জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১০ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তালিবুল ইলম সাথীদের জন্য কয়েকটি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

তালিবুল ইলম সাথীদের জন্য কয়েকটি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

মাহফুয আহমদ

 

এক. معارف الختني علىٰ سنن الترمذي

গতদিন জরুরি কিছু কিতাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইউকেভিত্তিক একটি অনলাইন বুকশপ দেখছিলাম। চোখের সামনে এলো কয়েকটি দুর্লভ কিতাব। তন্মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশি শায়খুল হাদীসের লেখা সুনানে তিরমিযীর আরবি ব্যাখ্যাগ্রন্থ। কিতাবের নাম মাআরিফুল খুতনী আলা সুনানিত তিরমিযী।

এটি শায়খুল হাদীস মুহাম্মদ নিয়াজ মখদুম আল-খুতনী রাহিমাহুল্লাহ রচিত একটি আরবি কিতাব। তিনি ছিলেন চীন অধিকৃত তুর্কিস্তানের অধিবাসী। চীনের উইঘুর অঞ্চলের জিংজিয়াংয়ে তাঁর জন্ম হয় ১৯১৪ সালে। শিক্ষার্জনের লক্ষ্যে তিনি বহু জায়গা সফর করেছেন। অবশেষে ১৩৬৪/১৯৪৪ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে তিনি ফারিগ হন। তাঁর উস্তাদদের মধ্যে অন্যতম শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি রাহিমাহুল্লাহ। ১৯৪৫ সালে তিনি বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) চলে আসেন। বস্তুত ছরছিনার পীর মরহুম নেসার উদ্দিন আহমদ রাহিমাহুল্লাহর অনুরোধে শায়খুল ইসলাম সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহিমাহুল্লাহ তাঁকে ছরছিনা প্রেরণ করেছিলেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত একাধারে ৪১ বছর তিনি ছরছিনা দারুস সুন্নাহ কামিল মাদরাসায় হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে ঢাকায় তাঁর ইন্তেকাল হয়। হাদীস অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখালেখি করতেও ভালবাসতেন তিনি। অবশ্য তাঁর লিখিত গ্রন্থসমূহ প্রকাশনার আলো দেখেনি। প্রাপ্ত তথ্যমতে এককালে তিনি জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম অল পাকিস্তানের সভাপতিও ছিলেন।

মাআরিফুল খুতনী মূলত সুনানে তিরমিযীর ওপর তাঁর রচিত একটি অসম্পূর্ণ আরবি ব্যাখ্যাগ্রন্থ। বহুবছর যাবত এটিও পাণ্ডুলিপি আকারে ছিলো। পাঞ্জাবের শায়খুল হাদীস মাওলানা জলিল আহমদ আখন আল খুতনী সাহেব গ্রন্থটি আবিষ্কার করে ২০১৮ সালে ছাপানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মাওলানা জলিল ১৪০৬/১৯৮৬ সালে জামিয়া ইসলামিয়া বিন্নুরি টাউন থেকে শিক্ষা সমাপন করেন।

বস্তুত ২০১০ সালে মাওলানা জলিল আহমদ আখন মাওলানা শাহ হাকিম আখতার রাহিমাহুল্লাহর নির্দেশে সিলেট সফরে আসেন। সেখান থেকে তিনি ঢাকায়ও গমন করেন। ঢাকায় তিনি শায়খুল হাদীস মুহাম্মদ নিয়াজ রাহিমাহুল্লাহর পরিবারের খবর শুনতে পেলেন। যেহেতু জলিল আহমদের পরিবারও চীনের ওই একই অঞ্চল থেকে পাকিস্তান গিয়েছিলেন; সেজন্য তিনি বাংলাদেশে অবস্থানকারী ওই পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হতে আগ্রহ দেখালেন। এক সূত্রে তিনি মরহুম শায়খুল হাদীস মুহাম্মদ নিয়াজ মখদুমের মেয়ে খালেদার জামাই জেনারেল নাঈমের সাক্ষাত লাভ করেন। তার দাওয়াতে তিনি খালেদার বাসায়ও যান। এভাবে মরহুমের পরিবারের সঙ্গে মাওলানা জলিল আহমদের সখ্যতা গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে ভদ্র মহিলা খালেদা তাকে জানালেন যে, তার আব্বা মৃত্যুর সময় ৭ জন মেয়ে সন্তান রেখে যান। কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় পিতার ইলমি উত্তরাধিকারের কোনো যত্ন নেওয়া হয়নি। এ সময় খালেদা মাওলানা জলিল আহমদের হাতে একটি পাণ্ডুলিপি তুলে দেন। এই পাণ্ডুলিপি ছিলো মূলত সুনানে তিরমিযীর ওপর রচিত একটি আরবি গ্রন্থ। সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসে তিনি পাকিস্তান থেকে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।

এই আরবি ব্যাখ্যাগ্রন্থে সুনানে তিরমিযীর আবওয়াবুত তাহারা থেকে আবওয়াবুল বুয়ূ পর্যন্ত এসেছে। অর্থাৎ এটি পুরো কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ নয়। শুরুতে হাদীস বিষয়ক সংক্ষিপ্ত একটি ভূমিকাও রয়েছে। ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তিনি সংক্ষিপ্ততার পথ বেছে নিয়েছেন। ফিকহি মাসায়েলের কিছুটা বিশদ পর্যালোচনা করেছেন। হানাফি ফিকহের প্রাধান্য দিতে গিয়ে বহু প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। কখনও যুক্তির নিরিখে হাদীসের সত্যতা তুলে ধরেছেন। মোটকথা, সংক্ষিপ্ত হলেও জানার মতো কিছু বিষয়ও পাওয়া যায় বাংলাদেশি শায়খুল হাদীসের লেখা এই আরবি ব্যাখ্যাগ্রন্থে।

যদিও তিনি জন্মসূত্রে তুর্কিস্তানি, কিন্তু বাংলাদেশেই তাঁর কর্মজীবন কেটেছে। ছরছিনা মাদরাসায় তিনি চীনের হুযুর হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন।

মাওলানা জলিল আহমদ সাহেবের আন্তরিক শুকরিয়া জানাই। তাঁর মাধ্যমেই আমরা এমন তুরাস এর সন্ধান পেলাম। তবে কিতাবটি ছাপানোর ক্ষেত্রে অন্য কেউ চাইলে আরও কিছু কাজ করতে পারেন। এতে আধুনিক মানসম্মত ছাপায় আরও যুৎসই তাহকিকের মাধ্যমে কাজটি ইলমি দুনিয়ায় সমাদৃত হতে পারে।

৫১২ পৃষ্ঠার ঝকঝকে ছাপা এই সংস্করণটি আমি সংগ্রহ করেছি ইংল্যান্ডের বুরাক (Buraq) অনলাইন বুকশপ থেকে। এটি ছেপেছে পাঞ্জাবের মাকতাবায়ে হাকিমুল উম্মত।

দুই.فضل الباري في فقه البخاري والسيح الجاري إلىٰ جنة البخاري

বিগত শতকে আল্লামা কাশ্মিরী রাহিমাহুল্লাহ ইলমে হাদীসের যে বিশাল খেদমত করে গেছেন, সেজন্য আজ ইলমি দুনিয়ায় তাঁর নাম স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ব্রান্ডে পরিণত হয়েছে। আরব বিশ্বে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে শায়খ রশিদ রিযা, আল্লামা যাহিদ কাউসারী, আল্লামা শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামাহ প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত মনীষী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহিমাহুল্লাহ এর অবদান এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। আল্লামা কাশ্মিরী এর আত-তাসরীহ বিমা তাওয়াতারা ফি নুযূলিল মাসিহ গ্রন্থটি তিনি আরব থেকে প্রকাশ করেন। শায়খের তাহকিক ও নিরীক্ষণ গ্রন্থটির মান বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছে। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি কাশ্মিরী রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

আল্লামা কাশ্মিরী সাধারণত নিজে লিখতেন না। তাঁর মুক্তাসম কথা ও আলোচনাসমূহ শিষ্যগণ নোট করে রাখতেন। তিনি বলতেন ছাত্ররা লিখতেন। পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘আমালি’। পরবর্তী সময়ে সেই আমালি বা নোটগুলোই মহামূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে বিদ্বান মহলে সমাদৃত হয়।

আল্লামা কাশ্মিরী রাহিমাহুল্লাহ একাধারে বহুবছর সহীহ আল-বুখারীর পাঠদান করেছেন। তাঁর দারস ও লেচকচারসমূহ অনেকেই নোট করেন। কিন্তু তাঁর সুযোগ্য শাগরেদ আল্লামা বদরে আলম মিরাটি রাহিমাহুল্লাহ সংকলিত ফায়যুল বারী সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে। এটি আরবি ভাষায় রচিত। বিশাল কলেবরের চার খণ্ডে তা প্রকাশিত হয়। আরব থেকেও আধুনিক মানসম্মত ছাপায় ৬ খণ্ডে তা বাজারে এসেছে। সহীহ আল-বুখারীর ওপর ফায়যুল বারী ছাড়া উর্দু ভাষায়ও কাশ্মিরী রাহিমাহুল্লাহর দারস গ্রন্থাকারে বের হয়েছে।

কিন্তু আরবি ভাষায় তাঁর দারস সংবলিত আরও কোনো গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে অন্তত আমার জানা ছিলো না। সেজন্য গতদিন ইউকে ভিত্তিক একটি অনলাইন বুকশপে কিছু জরুরি কিতাব খুঁজতে গিয়ে নতুন দুটি আরবি সংকলন আবিষ্কার করলাম। দুটোই আল্লামা কাশ্মিরীর সহীহ আল-বুখারীর দারস থেকে সংগৃহীত ও সংকলিত।

১. ফাযলুল বারী ফি ফিকহিল বুখারী। এটি সংকলন করেছেন কাশ্মিরী রাহিমাহুল্লাহ এর শাগরেদ মাওলানা আবদুর রাউফ হাজারওয়ী রাহিমাহুল্লাহ। তিনি আল্লামা কাশ্মিরীর নিকট সহীহ আল-বুখারী সর্বমোট তিনবার পড়েছেন। এটি ৪ খণ্ডে প্রকাশিত। সবকটি খণ্ড মিলিয়ে পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।

২. আস সায়হুল জারি ইলা জান্নাতিল বুখারী। এটি সংকলন করেছেন কাশ্মিরী রাহিমাহুল্লাহর শাগরেদ মাওলানা আবদুল হালিম ইবনে আমির বখশ মুলতানী রাহিমাহুল্লাহ। এটি ৩ খণ্ডে প্রকাশিত। সবকটি খণ্ড মিলিয়ে পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রায় একহাজার।

কিতাব দুটো হাতে পৌঁছার পর শায়খ ড. মুহি উদ্দিন আওয়ামাহ হাফিযাহুল্লাহকে অবগত করলাম। তাঁকে জানালাম, অধমের আল ফাওয়াইদুল মুনতাকাহ (দারুল ফাতহ, জর্ডান থেকে প্রকাশিত) গ্রন্থটি মূলত ফায়যুল বারী থেকে চয়নকৃত। এখন ইনশাআল্লাহ এই দুটো সংকলন থেকেও নতুন তথ্য সংযোজন করা যাবে। তিনি তা জেনে আনন্দ প্রকাশ করলেন। বললেন, আপনার উচিত হবে এই তিনটি সংকলনের মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা যে, কাশ্মিরী রাহিমাহুল্লাহর এই তিন শাগরেদের মধ্যে কে যথাযথভাবে তাঁর আলোচনাগুলো উপস্থাপন করেছেন। প্রত্যুত্তরে আমি বললাম, এটিও পৃথক একটি প্রসঙ্গ। কাজটি করতে পারলে অনেক উপকারী সাব্যস্ত হবে ইনশাআল্লাহ।

আপাতত দৃষ্টিতে আমার মনে হয়েছে, নতুন এই দুই আরবি সংকলনের বর্ণনাভঙ্গি কিছুটা দুর্বোধ্য এবং ক্ষেত্রবিশেষ অতি সংক্ষিপ্ত। ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই কিতাব দুটো পুরোপুরিভাবে পড়বো এবং অধমের আরবি কিতাব আল-ফাওয়াইদুল মুনতাকার পরবর্তী সংস্করণের জন্য তথ্য সংগ্রহ করবো।

তিন.رسائل الأعلام إلى العلامة أبي الحسن علي الندوي

আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবি রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে তো নতুনভাবে কিছু বলার নেই। তাঁর কর্মতৎপরতা ছিলো বিশ্বব্যাপী। তৎকালীন জগদ্বিখ্যাত মনীষীদের সঙ্গে তাঁর ছিলো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তাঁদের সঙ্গে যেমন সাক্ষাত হতো নিয়মিত, তেমনি চিঠিপত্রে মতবিনিময় হতো সমান্তরালে।

তাঁর প্রতি লেখা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞানী ও সম্মানিত ব্যক্তিদের বেশ কয়েকটি চিঠি একত্রিত করে এই বই সাজানো হয়েছে। এতে যেসব ব্যক্তিবর্গের চিঠি স্থান পেয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হলেন, আল্লামা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, শায়খ আলী তানতাবি, সাইয়েদ কুতুব শহিদ, ড. আহমদ আমীন, শায়খ ইউসুফ কারযাবি, শায়খ মুসতাফা সিবায়ী, বাদশাহ ফায়সাল প্রমুখ।

আল্লামা আবুল হাসান আলী নদবী রাহিমাহুল্লাহ এর জীবদ্দশায় ১৪০৪ সালে শায়খ মুহাম্মদ রাবি’ হাসানি নদবী হাফিযাহুল্লাহ এই সংকলনটি প্রস্তুত ও প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত গবেষক সাইয়েদ আবদুল মাজিদ গাওরি এই সংকলনের ওপর কিছুটা কাজ করেন। বিশেষত যেসব মনীষীর চিঠি এতে উল্লিখিত হয়েছে; তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তিনি যোগ করে দিয়েছেন। বৈরুতের দারু ইবনি কাসির থেকে ২২৪ পৃষ্ঠার বর্ধিত ও পরিমার্জিত এই সংস্করণটি ছাপা হয় ১৪২৫/২০০৪ সালে।

চার.مقدمات العلامة أبي الحسن علي الندوي

আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবি রাহিমাহুল্লাহ। ইলমি দুনিয়ায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিলো শীর্ষে। কী আরব! কী অনারব! সব জায়গায় তাঁর মূল্যায়ন ছিলো।

সেজন্য লেখক ও গবেষকগণ নিজেদের নতুন বইয়ের জন্য তাঁর দুটো কথা লিখিয়ে নিতে চাইতেন। এক্ষেত্রে শুধু তাঁর অনুজরাই নয়, বরং অনেক অগ্রজ মনীষীও তাঁর তাকরিয বা অভিমত দিয়ে নিজেদের বইয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছেন। শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়্যা, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহিমাহুল্লাহর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া পূর্ববর্তী সময়ের মনীষীদের যেসব গ্রন্থ নতুনভাবে তাঁর সময়ে তাহকিক করে ছাপানো হতো; সেরকম অনেক গ্রন্থের শুরুতেও তাঁর ভূমিকা শুভা পেয়েছে।

নদবি রাহিমাহুল্লাহর এইসব ভূমিকা, অভিমত ও অভিব্যক্তি একত্রিত করে সাইয়েদ আহমদ যাকারিয়া আল-গাওরী একটি সংকলন প্রস্তুত করেছেন। ৩ খণ্ডে প্রায় ১৩ শত পৃষ্ঠার এই সংকলনটি বৈরুতের দারু ইবনি কাসির থেকে ১৪৩১/২০১০ সালে প্রকাশিত হয়।

উল্লেখ্য যে, যদিও এগুলো বিভিন্ন বইয়ের শুরুতে নদবি রাহিমাহুল্লাহ লিখিত ভূমিকা বা অভিমত, কিন্তু কোনো কোনো মুকাদ্দিমা স্বয়ং একটি গ্রন্থের মর্যাদা রাখে। দুর্লভ তথ্য, অভিনব বিন্যাস এবং তাঁর স্বচ্ছ চিন্তা এসবের মান বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং সুযোগ থাকলে বইটি সংগ্রহ করা উচিত।

পাঁচ.مواهب الرحمن في أصول التفسير وعلوم القرآن

শায়খুল হাদীস আল্লামা হাফিয মাহমুদ হোসাইন সাহেব হাফিযাহুল্লাহ সিলেটের ক্ষণজন্মা এক জ্ঞানতাপস। হযরতের নিকট সরাসরি পড়ার সুযোগ অধমের না হলেও আমাদের একাধিক শিক্ষক তাঁর সুযোগ্য শাগরেদ। তাছাড়া হযরতের দারসে বসা না হলেও তাঁর রচিত অনেকগুলো দারসি বা একাডেমিক বই এবং সহযোগী ব্যাখ্যাগ্রন্থ পাঠের সুযোগ হয়েছে। একজীবন তিনি আমাদের আঙ্‌গুরা মাদরাসায় হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম শহরের একটি মাদরাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে কর্মরত আছেন। ইলমের ময়দানে তাঁর পাহাড়সম যোগ্যতা থাকার পরও তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। কোনোরকম প্রচার বা খ্যাতির তাঁর সামান্যত মোহ নেই। ইলমের সঙ্গে তাঁর বিনয় ও মহান আখলাক আমাদের জন্য আদর্শ ও অনুকরণীয়।

সিলেটের আযাদ দীনী ইদারা বোর্ডের একাধিক পাঠ্যপুস্তক তাঁর প্রস্তুত করা। আরবি, বাংলা ও উর্দু তিন ভাষায়ই তিনি সমান পারদর্শী। মুখতাসারুল মাআনি এর ভূমিকার একটি চমৎকার উর্দু শারহ লিখেছেন। শারহু ইবনি আকিল এরও একটি উর্দু ব্যাখ্যাগ্রন্থ রয়েছে তাঁর।

মাওয়াহিবুর রাহমান হযরত কর্তৃক সংকলিত একটি অনবদ্য আরবি গ্রন্থ। তাফসীর এর মূলনীতি এবং কুরআন এর জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে রচিত এ গ্রন্থটি আমাদের সকলের সংগ্রহ করা উচিত। এপর্যন্ত গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড বের হয়েছে। বাকিগুলোও সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ। এটি সংকলনে তাঁর সুযোগ্য ছেলে হাফিয মাওলানা আবদুল্লাহ আল ফাহিম ভাইও সহযোগিতা করেছেন বলে বই থেকে জানলাম। অধমকে এই কপিটি হাদিয়া দিয়েছেন শিক্ষানুরাগী একজন দীনি ভাই, খালেদ আহমদ।

সিলেটের দারুল হিকমাহ বইটি প্রকাশ করেছে। এর সত্ত্‌বাধিকারী, প্রখ্যাত আলেম, মাওলানা আবদুল মুকিত জালালাবাদি সাহেব আজকাল বেশ অসুস্থ। তাঁর আশু সুস্থতার জন্য আমরা দোয়া করছি।

ছয়. হারিরী সম্পর্কে কুরতুবীর মন্তব্য

প্রাচীন আরবি সাহিত্যের জগদ্বিখ্যাত একটি অনবদ্য গ্রন্থ হলো মাকামাতে হারিরি। আরব দেশের সাহিত্য অঙ্গনে এখনও এর কমবেশি চর্চা রয়েছে। তাছাড়া কওমি মাদরাসার সিলেবাসে এখনো সেটা পাঠ্যবই হিসেবে সমাদৃত।

গত রমজানে সূরা আল-কাহফের তাফসীর করতে গিয়ে একাধিক তাফসীরগ্রন্থ গভীর মনোযোগে অধ্যয়ন করতে হয়েছিলো। এর মধ্যে হাদীস ও তাফসীর বিশারদ আল্লামা কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহর আল-জামি লি আহকামিল কুরআন’ বা তাফসীরে কুরতুবী ছিলো অন্যতম। নবী মুসা আলাইহিস সালাম এবং পুণ্যবান বান্দা খিজির এর মধ্যকার কথাবার্তা এবং তাঁর পুরো শিক্ষা সফরের যে ইতিবৃত্ত কুরআনে এসেছে, এর ব্যাখ্যার এক পর্যায়ে আল্লামা কুরতুবী (মৃ. ৬৭১ হি.) সাহিত্যিক হারিরি (মৃ. ৫১৬ হি.)-এর প্রসঙ্গ টেনেছেন।

আল্লামা কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তায়ালা হারিরিকে ক্ষমা করুন! নবী মুসা আলাইহিস সালাম এবং খিজির যে একটি গ্রামে গিয়ে তাদের জন্য খাবার বন্দোবস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন; সে বিষয়ক আয়াতের ক্ষেত্রে হারিরি তাচ্ছিল্য ও বিকৃতমস্তিষ্কের পরিচয় দিয়েছেন। এতে তিনি বোকামি ও নিরর্থক কথার আশ্রয় নিয়েছেন। নিজে বিভ্রান্ত হয়েছেন। এই আয়াত থেকে তিনি প্রমাণ পেশ করতে চেয়েছেন যে, অনুনয়বিনয় করে কোনো কিছু চাওয়া এবং বারবার চাওয়া দোষের কিছু নয়! ব্যক্তির জন্য এটা লজ্জাজনক বা মানহানিকরও নয়। হারিরী কবিতার শ্লোকে বলেন, ‘তোমাকে যদি (খালি হাতে) ফিরিয়ে দেওয়া হয় তবে এতে কোনো লজ্জা নেই; কেননা ইতোপূর্বে মুসা ও খিজিরকেও ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

কুরতুবী বলেন, এটা দীন নিয়ে তামাশা এবং তা নবীগণের মর্যাদা পরিপন্থী। আল্লাহ তায়ালা সালাফে সালিহিনের ওপর রহম করুন; তাঁরা বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন প্রত্যেকটি মানুষকে এই ওসিয়ত করে গেছেন যে, তুমি আর যা কিছু নিয়ে বিদ্রূপ কর, ধর্ম নিয়ে বিদ্রূপ করা থেকে দূরে থাক। (তাফসীরে কুরতুবী, ১৩/৩৩৬)

লেখক: আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ