জামেয়া ওয়েবসাইট

শুক্রবার-২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছাত্ররাজনীতি কলেজ-ভার্সিটির মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাস্তান ও খুনি বানাচ্ছে!

ছাত্ররাজনীতি কলেজ-ভার্সিটির মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাস্তান ও খুনি বানাচ্ছে!

ছাত্ররাজনীতি কলেজ-ভার্সিটির মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাস্তান খুনি বানাচ্ছে!

ড. খালিদ হোসেন

 

অবশেষে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির বলি হয়ে অকালে নিভে গেল আরেকটি তাজা প্রাণ। তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ প্রতিপক্ষের কর্মিদের বেদম ও নৃশংস পিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন। ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে তাঁকে মেরে ফেলা হল ফ্যাসিবাদী কায়দায়। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা লোপ পেয়ে আদিমযুগের উপজাতীয় বর্বরতা মাথাচাড়া উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে র‌্যাগিং ও টর্চার সেল স্থাপন এবং ক্যাম্পাসে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ না থাকা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সুষ্ঠুধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ভিসি, প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটরদের ইচ্ছাকৃত নীরবতা দেশের সচেতন মানুষদের ক্ষুদ্ধ করে তুলেছে। তাঁরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি রুলস ব্যবহার করতেন এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। উপাচার্য তাঁরই প্রতিষ্ঠানের নিহত ছাত্রের লাশ দেখতে আসেননি, জানাযায় শরীক হননি; এমনকি আবরারের বাবাকে সান্ত্বনা দিতে তিনি বাসা থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। হতে পারে দলীয় আনুগত্যের কারণে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই সিদ্ধান্তে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘তিনি কেমন ভিসি?’ জিঘাংসার রাজনীতি আরো কতজনের প্রাণ কেড়ে নেয় কে জানে? এক বুক আশা নিয়ে মা-বাবারা তাঁদের সন্তানদের বুয়েটের মত মর্যাদাবান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই ফ্রিজিং ভ্যানে করে নিয়ে আসা প্রিয় সন্তানের লাশ কবরস্থ করতে হয়। এই বেদনা প্রকাশের ভাষা নেই; এই দুঃখ রাখার জায়গা নেই।

শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে থেকে দীক্ষা পান না, দীক্ষা পান অজানা রাজনৈতিক নিউক্লিয়াস থেকে। নির্মমতার সাথে সম্পৃক্ত যেসব বুয়েটশিক্ষার্থী পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন হয়তো তাঁদের বিচার হবে, হয়তো হবে না; যেমন অতীতে হয়নি। যদি বিচার হয় তাহলে আরো কিছু মেধাবী ছাত্র শিক্ষাজীবন শেষ করার আগেই অকালে ঝরে গেল। মাটি হয়ে গেল তাদের ও তাদের পরিবারের স্বপ্নসাধ| ক্রিমিনাল হিসেবে তাদের পরিচিতি ঘটবে। ঘাতক ও নিহত সবাই কিন্তু আমাদের সন্তান। এই অসুস্থ সংস্কৃতির অবশ্য পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিপক্ষের হাতে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন। যেসব দলীয় নেতৃবৃন্দ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন, তাঁরা এইসব হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারেন না। হত্যাকাণ্ডের বিচার অবশ্য হতে হবে। তবে কেবল বিচার যথেষ্ট নয়। আগামীতে যাতে হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যবস্থা নেয়া সর্বাধিক প্রয়োজন। এইগুলো উপসর্গ মাত্র, রোগের চিকিৎসা জরুরি। রোগ কিন্তু ক্রণিক।

সহযোগী একটি জাতীয় দৈনিক সূত্রে জানা যায় যে, বুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মি সন্দেহে নিয়মিত মারধর করা হয়। শিবির কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ নয়। আবরার ফাহাদকেও শিবির সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে। অথচ আবরারের পরিবার সরকার সমর্থক। একই চক্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধ করেছে। ডাকসু এটা করতে পারে না, এটা তাদের ইক্তিয়ার বহির্ভূত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী রাজনীতির চর্চা চলতে পারে না, এটা কেবল দুঃখজনক নয়, লজ্জাজনকও বটে। নবাব সলিমুল্লাহ প্রদত্ত জমির ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে আছে ১৯২১ সাল থেকে। মোট ৬০০ একর জমির মধ্যে নবাব সলিমুল্লাহর জমির পরিমাণ অনেক। তিনি ধর্মপরায়ণ মুসলিম ছিলেন। উপমহাদেশের স্বীকৃত বুযুর্গ হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) তাঁর দাওয়াতে একবার উত্তর ভারত থেকে ঢাকা আসেন। তাঁর হাতেই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ১৯০৫ সালে ঢাকায়। এই অঞ্চলের অনগ্রসর মুসলমানদের উচ্চতর শিক্ষা প্রদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দের অবদান অনস্বীকার্য। ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, ঢাকা মাদরাসার (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, নওয়াব সিরাজুল ইসলামসহ অনেকের অবদান অনস্বীকার্য| ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এ বিলে সম্মতি দেন। এ আইনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। এ আইনের বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। ধর্মীয় ব্যক্তিদের হাতে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা রীতিমত অন্যায় ও অন্যায্য পদক্ষেপ। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত কোন রাজনৈতিক দলবিশেষের সমর্থিত কোন ইসলামী ছাত্রসংগঠন কাজ করতে পারবে না এমন সিদ্ধান্ত দেশের প্রচলিত আইন ও নির্বাচন কমিশনের বিধির সাথে সাংঘর্ষিক। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বৃত্ত ভাঙতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানগবেষণার কেন্দ্র থাকবে না।

ছাত্ররাজনীতি আমাদের জন্য আদৌ প্রাসঙ্গিক কিনা এটা তর্ক সাপেক্ষ। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, ভবিষ্যতের জাতীয় নেতা তৈরির জন্য ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সহজেই ওই চিন্তার অপ্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করা সম্ভব। পৃথিবীর বহু প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ ছাত্রজীবনে রাজনীতির সাথে বিযুক্ত ছিলেন না। আমাদের দেশের বহু রাজনীতিবিদের ছাত্ররাজনীতির ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচি, ৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ৭১ এর মুক্তি সংগ্রাম, ৯০ এর এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনেএ দেশের ছাত্রসমাজের উজ্জ্বল অবদান রয়েছে। তবে তাঁদের অতীতের সে আদর্শবাদী ছাত্ররাজনীতির আদর্শবোধ ও ঐতিহ্য এখন আর অবশিষ্ট নেই। ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা অবশ্য থাকবে কিন্তু ছাত্ররাজনীতির কলুষ আবর্ত থেকে নিজকে বেরিয়ে আসতে হবে। ছাত্ররাজনীতি এক সময় ছিল শ্রদ্ধা ও সম্মানের প্রতীক, এখন তা হয়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও তদবির বাণিজ্যের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে এটা এখন অপ্রয়োজনীয়, নিন্দনীয় ও গর্হিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভি’র মতো মেধাবী ছাত্রদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে ক্রিমিনাল বানিয়েছেন আমাদের দেশের রাজনীতিকগণ। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের সংঘর্ষে নিহত হন ২৯জন। আর এ সময়ে তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্য সংগঠনের ১৫জন। জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো নির্মাণের বাজেট থেকে ছাত্রনেতাগণ যে বিপুল পরিমাণ চাঁদা নিয়েছে তা টক অব দি কান্ট্রি। কম বেশি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই চিত্র।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ২০০৮ সালের ৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ পুণর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে যে কথা বলেছিলেন তা যদি গভীর বিবেচনায় নিয়ে এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম, তা হলে ক্যাম্পাসে আর রক্ত ঝরতো না। তিনি বলেন, ‘লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন আছে কিনা তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। দেশের এই দুর্গতির জন্য লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি অনেকটা দায়ী। একজন ছাত্র যখন প্রতিমন্ত্রী হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে দেশের কোথাও না কোথাও বিপর্যয় হয়েছে। স্বাধীনতার আগে মেধাবীরা ছাত্র রাজনীতি করেছে। তাদের আন্দোলনের ফসল আমাদের স্বাধীনতা| কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির সে পুরনো ঐতিহ্য এখন নেই।’

আমাদের বড় বড় রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় স্বার্থে ও ক্ষমতার মোহে ছাত্রদের রাজনীতিতে ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। ফলে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত; লজ্জাজনক সেশনজট লেগেই আছে; যে কোন মুহূর্তে আপন সন্তান লাশ হয়ে ঘরে ফেরার অজানা আশংকায় অভিভাবকরা প্রহর গুণেন। কত মেধাবী ছাত্র অকালে ঝরে পড়েছে তার হিসাব রাখে কে? ছাত্ররাজনীতি আমাদের যা দিয়েছে, নিয়েছে তার শতগুণ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার মেধাবী ছাত্র আবু বকরের লাশ পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০১০ সালে। মৃত্যুর পর তার পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। বেঁচে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা সরকারী উচ্চপদস্থ অফিসার হতে পারতেন তিনি। পরবর্তীতে আদালতের রায়ে এই মামলার ১০ আসামী বেকসুর খালাস পান। এটার যদি বিচার হতো, খুনিদের সাজা হতো তাহলে হয়তো বুয়েটের আবরারের মৃত্যু হতো না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত ১০ বছরে ৮জন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪জন খুন হয়েছেন। আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি এবং খুনির সাজা হয়নি। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বাদ দিলেও কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতিতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৬৪জন ছাত্র। ক্যাম্পাসে সংগঠিত এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য এখন পর্যন্ত কেউ শাস্তি পায়নি। একমাত্র ১৯৭৪ সালে সংগঠিত চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের পর একটি মাত্র মামলার বিচার এবং রায় পাওয়া গেছে। কিন্তু পরে খুনিদের সেই শাস্তিও বাতিল হয়ে গেছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ও হতাহতের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করে। আইন অনুযায়ী মামলাও দায়ের করা হয়। কিছু অভিযুক্তকে আটকও করা হয়। তবে মামলাগুলো বিচারের মুখ দেখে না।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কোন না কোন ছাত্র সংগঠনের দখলে। ভর্তিবাণিজ্য, সিট দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস এখন লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্য। ছাত্র নেতারা একাডেমিক স্বার্থের পরিবর্তে জাতীয় রাজনৈতিক দলের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী। ক্যাম্পাসে অস্ত্র হাতে ‘যুদ্ধ করার’ ছবি দেশ বিদেশের মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল আরেক দলের সঙ্গে অথবা একই দলের দু’গ্রুপর মধ্যে যেভাবে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয় এবং যেভাবে প্রকাশ্যে হকিস্টিক, ক্রিকেট ষ্ট্যাম্প, দা, চাইনিজ কুড়াল, কাটা রাইফেল, চাপাতি নিয়ে প্রতিপক্ষের উপর হামলে পড়ে, সে দৃশ্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করে। চিহ্নিত ক্রিমিনালদের লালন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ প্রতিপক্ষের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বেশি সংখ্যায় ক্রিমিনালদের সংগঠনে রাখতেই হবে। নিরীহ ছাত্রদের ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন উন্নত দেশেতো নেই, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও নেই। কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস ও সি. পি. এম এর মত দলের নেতারা ছাত্রদের রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহারকে রীতিমত পাপ ও গর্হিত কাজ মনে করেন।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ পৃথিবীর বহু দেশে কোন সেশনজট নেই। নির্দিষ্ট সময়ে সেমিস্টার শেষ করা বাধ্যতামুলক। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁদের ছেলে মেয়েদের বিদেশী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান যাতে দুলাল-দুলালীরা নিরাপদে থাকতে পারে। হত দরিদ্র, প্রান্তিক কৃষক ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা দলীয় রাজনীতির বলি, কারণ তাদের পক্ষে বিদেশে গিয়ে পড়া লেখা করা সম্ভব নয়। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জ্ঞান চর্চা ও গবেষণার নিরবচ্ছিন্ন কেন্দ্র। মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতেন ও যোগ দেওয়ার সুযোগ পেতেন। এ ঐতিহ্য এখন আর নেই। এখন সব ধরণের নিয়োগ হয় দলীয় বিবেচনায়। ডীন, ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রভোস্ট নিয়োগে শিক্ষকদের ভোটের প্রভাব আছে। তাই শিক্ষক নিয়োগের চাইতে ভোটার নিয়োগের প্রয়াস প্রাধান্য পায়। দল নিরপেক্ষ অথবা প্রতিপক্ষ দলের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র-ছাত্রীকে ফার্স্ট ক্লাস না দিয়ে নিজের দলের ক্যান্ডিডেটকে ফার্স্ট ক্লাস দেওয়ার নজীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুরি ভুরি। এভাবে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরাই দলীয় ছত্রছায়ার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে দেয়া যায় না। এ কলংকজনক প্র্যাকটিস বন্ধ করতে হবে। সরকার বা বিরোধীদল ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার উদ্যোগ নেবেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে কারণ তাদেরকে দলীয় স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যবহার করতে হবে। ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি হচ্ছে তাঁদের কাছে ছাত্ররাজনীতি।

আমাদের সবার মনে রাখা দরকার যে, দেশের ছাত্র-জনগোষ্ঠী আমাদের সন্তান, ভাই ও আপনজন। তাদের জীবন নিয়ে আমরা ছিনিমিনি খেলতে পারি না। মানবজীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময় ছাত্রজীবন।জ্ঞানার্জনের নিরবচ্ছিন্ন সাধনা ছাড়া ছাত্রজীবন অর্থহীন। অর্জিত জ্ঞানের আলো নিয়েই তাকে সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখতে হবে। একজন ছাত্র ভবিষ্যত জীবনে কি ধরনের ব্যক্তি রূপে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তার প্রস্তুতির উপর। আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলার সাধনা চলে ছাত্রজীবনে। অধ্যয়ন ও নিয়মানুবর্তিতা ছাত্রজীবনের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। রীতিমত অধ্যয়ন, সৎগুণাবলি অর্জন ও কর্তব্যনিষ্ঠা ছাড়া মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না। তাই আমাদের উচিৎ ছাত্রদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে নেয়া এবং অধ্যয়নে মনোযোগী করা। ছাত্ররাজনীতির নামে এই ঔদ্ধত্য, দুর্বৃত্তপনা ও খুনাখুনি বন্ধ করতে হবে। এই ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে|

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এম.ই.এস ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম

 

PDF ফাইল…

[button link=”http://at.jamiahislamiahpatiya.com/wp-content/uploads/2019/11/November19.pdf”]ডাউনলোড করতে এখানে টাচ বা ক্লিক করুন[/button]

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ