ঈমানের দাবি ও প্রকৃত রাসূলপ্রেম
মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন
ভালবাসার দাবি হলো, যাকে ভালবাসি বলে দাবি করা হয় তার পক্ষে থাকা। সেই দাবির পক্ষে দলিল বা প্রমাণ থাকাও প্রয়োজন। নইলে সেই দাবি দুর্বল হয়ে যায় এবং দুর্বল হতে হতে একসময় দাফনের উপযোগী হয়ে যায়। সেই প্রমাণ কেবল মৌখিক হলেই হবে না, বাস্তবেও তার প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যায় পিতার প্রতি পুত্রের ভালবাসার দাবির প্রসঙ্গটি। যেমন কোনো এক পুত্র বললো যে, সে তার পিতাকে খুব ভালবাসে। এই যে পিতাকে ভালবাসে বললো পুত্র, সেটা কি কেবল তথ্য, কিংবা কতটুকু সত্য? বলার সাথে বাস্তবের কোনো ব্যবধান বা বিরোধ আছে কিনা? কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো যে, সেই ভালবাসার দাবি বাস্তব নয়, বলার মধ্যেই বৃত্তাবদ্ধ। আর সেজন্যই সেই ভালবাসা মৌখিক বলেই মেকি! অর্থাৎ পুত্র শুধু মুখেই বলে যে, সে তার পিতাকে ভালবাসে, কিন্তু পিতার আদেশ-নিষেধ একটিও মেনে চলে না। এককথায় সেই ভালবাসা শুধুই জবানে, জীবনে নয়। পুত্রের এহেন দাবিকে কেউ কি ভালবাসা বলবে, নাকি তামাশা বলবে? পিতাও কি পুত্রের এহেন ভালবাসায় (!) বিগলিত বা বিমুগ্ধ হয়ে যাবেন? যদি তা না হন, তাহলে সারা সৃষ্টি জগতের জন্য যিনি রহমত, যিনি পরম প্রভুর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে পা রেখেছেন প্রেম পরিবেশনের জন্য, তাঁর ব্যাপারে কেন বিপরীতটা চিন্তায় আসবে? বিশেষ করে যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করে তাদের মনে। মুসলমান হওয়ার শর্ত তো স্বয়ং মহান মাবুদ এই বলে বাতলে দিয়েছেন যে, কারো আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ বা পূরণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাঁর প্রিয় হাবিবকে (সা.) পরিপূর্ণভাবে ভালবাসবে। অর্থাৎ রাসূল (সা.)-কে ভালবাসলে আল্লাহকে ভালবাসার শর্ত পূরণ হবে, নইলে নয়। রাসূলে করিমও (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন তথা পৃথিবীতে প্রিয় বলতে যা কিছু আছে, সবকিছু অপেক্ষা সবচেয়ে তাঁকে বেশি ভালবাসবেনা, তার সেই ভালবাসার দাবি কখনো পূর্ণ হবে না। কিন্তু আমরা সেই ভালবাসার দাবি কতটুকু পালন করি? তাছাড়া তাঁকে তো আদম সন্তানদের জন্য আদর্শ হিসেবেও পাঠানো হয়েছে। আদর্শ কি? আদর্শ হলো তাই, যা অনুকরণযোগ্য ও অনুসরণযোগ্য। এই যে একদিকে ভালবাসার দাবি, অপরদিকে অনুকরণযোগ্য একমাত্র আদর্শ এগুলো যদি পালন বা বাস্তবায়ন না করি, তাহলে আমাদের মুসলমানিত্বের দাবি কি মিথ্যে হয়ে যায় না?
কিছু মুসলমান নামধারী তো এমন আছে, যাদের রাসূলপ্রেম রবিউল আউয়াল মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ, আওলাদে রাসূলপ্রেম মহরম মাসে মাতমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এতে কারো লাভ হোক বা না হোক, একশ্রেণির মৌ-লোভীর পেট ও পকেট ভরে ও ভারি হয়ে যায়। কবি নজরুল তাঁর কবিতায় এদেরকে ‘খোদার খাসি’ বলে ব্যঙ্গ করেছেন। এদের গুরুত্ব গরুর গোস্ত পর্যন্ত, এদের ত্যাগ বার্থরুম পর্যন্ত, এদের ভালবাসা সেই পেট ও পকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু প্রকৃত রাসূল প্রেমের বা প্রমাণের প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ যখন আসে, যেমন কেউ রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করলো, তার প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিবাদ না করলে ঈমানের বা ভালবাসার দাবি ভূয়া বলে প্রমাণিত হবে, তখন সেই মৌসুমি মওলানাদেরকে বাটি চালা দিয়েও পাওয়া যায় না। এটা কি রাসূলপ্রেম, নাকি প্রেমের নামে প্রহসন বা প্রতারণা? এ প্রসঙ্গে নজরুলের একটি কবিতার কতেক পঙ্ক্তি উদ্ধৃতির উপযোগীতা রাখে। কবি লিখেছেন,
ইসলামে তুমি দিয়ে কবর
মুসলিম বলে কর ফখর!
মুনাফেক তুমি সেরা বে-দীন!
ইসলামে যারা করে জবেহ,
তুমি তাহাদেরি হও তাবে।
তুমি জুতো-বওয়া তারি অধীন!
আমরা জানি রাসূলপ্রেম ছাড়া ঈমানের দাবি কখনো পূরণ হবে না। সাহাবায়ে কেরামরা তো প্রতিযোগিতায় লেগে যেতেন কে কার চেয়ে বেশি ভালবাসেন নবীজি (সা.)-কে। নবীজি (সা.)-এর জন্য নিজেদের জান-মাল কোরবানি দিতে সদা প্রস্তুত থাকতেন তাঁরা। সেই ভালবাসায় কোনো কপটতা বা কৃপণতা ছিলো না। যুদ্ধের ময়দানে হোক, কিংবা যেখানে হোক, নবীজি (সা.)-এর জানের ওপর কোন হুমকি এসেছে, তাঁরা জান দিয়ে সেই হুমকির মোকাবেলা করেছেন, কোনো কাফের কবি সরদারে কায়েনাতের (সা.) বিরুদ্ধে কটূক্তি করে কবিতা লিখেছে, সাহাবা কবি যারা ছিলেন, তারা তার জবাবে এমন কবিতা লিখেছেন, যার প্রতিটি শব্দ শর হয়ে শত্রুর শীর ও শরীরে তীব্রভাবে আঘাত হেনেছে। অর্থাৎ কি শারীরিক আক্রমণ, কি শব্দের আক্রমণ, উভয় ক্ষেত্রে তাঁরা নবীজি (সা.)-এর নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চে স্থান দিয়েছেন। এককথায় নবীজি’র (সা.) নিরাপত্তার ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন নির্ভীক ও নিরাপোষ।
কিন্তু হাল জামানার মৌসুমি ও মতলববাজ মওলানাদের নবী (সা.)-প্রেম মাঠে নয়, শুধু মুখে। এরা নামায, রোজা তথা ইসলামের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ইত্যাদি নিয়ে ওয়াজ করেননা, যা করেন তা ওয়াজ নয়, আওয়াজ। হয় প্রতিপক্ষকে গালাগালি, নয় তো কিচ্ছা বা কাউয়ালি! শরীয়তের কথা তারা ভুলেও বলেননা, কিন্তু মারেফাত বলতে বলতে মুখে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন! বলেন কিনা কলব ঠিক থাকলে নাকি সবকিছুই ঠিক! কিছু অজ্ঞ, অন্ধ ও অলস লোক আছে, যারা এদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে এবং ভালবাসে। অনুসরণ করার ও ভালবাসার কারণও আছে। কারণ আর কিছু নয়, না পড়ে, পরীক্ষা না দিয়ে, পাশের এমন পরামর্শ বা সহজ তরিকা আর কে বাতলাবে! হাক্কানি হুযুর যারা, তারা তো নামাযের কথা, রোযার কথা বলেন। কত কষ্ট নামায পড়া, রোযা রাখা! তার সাথে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ মেনে চলার শর্ত তো আছেই। এসব বাদ দিয়ে মারেফাত মারেফাত বলে মূর্খের মতো মুখর হওয়ার চেয়ে সহজ বা শর্টকাট তরিকা আর কি আছে? অথচ শরীয়ত হচ্ছে শীর। শীরকে বাদ দিয়ে শরীরকে, শরীর ভেতর আত্মাকে যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি শরীয়ত ছাড়াও ইসলামকে কল্পনা করা যায় না। শরীয়তের উৎস হযরত মুহাম্মদ (সা.)। সেই উৎসকে উপেক্ষা করে কেউ যদি উদ্দেশ্য করে ওপরঅলাকে পাওয়ার, সেই উদ্দেশ্য সফল তো হবেই না, বরং সে নিজের জন্য নরককে নিশ্চিত করে নেবে।
কিছু বুদ্ধিজীবী আছে, যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় প্রদান করলেও কাজেকর্মে উল্টোটাকেই উৎসাহিত করে। মুসলিম পরিচয়টা রাখে দোযখের ভয়ে নয়, বেহেশত লাভের লোভে। যদি বেহেশত থেকে থাকে, বিশ্বাস না করলে তো বঞ্চিত হতে হবে তা থেকে এ ধরণের একটা সন্দেহের বাতিকে সারাক্ষণ ভোগে তারা। অর্থাৎ দুনিয়াও ছাড়বে না, আবার বেহেশতের লালসাও লালন করবে। মোনাফেকি আর কাকে বলে! তারা আবার নিজেদেরকে খুব বেশি চালাক মনে করে। তারা চালাক বটে, কিন্তু কাউয়া-চালাক বলে যে একটি কথা চালু আছে সেরকম। কাক কোনো কিছু লুকাবার আগে চোখ বন্ধ করে লুকায়, মনে করে কেউ দেখছে না। কিন্তু বাস্তবে সবাই দেখে। কথায়ও তো আছে, অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকে না। আর কাকের কারবারও ময়লা নিয়ে এবং খেতেও খায় ময়লা। এই বুদ্ধিজীবিদের অবস্থাও তথৈবচ! মুসলিম পরিচয়কে ছাড়েতেও চায় না, আবার সেই পরিচয়ের পক্ষে কথা বলতে, কলম ধরতেও চায় না। প্রগতিশীলতার ভান ধরে আল্লাহকে বলে ঈশ্বর, প্রকৃতি ইত্যাদি। নবীজি (সা.)-এর নাম নিতে তাদের শরম লাগে! এই মোনাফেকদের বলি, যদি শরমই লাগে, মুসলমান পরিচয়টা পরিত্যাগ করলেই তো হয়! কারণ নবীজি (সা.)ই তো ইসলাম, ইসলামই তো নবীজি (সা.)। মঞ্জিলে মকসদে পৌঁছার পথ একটাই, সেটা হলো নবীজি (সা.)-এর প্রদর্শিত পথ সিরাতিম মুস্তাকিম। তাঁকে বাদ দিয়ে যে পথ, সেই পথ ভ্রান্তির, চির অশান্তির। সেই পথ চির অভিশপ্ত শয়তানের। কিছু কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবি আছে, দুনিয়ার সবকিছুর ব্যাপারে দারাজ দিল হলেও নবীজি (সা.)-এর প্রসঙ্গ বা কথা এলে তাদের মুখে যেন কেউ কুলুপ এঁটেছে এমন অবস্থা হয় এবং তাদের কলম আশ্চর্যজনকভাবে কৃপণ হয়ে যায়। এই ধরুন মাঝে মাঝে কিছু কুলাঙ্গার নবীজি (সা.)-কে কটূক্তি করে যখন কিছু লেখে, এবং তার প্রতিবাদে সারা দেশ ওঠে জেগে, তখন এই মুসলিম পরিচয়ধারী বুদ্ধিজীবীরা থাকেন নরম নীরব। যেন কিছুই হয়নি, কিছুই জানেন না তারা ভাজা মাছটি উল্টিয়ে খেতেও যেন জানেননা। নবীজি’র পক্ষে প্রতিবাদ করা দূরে থাক, টু শব্দটিও করেন না। কিন্তু রুশদী বা তসলিমা’র প্রসঙ্গ এলে তখন তাদের মুখে খই ফোটে! তারা একেকজন হয়ে যান মহাপণ্ডিত। এদের কাজকর্ম দেখে এদেরকে বাদুড়-বুদ্ধিজীবী বলাই বেহতর। বাদুড়কে দেখবেন, দিনের আলোকে তারা দুশমন ভাবে, রাতের আঁধারেই তাদের যত আনন্দ; গাছের ডালে যখন ঝুঁলে থাকে, তখন পা থাকে ওপর দিকে, আর মাথা থাকে নীচের দিকে; সবচেয়ে অবাক হওয়ার কথা, যেটাই মুখ তার, সেটাই আবার মলধার। এসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মুখ ও মলধার অভিন্ন, এরা আলোতে মুখ লুকায়, অন্ধকারে লাফায়।
কি মতলববাজ মৌসুমি মওলানা, কি মুসলমান পরিচয়ধারী বাদুড়-বুদ্ধিজীবী, বলছি শোনো, যে তুমি আজ আল্লাহ ও তাঁর হাবিবের (সা.) পক্ষাবলম্বন করতে পিছপা হচ্ছো, আল্লাহ ও তাঁর হাবিব (সা.)-এর কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ও কলম ধরতে কৃপণতার পরিচয় দিচ্ছ, সেই তুমি কীভাবে আখেরাতের কঠিন কষ্টের দিনে আল্লাহর অনুগ্রহ এবং রাসূলের (সা.) শাফায়াত আশা কর? মনে রেখ, তোমার এই লজ্জা সেদিন তোমাকে মহা লজ্জায় ফেলবে, তোমার এই কৃপণতা ও কপটতা সেদিন তোমার জন্য কঠিন কষ্ট ও দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যে তুমি আজ নবীজি’র (সা.) পক্ষে কথা বলতে পিছপা হচ্ছো, সেই তোমাকে শাফায়াত তো দূরের কথা, উম্মত হিসেবে তোমার পরিচয় দিতে নবীজি (সা.)ও লজ্জাবোধ করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অপমানকে যে মনে করেনা নিজের অপমান, সে কিসের মুসলমান? কবি নজরুল তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন,
রাসূলের অপমানে যদি
না কাঁদে তোর মন,
মুসলমান না মুনাফিক তুই
রাসূলের দুশমন।
সবশেষে বলি, রাসূলুল্লাহ (সা.) হলেন সারা সৃষ্টি জগতের জন্য সূর্যস্বরূপ| অন্ধকার যতই করুক সূর্যের বদনাম, সূর্য ঠিকই ছড়াবে আলোর পয়গাম, রওশন হবে তার নাম, অন্ধকার হবে নাকাম। আর রাসূল (সা.) তো নিজেই বলেছেন তিনি আয়না। আয়না কি? আয়না হলো তাই, তার সামনে যে বস্তু, ব্যক্তি বা প্রাণী থাকবে, তার চেহারা বা অবয়ব অবিকল সেই আয়নায় প্রতিফলিত বা প্রতিবিম্বিত হবে। সামনে হরিণ থাকলে হরিণের চেহারা তাতে দেখা যাবে, হায়েনা থাকলে হায়েনার চেহারা দেখা যাবে, বাঘ থাকলে বাঘের চেহারা, বানর থাকলে বানরের চেহারা দেখা যাবে। তদ্রূপ রাসূলুল্লাহ (সা.) হলেন এমন এক পবিত্র ও পরিস্কার আয়না বা দর্পন, যার চিন্তা চরিত্র ও চেহারা যেমন, সেখানে হবে ঠিক তারি তেমন প্রতিফলন। যে ঈমানের দৃষ্টি দিয়ে সেই দর্পনে দৃষ্টি দেবে, সে তারি প্রতিফলন সেখানে প্রত্যক্ষ করবে; যে নিজে শয়তান, সে তার শয়তানি রূপেরই প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করবে। কেউ যদি তাতে, শয়তানকে দেখে, তাতে দর্পনের কি দোষ? দোষ তো তার, দর্পনে প্রতিফলন হয় শয়তানি রূপ যার।