শুক্রবার-১৬ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-১৬ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পিতা-মাতার কাছে সন্তানের অধিকার

পিতা-মাতার কাছে সন্তানের অধিকার

শেখ খালেদ

 

সর্বপ্রথম সে আল্লাহর প্রশংসা আদায় করছি যিনি আমাদেরকে ঈমানের মতো নেয়ামত দান করেছেন। কোটি দরুদ ও সালামের হাদিয়া পেশ করছি মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর, আল্লাহ মানুষকে অগণিত অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন তন্মধ্যে বিশেষ এক নেয়ামত হলো সন্তান-সন্তুতি। এ নিয়ামতের শুকরিয়া যথাযথভাবে আদায় করা গেলে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা নিশ্চিত ধরা দেবে ইন শা আল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা যেমন সন্তানকে পিতা-মাতার অধিকার রক্ষার আদেশ দিয়েছেন তেমনি পিতা-মাতাকে সন্তানদের অধিকার খর্ব করতে নিষেধ করেছেন। ইসলাম হচ্ছে ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম যা প্রত্যেকের অধিকারের প্রতি সচেতন। ইসলামের আদর্শে যদি সন্তানদের গড়ে তোলা যায় তথা পিতা-মাতা তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য আদায়ে যদি সচেষ্ট থাকে তাহলে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা আশা করা যায় এবং আজকের সমাজে যে বৃদ্ধাশ্রমের সংস্কৃতি জন্মেছে সেটার গতিরোধ করাও সম্ভবপর হবে।

নিম্নে সন্তানদের প্রতি পিতা মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করার প্রয়াস পাব وما توفيقي إلا بالله|

১. সন্তান আল্লাহপ্রদত্ত আমানত

সন্তান হলো আল্লাহর দেয়া আমানত। এ আমানতের খেয়ানত কোনোভাবে করা ঠিক নয় ইসলাম সন্তানের জন্মের আগ থেকে সন্তানের অধিকার রক্ষায় যত্নশীল আর এই ইসলামের ছোঁয়ায় জাহেলিয়াতের অমানুষ গুলোকে মানুষে পরিণত করেছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তারা সন্তানের জীবননাশে কুণ্ঠাবোধ করত না। ইসলাম এ নির্মম, নির্দয়, গর্হিত কর্মকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন,

وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللّٰهُ اِلَّا بِالْحَقِّؕ ۰۰۱۵۱

‘তোমরা আল্লাহর বৈধতা ছাড়া কোনো আত্মাকে হত্যা করো না।’[1]

জাহিলিয়াতের মানুষরূপি পশুগুলো যখন নিজের সন্ততানদের খাদ্যাভাবে জীবন্ত কবর দিত ঠিক সে মুহূর্তে ইসলাম তাদেরকে মানবতার শিক্ষা দিয়েছে। খাদ্যের অভাবে সন্তান হত্যা করাকে হারাম ঘোষণা করেছে,

وَلَا تَقْتُلُوْۤا اَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ اِمْلَاقٍ١ؕ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَاِيَّاكُمْؕ ۰۰۳۱

‘তোমরা সন্তানদের খাদ্যাভাবের ভয়ে মেরে ফেলো না। আমি তোমাদের ও তাদের সকলের জীবিকা প্রদান করি।[2]

এভাবে জন্ম থেকে নিয়ে পিতা মাতার দায়িত্ব পালনে যত্নশীল হতে হবে। সন্তানের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে বলেছে ইসলাম। তার আগমনে আনন্দের ফুয়ারা যেন প্রবাহমান থাকে সেদিকেও ইসলাম দৃষ্টি দিয়ে বলেছেন সন্তান ভূমিষ্ট হলে সুন্দর নাম দিতে হবে। আকীকা করাতে হবে। তার তালীম-তরবীরতে সদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

হযরত ওমর (রাযি.)-এর কাছে একজন লোক তার সন্তানের অভিযোগ নিয়ে আসলে হযরত ওমর (রাযি.) তার সন্তানকে ডাকলেন। আর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন তখন ছেলেটি হযরত ওমর (রাযি.)-কে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! ছেলে কি তার পিতার কাছে কোনো অধিকার পায়? তখন হযরত ওমর (রাযি.) বললেন, অবশ্যই পাবে। একজন দীনী সৎ মা পাওয়ার অধিকার পাবে।

একটি সুন্দর নামের অধিকার পাবে সুশিক্ষার অধিকার পাবে তখন ছেলেটি বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! তাহলে আপনি আমার পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করুন তিনি আমার হক আদায় করেছেন কিনা? তিনি আমার নাম রেখেছেন জুয়াল যার অর্থ কিট বা সামুদ্রিক পোকা, তিনি আমাকে সুশিক্ষাও দান করেন নি তখন হযরত ওমর (রাযি.) বলে উঠলেন,

عققت ولدك قبل أن يعقق.

অর্থাৎ সে তোমার অধিকার নষ্ট করার আগেই তুমি তার অধিকার খর্ব করে দিলে। সুতরাং মা ও বাবার দায়িত্ব হল সন্তানের যথাযথ অধিকার রক্ষা করা।

২. জাহান্নাম থেকে রক্ষা করা অভিভাবকের দায়িত্ব কর্তব্য

পরিবারের দায়িত্বশীল হিসেবে সন্তানদের দীনী পরিবেশে লালন-পালন করার মাধ্যমে তাদেরকে পরকালের ভয়াবহ জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে হবে এটি পিতা-মাতার একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। পবিত্র কুর’আনে বলেন,

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا ۰۰۶

‘মুমিনগণ তোমরা নিজেদের এবং পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’[3]

একজন অভিভাবক হয়ে যদি এই গুরুদায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তাহলে এর জবাবদিহিতা অবশ্যই করতে হবে।

৩. পরিবারকেন্দ্রিক শিক্ষা

আদর্শ পিতা ও মাতার দায়িত্ব হলো সন্তানদেরকে পরিবারেই আল্লাহর সাথে পরিচয় করানো। দীনের প্রাথমিক লেভেলের প্রশিক্ষণ করানো কারণ বুনিয়াদি শিক্ষাই একটি জাতি ও সমাজকে আদর্শ সমাজ ও জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

হযরত লোকমান (আ.) আপন সন্তানের সাথে তা পালন করেছেন। হযরত লোকমানের দায়িত্ব মহান আল্লাহর দরবারে এতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে যে, তিনি তা কেয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষ তথা সকল অভিভাবকদের জন্য নমুনা হিসেবে রেখে দিয়েছেন,

وَ ِذْ قَالَ لُقْمٰنُ لِابْنِهٖ وَ هُوَ يَعِظُهٗ يٰبُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللّٰهِ١ؔؕ اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ۰۰۱۳

‘লোকমান আপন সন্তানকে উপদেশ দিয়ে বললেন হে বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক করিও না। কেননা শিরক এক মহাপাপ।’[4]

সাথে সাথে সন্তানদেরকে পরিবারেই সামাজিকীকরণের শিক্ষা দিতে হবে এটা তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়ক হবে।

এ সুন্দর দায়িত্ব পালন করার জন্য আল্লাহ অভিভাবক তথা সকল মানুষকে শিক্ষা দিলেন যখন তোমরা আমার হকের প্রতি খেয়াল রাখো তখন আমিও দুনিয়ার সন্তানদেরকে আদেশ দিচ্ছি যে তারা যেন অভিভাবকদের হক নষ্ট না করে এবং মাতা পিতার প্রতি সদাচরণ করে যেমন- আল্লাহ কুরআনে বলেন,

وَوَصَّيْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًاؕ ۰۰۸

‘আমি সন্তানদের পিতামাতার প্রতি সদাচারণ করার নির্দেশ দিয়েছি।’[5]

একজন শিশু জন্মগতভাবেই ইসলামের ওপর তথা স্বভাবজাত ইসলাম নিয়েই জন্ম লাভ করে কিন্তু তার পিতা ও মাতা তাকে অগ্নিপূজক মূর্তিপূজক ইহুদি ও খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলে। রাসূল (সা.) বলেন,

«كُلُّ مَوْلُوْدٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ».

‘প্রত্যেক শিশু স্বভাবজাত ইসলাম নিয়ে ভূমিষ্ট হয় তার পিতামাতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান, অগ্নিপূঁজক বানিয়ে ফেলে।’[6]

তাহলে বাবা মায়ের গুরুদায়িত্ব হলো সন্তানকে ইসলাম শিক্ষা দেওয়া। একবার চিন্তা করা দরকার আমরা কি সন্তানদের এসব অধিকার আদায় করেছি? এসব দায়িত্ব পালন করেছি?

৪. ইবাদাত পালনের সন্তানদেরকে অভ্যস্ত করে তোলা

প্রাপ্তবয়স্ক তেই ইসলামের মৌলিক তথা ফরয ইবাদতগুলো তে তাকে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে আল্লাহ তাআলা অভিভাবকদের দায়িত্বের প্রতি অবহিত করে বলেন,

وَاْمُرْ اَهْلَكَ بِالصَّلٰوةِ ؕ  ۰۰۱۳۲

‘তোমার পরিবারকে নামাযের আদেশ কর।’[7]

এভাবে নামায যাকাত এবং উন্নত জীবন চলার পথে প্রতিটি ধাপের শিক্ষা দেওয়া একজন অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ফলে সে সময়ানুবর্তীতা ও দায়িত্বের প্রতি সচেতন হয়ে উঠবে শৈশবকাল থেকেই। সন্তানকে কি শিক্ষা দিতে হবে তা আল্লাহ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন,

يٰبُنَيَّ اَقِمِ الصَّلٰوةَ وَاْمُرْ بِالْمَعْرُوْفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلٰى مَاۤ اَصَابَكَؕ ۰۰۱۷

‘হে বৎস! নামায কায়েম করো সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ করো আর আরোপিত মুসিবতে ধৈর্য ধারণ কর।’[8]

এসব শিক্ষা ছেলেমেয়ে সকলকে দিয়ে আদর্শ পরিবার গড়ে তুলতে হবে।

৫. শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া

ইসলাম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা করে গুরুত্বারোপ করেছে তাই সন্তানদের আদব শিষ্টাচার ভদ্রতা নম্রতা সন্তানদের শিক্ষা দেওয়া অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হাদীসে এসেছে,

«لَأَنْ يُؤَدِّبَ الرَّجُلُ وَلَدَهُ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَتَصَدَّقَ كُلَّ يَوْمٍ بِنِصْفِ صَاعٍ».[9]

উক্ত হাদীসে সবচেয়ে উত্তম বলা হয়েছে আপন সন্তানকে শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়াকে। এভাবে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরও বলেন,

«مَا نَحَلَ وَالِدٌ وَلَدًا مِنْ نَحْلٍ أَفْضَلَ مِنْ أَدَبٍ حَسَنٍ».

‘পিতা-মাতার পক্ষ থেকে ছেলেকে সুন্দর আদর্শ শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে উত্তম আর কোনো উপহার নেই।’[10]

এভাবে পিতামাতা তার সন্তানকে চরিত্রবান হিসেবে গড়ে করে তোলার দায়িত্ব পালন করবে।

৬. ছেলে-মেয়েকে শিক্ষার অধিকার দেওয়া

ইসলাম যেভাবে সন্তানদেরকে বাহ্যিক অধিকার আদায় করতে নির্দেশ দেয় তেমনি চিন্তাগত, বিমূর্ত, বুদ্ধিভিত্তিক অধিকার আদায় করার জন্য পিতা-মাতার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন জ্ঞানচর্চার প্রতি সকলকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে স্বয়ং আল-কুরআন। মহান আল্লাহ বলেন,

اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَۚ۰۰۱ خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍۚ۰۰۲ اِقْرَاْ وَ رَبُّكَ الْاَكْرَمُۙ۰۰۳ الَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِۙ۰۰۴

‘পড়ুন, আপনার প্রভুর নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে। পড়ুন সেই মহামান্বিত প্রভুর নামে যিনি কলম দিয়ে শিক্ষা দিয়েছেন।’[11]

এভাবে সকলের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন,

«طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَىٰ كُلِّ مُسْلِمٍ».[12]

ছেলে-মেয়েকে কুরআন হাদীসের শিক্ষা প্রদান করা পিতা-মাতার প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় কোনো অভিভাবক তাহলে কাল কেয়ামতের ময়দানে দায়িত্বহীনতার কারণে আযাবের সম্মুখীন হতে হবে বরং তখন আপন সন্তানরাই পিতামাতার জন্য অভিযোগ দায়ের করবেন। কুরআনের ভাষায়:

وَقَالُوْا رَبَّنَاۤ اِنَّاۤ اَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَآءَنَا فَاَضَلُّوْنَا السَّبِيْلَا۰۰۶۷ رَبَّنَاۤ اٰتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًاؒ۰۰۶۸

‘তারা বলবে আমরা আমাদের বড়দের অভিভাবক, নেতাদের অনুসরণ করে ছিলাম তারাই আমাদেরকে ভ্রষ্ট করেছে হে প্রভু তাদেরকে আজ দ্বিগুণ আযাব দিন এবং তাদেরকে মহাঅভিশাপ দিন।’[13]

ছেলে-মেয়েদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দায়িত্ব আদায়ের পাশাপাশি তাঁর তরবিয়তের শিক্ষার অনুশীলনী করানো পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ দায়িত্ব কখনো কখনো সন্তানদেরকে নিজেরা দিয়ে আদায় করবেন আবার কখনো তা তাদেরকে মাদরাসায় মসজিদে পাঠানোর মাধ্যমে আদায় করবে এভাবে হিকমাহ ও দাওয়াত শিক্ষা দিতে হবে যা আল্লাহ কুরআনে আদেশ করেছেন,

اُدْعُ اِلٰى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِيْ هِيَ اَحْسَنُؕ ۰۰۱۲۵[14]

তখন একজন শিশু পরিপূর্ণ ইসলামি জ্ঞানে গুণান্বিত হবে আল্লাহর পথে আহবানকারী হবে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ কারী হয়ে উঠবে। একজন মুমিনের অনুপম বৈশিষ্ট্য পিতা-মাতার দায়িত্ব সন্তানদের শৈশব থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসার তালিম দিয়ে বড় করে তুলবেন, তাদেরকে জান্নাত জাহান্নামের খবর জানাবেন যদি পিতা-মাতা এ দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে আপন সন্তানদেরকে যেন নিজ হাতে আগুনের জ্বালানি বানালেন। ইবনুল জাওযী (রহ.)-এর একটি ঘটনা: জনৈক ব্যক্তির মেয়ে সন্তান ছাড়া অন্য কোনো সন্তান ছিল না ফলে সে মেয়েকে কোনো ধরনের শাসন করতো না এভাবে মেয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে গেল বাদশার দরবারে একজন আবেদ কুরআনের আয়াত পড়ছিলেন,

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا ۰۰۶

‘মুমিনগণ তোমরা নিজেদের এবং পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’[15]

মেয়েটি তা শুনে আবেদকে পড়া বন্ধ করতে বলল কিন্তু আবেদ পড়া চালিয়ে গেল কয়েকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও যখন বুযুর্গ থামছে না মেয়েটি রাগান্বিত হয়ে নিজে কাপড় ছিড়ে বাবার কাছে নালিশ দিল বাবা তখন ঘটনার বিবরণ শুনে বুযুর্গের দোষ বললেন না যেহেতু তিনি বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাবান ছিলেন এবং আবেদ সম্পর্কে তার ভালো করে জানা ছিল।

তখন মেয়েটিও নিজের ভুল স্বীকার করে নিল তৎক্ষণাৎ তার মনে সেই পঠিত আয়াতের অর্থের কথা মনে পড়ল। তখন মেয়ে বাবাকে বললো, তাহলে তিনি যা পড়ছেন যে, আল্লাহর একটা জাহান্নাম আছে সেখানে মানুষকে জ্বালানি বানাবেন তা কি ঠিক? বাবা বলল হা ঠিক। তখন মেয়েটির অন্তর সেই আল্লাহর প্রতি ঝুঁকে পড়ল। বাবাকে বললো, বাবা! তাহলে কেন তুমি আমাকে এতদিন জানাওনি? আমাকে কুরআনের বাণী শিখাওনি? অতএব এ মেয়েটি আল্লাহর কসম খেয়ে বলল আজ থেকে কোনো উন্নত বিলাসী খাবার আমি খাব না কোনো আরামদায়ক বিছানাতে আমি ঘুমাবো না যতক্ষণ না আমি জানতে পারবো জান্নাত কিংবা জাহান্নামে আমার ঠিকানা কোথায়। এভাবে মেয়েটি একজন খাটি আল্লাহর বান্দী হয়ে গেল সুবাহানাল্লাহ! চিন্তা করুন আমরা কি আমাদের মেয়েদেরকে জান্নাত জাহান্নামের সংজ্ঞা দিয়েছি নাকি প্রতিনিয়ত ও তাদেরকে জাহান্নামের জ্বালানী হিসেবে তৈরি করছি। আমরদের মা হিসেবে বাবা হিসেবে কি দায়িত্ব আছে একবার ভাবুন

৭. দায়িত্ব-কর্তব্যের অবহেলা হলে জবাবদিহিতা

যদি সন্তানদেরকে দিন শিক্ষা, সুশিক্ষা, চরিত্র গঠনের শিক্ষা, দাওয়াতে ইলাল্লাহর শিক্ষা, জান্নাত-জাহান্নামের শিক্ষা, কুরআন-হাদীসের শিক্ষা না দিই তাহলে আল্লাহর দেয়া নেয়ামত এর অপব্যবহার হবে এর জবাবদিহিতা আল্লাহর আদালতে দিতে হবে। সেদিকে সতর্ক করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

«كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، الْإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِيْ أَهْلِهِ وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالْـمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِيْ بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْئُوْلَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا».

‘সাবধান তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে পুরুষ তার ঘরের অভিভাবক তাকে তার অধীনে থাকা সন্তান ও বাকী সদস্যদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে এভাবে মহিলা তার স্বামীর ঘরে একজন অভিভাবক তার থেকে তার অধীনদের ব্যাপারে কৈফিয়ৎ নেওয়া হবে।’[16]

একবার চিন্তা করুন আমি অভিভাবকের সংজ্ঞায় পড়েছি কিনা যদি পড়ি তাহলে নিশ্চিত আমাকে আল্লাহর চুলচেরা বিশ্লেষণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে আসুন আমরা অভিভাবকরা সচেতন হই সন্তানদেরকে দিন শেখানোর ক্ষেত্রে অগ্রগামী হি। কেননা আল্লাহ কল্যাণে অগ্রগামী হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন,

فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرٰتِ١ؐؕ ۰۰۱۴۸[17]

হযরত ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কিয়ামতের পিতাকে সন্তান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে সন্তান থেকে পিতার হকের কথা জিজ্ঞাসা করার আগে কেননা আল্লাহ আগে সন্তানের অধিকার নিশ্চিত করেছেন,

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا ۰۰۶

‘মুমিনগণ তোমরা নিজেদের এবং পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’[18]

উক্ত আয়াত দিয়ে, অতঃপর পিতামাতার অধিকার নিশ্চিত করেছেন নিম্ন وَوَصَّيْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًاؕ ۰۰۸[19] আয়াত দিয়ে। সুতরাং আগে সন্তানের হক আদায় করতে হবে।

ইমাম গাযালী (রহ.) বলেছেন সন্তানরা পিতা মাতার কাছে আমানত আর সন্তানদের অন্তর হলো সব ধরনের কলুষমুক্ত একটি পরিষ্কার কাগজের নেয় সেখানে যা আঁকা হবে তাই ধারণ করবে অর্থাৎ শৈশবের যা শিক্ষা দেওয়া হবে তাই সে কবুল করবে তাই সন্তানদেরকে কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে নইলে তার জবাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে উপরের আলোচনাতে একটি কথায় প্রমাণ হল সর্বাবস্থায় সন্তানের হকের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে।

৮. সন্তানের জন্য দুআ করা পিতা মাতার দায়িত্ব কর্তব্য

আল্লাহ তাআলা সন্তানদের জন্য কিভাবে দুআ করতে হবে তা পবিত্র কুরআনে বলে দিয়েছেন,

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَذُرِّيّٰتِنَا قُرَّةَ اَعْيُنٍ ۰۰۷۴

‘হে আল্লাহ! আমাদের এমন স্ত্রী এবং সন্তান-সন্তুতি দান করুন যা হবে আমাদের জন্য নয়ন-প্রীতিকর।’[20]

সন্তান পাওয়ার জন্য দুআ করতে হবে যা আমরা ইবরাহীম (আ.)-এর ঘটনা থেকে জানতে পারি,

رَبِّ هَبْ لِيْ مِنَ الصّٰلِحِيْنَ۰۰۱۰۰

‘হে আল্লাহ! আমাকে সৎ সন্তান দান করুন।’[21]

সুতরাং প্রতিটি মা-বাবার উচিত তার আপন সন্তানদের জন্য দুআ করা। মা হিসেবেও সন্তান গঠনে অনেক দায়িত্ব রয়েছে যা অবশ্যই সুন্দর জাতি গঠনে সহায়ক হবে। পরিশেষে কিছু আদর্শ মায়ের গল্প বলি:

ইমাম মালেক (রহ.)-এর মা

ইমাম মালেকের আম্মা শৈশবেই ইমাম মালেক কে কুরআন শিক্ষা করতে পাঠান এবং নিজের ছেলেকে বিভিন্ন আলেমদের মজলিসে পাঠাতেন এমনকি মুহাদ্দিস ররীয়া (রহ.)-এর কাছে পাঠানোর সময় বলেছিলেন তার কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন এর আগে তার ইহতিরাম আদব তথা শিষ্টাচার শিখে নেবে।

ইমাম শাফিয়ী (রহ.)-এ মা

পিতার মৃত্যুর পর মায়ের কোলে বড় হন ইমাম শাফিয়ী (রহ.)। তার মা ও একজন প্রজ্ঞাবান ও প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন দুই বছর বয়সের সময় তাকে নিয়ে গাজা অঞ্চল থেকে মক্কায় হিজরত করেন যেখানে ইলমের চর্চা হতো সেখানে তাকে নিয়ে যেত। ফলে ইমাম শাফিয়ী (রহ.) শৈশবকাল থেকেই ইলমের পরিবেশে বেড়ে উঠেন এজন্যই তিনি জগৎ বিখ্যাত হয়েছেন। তার ব্যক্তিত্ব গঠনে তার মায়ের অবদান অনস্বীকার্য|

ইমাম আহমদ (রহ.)-এর মা

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এতিম অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন অভাবী সংসার ছিল তার মায়ের তবুও তার মা তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি ইমাম আহমদ (রহ.)-এর স্মৃতিচারণ করে বলেন আমার মা আমাকে ভোর রাতে হিফজের জন্য উঠিয়ে দিতেন ওযুর জন্য গরম পানি দিতেন, এমন কি তিনি পরে আমাকে মসজিদ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতেন। তিনি বলেন আমার বয়স সতেরো হলে আমাকে তিনি হাদীস শিখতে পাঠান। আর ছেলেকে এই বলে উৎসাহ দিলেন ইলমের জন্য সফর করা আল্লাহর নিকট হিজরতের মর্যাদা রাখে। বিদায় বেলা মা ছেলেকে বললেন বাবা আল্লাহর কাছে আমানত রাখলে তিনি সেটা কখনো নষ্ট করেন না আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে আমানত হিসাবে রাখলাম। এভাবে ইমাম আহমদ মায়ের অনুপ্রেরণায় জগৎ বিখ্যাত মুহাদ্দিস হলেন। এখানে কি আমাদের কিছু শিখার নেই?

ইমাম বুখারী (রহ.)-এর

শৈশবেই পিতা মারা যান ফলে মাকে তারই দেখতে হতো কিন্তু একসময় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। একদিন তার মা হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে স্বপ্নে দেখেন তিনি তাকে তার জন্য বেশি বেশি দোয়া করার জন্য বললেন সকালে দেখলেন ছেলে ভালো হয়ে গেছে তখন তিনি ছেলেকে শিক্ষার জন্য পাঠান এবং আলেমদের মজলিসে প্রেরণ করেন এমনকি মা নিজেই তাকে দিয়ে আসতেন এভাবে মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ বিশ্বইমাম বুখারী (রহ.)-এর মতো একজন বিখ্যাত মনীষী পেয়েছে।


[1] আল-কুরআন, সুরা আল-আনআম, ৬:১৫১

[2] আল-কুরআন, সুরা আল-ইসরা, ১৭:৩১

[3] আল-কুরআন, সুরা আত-তাহরীম, ৬:৬৬

[4] আল-কুরআন, সুরা লুকমান, ৩১:১৩

[5] আল-কুরআন, সুরা আল-আনকাবুত, ২৯:৮

[6] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ২০০, হাদীস: ১৩৮৫

[7] আল-কুরআন, সুরা তাহা, ২০:১৩২

[8] আল-কুরআন, সুরা লুকমান, ৩১:১৭

[9] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ২৪, পৃ. ৪৯১Ñ৯৪২, হাদীস: ২০৯৭০

[10] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ৩৩৮, হাদীস: ১৯৫২

[11] আল-কুরআন, সুরা আল-আলাক, ৯৬:১Ñ৪

[12] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, খ. ১, পৃ. ৮১, হাদীস: ২২৪

[13] আল-কুরআন, সুরা আল-আহযাব, ৩৩:৬৭Ñ৬৮

[14] আল-কুরআন, সুরা আল-নাহল, ১৬:১২৫

[15] আল-কুরআন, সুরা আত-তাহরীম, ৬:৬৬

[16] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৫, হাদীস: ৮৯৩

[17] আল-কুরআন, সুরা আল-মায়িদা, ২:১৪৮

[18] আল-কুরআন, সুরা আত-তাহরীম, ৬:৬৬

[19] আল-কুরআন, সুরা আল-আনকাবুত, ২৯:৮

[20] আল-কুরআন, সুরা আল-ফুরকান, ২৫:৭৪

[21] আল-কুরআন, সুরা আস-সাফফাত, ৩৭:১০০

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ