মুফতি নুর মুহাম্মদ রাহমানী
হালাল খাবার মহান আল্লাহর ভালবাসা ও জান্নাত লাভের রাস্তা, দোয়া কবুলের হাতিয়ার। বয়সে বরকত হয় এবং ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায় এতে। দুনিয়ার সৌভাগ্য এবং আখিরাতে জান্নাত লাভে সহায়ক হয়। কথায় মিষ্টতা আনে। আমল করার আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। হালাল উপার্জনে বংশের মধ্যে বরকত হয়। নিজের পরিশ্রমে উপার্জন মানুষের ভদ্রতার পরিচায়ক।
ইসলামে যেখানেই পরিশ্রম ও হালাল উপার্জনের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে সেখানেই হারাম সম্পদ ও অবৈধ আমদানি-রফতানিতে অর্জিত উপার্জনকে মানুষের ধ্বংস, নেক কাজ বরবাদ হওয়া এবং এর ধ্বংসাত্মক প্রতিফলগুলোকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই হালাল উপার্জনকে যেমনিভাবে নেক ও পুণ্যের বিষয় বলা হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে অবৈধ ও হারাম ধন-সম্পদকে বিপদ-মুসিবত এবং পাপাচারের মৌলিক কারণ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বোঝা গেল মুমিন বান্দার জীবনধারাতে হালাল উপার্জন মৌলিক গুরুত্বের দাবিদার। কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা এ ব্যাপারে আমাদের ভরপুর নির্দেশনা দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে, তোমরা তা আহার করো এবং কোনোক্রমেই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা আল-বাকারা: ১৬৮)
অবৈধ উপায়ে উপার্জিত সম্পদের ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করো না এবং মানুষের ধনসম্পত্তির কিয়াদাংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের কাছে নিয়ে যেয়ো না।’ (সূরা আল-বাকারা: ১৮৮)
হালাল রিজিক উপার্জন করাকে ইসলাম ইবাদত হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ফরজ ইবাদতসমূহের (নামায, রোযা, যাকাত ইত্যাদি) পরে হালাল উপার্জন করাও একটি ফরজ এবং ইবাদতের গুরুত্ব রাখে।’
অন্য হাদীসে এসেছে, ‘কোনো মানুষ এর চেয়ে উত্তম উপার্জন খায়নি যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে খায়। নবী দাউদ (আ.)ও নিজ হাতের উপার্জন খেতেন।’ (সহীহ আল-বুখারী)
নবী মুসা (আ.) দেনমোহরের বিনিময়ে তাঁর স্ত্রীর বকরি চড়িয়েছেন বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা শুআইবা (আ.)-এর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘আমার একান্ত ইচ্ছা, আমার এ কন্যাদুটির একটিকে বিয়ে দেব তোমার সাথে এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করে দেবে, আর যদি দশ বছর পুরা করে দাও, তবে সেটা হবে তোমার অনুগ্রহ।’ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় ইবনে কসীর (রহ.) বলেন, মুসা বললেন, আমার ও আপনার মাঝে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, আট বছর ও দশ বছর এ দুটির যে কোনো একটি সময় আমি পূরণ করব। আর এটা আমার ইচ্ছাধীন।
হজরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, ‘আমি রাসূল (সা.)-এর সামনে এই আয়াত তিলাওয়াত করলাম- ‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে, তোমরা তা আহার করো …। হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে মুসতাজাবুদ দাওয়া (যার দোয়া কবুল হয়) হওয়ার দোয়া করে দেন। নবীজি (সা.) বললেন, হে সা’দ! হালাল ও পবিত্র খাবার খাবে তাহলে তুমি মুসতাজাবুদ-দাওয়া হয়ে যাবে। সেই সত্তার কসম যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ! প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি নিজের পেটে হারাম খাবার দিয়ে দিয়েছে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার ইবাদত কবুল হবে না।’
আরেক হাদীসে এসেছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর উপযোগী।’ (জামে তিরমিযী: ৬১৪)
আজ প্রায়ই অনেকের মুখে অভিযোগ শোনা যায়, এত দোয়া করছি, তারপরও তো আমাদের অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে না! অথচ একটু চিন্তা-ফিকির করলেই দেখা যাবে, আমাদের সমাজ-জীবনে হালাল উপার্জনের চিন্তা কতটুকু আছে! বলতে গেলে প্রায় শূণ্যের কোটায় আমাদের হালাল-হারাম বেঁচে চলার মানসিকতা।
সাধারণ অবস্থা এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নিজের মনের বিভিন্ন চাহিদাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হচ্ছে। অথচ মানুষের চাহিদা কুল-কিনারাহীন সমুদ্র। দুনিয়ায় সব আশা পুরণ হবে এ তো অসম্ভব কথা। অথচ এই হরেক রকম চাহিদা পূর্ণ করার জন্য আমাদের প্রতিযোগিতা চলছে নিয়মিত। একটি পরিবারে স্বামীর চাহিদা এক রকম। স্ত্রীর চাহিদা এক রকম। সন্তানের চাহিদা এক রকম। তখন পরিবার প্রধান সবার চাহিদা মেটানোর জন্য ওঠেপড়ে লেগে পড়েন। চিন্তা করেন না এদের অতিরিক্ত চাহিদা পুরা করার জন্য যে উপার্জন করা হচ্ছে তা হালাল না হারাম! বৈধ না অবৈধ। পবিত্র না অপবিত্র। শরিয়তের সীমারেখার ভেতরে না বাইরে। এটা তো সম্পূর্ণ নবীজির কথার বাস্তবায়ন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের এমন এক কাল অতিক্রম করবে, যাতে মানুষ এ কথার চিন্তা করবে না, যে সম্পদ উপার্জন করা হচ্ছে তা হালাল না হারাম?’ (মিশকাত)
যখন মানুষ হালাল খাবারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। ধৈর্য, অল্পেতুষ্টি, যুহদ (দুনিয়া অনাসক্তি), অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া, লোভ-লালসা এবং বিলাসিতা পরিহার এগুলোকে তোয়াক্কা করে না, তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বরকত শেষ হয়ে যায়। যার দরুন বেশিও অল্প মনে হয়। এ ধরনের ব্যক্তির যদি কারুনের ভাণ্ডারও মিলে যায়, সেটাকেও সে নিতান্ত কম মনে করবে। এটাই কারণ যে, সে যখন এই অবৈধ সম্পদ থেকে আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাত করে তখন তা কবুল হয় না। তা ছাড়া হারাম ব্যাংক-ব্যালেন্স যতক্ষণ পর্যন্ত তার মালিকানায় থাকে ততক্ষণ তার জন্য দোযখের রাস্তা সুগম হতে থাকে।
অবৈধ উপায়ে উপার্জিত সম্পদ পুরাই ধ্বংস। কোনো কল্যাণ নেই এতে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত হাদীসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে বান্দা হারাম সম্পদ অর্জন করে, যদি তাকে সাদাকা করে দেয় তবে তা কবুল হবে না। আর যদি খরচ করে তাহলে তাতে বরকত নেই। মৃত্যুর পর রেখে গেলে তবে জাহান্নামে যাওয়ার উপকরণ।’ (মুসনদে আহমদ)
হারাম সম্পদ কম আর বেশি নয়, এর থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা একমাত্র হালাল খাবার দ্বারাই সমাজ-জীবন ঠিক থাকে। দোয়া কবুল হয়। সবকিছুতে বরকত হয়। আল্লাহ পাক আমাদেরকে হারাম থেকে বাঁচার এবং হালালের কদর করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ