শুক্রবার-১৬ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-১৬ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

 অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি: প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ

 অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি: প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ

সাম্প্রতিক সময়ে গোষ্ঠীচেতনা, সম্প্রদায়গত বিভেদ, সংকীর্ণ মনোবৃত্তি, দলীয় উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বজনীন চিন্তার ঘাটতি, পরমতের প্রতি অশ্রদ্ধা সমাজে ক্রমবর্দ্ধমানহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো অসহিষ্ণুতার অন্যতম কারণ। অসহিষ্ণুতা একটি ব্যাধি যা ব্যক্তির অহংবোধ থেকে তৈরি হয় এবং ভালবাসার বদলে হিংসা ও ঘৃণা ছড়িয়ে সমাজদেহকে জরাগ্রস্থ করে দেয়। অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির সাথে, হিংসা, বিদ্বেষ, জনপ্রিয়তা ও অর্থ-বিত্তের সম্পর্ক জড়িত। পরমতের প্রতি অসম্মানের এ ভয়াবহ ব্যাধি পরিবার, সমাজ, রাজনীতি ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বিকশিত হচ্ছে। উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতার চর্চা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেলে মানুষকে সামাজিক বৈরিতায় বৃত্তবন্দি করে ফেলে। পৃথিবী আবাসযোগ্যতা হারায়। বিনয়, সৌজন্য ব্যবহার, মানবিক আচরণ ও ভ্রাতৃত্বের ঐতিহ্য দিয়ে এ ব্যাধিকে নির্মূল করতে হবে। শত ফুল শতদল ফুটতে দাও। পৃথিবী আবাসযোগ্য হোক।

বিশিষ্ট সমাজ বিশ্লেষক ও রাজনীতি বিজ্ঞানীর ড. মাহফুজ পারভেজের মন্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, ‘একটি বহুত্ববাদী, উদার, গণতান্ত্রিক জাতি-সমাজ গঠনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যে ধরনের টানাপড়েন চলতে থাকে তাতে অসহিষ্ণুতার নানা ক্ষেত্র নির্মিত হয়। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণের চ্যালেঞ্জের পথ পাড়ি দিতে হয় বহু স্বার্থগোষ্ঠীর অসহিষ্ণু অবস্থানকে ডিঙিয়ে। কখনও লিঙ্গ চেতনার লড়াই, সম্প্রদায়গত দ্বন্ধ, আবার কখনও শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার পরিসরে দলগত রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যেও বাই-প্রডাক্ট হিসাবে অসহিষ্ণুতার উদ্ভব হয়’।

কোন বক্তা যদি হেলিকপ্টারে চড়েন এটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক মন্তব্যের ঝড় উঠে। এদেশের যদু মধুরা হেলিকপ্টারে চড়তে পারলে একজন জননন্দিত বক্তা ও বুযুর্গ ব্যক্তি চড়লে অসুবিধা কোথায়? একদিনে একজন গ্রহণযোগ্য বক্তাকে একাধিক মাহফিলে শরিক হতে হয়। হেলিকপ্টার তাঁদের জন্য বিলাসিতা নয়, অপরিহার্য বাহন। আগামীতে হয়তো রকেটেরও প্রয়োজন পড়তে পারে। একজন আলিমের প্রতি সম্মান দেখাতে কেন আমরা কার্পণ্য করি। কারো মাহফিলে যদি উপচেপড়া মানুষের ভীড় হয় তাতে আমাদের খুশি হওয়ার কথা ছিল। ব্যাণ্ডপার্টি ও ডিজে কালচার থেকে যুবক সম্প্রদায় ওয়াজ মাহফিলের দিকে ছুটতে শুরু করেছে। এটা নতুন আশার সঞ্চার করে। অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মনকে ছোট করে দিচ্ছে। জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ। এ অনুগ্রহ ও দয়ার প্রতি সম্মান দেখাতে না পারলে, কেড়ে নেয়ার মত দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।

আবহমানকাল ধরে শীতের মওসুমে শহরে ও গ্রামাঞ্চলে ওয়ায, তাফসীর, জিকির, মীলাদ, সীরাত মাহফিলের প্রথা চালু রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাহফিলের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। সাধারণ মানুষ ওয়ায়েযদেরকে সম্মানের চোখে দেখেন। ওয়ায়েযদেরকে মুখে পবিত্র কুরআন, হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস শুনে শ্রোতাদের মন বিগলিত হয়, ঈমানী চেতনা জাগ্রত হয় এবং নেক আমলে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। সমাজে তাওহীদী আদর্শ, নৈতিকতা ও তাকওয়ার ভিত তৈরিতে ওয়াজ মাহফিলের ভূমিকা অস্বীকার করার জো নেই। মাদকাসক্তি, জুয়া-ক্যাসিনো, বেলেল্লাপনা, সন্ত্রাস, যৌতুক, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে ওয়ায়েজ ও বক্তাগণ সদা সোচ্চার। মাজহাবি বিরোধ ও ইখতিলাফি মাসায়েলগুলো প্রকাশ্যে আলোচনা করলে অসহিষ্ণুতা নতুন মাত্রা পায়। পরবর্তীতে তা সংঘাতে রূপ নেয়। যদি আলোচনা করতেই হয় তাহলে পবিত্র কুরআন, সহীহ হাদিস ও ফকিহদের ভিন্নমতগুলোও ব্যাখ্যা করা দরকার।

ইদানিংকালে ওয়ায মাহফিলের চিরায়ত সংস্কৃতির কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কৌতুক, হাস্যরস, দৃষ্টিকটু দেহভঙ্গি, অনির্ভরযোগ্য কিসসা-কাহিনী, বিশেষ কোনো গায়িকা-নায়িকার গানের নকল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে। ওয়াজ কিছুটা বিনোদনের রূপ নিয়ে দুর অজানার পথ ধরেছে। ওয়াযের ময়দানে সুরের একটি বিশেষ আবেদন রয়েছে; এ কথা অস্বীকার করা যায় না। সুরের লহরি ও তরঙ্গায়িত মুর্চ্ছনায় শ্রোতাদের সম্মোহিত করে রাখা যায়। সুললিত কণ্ঠস্বর আল্লাহ তাআলার দান। এটাকে জনগণের দিল পরিবর্তন ও নৈতিকতার উজ্জীবনে ব্যবহার করা গেলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়। সাধারণ জনগণ সুরের পাগল। তাদের মতে ওয়াজ হলো সুরের টান। অপর দিকে এমন বক্তা ও ওয়ায়েজ আছেন যাদের কথায় সুর নেই, আছে সুধা; লয় নেই, আছে অমৃত। আছে পবিত্র কুরআন-হাদীসের তাত্ত্বিক আলোচনা, নিগূঢ় পর্যালোচনা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। কথা সাদামাটা ও বক্তব্য সরাসরি হওয়ায় নেক আমলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। তাঁদের চাহিদা আছে শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে। মাদরাসায় শিক্ষিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বক্তারা যখন মাঠে আসেন তখন সমাজে নতুন চাহিদা তৈরি হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে বেদনার সাথে লক্ষ্য করা গেছে যে, একজন আলিম, একজন ওয়ায়েজ প্রকাশ্য মাহফিলে অপর আলিম ও ওয়াজের বিরুদ্ধে কদর্য বিষোদগার, হিংসাত্মক সমালোচনা, রুঢ় শব্দ ব্যবহার এমন কি পাদুকা প্রদর্শনের মত নিচু প্রকৃতির কাজও করেছেন। এক অপরকে রাসূল (সা.)-এর দুশমন, তাগুতের দোসর, গোমরাহ, বিদেশি এজেন্ট ও ইহুদির দালাল এমন কি কাফির বলার দৃষ্টতাও দেখানো হচ্ছে। তাঁদের অনুসারীগণ ফেসবুকে পক্ষে বিপক্ষে বিতর্কের ঝড় তুলে পরিস্থিতিকে আরো জটিল এবং আগুনে ঘৃতাহুতির মত ন্যাক্কারজনক কাজ করে যাচ্ছেন। এসব কারণে আদালতে মামলা পর্যন্ত রুজু হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন পরিস্থিতিকে আর বাড়তে দেয়া যায় না। এখন লাগাম টেনে ধরার সময়। ইসলামি রাজনৈতিক দলসমূহের হাইকমাণ্ড, সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুযুর্গ পীর ও ওলামা মাশায়েখদের হস্তক্ষেপ সময়ের দাবি। দুর ও নিকট অতীতের ঐতিহ্যলালিত অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির অর্গল ভেঙে দিতে হবে। ব্যক্তির নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহনশীল সমাজ বিনির্মাণের এটা অপরিহার্য পূর্বশর্ত।

মতের যেমন ভিন্নমত থাকতে পারে, তেমনি ভিন্নমতের বিপরীতেও তৃতীয় মত থাকতে পারে। তবে একাডেমিক পর্যালোচনা করতে গিয়ে মাত্রাজ্ঞানের সীমা যেন আমরা ছাড়িয়ে না যাই, সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। আমরা কী পারি না আমাদের যে কোন ভাইয়ের ভালো ও ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করে মন্দ ও নেতিবাচক দিকগুলো বর্জন করতে? আমরা কী দিলের দরদ নিয়ে আমাদের ভাইয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ইসলাহের ব্যবস্থা করতে? এর জন্য প্রয়োজন উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও পক্ষপাতহীন পর্যবেক্ষণ।

মতের ভিন্নতা, সাধারণ বিষয়ে ইখতিলাফ ও মাযহাবী বিরোধ নিয়ে আমরা মুসলমানেরা যুগে যুগে যেভাবে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও সহিংসতায় রক্ত ঝরিয়েছি তা ইসলামের ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় স্মৃতি। মুফাস্‌সিরে কুরআন ইমাম ইবনু জারীর আত-তাবারী (রহ)-কে বাগদাদের কবরস্থানে দাফন করতে দেইনি ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহ.)-এর তথাকথিত অনুসারীগণ। নিজ বাড়ির উঠানে তাঁকে কবর দিতে হয়েছে। দামেস্কের মসজিদে উমাইয়াদের হাতে নির্মম পিটুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারান বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিস ইমাম নাসাঈ (রহ.)। ইমাম বুখারী (রহ.)-কে মাতৃভূমি বুখারা থেকে বের করে দিয়েছিলেন তাঁর স্বধর্মাবলম্বীরা| সরকারের সাথে যোগসাজশ করে হাফেয ইবন তাইমিয়া (রহ.)-কে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন একশ্রেণীর আলিম। খলীফা মুসতাসিম বিল্লাহ তথা সুন্নিদের শায়েস্তা করার জন্য মোঙ্গল নেতা হালাকু খানকে বাগদাদে ডেকে এনেছিলেন শীয়াপন্থি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর লোকেরাই। ফলে ধ্বংস হয়ে গেল সভ্যতার লীলাভূমি ঐতিহাসিক নগরী বাগদাদ; জ্বলে পুরে ভস্ম হয়ে গেল মুসলমানদের পাঁচ শ’ বছরের সমৃদ্ধ পাঠাগার ও লাখ লাখ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি; মারা গেল বাগদাদ নগরীর ২০ লাখের মধ্যে ১৬ লাখ মানুষ। স্পেন বিজয়ী সেনাপতি মূসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদের সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি কেড়ে নেন ওমাইয়া খলিফাগণ। জীবনের শেষ দিনগুলোতে আরবের রাস্তায় তাঁদের ভিক্ষা করতে দেখা গেছে। নির্মমতা ও অসহিষ্ণুতা আর কারে বলে? বর্তমান শতকের বিশ্ববরেণ্য স্কলার সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর বিরুদ্ধে একশ্রেণীর আলিম আরবি ভাষায় বিরাট গ্রন্থ রচনা করেন। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ শায়খুল ইসলাম বিচারপতি মুফতি তকী ওসমানীকে হত্যা করার জন্য তাঁর গাড়িবহরে গুলিবর্ষণ করা হয়। তিনি বেঁচে গেলেও তাঁর দেহরক্ষী প্রাণ হারান। এভাবেই তৈরি হয়ে গেছে বিভেদ ও বিরোধের কঠিন ও দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর।

আমরা যারা তাকলীদে বিশ্বাসী এবং ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.)-এর অনুসারী; আমরা যারা ইমাম শাফেয়ী (রহ.), ইমাম মালেক (রহ.), ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহ.), শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.), আল্লামা ইবনুল কাইয়িম আল-জাওযিয়া (রহ.), শায়খ আবদুল্লাহ ইবনু বায (রহ.) ও শায়খ মুহাম্মদ সালিহ আল উসায়মিন (রহ.)-এর ফিকহী গবেষণাকে অত্যন্ত মর্যাদা ও সম্মানের চোখে দেখি। অপরদিকে গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদের মধ্যে অনেকে (সবাই নয়) মুকাল্লিদদের এবং বিশেষত ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.)-এর প্রতি যে তীর্যক ভাষায় বিষোদগার করেন তা কেবল বেদনাদায়ক নয়, লজ্জাজনকও বটে। আবার এর জবাব দিতে গিয়েও আমরা সীমা লঙ্ঘন করে বসি। সংকীর্ণতার দুষ্ট কীট উদারতার সম্ভাবনাকে করেছে দংশিত ও ছিন্নভিন্ন। উম্মাহর ঐক্যের পথে এ মনোবৃত্তি বিরাট অন্তরায়স্বরূপ| আমরা আসলে নিজেদের দল, গোষ্ঠী, মত ও চিন্তাধারার নির্ধারিত গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি। দলীয় অন্ধত্ব ও সংকীর্ণতার বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়েছি। এ প্রক্রিয়া-পদ্ধতিতে নিজেদের দল ভারি হলেও মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে এবং প্রকারান্তরে লাভবান হচ্ছে ইসলামের বৈরী শক্তি।

ওলামা-মাশায়েখ পারস্পরিক ছোটখাটো মতভেদ ভুলে কওম ও মিল্লাতের বৃহত্তর স্বার্থে একতাবদ্ধ হতে পারলে ইতিবাচক ও বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করা যায়। ইতিহাসের পাঠকদের জানা আছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি গঠিত হয় আন্দোলনের মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা৷ কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের সেক্যুলার রাজনীতিক ও উচ্চ বিলাসী মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি ছিল রাষ্ট্রকে ইসলামিকরণের বিপক্ষে। তাঁরা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, বিভিন্ন ঘরানার আলিমগণ পরস্পর দলাদলি ও মত বিরোধে বিপর্যস্ত। ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুসরণে প্রত্যেক তরিকার নিজস্ব ব্যাখ্যা বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামি আদর্শ বাস্তবায়ন করতে গেলে সাংঘাতিক বিভাজন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

পরিস্থিতির এমনতর প্রেক্ষাপটে দেওবন্দী, বেরলভী, শিয়া, জামায়াতে ইসলামি ও আহলে হাদীস ঘরানার আলিম ও স্কলারগণ বহু আলাপ আলোচনা ও মত বিনিময়ের পর ১৯৫২ সালে ২২ দফা শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা তৈরি করতে সক্ষম হন। ইতিহাসে এটি ওলামাদের ২২ দফা নামে পরিচিত। হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) এর খলিফা ও বিখ্যাত সীরাত গবেষক আল্লামা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী (রহ.) এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ৩১জন শীর্ষস্থানীয় আলিম ২২ দফা রূপরেখায় স্বাক্ষর করেন। বিভিন্ন ঘরানার আলিমদের প্রণীত ২২ দফার ভিত্তিতে রচিত হয় পাকিস্তানের প্রথম ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান। ১৯৫৬ সালে ২৯ ফেব্রুয়ারী এটি পার্লামেন্টে গৃহীত হয় এবং ২৩ মার্চ কার্যকর করা হয়। এ সংবিধানে ছিল ২৩৪টি অনুচ্ছেদ ও ১৩টি অধ্যায়। ১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এ সংবিধান স্থগিত করে দেন৷

২২ দফা ছিল পাকিস্তানকে শরীয়াহ আইনের ভিত্তিতে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার রূপরেখা। এ রূপরেখার দলিলে অন্যদের মধ্যে সাক্ষর করেন জামায়াতে ইসলামির আমীর মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, কালাত রাজ্যের মন্ত্রী মাওলানা শামসুল হক আফগানী, জমিয়তে ওলামায়ে পাকিস্তানের সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ আল কাদেরী, সীমান্ত প্রদেশের মানকি শরীফের পীর মুহাম্মদ আজিজুল হাসানাত, নেজামে ইসলাম পার্টির মাওলানা আতাহার আলী, জমিয়তে হিজবুল্লাহর আমীর শর্ষীনার পীর মাওলানা আবু জাফর মুহাম্মদ সালেহ, জমিয়তে আহলে হাদীসের আমির মাওলানা দাউদ গজনভী, বাংলাদেশের মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, শীয়া অধিকার আন্দোলনের নেতা মুফতি হাফেজ কিফায়েত হোসেন মুজতাহিদ, জামিয়া আশরাফিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ হাসান, শায়খুল তাফসির আল্লামা ইউসুফ বান্নুরি, মজলিসে ইহরারের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী জলান্ধরী, শায়খুল তাফসির মাওলানা আহমদ আলী লাহোরি, শায়খুল হাদিস আল্লামা ইদরিস কান্ধলভী, মাওলানা ইহতিশামুল হক থানভী, মাওলানা বদরে আলম মিরাটি ও আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী।

১৯৫২ সালের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, বিপদ, সংকট ও বিপর্যয় মানুষকে একে অপরের কাছে নিয়ে যায়। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ অনুভূত হয়। এখান থেকে সবার শিক্ষা নেওয়া দরকার। আল্লামা ইকবাল বলেন,

خدا تجھے کسی طُوفاں سے آشنا کر دے
کہ تیرے بحر کی موجوں میں اضطراب نہيں

‘কোন ঘূর্ণিঝড়ের সাথে আল্লাহ তোমাদের মুখোমুখি করুন, কারণ তোমার সাগরে অভিঘাতপূর্ণ তরঙ্গ নেই।’

অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি নস্যাত করে ভ্রাতৃত্বের বাতাবরণ তৈরিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। হৃদয়কে প্রসারিত করতে পারলে কী অপার আনন্দ উপলব্ধি করা যায়, অনেকে এটা জানেন না। বাক সংযম, উদার আচরণ, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা সুষ্ঠু সমাজ নির্মাণে সহায়ক। আলিম ওলামাদের পারস্পরিক কোন্দল, দলাদলি কাদা ছোড়াছুড়িতে বৈরিশক্তি লাভবান হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থে বৃহত্তর ঐক্যের ধারণা ও চেতনা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরি বলে তথ্যাভিজ্ঞমহল মনে করেন।

ড. খালিদ হোসেন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ