বৃহস্পতিবার-১৫ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-১৫ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাহাবী: পরিচয় ও মর্যাদা

সাহাবী: পরিচয় ও মর্যাদা

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ

 

সাহাবীর পরিচয়

‘সাহাবী’ শব্দটি আরবি ভাষার ‘সুহবত’ শব্দের একটি রূপ। একবচনে ‘সাহেব’ ও ‘সাহাবী’ এবং বহুবচনে ‘সাহাব’ ও ‘আসহাব’ ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থ সঙ্গী, সাথী, সহচর, এক সাথে জীবন যাপনকারী অথবা সাহচর্যে অবস্থানকারী। ইসলামি পরিভাষায় ‘সাহাবা’ শব্দটি দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মহান সঙ্গী-সাথীদের বোঝায়। ‘সাহেব’ শব্দটির বহুবচনের আরও কয়েকটি রূপ আছে। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গী-সাথীদের বোঝানোর জন্য ‘সাহেব’-এর বহুবচনে ‘সাহাবা’ ছাড়া ‘আসহাব’ ও ‘সাহব’ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

হাফিয ইবনে হাজার আল-আসকলানী (রহ.) আল-ইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা গ্রন্থে সাহাবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,

إن الصحابي: من لقي النبيّ ﷺ مؤمنًا به، ومات على الإسلام.

‘সাহাবী সেই ব্যক্তি যিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান সহকারে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের ওপরই মৃত্যুবরণ করেছেন।’[1]

উপর্যুক্ত সংজ্ঞায় সাহাবী হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। যথা-

  1. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান,
  2. ঈমানের অবস্থায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ (আল-লিকা) ও
  3. ইসলামের ওপর মৃত্যুবরণ (মাওত আলাল ইসলাম)।

প্রথম শর্তটি দ্বারা এমন লোক সাহাবী বলে গণ্য হবে না যারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ তো লাভ করেছে কিন্তু ঈমান আনেনি। যেমন- আবু জাহল, আবু লাহাব প্রমুখ মক্কার কাফিরবৃন্দ।

দ্বিতীয় শর্ত অর্থাৎ সাক্ষাৎ দ্বারা এমন ব্যক্তিও সাহাবী বলে গণ্য হবেন, যিনি হুযুরের তো সাক্ষাৎ লাভ করেছেন, কিন্তু অন্ধত্ব বা এ জাতীয় কোনো অক্ষমতার কারণে চোখে দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমন- অন্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.)।

তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ মাউত আলাল ইসলাম দ্বারা এমন লোকও সাহাবায়ে কেরামের দলে শামিল হবেন যাঁরা ঈমান অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছেন। তারপর মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়েছেন। তারপর আবার ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। পুনরায় ইসলাম গ্রহণের পর নতুন করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ না করলেও তিনি সাহাবী বলে গণ্য হবেন। এটিই সর্বাধিক সঠিক মত। যেমন- হযরত আশয়াস ইবনে কায়েস (রাযি.) ও আরও অনেকে। হাদীস বিশারদগণ হযরত আশয়াস ইবনে কায়েস (রাযি.)-কে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে গণ্য করে তাঁর বর্ণিত হাদীস সহীহ ও মুসনদ গ্রন্থসমূহে সংকলন করেছেন। অথচ তিনি ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে যান এবং হযরত আবু বকর (রাযি.)-এর খিলাফতকালে আবার ইসলামে ফিরে আসেন।

শেষোক্ত শর্তের ভিত্তিতে এমন ব্যক্তি সাহাবী বলে গণ্য হবে না যে ইসলামের অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছে, কিন্তু পরে মুরতাদ অবস্থায় মারা গেছে। যেমন- আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ আল-আসাদী। সে মুসলমান হয়ে হাবশায় হিজরত করার পর খ্রিস্টান হয়ে যায় এবং সেখানে মুরতাদ অবস্থায় মারা যায়। তাছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল, রাবীয়া ইবনে উমাইয়া প্রমুখ মুরতাদ ব্যক্তিবর্গ। সাহাবী হওয়ার জন্য ইসলামের ওপর মৃত্যুবরণ শর্তটি উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।

উপর্যুক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, ঈমান সহকারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাতের পর তাঁর সাহচর্য বেশি বা অল্পদিনের জন্য হোক, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে কোনো হাদীস বর্ণনা করুক বা না করুক, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুক বা না করুক, এমন কি যে ব্যক্তির জীবনে মুহূর্তের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ ঘটেছে এবং ঈমানের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, এমন সকলেই সাহাবায়ে কেরামের অন্তর্ভুক্ত।

যারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনেনি, কিন্তু পূর্ববর্তী অন্য কোনো নবীর প্রতি ঈমান সহকারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছে, তারা সাহাবী নয়। আর বুহাইরা রাহিবের মত যাঁরা পূর্ববর্তী কোনো নবীর প্রতি ঈমান সহকারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নুবুওয়াত লাভের পূর্বে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন, তিনি ভবিষ্যতে নবী হবেন এমন ব্যক্তিদের সাহাবা হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। মুসলিম মনীষীরা তাঁদের সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতে পারেননি।

উল্লিখিত সংজ্ঞার শর্তাবলি জিনদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জিনরাও ‘সাহাবা’ ছিলেন। কুরআন মজিদে এমন কিছু জিনের কথা বলা হয়েছে যাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কুরআন তিলাওয়াত শুনে ঈমান এনেছিলেন। নিঃসন্দেহে তারা অতি মর্যাদাবান সাহাবা ছিলেন।

সাহাবীর উল্লিখিত সংজ্ঞাটি ইমাম বুখারী (রহ.) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)সহ অধিকাংশ পণ্ডিতের নিকট সর্বাধিক সঠিক বলে বিবেচিত। অবশ্য সাহাবীর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি অপ্রসিদ্ধ মতামতও আছে। যেমন- কেউ কেউ সাক্ষাতের (আল-লিকা) স্থলে চোখে দেখার (রুইয়াত) শর্ত আরোপ করেছেন। কিন্তু তাতে এমন সব ব্যক্তি বাদ পড়ে যাবেন যাঁরা মুমিন হওয়া সত্ত্বেও অন্ধত্বের কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে চোখে দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমন- আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাযি.)। অথচ তিনি অতি মর্যাদাবান সাহাবী ছিলেন।[2]

সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা

সাহাবায়ে কেরামের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা হিসেবে স্তরভেদ থাকতে পারে, কিন্তু পরবর্তী যুগের কোনো মুসলমানই তা তিনি যত বড় জ্ঞানী, গুণী ও সাধক হোন না কেন কেউই একজন সাধারণ সাহাবীর মর্যাদাও লাভ করতে পারেন না। এ ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা একমত।

এ সাহাবীরাই আল্লাহর রাসুল (সা.) ও তাঁর উম্মতের মধ্যে প্রথম মধ্যসূত্র। পরবর্তী উম্মত আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআন, কুরআনের ব্যাখ্যা, আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর পরিচয়, তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, মোটকথা দীনের সবকিছুই একমাত্র তাঁদেরই সূত্রে, তাঁদেরই মাধ্যমে জানতে পেরেছে। সুতরাং এ প্রথম সূত্র উপেক্ষা করলে, বাদ দিলে অথবা তাঁদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি হলে দীনের মূল ভিত্তিই ধসে পড়ে। কুরআন ও হাদীসের প্রতি অবিশ্বাস দানা বেঁধে ওঠে।

হাফিয ইবনে আবদুল বারর (রহ.) সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন,

‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুহবত ও তাঁর সুন্নাতের হিফাযত ও ইশায়াতের দুর্লভ মর্যাদা আল্লাহ তাআলা এসব মহান ব্যক্তির ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন। এ কারণেই তাঁরা খায়রুল কুরুন ও খায়রু উম্মাতিনের মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।’[3]

হাফিয আবু বকর ইবনে খতীব আল-বাগদাদী (রহ.) বলেন,

وَالْأَخْبَارُ فِيْ هَذَا الْـمَعْنَىٰ تَتَّسِعُ، وَكُلُّهَا مُطَابِقَةٌ لِّـمَا وَرَدَ فِيْ نَصِّ الْقُرْآنِ، وَجَمِيْعُ ذَلِكَ يَقْتَضِيْ طَهَارَةَ الصَّحَابَةِ، وَالْقَطْعَ عَلَىٰ تَعْدِيْلِهِمْ وَنَزَاهَتِهِمْ، فَلاَ يَحْتَاجُ أَحَدٌ مِّنْهُمْ مَّعَ تَعْدِيْلِ اللهِ تَعَالَىٰ لَـهُمُ الْـمُطَّلِعِ عَلَىٰ بَوَاطِنِهِمْ إِلَىٰ تَعْدِيْلِ أَحَدٍ مِّنَ الْـخَلْقِ لَـهُمْ، فَهُمْ عَلَىٰ هَذِهِ الصِّفَةِ إِلَّا أَنْ يَثْبُتَ عَلَىٰ أَحَدٍ ارْتِكَابُ مَا لَا يَحْتَمِلُ إِلَّا قَصْدَ الْـمَعْصِيَةِ، وَالْـخُرُوْجِ مِنْ بَابِ التَّأْوِيْلِ، فَيُحْكَمُ بِسُقُوْطِ الْعَدَالَةِ، وَقَدْ بَرَّأَهُمُ اللهُ تَعَالَىٰ مِنْ ذَلِكَ، وَرَفَعَ أَقْدَارَهُمْ عَنْهُ، عَلَىٰ أَنَّهُ لَوْ لَـمْ يَرِدْ مِنَ اللهِ b وَرَسُوْلِهِ فِيهِمْ شَيْءٌ مِّمَّا ذَكَرْنَاهُ لَأَوْجَبَتِ الْـحَالُ الَّتِيْ كَانُوْا عَلَيْهَا، مِنَ الْـهِجْرَةِ، وَالْـجِهَادِ، وَالنُّصْرَةِ، وَبَذْلِ الْـمُهَجِ وَالْأَمْوَالِ، وَقَتْلِ الْآبَاءِ وَالْأَوْلاَدِ، وَالْـمُنَاصَحَةِ فِي الدِّيْنِ، وَقُوَّةِ الإِيْمَانِ وَالْيَقِيْنِالْقَطْعَ عَلَىٰ عَدَالَتِهِمْ وَالْاعْتِقَادَ لِنَزَاهَتِهِمْ، وَأَنَّهُمْ أَفْضَلُ مِنْ جَمِيْعِ الْـمُعَدَّلِيْنَ وَالْـمُزَكَّيْنَ الَّذِيْنَ يَجِيْؤُنَ مِنْ بَعْدِهِمْ أَبَدَ الْآبِدِيْنَ.

‘উল্লিখিত ভাব ও বিষয়ের হাদীস ও আখবারের সংখ্যা অনেক এবং সবই নাসসুল কুরআনের ভাবের সাথে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ তাতে সাহাবায়ে কেরামের সুমহান মর্যাদা, আদালত, পবিত্রতা ইত্যাদি ভাব ব্যক্ত হয়েছে। আল্লাহ ও রাসুল (সা.) কর্তৃক তাঁদের আদালতের ঘোষণা দানের পর পৃথিবীর আর কোনো মানুষের সনদের মুখোপেক্ষী তাঁরা নন। আল্লাহ ও রাসুল (সা.) তাঁদের সম্পর্কে কোনো ঘোষণা না দিলেও তাঁদের হিজরত, জিহাদ, সাহায্য, আল্লাহর রাহে ধন-সম্পদ ব্যয়, পিতা ও সন্তানদের হত্যা, দীনের ব্যাপারে উপদেশ, ঈমান ও ইয়াকীনের দৃঢ়তা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড একথা প্রমাণ করতো যে, আদালত, বিশ্বাস, পবিত্রতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ন্যায়পরায়ণ ও পবিত্র ব্যক্তিই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, তাঁরা ছিলেন সকলের থেকে উত্তম।’[4]

কোনো কোনো সাহাবীর জীবদ্দশায় রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তবে মুসলিম পণ্ডিতদের অনেকে সাহাবায়ে কেরামের সকলেই জান্নাতী বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হাফিয ইবনে হাজার আল-আসকলানী (রহ.) আল-ইসাবা গ্রন্থে স্পেনের ইমাম ইবনে হাযাম (রহ.)-এর মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন,

الصحابة كلّهم من أهل الجنة قطعا.

‘সাহাবায়ে কেরামের সকলেই নিশ্চিতভাবে জান্নাতী।’[5]

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবায়ে কেরামের গালি দেওয়া বা হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সমালোচনা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন,

«اللهَ اللهَ فِيْ أَصْحَابِيْ، لَا تَتَّخِذُوْهُمْ غَرَضًا بَعْدِيْ، فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّيْ أَحَبَّهُمْ، وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِيْ أَبْغَضَهُمْ».

‘আল্লাহ, আল্লাহ! আমার পরে তোমরা তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করো না। তাদেরকে যারা ভালবাসে, আমার মুহাব্বতের খাতিরেই তাঁরা ভালবাসে, আর যারা তাঁদেরকে হিংসা করে, আমার প্রতি হিংসার কারণেই তারা তা করে।’[6]

সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা

সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা যে কত তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না। ইমাম আবু যারআ আর-রাযী (রহ.) বলেছেন,

تُوُفِّيَ النَّبِيُّ وَمَنْ رَآهُ وَسَمِعَ مِنْهُ زِيَادَةٌ عَلَىٰ مِائَةِ أَلْفِ إِنْسَانٍ مِّنْ رَجُلٍ أَوِ امْرَأَةٍ، كُلُّهْمْ قَدْ رَوَىٰ عَنْهُ سَمَاعًا أَوْ رُؤْيَةً.

‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন ইনতিকাল করেন, তখন যারা তাঁকে দেখেছেন এবং তাঁর কথা শুনেছেন এমন লোকের সংখ্যা নারী-পুরুষ মিলে এক লাখেরও ওপরে। তাঁদের প্রত্যেকেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস বর্ণনা করেছেন।’[7]

তাহলে যে সকল সাহাবী কোনো হাদীস বর্ণনা করেননি তাঁদের সংখ্যা যে কত বিপুল তা সহজেই অনুমেয়। ইমাম আবু যারআ (রহ.)-এর একথার সমর্থন পাওয়া যায় সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হযরত কা’ব ইবনে মালিক (রাযি.)-এর একটি বক্তব্য দ্বারা। তিনি তাবুক অভিযান বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন,

وَالنَّاسُ كَثِيرٌ، لَا يُحْصِيْهِمْ دِيْوَانٌ.

‘মানুষের সংখ্যা অনেক। কোনো দফতর বা দিওয়ান তা গণনা করতে পারবে না।’[8]

সাহাবায়ে কেরামের যথাযথ হিসেব কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের শেষ দিকে মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর হাতে বাইয়াত হয়। কেউ কেউ বলেছেন, হিজরী দশম সনে মক্কা এবং তায়েফে একজনও অমুসলিম ছিল না। সকলে ইসলাম গ্রহণ করে বিদায় হজ্জে অংশগ্রহণ করে। এমনিভাবে আরবের বহু গোত্র সম্পূর্ণভাবে মুসলমান হয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ ছিল মরুবাসী। তাদের হিসেব সংরক্ষণ করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাছাড়া হযরত আবু বকর (রাযি.)-এর খিলাফতকালে ভণ্ডনবী ও ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে অসংখ্য সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। তাঁদের অনেকের পরিচয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াত ও অসংখ্য হাদীসে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি আয়াতের অর্থ উদ্ধৃত হলো:

॥১॥

مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللّٰهِ١ؕ وَالَّذِيْنَ مَعَهٗۤ اَشِدَّآءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيْنَهُمْ تَرٰىهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَّبْتَغُوْنَ فَضْلًا مِّنَ اللّٰهِ وَرِضْوَانًا١ٞ سِيْمَاهُمْ فِيْ وُجُوْهِهِمْ مِّنْ اَثَرِ السُّجُوْدِ١ؕ ذٰلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرٰىةِ١ۛۖۚ وَمَثَلُهُمْ فِي الْاِنْجِيْلِ١ۛ۫ۚ ؒ۰۰۲۹

‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল; তাঁর সহচরগণ, কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাঁদেরকে রুকু ও সাজদায় অবনত দেখবে। তাঁদের মুখমণ্ডলে সাজদার চিহ্ন থাকবে, তাওরাতে তাঁদের বর্ণনা এরূপই এবং ইনজীলেও।’[9]

॥২॥

وَالسّٰبِقُوْنَ الْاَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهٰجِرِيْنَ وَالْاَنْصَارِ وَالَّذِيْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِاِحْسَانٍ١ۙ رَّضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ وَاَعَدَّ لَهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِيْ تَحْتَهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِيْنَ فِيْهَاۤ اَبَدًا١ؕ ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ۰۰۱۰۰

‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখোনে তারা চিরস্থায়ী হবে। এটা মহা কামিয়াবি।’[10]

॥৩॥

لِلْفُقَرَآءِ الْمُهٰجِرِيْنَ الَّذِيْنَ اُخْرِجُوْا مِنْ دِيَارِهِمْ وَاَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُوْنَ فَضْلًا مِّنَ اللّٰهِ وَرِضْوَانًا وَّيَنْصُرُوْنَ اللّٰهَ وَرَسُوْلَهٗ١ؕ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الصّٰدِقُوْنَۚ۰۰۸ وَالَّذِيْنَ تَبَوَّؤُ الدَّارَ وَالْاِيْمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّوْنَ مَنْ هَاجَرَ اِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُوْنَ فِيْ صُدُوْرِهِمْ حَاجَةً مِّمَّاۤ اُوْتُوْا وَيُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤى اَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ١۫ؕ ۚ۰۰۹

‘এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যাঁরা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি হতে উৎখাত হয়েছে। তাঁরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাহায্য করে। তারাই তো সত্যাশ্রয়ী। মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এ নগরীতে (মদীনা) বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে তাঁরা মুহাজিরদের ভালবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না, আর তাঁরা তাঁদেরকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও।’[11]

এ আয়াতে প্রথম মুহাজির ও পরে আনসারদের প্রশংসা করা হয়েছে।

॥৪॥

অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের শানে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁদের সম্মান, মর্যাদা ও স্থান নির্ধারণ করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যেমন-

عَنْ عَبْدِ اللهِ، أَنَّ النَّبِيَّ قَالَ: «خَيْرُ أُمَّتِيْ قَرْنِيْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُونَْهُمْ ثُمَّ يَجِيءُ قَوْمٌ تَسْبِقُ أَيْمَانُهُمْ شَهَادَتَهُمْ وَيَشْهَدُوْنَ قَبْلَ أَنْ يُسْتَشْهَدُوْا».

‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম লোক হচ্ছে আমার যুগের লোকেরা। তারপর তার পরের যুগের লোকেরা, তারপর তার পরের যুগের লোকেরা। তারপর এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যাদের কসম হবে তাদের সাক্ষ্যের অগ্রগামী। তাদের কাছে সাক্ষী চাওয়ার আগেই তারা সাক্ষ্য দেবে।’’[12]

॥৫॥

«لَا تَسُبُّوْا أَصْحَابِيْ، فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ، ذَهَبًا مَّا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ، وَلَا نَصِيْفَهُ».

‘তোমরা আমার সাহাবায়ে কেরামের গালি দেবে না, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও ব্যয় করো তবুও তাঁদের যেকোনো একজনের মূদ বা তার অর্ধেক পরিমাণ যবের সমতুল্য হবে না।’[13]

॥৬॥

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : «مَهْمَا أُوْتِيْتُمْ مِنْ كِتَابِ اللهِ فَالْعَمَلُ بِهِ , لَا عُذْرَ لِأَحَدٍ فِيْ تَرْكِهِ, فَإِنْ لَّـمْ يَكُنْ فِيْ كِتَابِ اللهِ, فَسُنَّةٌ مِنِّيْ مَاضِيَةٌ, فَإِنْ لَّـمْ يَكُنْ سُنَّتِيْ, فَمَا قَالَ أَصْحَابِيْ, إِنَّ أَصْحَابِيْ بِمَنْزِلَةِ النُّجُوْمِ فِي السَّمَاءِ فَأَيُّمَا أَخَذْتُمْ بِهِ اهْتَدَيْتُمْ, وَاخْتِلَافُ أَصْحَابِيْ لَكُمْ رَحْمَةٌ».

‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাবের যা কিছু দেওয়া হয়েছে তার ওপর আমল করতে হবে। তা তরক করা সম্পর্কে তোমাদের কারো কোনো ওজর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। যদি আল্লাহর কিতাবে কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়া যায় তাহলে আমার সুন্নাহে খোঁজ করতে থাক। যদি তাতেও না পাওয়া যায় তাহলে আমার সাহাবায়ে কেরামের কথায় তালাশ করতে হবে। আমার সাহাবীরা আকাশের তারকা সদৃশ। তার কোনো একটিকে তোমরা গ্রহণ করলে সঠিক পথ পাবে। আর আমার সাহাবায়ে কেরামের পারস্পরিক ইখতিলাফ বা মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমতস্বরূপ।ÕÕ[14]

[1] ইবনে হাজর আল-আসকলানী, আল-ইসাবা ফী তামীযিস সাহাবা, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৫ হি. = ১৯৯৫ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৫৮

[2] ইবনে হাজর আল-আসকলানী, আল-ইসাবা ফী তামীযিস সাহাবা, খ. ১, পৃ. ১৫৯

[3] ইবনে আবদুল র্বার, আল-ইসতিআব ফী মা’রিফাতিল আসহাব, দারুল জীল, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১২ হি. = ১৯৯২ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১

[4] (ক) আল-খতীবুল বাগদাদী, আল-কিফায়া ফী মা’রিফাতি উসূলি ‘ইলমির রিওয়ায়া, আল-মাকতাবাতুল ইলমিয়া, মদীনা মুনাওওয়ারা, সউদী আরব, পৃ. ৪৯; (খ) ইবনে হাজর আল-আসকলানী, আল-ইসাবা ফী তামীযিস সাহাবা, খ. ১, পৃ. ১৩১-১৩২

[5] (ক) ইবনে হাযম, আল-ফাসাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, মাকতাবাতুল খানজী, কায়রো, মিসর (প্রথম সংস্করণ: ১৩১৭ হি. = ১৯০০ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ১১৬; (খ) ইবনে হাজর আল-আসকলানী, আল-ইসাবা ফী তামীযিস সাহাবা, খ. ১, পৃ. ১৬৩

[6] (ক) আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর, খ. ৫, পৃ. ৬৯৬, হাদীস: ৩৮৬২; (খ) ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ = আল-ইহসান ফী তকরীবি সহীহ ইবনি হিব্বান, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪১৪ হি. = ১৯৯৩ খ্রি.), খ. ১৬, পৃ. ২৪৪, হাদীস: ৭২৫৬; (গ) ইবনে হাজর আল-আসকলানী, আল-ইসাবা ফী তামীযিস সাহাবা, খ. ১, পৃ. ১৬৩, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল (রাযি.) থেকে বর্ণিত

[7] ইবনে হাজর আল-আসকলানী, আল-ইসাবা ফী তামীযিস সাহাবা, খ. ১, পৃ. ১৫৪

[8] (ক) মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ২১২৯, হাদীস: ২৭৬৯; (খ) ইবনে হাজর আল-আসকলানী, আল-ইসাবা ফী তামীযিস সাহাবা, খ. ১, পৃ. ১৫৫

[9] আল-কুরআন, সুরা আল-ফাতহ, ৪৮:২৯

[10] আল-কুরআন, সুরা আত-তাওবা, ৯:১০০

[11] আল-কুরআন, সুরা আল-হাশর, ৫৯:৮Ñ৯

[12] (ক) আবু দাউদ আত-তায়ালিসী, আল-মুসনদ, দারু হিজরা, কায়রো, মিসর (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৯ হি. = ১৯৯৯ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ২৩৯, হাদীস: ২৯৭; (খ) আবু আওয়ানা, আল-মুসতাখরাজ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওওয়ারা, সউদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪৩৫ হি. = ২০১৪ খ্রি.), খ. ১৯, পৃ. ২৪৩, হাদীস: ১১০৫৩

[13] (ক) আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ৮, হাদীস: ৩৬৭৩, হযরত আবু সায়ীদ আল-খুদরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত; (খ) মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ১৯৬৭, হাদীস: ২৫৪০, হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত; (গ) ইবনে হাজর আল-আসকলানী, আল-ইসাবা ফী তামীযিস সাহাবা, খ. ১, পৃ. ১৬৫

[14] (ক) আল-বায়হাকী, আল-মদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা, দারুল খুলাফা লিল-কুতুবিল ইসলামিয়া, কুয়েত, পৃ. ১৬২, হাদীস: ১৫২; (খ) আল-খতীবুল বাগদাদী, আল-কিফায়া ফী মা’রিফাতি উসূলি ‘ইলমির রিওয়ায়া, পৃ. ৪৮

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ