আবিদুর রহমান তালুকদার
ভাইরাস অতিসূক্ষ্ম ও অকোষীয় একটি বৈজ্ঞানিক অণুজীব। অচ্যুত ও অস্পৃশ্য এ ভাইরাসটি আজ পুরো বিশ্বের আতঙ্ক। ‘করোনা’ নামক এ মহামারির ভয়াবহ বিস্তারে থমকে গেছে সমগ্র পৃথিবীর সচল চাকা। নির্জীব ও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে সরব বসুন্ধরার সজীব গতিপ্রবাহ। এ ভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বনেতৃত্বের ব্যর্থতা ও অসহায়ত্বে আধুনিক প্রযুক্তি মুখ থুবড়ে পড়েছে। গ্লোবাল ভিলেজের নির্মাতা ইউরোপ-আমেরিকার গর্ব অনেকটা ধুলোয় মিশে গেছে। নিকট ইতিহাসের আধুনিক বিশ্ব এমন কঠিন সংকটের মুখোমুখী এ যাবত হয়নি। চীনের হুবেই শহরের উহান অঞ্চলে এ ভাইরাসের উৎপত্তি। সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা কর্তৃক নিষিদ্ধ বস্তুর ব্যবহারের করুন পরিণতি হিসেবে সর্বগ্রাসী এ মহামারির উদ্ভব। জীবাণু অস্ত্র তৈরির গবেষণাগার থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এমন অভিযোগও রয়েছে চীন এর বিরুদ্ধে। ইরান ও চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও পাল্টা এই অভিযোগের কামান তাক করেছে।
ঘটনার সূত্রপাত যেথাই হোক, নিষিদ্ধ ও হারাম বস্তুর প্রতি মানুষের আকর্ষণের শ্বাস্তিস্কবরূপ খোদায়ি গযব হিসেবেই করোনার এই প্রাদুর্ভাব। কথিত আছে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কম্যুনিস্ট চীনে চেয়ার-টেবিল ব্যতীত সকল প্রকার চতুষ্পদ জন্তু সুস্বাদু আহার্য হিসেবে স্বীকৃত| মুসলমানদের দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনে হারাম দ্রব্যের ব্যাপক ব্যবহার ও প্রচলন রয়ে গেছে। যা করোনার মতো হাজারো ভাইরাসের রূপ ধারণ করে যে কোনো সময় সংক্রমণের সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। আল্লাহপ্রদত্ত জীবন বিধানের সর্বাঙ্গীন অনুশীলনই মুসলমানদের সম্ভাব্য ভাইরাসের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে।
করোনা ভাইরাস: উৎপত্তি ও প্রতিকার
মানুষের জন্য নিষিদ্ধ বস্তুর তালিকা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيْرِ وَمَاۤ اُهِلَّ لِغَيْرِ اللّٰهِ بِهٖ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوْذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ۠ وَالنَّطِيْحَةُ وَ مَاۤ اَكَلَ السَّبُعُ اِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ١۫ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَاَنْ تَسْتَقْسِمُوْا بِالْاَزْلَامِؕ ۰۰۳ {المائدة}
উপর্যুক্ত আয়াতে (এক) মৃতজন্তু, রক্ত, শুকরের গোশত, গাইরুল্লাহর নামে জবাইকৃত পশু-পাখি… এবং জুয়া ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি ভিন্ন নির্দেশে (দুই) মাদক দ্রব্য, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, আত্মসাৎ, মিথ্যাচার, ব্যাভিচার ইত্যাদিও শরিয়তের অকাট্য দলিল দ্বারা হারাম ঘোষিত। মুসলমানগণ প্রথম প্রকারের নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেও অনেকে দ্বিতীয় প্রকারের বস্তুসমগ্র আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করে থাকে। একজন মুসলমানের পানাহারের মেন্যুতে শুকরের গোশত আপ্যায়ন করা হলে নির্ঘাত তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলবে। আবার একই ব্যক্তির সামনে মাদক পরিবেশিত হলে সে আগ্রহভরে তা গ্রহণ করে। শুকরের গোশত ভক্ষণ করা আর সুদ, ঘুষ ও দুর্নীতির অর্থ গ্রহণের মধ্যে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো পার্থক্য নেই। মুসলমানদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রথম প্রকারের বস্তুসমূহ নিষিদ্ধ হলেও দ্বিতীয় প্রকারের বস্তুসমূহের ব্যাপারে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। বরং বিভিন্ন মুসলিম সরকার এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা প্রদান করে। তারা হালালকে হারাম ঘোষণা করে এবং হারামকে বৈধতা দিয়ে খোদার আসনেও অধিষ্টিত হয়। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের প্রধান কর্তব্য ছিল, শরিয়তকর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত বস্তুসমূহের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। ভাইরাসের মূল উৎস চিহ্নিত না করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার দুর্নিবার প্রচারণা বিধানদাতা প্রভূর সঙ্গে উপহাস করার নামান্তর।
ইসলাম ও সংক্রামক ব্যাধি
সংক্রামক ব্যাধি সম্পর্কীয় ইসলামের বিধি-নিষেধ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। মহামারি থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষার ব্যাপারে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সতর্কতামূলক বিধি-ব্যবস্থা ইসলামের চৌদ্দশত বছর পূর্বের নির্দেশনার অংশবিশেষ। তবে বস্তুবাদী চিকিৎসা ব্যবস্থার অজ্ঞতাসূলভ ধ্যান-ধারণা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
মূলত সংক্রমণের মৌলিক কোনো ক্ষমতা ইসলামে স্বীকৃত নয়। আল্লাহর হুকুমের বাইরে কোনো বস্তুর এমন কোনো শক্তি নেই, যা অপরকে সংক্রমণ করতে পারে। আবার সংক্রমণের বাস্তবতা এবং তা থেকে বাঁচার সতর্ককতামূলক ব্যবস্থাকে ইসলাম অস্বীকারও করে না। রাসুল (সা.) দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন। ইমাম বুখারি ও মুসলিম আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন,
«لَا عَدْوَىٰ وَلَا صَفَرَ، وَلَا هَامَةَ»، فَقَالَ أَعْرَابِيٌّ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، فَمَا بَالُ الْإِبِلِ، تَكُوْنُ فِي الرَّمْلِ كَأَنَّهَا الظِّبَاءُ، فَيُخَالِطُهَا الْبَعِيْرُ الْأَجْرَبُ فَيُجْرِبُهَا؟ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «فَمَنْ أَعْدَى الأَوَّلَ».
‘সংক্রমণের মৌলিক ও নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। সফর মাসকে অশুভ মনে করার কোনো ভিত্তি নেই। ইসলামে অশুভ ধারণার কেনো অস্থিত্ব নেই। জনৈক বেদুঈন প্রশ্ন করলো, মাঠে বিচরণশীল হরিণের মতো পরিচ্ছন্ন উটসমূহ চুলকানীযুক্ত উটের সঙ্গে মিশ্রিত হবার কারণে তাদের মধ্যে এই ব্যাধির সংক্রমণের কারণ কি? রসুল (সা.) উত্তর দিলেন, পারস্পরিক সংশ্রব সংক্রমণের কারণ হলে প্রথম উটটিকে কে সংক্রমণ করলো?’ (সহীহ আল-বুখারী: ৫৩১৬)
সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শের কারণে অন্যের সংক্রমণের কোনো আশংকা নেই বলেই রসুল (সা.) মহামারি আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে আহারে অংশগ্রহণ করেছেন।
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ أَخَذَ بِيَدِ مَجْذُوْمٍ فَأَدْخَلَهُ مَعَهُ فِي الْقَصْعَةِ، ثُمَّ قَالَ: «كُلْ بِسْمِ اللهِ، ثِقَةً بِاللهِ، وَتَوَكُّلًا عَلَيْهِ»
‘রসুল (সা.) মহামারি আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে আহার করেছেন। তিনি বলেন, সংক্রমণের ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করো।’ (তিরমিযী: ১৮১৭)
উপর্যুক্ত হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, সৃষ্টি জগতের কোনো বস্তুর মধ্যে সংক্রমণের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। কারো মধ্যে সংক্রমণ দেখো গেলে বুঝতে হবে একমাত্র আল্লাহর হুকুমেই এটি সংঘটিত হয়েছে। তবে ইসলাম সংক্রমণের অস্থিত্ব ও বাস্তবতা কখনো অস্বীকার করে না। যার ফলে সংক্রমণ রোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি ইসলামে জোর তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
নিম্নের হাদীসে মহামারি সংক্রমণের অস্থিত্ব ও বাস্তবতা স্বীকার করে এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ নিদেশনা রয়েছে।
«إِذَا سَمِعْتُمْ بِالطَّاعُوْنِ بِأَرْضٍ فَلاَ تَدْخُلُوْهَا، وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلاَ تَخْرُجُوْا مِنْهَا».
‘কোনো এলাকায় মহামারি সংক্রমণের খবর পাওয়া গেলে তাতে প্রবেশ করো না। আবার তোমাদের বসবাস মহামারি আক্রান্ত এলাকায় হলে, তা থেকে বের হবার চেষ্টাও করো না।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৫৭২৮)
«وَفِرَّ مِنَ الْـمَجْذُوْمِ كَمَا تَفِرُّ مِنَ الأَسَدِ».
‘মহামারি আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে এভাবে পালাও, যেভাবে বাঘ দেখলে পলায়ন করো।’ (মুসনদে আহমদ: ৯৭২০)
«لَا تُدِيْمُوا النَّظَرَ إِلَى الْـمَجْذُوْمِيْنَ».
‘মহামারি আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি দীর্ঘক্ষণ দৃষ্টিপাত করো না।’ (ইবনে মাজাহ: ৩৫৪২)
كلم المجذوم وبينك وبينه قيد رمح، أَو رمحين.
‘মহামারি আক্রান্ত ব্যক্তি ও তোমার মাঝে এক বর্শা (তিন ফিট) বা দুই বর্শা (ছয় ফিট) পরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলো।’ (আবু নুআইম: আল-তিব্বুন নাবাওয়াওয়ী, পৃ. ৩৫৫)
«لَا يُوْرِدَنَّ مُمْرِضٌ عَلَىٰ مُصِحٍّ.
‘সংক্রমিত ও অসুস্থ উটের মালিকেরা সুস্থ উটসমূহ থেকে অসুস্থ উটসমূহকে যেনো আলাদা রাখার ব্যবস্থা করে।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৫৭৭১)
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ইসলামে সংক্রমণ প্রতিরোধ নীতি
ভাইরাস প্রতিরোধ ও মহামারির বৈশ্বিক প্রার্দূভাব ঠেকাতে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সামাজিক দূরত্ব, হোম কোয়ারেন্টাইন ও বারবার হাত ধোয়াসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি গুরুত্বারোপ করে। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিধি-নিষেধসমূহ ইসলামের চৌদ্দ বছর পূর্বের স্বাস্থ্যবিধি দ্বারা সমর্থিত। বিজ্ঞানের প্রধান ও প্রথম শিক্ষক মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতির জন্য সতর্কতামূলক স্বাস্থ্যবিধি প্রণয়ন করেছেন।
মাস্ক পরিধান করা
সংক্রমণ ঠেকানোর নিমিত্তে মাস্ক একটি বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় মাধ্যম। উন্নত দেশের অনেক সচেতন নাগরিক বায়ুদুষণ থেকে বাঁচার জন্য মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের (ভাইরোলোজিস্ট) মতে, হাত থেকে মুখে সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক ব্যবহার করে সুফল পাবার অনেক নজির আছে। আঠারো শতকে প্রথম সার্জিক্যাল মাস্কের প্রচলন শুরু হয় বলে জনশ্রুতি আছে। ইউনিভার্সিটি অব লণ্ডনের সেন্ট জর্জেসের ড. ডেবিড ক্যারিংটন বলেন, সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক বায়ুবাহিত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভাইরাসই বায়ুবাহিত। মাস্কে চোখ খোলা থাকে বলে সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায়। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, মানুষ প্রতি ঘন্টায় গড়ে ২৩ বার হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করে। সুতরাং ভাইরাস থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে সমগ্র মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে পারলে ভালো। ভাইরাস থেকে মুক্তির লক্ষে কে সর্বপ্রথম মাস্ক পরিধান করেন? এ বিষয়ে আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান অতি সীমিত। এ কৃতিত্বের জন্য যারা গর্ববোধ করেন তাদের অনেকেই এ বিষয়ে খোঁজ নেয়ার তেমন গরয বোধ করেনি। সর্বপ্রথম যিনি ভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক পরিধান করেছিলেন তিনি হলেন মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.)।
عَنِ الْوَلِيْدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ: أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ مَرَّ عَلَىٰ مَجْذُوْمٍ، فَخَمَرَ أَنْفَهُ فَقِيْلَ لَهُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَلَيْسَ قُلْتَ: لَا عَدْوَىٰ وَلَا طِيَرَةَ؟ قَالَ: بَلَىٰ.
‘ওয়ালিদ ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) ভাইরাস আক্রান্ত এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চেহারা ঢেকে ফেলেন। তাকে প্রশ্ন করা হলো, আপনিই তো বলেছেন, সংক্রমণের মৌলিক ও নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। ইসলামে অশুভ ধারণার কেনো অস্থিত্ব নেই। তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবু শায়বা, খ. ৫, পৃ. ৩১১, হাদীস: ২৬৪০৯)
বারবার হাত ধোয়া
পরিচ্ছন্নতা অভিযান মহামারি প্রতিরোধে প্রধান উপাদান। পক্ষান্তরে অপরিচ্ছন্নতা রোগ-জীবাণুর প্রধান উদ্দীপক। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে পরিত্রাণের লক্ষে বারবার হাত ধোয়ার প্রতি চিকিৎসা বিজ্ঞান নির্দেশনা প্রদান করছে। ইসলামে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধাংশ হিসেবে স্বীকৃত| একজন মুসলমানের প্রতি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য দৈনিক পাঁচবার হাত ধোয়ার নির্দেশ রয়েছে। তাও কব্জি পর্যন্ত নয়; কনুই অবধি। মুখের বহিরাংশ তথা চেহারা নয়; মুখগহ্বর ধোয়ার পাশাপাশি কণ্ঠনালী পর্যন্ত গড়গড়া করার বিধান জারি করা হয়েছে। হাত-পায়ের আঙ্গুলসহ দাঁত খিলাল করার নির্দেশনা বলবৎ রয়েছে। দৈনিক দুইবার নয়; নামাযের অযু ছাড়াও একাধিকবার মিসওয়াক করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। পানাহারের পূর্বাপর ও নিদ্রা হতে গাত্রোত্থানের পর হাত ও মুখ-গহ্বর ব্রাশ করা ইসলামের একটি অপরিযার্য বিধান। ইসলামে পানাহারের পূর্বাপর ও নিদ্রা হতে গাত্রোত্থানের পর হাত ও মুখ ধোয়ার বিজ্ঞানসমর্থিত বিধান বারবার হাত ধোয়াকে উৎসাহিত করে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এ পর্যায়ে উপনীত হতে হয়তো আরো কিছু অপেক্ষার প্রহর গুণতে হবে। ইসলামের স্বচ্ছতাবিধি এখানো আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে দেড় হাজার বছর এগিয়ে। হাদীস শরিফে বর্ণিত আছে,
«بَرَكَةُ الطَّعَامِ الْوُضُوءُ قَبْلَهُ، وَالْوُضُوءُ بَعْدَهُ».
‘পানাহারের পূর্বাপর হাত ও মুখ ধোয়ার মধ্যে খাদ্যের বরকত নিহিত।’ (আবু দাউদ: ৩৭৬১)
রসূল (সা.) ইরশাদ করেন,
إِذَا اسْتَيْقَظَ أَحَدُكُمْ مِنْ نَوْمِهِ فَلْيَغْسِلْ يَدَهُ قَبْلَ أَنْ يُدْخِلَهَا فِي وَضُوئِهِ، فَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَا يَدْرِي أَيْنَ بَاتَتْ يَدُهُ.
‘নিদ্রা হতে জাগ্রত হওয়ার পর পাত্রে হাত রাখার পূর্বে তোমার হাত ধুয়ে নাও। কেননা ঘুমন্তাবস্থায় তোমার এ হাত কোথায় বিচরণ করেছে তুমি তা জানো না।’ (মুওয়াত্তা মালিক খ. ১, পৃ. ২১, হাদীস: ৯)
মুখগহ্বর ও দাঁতের ফাঁক-ফোকরে আটকে থাকা অবশিষ্ট খাদ্যকণা বের করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে রসূল (সা.) ইরশাদ করেন,
«حَبَّذَا الْـمُتَخَلِّلُونَ»، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الْـمُتَخَلِّلُونَ؟ قَالَ: الْـمُتَخَلِّلُ مِنَ الْوُضُوءِ: أَنْ تَتَخَلَّلَ أَصَابِعَكَ وَأَسْنَانَكَ، وَالْـمُتَخَلِّلُ مِنَ الطَّعَامِ، فَإِنَّهُ لَيْسَ شَيْءٌ أَشَدَّ عَلَى الْـمَلَكِ الَّذِي مَعَ الْعَبْدِ أَنْ يَجِدَ مِنْ أَحَدِكُمْ فَيْحَ الطَّعَامِ.
‘খিলালকারীগণ কতই না চমৎকার! সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! খিলালকারী কারা? তিনি উত্তর দিলেন, অযু করার সময় যে আঙ্গুল ও দাঁত খিলাল করে এবং আহার করার পর দাঁত খিলাল করে। কেননা বান্দার সঙ্গে অবস্থানকারী ফেরেশতাদের নিকট দাঁতের ফাঁকে ও মুখ-গহ্বরের আটকে থাকা খাদ্যাংশের দুর্গন্ধ মারাত্মক কষ্টদায়ক ও অসহ্য মনে হয়। (মুসান্নাফ ইবনে আবু শায়বা, খ. ১, পৃ. ৩৩, হাদীস: ১৩)
مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ، فَيَتَصَافَحَانِ إِلَّا غُفِرَ لَـهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا.
‘দুইজন মুসলমান পারস্পরিক সাক্ষাতের পর মুসাফহা করলে, পৃথক হবার পূর্বেই উভয়ের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’ (আবু দাউদ, খ. ৪, পৃ. ৩৫৪, হাদীস: ৫২১২)
হোম কোয়ারেন্টাইন
নিরাপদ জীবন ও একাকিত্ব যাপন ভাইরাসের বিস্তৃতি রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যম হিসেবে আধুনিক বিশ্ব লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টাইন এর মতো অত্যাধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণার মাধ্যমে সরকার জনস্বার্থ নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মার্কিন গবেষণা জার্নাল নিউজ উইক এর প্রতিবেদনে প্রকাশ, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যের গবেষক ড. কেরি কনসিডাইন বলেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন হোম কোয়রেন্টাইন এর প্রথম উদ্ভাবক। এটি মহামারি মোকাবেলায় ইসলামের সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশবিশেষ। ইসলামের মূল দর্শন হলো, নিজেকে বিপদমুক্ত রাখা ও অপরের বিপদের কারণ না হওয়া। খলিফা ওমর (রাযি.)-এর খিলাফতকালে ফিলিস্তিনে আমওয়াস নামক মহামারি দেখা দিলে আমর ইবনুল আস (রাযি.) জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। নিরাপদ জীবন যাপনের লক্ষে আক্রান্ত রোগীদের পাহাড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, মহামারির এই ভাইরাস কোথাও দেখা দিলে তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল (সা.)-এর স্বাস্থ্যবিধি ছিল বর্তমান কালের চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকেও আধুনিক। তিনি শুধুমাত্র শারীরিক দূরত্ব নয়; মহামারি আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রেও দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
মুসাফাহা ও করমর্দন থেকে বিরত থাকা
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে মহামারি মোকাবেলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে পারস্পরিক করমর্দন নিরুৎসাহিত করা হয়। ইসলামে জনস্বার্থ বিবেচনায় ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার অনেক নজির রয়েছে। ইসলামে দুইজন মুসলমানের পারস্পরিক মোসাফাহা অতীব ফজিলতপূর্ণ আমল।
مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ، فَيَتَصَافَحَانِ إِلَّا غُفِرَ لَـهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا.
‘দুইজন মুসলমান পারস্পরিক সাক্ষাতের পর মোসাফহা করলে, পৃথক হবার পূর্বেই উভয়ের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’ (আবু দাউদ, খ. ৪, পৃ. ৩৫৪, হাদীস: ৫২১২)
হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করা ইসলামের অতি প্রাচীন রীতি। কিন্তু মহামারি সংক্রমণের আশঙ্কায় রসূল (সা.) এ নিয়ম শিথিল করেছেন। সাকিফ গোত্রের মাহামারী আক্রান্ত একজন ব্যক্তিকে হাতের উপর হাত না রেখেই রসূল (সা.) বায়আত করেন। সহীহ মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে,
كَانَ فِي وَفْدِ ثَقِيفٍ رَجُلٌ مَجْذُومٌ، فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ النَّبِيُّ ﷺ «إِنَّا قَدْ بَايَعْنَاكَ فَارْجِعْ»
‘সাকিফ গোত্রের প্রতিনিধি দলে একজন মহামারি আক্রান্ত লোক ছিল। তার নিকট রসূল (সা.) লোক মারফত খবর পাঠালেন যে, তোমার বাইআত সম্পন্ন হয়ে গেছে। তুমি এখন যেতে পারো।’ (সহীহ মুসলিম: ১৭৫২)
হাঁচি দেওয়ার সময় মুখে টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করা
হাঁচি আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। এটি শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দূর করে মনে প্রফুল্লতা আনে। এ নেয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ রসূল (সা.) হাঁচি দেয়ার পর আলহামদুলিল্লাহ বলতেন। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করে, একবার হাঁচির সাথে শরীর থেকে তিন হাজার রোগব্যাধি দূরিভূত হয়। যেখানে একটি রোগের চিকিৎসার জন্য সাধারণত তিন হাজার টাকা ব্যয় হয়, সেখানে তিন হাজার রোগ উপশম হওয়ার কারণে একবার আলহামদু লিল্লাহ বলে শুকরিয়া আদায় করা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। হাদীসের কিতাবসমূহে হাঁচি দেয়ার বিস্তারিত নিয়ম-কানুন বিধৃত হয়েছে। কেবলমাত্র মহামারি থেকে বেঁচে থাকার জন্যই নয়, রসূল (সা.) সর্বদা জনস্বার্থ বিবেচনায় হাঁচি দেয়ার সময় কাপড় দিয়ে মুখে ঢেকে রাখতেন এবং শালীনতা রক্ষায় হাঁচির আওয়াজ ক্ষীণ রাখার পরামর্শ দিতেন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: «إِذَا عَطَسَ وَضَعَ يَدَهُ أَوْ ثَوْبَهُ عَلَى فِيهِ، وَخَفَضَ أَوْ غَضَّ بِهَا صَوْتَهُ» – شَكَّ يَحْيَى.
‘আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসূল (সা.) হাঁচি দেওয়ার সময় নিজের হাত অথবা কাপড় দ্বারা মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতেন এবং হাঁচির স্বর ছোট রাখার চেষ্টা করতেন।’ (আবু দাউদ: ৫০২৯)
দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা
অসুস্থ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ইসলামের একটি বাস্তবসম্মত বিধান। রসূল (সা.) অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা করার জন্য তাদের বাসস্থানে উপস্থিত হতেন এবং চিকিৎসা গ্রহণের প্রতি রোগীদের উদ্বুদ্ধ করে বলতেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা রোগ সৃষ্টি করেছেন এবং সকল রোগের প্রতিষেধক আবিস্কার করেছেন।
عَنْ سَعْدٍ، قَالَ: مَرِضْتُ مَرَضًا أَتَانِي رَسُولُ اللهِ ﷺ يَعُودُنِي فَوَضَعَ يَدَهُ بَيْنَ ثَدْيَيَّ حَتَّى وَجَدْتُ بَرْدَهَا عَلَى فُؤَادِي فَقَالَ: إِنَّكَ رَجُلٌ مَفْئُودٌ، ائْتِ الْـحَارِثَ بْنَ كَلَدَةَ أَخَا ثَقِيفٍ فَإِنَّهُ رَجُلٌ يَتَطَبَّبُ فَلْيَأْخُذْ سَبْعَ تَمَرَاتٍ مِنْ عَجْوَةِ الْـمَدِينَةِ فَلْيَجَأْهُنَّ بِنَوَاهُنَّ ثُمَّ لِيَلُدَّكَ بِهِنَّ .
‘সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাযি.) বর্ণনা করেন, একদিন আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। রসূল (সা.) আমাকে দেখতে আসলেন। তিনি আমার বুকে নিজ হাত রাখলেন। তাঁর হাতের স্নিগ্ধ পরশে আমি অন্তরের শীতলতা অনুভব করলাম। তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, আপনি হৃদরোগে আক্রান্ত। আপনি সাকিফ গোত্রের হারিস বিন কালদা’র চিকিৎসা গ্রহণ করুন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার দক্ষতা ভালো। সে মদিনার সাতটি আজওয়া খেজুর বিচূর্ণ করে দুধ অথবা ঘি দ্বারা মিশ্রিত করে রোগীকে সেবন করায়।’ (আবু দাউদ: ৩৮৭৫)
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা ও আঙিনা পরিস্কার রাখা
মহামারির প্রদুর্ভাব থেকে পরিত্রাণের লক্ষে রসূল (সা.) শুধুমাত্র শারীরিক পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি পরিবেশ-প্রতিবেশের পরিচ্ছন্নতার প্রতিও সমান উৎসাহ প্রদান করেন। আবু মুসা আশআরী (রাযি.) বলেন, আমাকে আমিরুল মুমিনীন ওমর (রাদি.) রাস্তা-ঘাট পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন,
إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ يُحِبُّ الطَّيِّبَ، نَظِيفٌ يُحِبُّ النَّظَافَةَ، كَرِيمٌ يُحِبُّ الكَرَمَ، جَوَادٌ يُحِبُّ الـجُودَ، فَنَظِّفُوا، أُرَاهُ قَالَ، أَفْنِيَتَكُمْ وَلاَ تَشَبَّهُوا بِاليَهُودِ.
‘রসূল (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা পবিত্র; তিনি পবিত্রতা পছন্দ করেন। তিনি পরিচ্ছন্ন; পরিচ্ছন্নতা ভালবাসেন। তিনি দয়ালু; দয়া ও অনুগ্রহকে ভালবাসেন। তিনি বদান্য; বদান্যতা পছন্দ করেন। অতএব তোমরা আঙ্গিনা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখো এবং ইহুদিদের মতো আচরণ করো না।’ (তিরমিযী: ২৭২৯)
জনসমাবেশে থুথু ফেলা ও মসজিদ পরিস্কার রাখার ব্যাপারে রসূল (সা.) বলেন,
البُزَاقُ فِي الْـمَسْجِدِ خَطِيئَةٌ وَكَفَّارَتُهَا دَفْنُهَا.
‘মসজিদে থুথু নিক্ষেপ মারাত্মক পাপ। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত হলো এ থুথু বাইরে ফেলে দেওয়া।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৪০৪)
রসূল (সা.) মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এগুলো সর্বদা পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
লেখক: সভাপতি, জাগৃতি লেখক ফোরাম, পিএইচ. ডি. গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়