগে একবার মহামারী প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শাহাদাতবরণ করেন অনেক সাহবায়ে কেরাম। তার মধ্যে একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী, জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন। রাসূল (সা.) প্লেগ সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটা হচ্ছে একটা আযাব। আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ওপর ইচ্ছা তা প্রেরণ করেন। তবে আল্লাহতাআলা মুমিনদের জন্য তা রহমতস্বরূপ করে দিয়েছেন। কোনো বিশ্বাসী যদি আক্রান্ত জায়গায় ধৈর্য সহকারে অবস্থান করে এবং অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তাআলা তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে, যদি মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে, সে শহীদের মর্যাদা পাবে।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৩৪৭৪)

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নজাগে করোনাভাইরাস কি তাহলে আল্লাহতাআলার পক্ষ থেকে কোনো আজাব? আবার বলেছেন এটি বিশ্বাসীদের জন্য শর্ত সাপেক্ষে রহমত! উল্লেখ্য, একই মহামারী কারো জন্য হতে পারে আজাব, আবার কারো জন্য হতে পারে রহমত। এটি মুমিনদের জন্য শাপে বর! তাই এটিকে ঢালাওভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব বা রহমত বলার সুযোগ নেই। বলা যেতে পারে, ‘অবিশ্বাসীদের জন্য আজাব আর বিশ্বাসীদের জন্য রহমত।’

করোনায় করণীয়

এক. যথাযথ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

দুই. পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।

তিন. সজাগ, সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে বরং মহান রবের দরবারে ইস্তেগফার, কান্নাকাটি, ক্ষমা প্রার্থনা এবং বেশি বেশি দুআ ও দরুদ পড়তে হবে। আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে হবে।

اللّٰهُمَّ لَا تَقْتُلْنَا بِغَضَبِكَ وَلَا تُهْلِكْنَا بِعَذَابِكَ وَعَافِنَا قَبْلَ ذَلِكَ.

আল্লাহ না করুক, তারপরও যদি কোন মুমিন আক্রান্ত হন, তাহলে ধৈর্য ধরতে হবে এবং আল্লাহপাকের হুকুমের ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মহান রবের হুকুমের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কবি আল-মাহমুদের ভাষায় বলতে চাই, ‘ভালো মন্দ যা কিছু ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’ কেননা ‘আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ, সবকিছু বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।’ (আল-আনআম: ১৬২) রাসূল (সা.) বলেন, ‘মুমিনের বিষয়টি আশ্চর্যজনক! তার প্রত্যেকটি বিষয় কল্যাণকর, এটা মুমিন ব্যতিত অন্যকারো ভাগ্যে নেই। যদি তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, আল্লাহর শোকর আদায় করে, এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে ধৈর্য ধারণ করে, এটাও তার জন্য কল্যাণকর।’ (সহীহ মুসলিম: ৫৩২২)

জন্ম ও মৃত্যু মহান রব তথা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রিত মহিমা। এসব বিধাতার শাশ্বত বিধান। তারই নিয়ন্ত্রণাধীন ও ইচ্ছাধীন। অতএব যে বিষয়টি হাতের নাগালের বাইরে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ও অনুশোচনা কখনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। পরিশেষে মহান রবের দরবারে দু’হাত তুলে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ করি, হে আল্লাহ! হে রহমান! হে রহিম! আমাদেরকে দয়া কর। তোমার গজব দ্বারা আমাদেরকে হত্যা করো না। তোমার আজাব দ্বারা আমাদেরকে ধ্বংস করে দিও না। এসবের পূর্বেই আমাদেরকে সুস্থতা দান করুন। আমীন, ইয়া রব্বাল আলামীন।

লেখক: গ্রন্থকার গবেষক,  হাটহাজারী, চট্টগ্রাম

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ