আল্লামা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.): তাঁর ইলমি মাকাম
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
বিশ্বনন্দিত ইসলামী শিক্ষা নিকেতন ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস হযরত আল্লামা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.)-এর ইলমি গভীরতা, গবেষণাকর্ম, অনুবাদ সাহিত্য, পঠনপাঠন অভিজ্ঞতা সমসাময়িককালে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তাঁর ৮০ বছরের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য, জ্যোতির্ময় ও কর্মমুখর। হেলাফেলা ও অবহেলায় জীবনের একটি মুহূর্তও বিনষ্ট হতে দেননি। ইলমে দীন আহরণ ও বিতরণ ছিল তাঁর সারা জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। ছাত্রজীবন থেকে রুটিনমাফিক দৈনন্দিন জীবন পরিচালনায় তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন দেওবন্দী ঘরানার এক বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও জ্ঞানসাধক, যার যশ, খ্যাতি ও পরিচিতি ভারতের সীমানা পেরিয়ে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতের গুজরাটের ইলমি খান্দানে জন্মগ্রহণকারী এই মনীষী এমন এক এলাকায় প্রাথমিক পড়ালেখা সম্পন্ন করেন, যার নাম ছিল পালনপূর। বিদগ্ধ ও মুহাক্কিক আলিমে দীনের জন্য পুরো উপমহাদেশে পালনপূরের খ্যাতি ও পরিচিতি রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত সাহারানপূরের মাজাহেরুল উলুম মাদরাসায় পাঠগ্রহণ শেষ করে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। ২২ বছর বয়সে কৃতিত্বের সাথে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে তিনি দাওরায়ে হাদীস ডিগ্রি প্রাপ্ত হন। অতঃপর তিনি হযরত মুফতি সাইয়েদ মাহদি হাসান শাহজাহানপুরী (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে ‘ইফতা’-এর কোর্স সম্পন্ন করেন। খ্যাতনামা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ মাওলানা মুফতি মাহমুদ হাসান নানুতুভী (রহ.)-এর সহকারী হিসেবে ফতোয়া রচনার দুর্লভ সৌভাগ্য তাঁর ভাগ্যে জোটে। তাঁর প্রদত্ত ও সাক্ষরিত বহু গুরুত্বপুর্ণ ফতোয়া দারুল উলুম দেওবন্দের ইফতা বিভাগের রেজিষ্টারে সংরক্ষিত আছে।
দারুল উলুম দেওবন্দে যেসব খ্যাতনামা উস্তাদের কাছে তিনি ইলমে দীন হাসিল করার সৌভাগ্য লাভ করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, মাওলানা সাইয়েদ আখতার হোসাইন সাহেব দেওবন্দী, মাওলানা বশির আহমদ খান সাহেব বুলন্দশহরী, মাওলানা সাইয়েদ হাসান সাহেব দেওবন্দী, হাকিমুল ইসলাম কারী মুহাম্মদ তৈয়ব সাহেব দেওবন্দী, মাওলানা ফখরুল হাসান সাহেব মুরাদাবাদী, মাওলানা মুহাম্মদ যহুর সাহেব দেওবন্দী, মাওলানা ফখরুদ্দিন সাহেব মুরাদাবাদী, আল্লামা মুহাম্মদ ইবরাহীম সাহেব বলিয়াভী, মুফতিয়ে আযম মাওলানা মুফতি সাইয়েদ মাহদী হাসান সাহেব শাহজাহানপুরী, শায়খ মাহমুদ আবদুল ওয়াহাব মাহমুদ সাহেব মিসরী, মাওলানা ওয়াকার আলী সাহেব বিজনূরী ও মাওলানা নসির আহমদ খান সাহেব বুলন্দশহরী।
ফারিগ হওয়ার পর সুরাটের রান্দির দারুল উলুম আশরাফিয়ায় উস্তাদ হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘ ৯ বছর তিনি এই মাদরাসায় বিভিন্ন কিতাব বিশেষ করে আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, তাহাভী, শামায়েল, মুআত্তাইন, মিশকাত, জালালাইন, হিদায়া আখিরাইন, আল ফাউযুল কবির পাঠ দান করেন। দারস ও তাদরীসের পাশাপাশি তিনি নানা বিষয়ে নিবন্ধ রচনায় ব্যাপৃত হন। ‘ইফাদাতে নানুতুভী’ শিরোনামে লিখিত একটি গবেষণা নিবন্ধ আল্লামা মানযুর নুুমানী (রহ.) কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক ‘আল-ফুরকান’-এ কিস্তি আকারে ছাপা হয়। এ সময় তিনি মাওলানা আবু তাহের পাটনী (রহ.) লিখিত ‘আল-মুগনী’-এর আরবি শরাহ রচনা করেন।
১৩৯৩ হিজরী সালে তিনি মাদরে ইলমি দারুল উলুম দেওবন্দে উস্তাদ মনোনীত হন। একাধারে ৪৮ বছর তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষকতার খিদমত আঞ্জাম দেন সফলতার সাথে। এই সময়ে তিনি মুসাল্লামামুস সাবুত, হিদায়া, সুল্লুমুল উলুম, জালালাইন, আল-ফাউযুল কবির, শারহে আকায়েদ নাসাফী, মোল্লা হাসান, তাফসীরে বায়যাভী, মুতানাব্বী, মাইবুযী, মিশকাত, সাবায়া মুআল্লাকা, নুখবাতুল ফিকর, তাফসীরে মাযহারী, সিরাজী, নাসায়ী, মুওয়াত্তা ইমাম মালেক, দিওয়ানে হামাসা, মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ, মুসলিম, তিরমিযী, বুখারী, ইবনে মাজাহ, তাহাভী, আল ইতকান, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, হুসামী, মুসামারাহ, মুকাদ্দামাহ ইবনে সালাহ, রশিদীয়াহ, তাফসীরে মাদারিকের দারাস প্রদান করেন। এতগুলো অতিগুরুত্বপূর্ণ কিতাবের পাঠদানের সৌভাগ্য ও সুযোগ ক’জনের আসে?
উপর্যুক্ত কিতাবের তালিকা পর্যালোচনা করলে সহজে প্রতীয়মান হয় যে, যিনি এসব কিতাব পাঠদান করেন তাঁর ইলমি মাকাম কত উঁচু। হযরতের দারসে বসে ইলম অর্জনে শিক্ষার্থীদের বিশেষ আগ্রহ সবসময় লক্ষ্য করা গেছে। জটিল থেকে জটিলতর বিষয়গুলো বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপন করার গুণ ও যোগ্যতা ছিল তাঁর সহজাত।
শায়খুল হাদীস হয়রত আল্লামা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.) শিক্ষকতা জীবন তথা আমলি যিন্দেগীর প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অতি মূল্যবান। ব্যস্ততার মাঝেও অধ্যবসায়, অধ্যয়ন, লেখালেখি থেকে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি। একাগ্রতা ও মেহনত তাঁকে সফলতার স্বর্ণ শিখরে পৌঁছায়। তাঁর লিখিত ছোট বড় গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক। মৌলিক রচনার পাশাপাশি তিনি বহু কিতাবের তরজমা করেছেন ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন। উর্দু, আরবি ও ফার্সী ভাষায় তাঁর পারঙ্গমতা বিস্ময়কর। অনুবাদ মূলতঃ দুরুহ কাজ। দু’ভাষার ওপর সমান দক্ষতা না থাকলে অনুবাদ হৃদয়গ্রাহী ও প্রাঞ্জল হয় না। যে কোন বিদেশী ভাষা থেকে মাতৃভাষায় অনুবাদ যতটা সহজ, বিদেশী ভাষা থেকে আরেকটি বিদেশী ভাষায় তরজমা ততটা কষ্টসাধ্য। আল্লামা মুহাম্মদ তাহের পাটনী (রহ.) রচিত আসমাউর রিজালের কিতাব ‘আল-মুঘনী’-এর আরবি শরাহ লিখেছেন হযরত মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.)। ‘যুবদাতুত তাহাভী’ নামে ইমাম তাহাভীর ‘শারহু মাআনী আল আছার’ সংক্ষেপিত শরাহ আরবিতে লিখেছেন তিনি। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) কর্র্তৃক ফার্সী ভাষায় রচিত উসূলে তাফসীর বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল ফাউযুল কবির’ তিনি আরবি ভাষায় তরজমা করে এর নামকরণ করেন ‘আল-আউনুল কবির’। দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস ও মুফতি জনাব মাওলানা মুহাম্মদ আমিন ইবন ইউসূফ পালনপুরী (দা. বা.) ‘আল-খায়রুল কাছির’ নামে এটাকে আরবি থেকে উর্দূতে ভাষান্তর করেন।
শায়খুল হাদীস হয়রত আল্লামা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.) লিখিত কয়েকটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হল। বিষয়বৈচিত্র ও জ্ঞান গবেষণার কারণে এই কিতাবগুলো সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আহলে ইলমদের কাছে তাঁর রচিত কিতাবের রয়েছে বিশেষ চাহিদা।
- তাফসীরে হিদায়তুল কুরআন (১-৫ খণ্ড),
- ফায়যুল মুনঈম, মুসলিম শরীফের শরাহ,
- তুহফাতুত দুরার, নুখবাতুল ফিকরের শরাহ,
- মাবাদিউল ফালসাফা, আরবি,
- মুঈনুল ফালসাফা, উর্দু,
- মিফতাহুত তাহযীব,
- আসান মানতিক,
- আসান সারাফ,
- মাহফুযাত, নির্বাচিত আয়াত ও হাদীস সংকলন (১-৩ খণ্ড),
- শারহু রাসমিল মুফতি,
- শারহু তাওসীকিল কালাম,
- হায়াতে ইমাম আবু দাউদ সিজিস্তানী (রহ.),
- মাশাহিরে মুহাদ্দিসিন ওয়া ফুকহায়ে কিরাম,
- হায়াতে ইমাম তাহাভী (রহ.),
- ইসলাম তাগাইয়ার পযির দুনিয়া মে,
- নুবুওয়াত নে ইনসানিয়ত কো কিয়া দিয়া?
- দাড়ি আউর আম্বিয়া কি সুন্নাতেঁ,
- হুরমতে মুসাহারাত,
- তাসহীলে আদিল্লায়ে কামিলা,
- ইযাহুল আদিল্লাহ,
- হাওয়াশিয়ে ইমদাদুল ফাতাওয়া,
- ইফাদাতে নানুতুভী,
- ইফাদাতে রশিদীয়াহ,
- রাহমাতুল্লাহিল ওয়াসিয়াহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার উর্দু শরাহ, (১-৫ খণ্ড),
- ফতওয়া সংকলন,
- তুহফাতুল আলমায়ী, শরহে সুনান তিরমিযী (১-৫ খণ্ড),
- মিফতাহুল আওয়ামিল,
- গাঞ্জিনায়ে সারাফ,
- কিয়া মুকতাদী পর ফাতিহা ওয়াজিব হ্যা,
- তারাযী, শারহে সিরাজী,
- কামিল বুরহানে ইলাহী, (১-৪ খণ্ড),
- আসান ফার্সি (১-২ খণ্ড),
- আসরী তালীম আওর উস কে তাকাযে,
- আল-কালামুল মুফীদ ফি তাহরীরিল আসানীদ,
- আল-ওয়াফিয়া শারহে কাফিয়া,
- হাশিয়াতু হুজ্জাতিল্লাহিল বালিগাহ, আরবি (১-২ খণ্ড),
- আসান নাহু, (১-২ খণ্ড)|
২০০৭ সালে আমি যখন দারুল উলুম দেওবন্দ সফর করি হযরত মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.)-এর সাথে তাঁর কক্ষে মুলাকাত করি এবং দোয়া নিই। চট্টগ্রামের জিরি আল-জামিয়াতুল আরাবিয়া আল-ইসলামিয়ায় তিরমিযী শরীফের পাঠদানের সময় আমি অন্যান্য শারুহাতের সাথে নিয়মিত হযরতের লিখিত ‘তুহফাতুল আলমাঈ, শরহে সুনান তিরমিযী’ অধ্যয়ন করে থাকি। এতে আমার জ্ঞানের অনুষদ বাড়ে এবং তালিবে ইলমরা সমানভাবে উপকৃত হয়। এভাবে হযরত পালনপুরী (রহ.) সাথে আমার ইলমি সম্পর্ক বহাল রয়েছে। দোয়া করি আল্লাহ তাআলা হযরতের সব খিদমাত কবুল করুন এবং জান্নাতে উচ্চ মাকাম নসীব করুন, আমিন ইয়া রাব্বাল আলামীন।