জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভারতবর্ষে সংস্কৃতিতে আগ্রাসনের কথা

ভারতবর্ষে সংস্কৃতিতে আগ্রাসনের কথা

ভারতবর্ষে সংস্কৃতিতে আগ্রাসনের কথা

কাজী সিকান্দার

 

ভারতবর্ষের পরিচয়। ভারতবর্ষ হলো এশিয়া মহাদেশের মধ্যদক্ষিণে অবস্থিত। পৃথিবীর বৃহত্তম উপমহাদেশ। ভারতবের্ষর উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বে হলো হিমালয় পর্বত। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। পূর্বে মায়ানমার। পশ্চিমে ইরান ও আরব সাগর। বর্তমানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, ভুটান, নেপাল সহ বিস্তৃত এ এলাকাকে ভারতবর্ষ বলা হতো। ভারত শব্দ ঐতিহাসিকগণের মতে ‘ভরত’ একজন হিন্দু রাজা ছিল তার নামানুসারে ভারত। সিন্ধ, শব্দটি ফরাসি সাহিত্যে ‘হিন্দ’ ও সিন্ধ’ হিসেবে উল্লেখ হয়েছে তাই তাকে হিন্দও বলে। আর এ দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বেশি হওয়াতে তাকে মুসলমানরা হিন্দুস্থান বলে। গ্রিকরা যখন আক্রমণ করেণ তখন তারা প্রথম সিন্ধের সাথে পরিচিত হয় তারা তাকে ‘ইন্ডাস’ বলতো তা থেকে ভারতবর্ষকে ‘ইন্ডিয়া’ বলা হয়। এ ছিল ভারতবর্ষের স্থান ও নামকরণ করার ইতি কথা।

এ ভারত উপমহাদেশে অষ্টম শতাব্দীর পূর্বেই মুসলমানদের আগমন ঘটে। হযরত ওমর (রাযি.)-এর আমলে ভারত উপকুলে প্রথম অভিযান চালানো হয়। এরপর হযরত ওসমান (রাযি.)-এর যুগে আবদুল্লাহ বিন উমরের নেতৃত্বে দ্বিতীয় অভিযান চালান। এরপর হযরত আলী (রাযি.) ৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে আবার অভিযান পরিচালিত হয় এবং হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর আমল ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দেও অভিযান চালান। তবে উপর্যুক্ত অভিযানগুলো সফল হয়নি। আরবগণ ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও এ অঞ্চলে তারা ব্যবসা করতে আসতো। আর যখন ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের ভেতর নতুন এক ঐশ্বরিক শক্তি সঞ্চার হলো তখনো তারা বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করতে আসতো এবং তাদের নতুন সত্য সুন্দর ধর্মকে প্রচারের লক্ষ্যে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ভ্রমণ করতেন। যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হতো। যেখানে মাজলুমের হাহাকারে আকাশ বাতাস ভারি হতো।

যেখানে জালেম জুলুমের সীমা অতিক্রম করে ফেলতো সেখানে, সে জায়গায় বা সেই দেশে মুক্তির বার্তাবাহক বা স্বাধীকার ধারক বাহক হয়ে পৌঁছতো আরবগণ। সৃষ্টিকর্তা মনোনিত মানবগণ। ভারতবর্ষ ছিল প্রতিমা পুঁজার এক দেশ। ইসলাম আসার পূর্বে এ দেশে তিনটি ধর্ম প্রাধান্য পায়। বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম ও জৈনধর্ম। বৌদ্ধধর্ম যা গৌতম বুদ্ধ, যে বিহারের বৌদ্ধগায়ায় মোক্ষলাভ করে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করে। যা মৌর্য সম্রাট মহামতি আশোকের সময় ভারতবর্ষে বিস্তৃত হয়। যাদের মূল মন্ত্র হল, ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে আত্মশুদ্ধি অর্জন। জীবে দয়া ও পূণর্জন্ম।

জৈনধর্ম

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতকে মহাবীর নামক এক ক্ষত্রীয় সন্ন্যাসী জৈনধর্ম প্রবর্ত করে। এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মের বিদ্রোহ হিসেবে প্রতিষ্ঠা হয়। এটি বিহারেই সীমাবদ্ধছিল। তাদের মূলমন্ত্র অনেকটাই বৌদ্ধ ধর্মের আদলে তবে কিছু পার্থক্য আছে। হিন্দুধর্ম ছিল ভারতবর্ষে প্রভাবশালী। বিভিন্ন রাজা দীর্ঘদিন ধরে অতিবাহিত হয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। এদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো অনেক দেব দেবীর পুজো করা। এদের মধ্যে মানুষে মানুষে ছিল বিস্তর ফারাক। কোন গোত্র অন্য গোত্রকে মানুষই মনে করতো না। কারো শরীরের সাথে অন্য নিম্নমানের বংশের কারো শরীর টাচ বা লাগলে উঁচু বংশের লোকটি গোসল করতো। কারো ঘরে অন্য কেউ গেলে তা ধুয়ে ফেলতো। এ সংস্কৃতিগুলো হিন্দুদের কাছে এখনো কিছু কিছু রয়েছে। জাতিভেদ প্রথার নির্মম যাতাকলে নিষ্পেষিত ছিল তারা। একই ধর্মাবলম্বী বৈশ্য ও শূদ্ররা ছিল নিচু জাতের। সমাজে তাদের কোন অধিকারই ছিল না। তারা ধর্মীয় গ্রন্থও পড়ার অধিকার পেতো না।

তবে অষ্টম শতাব্দীর পূর্বে আরব বণিকগণ ভারতবর্ষে যখন আসে এবং তাদের কৃষ্টি কালচার দেখে তখন দলে দলে ভারতের হিন্দু সহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীগণ মুসলমান হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে মুসলিম বাড়তে লাগলো। ক্রমান্বয়ে মুসলিম রাজা ও সেনাপ্রধানগণ এসে রাজত্ব নিল। হাজ্জাজ ইবেনে ইউসুফের জামাতা মুহাম্মদ ইবনে কাসেম (৭১১ খ্রি.) সিন্ধু জয় করেন। তিনি রাজা দাহিরকে পরাজিত করেন। যে সময় রাজা দাহির তার জনগণের ওপর জুলুম নিষ্ঠুর আচরণ করতো। এর ফলে জাঠ ও মেড সম্প্রদায় মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে স্বাগত জানায়। এরপর মুহাম্মদ খলজি আসেন। ১৫২৬ খ্রি. আগমণ ঘটে মোগলদের। চলতে থাকে মুসলিম শাসন।

ভারতবর্ষে ৭১১ থেকে ১০১০ সাল পর্যন্ত আরবগণ ছিলেন। এরপর ১০১০ থেকে ১১৮৬ পর্যন্ত গজনীর শাসন। ১১৭৫ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঘুরী বংশ শাসন করে। এরপর ১২০৬ থেকে ১৫২৬ পর্যন্ত ভারতবর্ষে মুসলিম সালতানাত যুগ ছিল। আর ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত মুসলিম মুগল শাসন ছিল। এ দীর্ঘ এগার শত বছর ধরে ভারতবর্ষে মুসলিমরা শাসন করেছে। এ সময়ে জাগায় জাগায় গড়ে উঠে ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতি চর্চার বিভিন্ন কেন্দ্র। মসজিদ, মাদরাসা, খানকা, মুসাফির খানা, এগুলোর সাথে গড়ে উঠে উচ্চমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হতো। কুরআন-হাদীসের চর্চা হতো। মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতের আধ্যাত্মিকতার শক্তিতে শক্তিমান হতো।

এরপর বিপরীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও তাদের মন্দির ভিত্তিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা করছে।

মুসলমানদের সমতাভিত্তিক সুন্দর সংস্কৃতি দেখে লক্ষ লক্ষ হিন্দু বা অন্য জাতী মুসলিম হতে লাগলো। যে ধর্মে সবাই সমান। সে কালো বা ধলা হোক, সে নিচু বংশের বা উঁচু বংশের। সে ধনী বা গরিব সবাই একই কাতারে এক সাথে মসজিদে নামায আদায় করছে। যা হিন্দুসমাজে ছিল বিরল বা দূর্লভ। তাদের মন্দিরে সবাই প্রবেশ করার অধিকার ছিলে না। তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ সবাই পাঠ করার অধিকার ছিলো না। এ ভারতবর্ষে মুসলিম হিন্দু ও অন্যান্য জাতি মিলে বসবাস করছে। কোন জাতি কোন দিন তাদের পরদেশি বা সাম্রাজ্যবাদী বা আগ্রাসনকারী হিসেবে দেখা হচ্ছে না। এমন সময় এরপর ভারতবর্ষে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নামের ইংরেজদের বণিকদল। ইংরেজরা ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে আসে আর ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে আসে উক্ত বণিক দল ভাসকো ডি গামার মাধ্যমে। তারা সম্রাট জাহাঙ্গীর থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করতে লাগলো। কিন্তু পরবর্তীতে বাদশাহ শাহ জাফর তাদেরকে অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেন। ফলে ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে ছোট ছোট কয়েকটি এলাকায় ইংরেজরা রাজত্ব করে। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের মহীশুর প্রদেশের গভর্ণর হয়ে যায়। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের চারটি প্রদেশের গভর্ণর হয় ইংরেজ। ১৮৫৭ সালে তারা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমাতায় আসে। এবং ভারতকে কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্রিটিশ রাজ্যের আওতাধীন করা হয় ১৮৫৭ সালে।

১৮৫৭ সালে ভারতকে কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্রিটিশ রাজ্যের আওতাধীন করা হয়। ১৮৫৭ সালে আলেমরা আযাদী আন্দোলন করে। মুসলিম আলেমসমাজ এ আন্দোলনকে ব্যাপক করার নিমিত্বে সকল শ্রেণির লোককে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে। তবে এ সকল শ্রেণি সম্পৃক্ততার মধ্যে সিপাহীদের অংশগ্রহণ উল্লেখ হারে বেশি হয়েছে। তাই পরবর্তীতে এ আজাদী আন্দোলনকে সিফাহী বিপ্লবও বলা হয়। মূলত এ আন্দোলনের পরই ব্রিটিশরা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ রেখা ভেঙে দিয়ে ব্রিটিশ রাজ্যের আওতাধীন করে ভারতকে।

এরপর শুরু হয় সংস্কৃতি ধ্বংসের নীল নকশা। এতদিন তারা মুসলিমদের মাদরাসা, মকতব ও মসজিদ ধ্বংস করেছে। লক্ষ লক্ষ আলেমকে শহীদ করেছে। যখনি মাদরাসা, মসজিদ ও ছোট বড় আনেক আলেম শেষ তখন তারা মুসলিমের ত্রাণকর্তা হিসেবে আভির্ভূত হয়। আঘাত করে তারা ক্ষত সৃষ্টি করলো এবার সাধুবেশে মলম লাগানোর ছলে লবন ছিটানো শুরু করলো। মুসলমানের সংস্কৃতি শেখার মাধ্যম ছিল মাদরাসা, মকতব ও মসজিদ। তারা এ প্রতিষ্ঠানগুলোর যে জমি, অর্থ ছিল সব সরকারে নিয়ে নিলো। অর্থাভাবে ও আলেম শূন্যতার কারণে মুসলিমদের শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচার প্রচার ও প্রসারের প্রতিষ্ঠান শেষ দিকে।

এ সুযোগ ইংরেজরা ভালোভাবে গ্রহণ করলো। তারা মুসলমানদের দরদী হয়ে ইসলামের তাহযীব তামাদ্দুন ধ্বংস করার জন্য কিছু কাজ হাতে নিল।

১৮২৬ সালে সর্বত্র ইংরেজি মাধ্যম বাধ্যতামূলক করা। ১৮৩৭ সালে দেওয়ানী ও ফৌজদারিতে যে ফারসির প্রচলন ছিল তা বাতিল করা। তার স্থলে স্থানীয় ভাষা ও ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা। ১৮২৯ সালে আলিয়া মাদরাসায় ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট বিভাগ চালু করা। ১৮৪৯ সালে আলিয়া মাদরাসায় এ্যাংলো এরাবিক, ক্লাশ চালু করা। এ্যাংলো ফারসিয়ান বিভাগ ১৮৫৪ সালে স্থায়ী ভাবে পত্তন করা। ১৮২১ সালে পরীক্ষার ধরন পরিবর্তন করা।

চার্লস মি. গ্রান্ট ১৭৯৩ সালে পরিকল্পনা করে যে, ভারতে তাদের ধর্ম বিস্তার করবে। তাই সে তাদের শিক্ষানীতি ভারতে বাস্তবায়ন করার জন্য সুপারিশ করে। মূলত তখন ইংল্যান্ডের শিক্ষা ছিল ধর্ম সংক্রান্ত। যারা শিক্ষাগ্রহণ করতো তাদের উদ্দেশ্যও ছিল ধর্ম। ১৭৯৩ সালে মি. গ্রান্ট যে আবেদন করে তা গৃহীত হয়নি। পরবর্তীতে মি. গ্রান্ট ১৭৯৪ তে তিনি কোম্পানির ডিরেক্টর হয় আর ১৮০২ সালে সে বিলাতের পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়। ১৮১৩ সালে এসে তার উত্থাপিত শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হয়। এর ফলে ইংল্যান্ড থেকে পাদরিদের আসার দ্বার খুলে এবং তার এসে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে, আর তাদের খরচ বহন করে সরকার। তাদের সকল চেষ্টা বাস্তবে রূপ নেয় ১৮৩১ থেকে ১৮৫৩ সালে। ১৮৫৩ সালে পার্লামেন্টের সাব-কমিটিতে প্রদত্ত বিবরণে তা স্পষ্ট হয়।

‘এ অবস্থায় এদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রদানের অর্থ দাঁড়াবে তাদের মানসিকতা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেওয়া। যে সব নবীন যুবক আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে পূর্বেকার ধারা অনুযায়ী তারা প্রচলিত নিয়মে স্বাধীনতা লাভের চেষ্টার কথা ভুলে যাবে। অর্থাৎ স্বশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তারা তখন দেশের সকল পর্যায়কে পাশ্চাত্য রঙ্গে রঙিন করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে।’

এ শিক্ষার প্রসার হলে ক্রমান্বয়ে তারা আমাদেরকে জবরদস্তি শাসনকারী হিসেবে আর মনে করবে না। বরং তারা আমাদেরকে বন্ধু ও পৃষ্ঠাপোষক হিসেবে জ্ঞান করবে।

এদের সমন্বয়ে বর্তমানে একটি ছোট দলের সৃষ্টি হয়েছে। তারা আমাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে চলে। এরা দেশের স্বাধীনতার পুনরুত্থানের জন্য আমাদের সাহায্য চাইবে।

১৮৩৫ সালে ২৮ শে জুন স্যার লার্লস ট্রি ভলেন দ্বিতীয় বার কমিটির নিকট আরেকটি বিবরণ পেশ করে।

যদিও ধর্মীয় নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সরকারি কলেজেসমূহের পাঠ্য তালিকায় বাইবেলের অন্তর্ভুক্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারের প্রশ্নে এক্ষেত্রে একটি অহেতুক বাধার সূত্রপাত করা হয়েছে বলে আমরা তার প্রতিবাদ করবো। কিন্তু আমার মতে এ অভিযোগ অমূলক এবং সম্পূর্ণ অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। কেননা বিভিন্ন কলেজের জন্য ইংরেজি বইয়ের লাইব্রেরির পত্তন করা হয়, প্রত্যেক লাইব্রেরিতে পত্তন করা হয়, প্রত্যেক লাইব্রেরিতে বাইবেলের কপি রাখা হয়েছে। এখন তো আমি এখবরও শুনেছি যে, লোকেরা বাইবেলের ব্যাখ্যা পুস্তুকও অনুসন্ধান করছে। এখন লাইব্রেরিতে তার ব্যাখ্যা পুস্তকও রাখতে হবে।

আমি যেমন পূর্বে বলেছি বাইবেল যদিও পাঠ্য হিসেবে পড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু সরকারি কলেজসমূহে ইংরেজি সাহিত্য তো পড়ানো হয়। যথা মিল্টন, বেকন, এডিসন ও জনসন প্রমুখের কাব্য ইত্যাদি। এদের সকল পুস্তকেই বাইবেলের শিক্ষার সমাহার রয়েছে। এবং এসব ছাত্রদেরকে বোঝাতে হলে বার বার বাইবেলের উদ্ধৃতি এবং বাইবেলের শিক্ষা সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে হবে। ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখে বোঝা যাবে খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে তাদের জানাশোনা কতটুকু অগ্রসর হয়েছে।

আমার মতে যেসব স্কুলে উপযুক্ত শিক্ষার বন্দোবস্ত রয়েছে সেগুলিতে প্রচুর আর্থিক সাহায্য করা। আমার উদ্দেশ্য এটি নয় যে, এমন দিন, কোন দিন আসবে না যখন সরকারি কলেজসমূহেও খ্রিস্টধর্ম শিক্ষা চালু করা যাবে। আমার মতে এমন উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যে দিকে লোকেরা আকৃষ্ট হবে।

ভারতের একটি অংশ যখন শিক্ষিত হবে। আমাদের উচিত হবে খ্রিস্টধর্মের শিক্ষা চালু করা। কিন্তু আমাদেরকে এ ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যাতে সৈন্যবাহিনীর মাঝে কোন রকম অসন্তোষ না জাগে।

কলিকাতা থেকে বিদায় গ্রহণের পূর্বে আমি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকারী এদেশীয় উচ্চ শিক্ষিত এবং বিশেষ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরি করেছিলাম। এসব ব্যক্তি হিন্দু কলেজে পড়াশুনা করতো। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের মূলে এদের প্রচুর সাধনা এবং সহযোগিতা রয়েছে। এদেরকে কিভাবে খ্রিস্টান করতে হবে লোকেরা তার কোন ফন্দি জানে না।

আমার তো বিশ্বাস, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যেমন সকলেই গোত্রবন্দি হয়ে খ্রিস্টান হয়েছে। এখানকার লোকেরাও দলে দলে খ্রিস্টান হতে বাধ্য। এ দেশে পরোক্ষভাবে পাদরিদের দ্বারা এবং প্রত্যক্ষভাবে বই-পুস্তুক, পত্র-পত্রিকা এবং ইংরেজদের সাথে আলাপ-আলোচনা ও মেলামেশার দ্বারা খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তিত হতে পারে।’ (হিস্টোরি অব ইংলিশ অ্যাডোকেশন ইন ইন্ডিয়া, পৃ. ৬৭-৬৯)

১৮৩০ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বরে বোর্ড অব ডাইরেক্টরের পক্ষ থেকে জেনারেলের নামে একটি চিঠি আসে। তাতে লেখা হয়, ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য সদা সচেষ্ট থাকতে হবে। যাতে আগামীতে যখনই অফিস আদালতে ফারসির স্থলে ইংরেজি প্রবর্তন করা হবে, তখন ইংরেজি শিক্ষিত লোকদের কোন অভাব যেন না হয়। এরপর ইংরেজি গ্রন্থাবলি উরদু, বাংলা এবং ফারসিতে অনুবাদ শুরু হলো।

১৮৩৪ সালে লর্ড ম্যাকালে ভারতের সুপ্রীম কাউন্সিলের সদস্য হয়। তাকে বড় লাট শিক্ষা কাউন্সিলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এ মহাদেশের পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে মর্যাদা দেওয়া হয়। (হিস্টোরি অব ইংলিশ অ্যাডোকেশন ইন ইন্ডিয়া, পৃ. ৫০)

১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে এ লর্ড ম্যাকালের একটি স্মৃতি কথা প্রকাশিত হয়, তাতে সে লিখে যে, আমরা এমন সব পুস্তকাদি ছাপাই (বোর্ড কর্তৃপক্ষ) তার মূল্য যেমন কম তেমনি কাজও অত্যন্ত বাজে আর আমরা কৃত্রিম ও মিথ্যা অনুপ্রেরণা, মিথ্যা ইতিহাস, অবান্তর বিজ্ঞান, অকেজো দর্শন এবং ভ্রষ্ট মতবাদের শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করেছি। (Education in India under E. I. Company-Basu, p. 80)

ইংরেজরা এ শিক্ষায় শিক্ষিতদেরকে বিভিন্ন চাকরী দিতে লাগলো। হিন্দুরা তাদের এ প্রলোভন সাধরে গ্রহণ করলো। সাথে কিছু মুসলিমরাও গ্রহণ করলো। ইসলামি পণ্ডিতগণ প্রথমে এবং শেষেও ইংরেজদের বিরোধিতা করেছে। তাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকতে বার বার বলেছে। ঐ সময় উচ্চাভিলাষী মুসলিমরা এ কথাগুলো কানে নেয়নি। ফলে সেই ফল আজ জাতি ভোগ করছে। হাড়ে হাড়ে মাসুল দিতে হচ্ছে এখন জাতিকে। ইসলামি সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে মুসলিমরা।

এ এক শিক্ষা ব্যবস্থা যা শুধুই জাগতিক বস্তুবাদী শিক্ষা। যাদের সামনে শুধু দুনিয়ার ভোগ বিলাসিতা ও বড় অঙ্কের টাকার বান্ডিল থাকে। তাদের সকল উপমা ও মোহ দেখানো হয় কিভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করা যায়। ইংরেজি ভাষা শিখ কথা বলা শিখ তবে তুমি লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারবে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হও তবে তুমি লক্ষ টাকার সেলারি পাবে। সুদ খাও তবে তোমার টাকা বৃদ্ধি পাবে। ঘুষ গ্রহণ কর এটি তোমার উপহারস্বরূপ তবে তোমার টাকার অঙ্ক বাড়বে। এ লজিকই তাদের লক্ষ্য মাত্রা। আর এটি ইংরেজদের যুগে তা বাস্তবায়ন করেছে ও হিন্দু এবং দুনিয়া লোভী বা উচ্চাভিলাষী কিছু মুসলিম তাদের মন্ত্র গ্রহণ করেছে।

এ শিক্ষার মাধ্যমে ইংরেজরা তাদের সংস্কৃতি পুরা ভারতবর্ষে বিস্তার ঘটায়। এভাবে তারা ইসলামি সংস্কৃতি ধ্বংসের পায়তারা করে এবং কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়।

ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ ইংরেজরাই সৃষ্টি করেছে। এ মতবাদের মাধ্যমেই আজকে বলা হচ্ছে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ মূলত এটি কোন মুসলিম গ্রহণ করতে পারে না। ইংরেজরা ইসলামি আমলের মধ্যে আলিয়া মাদরাসার মাধ্যমে বেদাত সৃষ্টি করেছে। আর বাহ্যিকভাবে স্কুল, কলেজের শিক্ষার মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে আচার অনুষ্ঠান, চলন-বলন, পোষাক-পরিচ্ছদের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন করেছে। এখন পুরো মুসলিম জগত সংস্কৃতি আগ্রাসনের কবলে নিপতিত।

তাদের সেই কার্যক্রমে আজ আমাদের দেশে নাস্তিকতার চর্চা হচ্ছে, ধর্মান্তর হওয়ার ঘটনা ঘটছে। কৃষ্টি কালচার মুসলিম হয়েও খ্রিস্টানদের কৃষ্টি কালচার লালন পালন করছে। অপর এক গোষ্ঠী ধর্মের নামে সকল বিদআতী কুফুরী কাজ করে যাচ্ছে।

এ থেকে মুসলিম মিল্লাত মুক্তি পেতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার অমূল পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষাধারা পরিবর্তন করতে হবে। সকল প্রতিষ্ঠানকে ইসলামি শিক্ষায় রূপান্তর করতে হবে। আর সকল কারিগরী বিজ্ঞান শিক্ষা এর মাধ্যমেই করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এভাবে আমরা মুক্তি পেতে পারি।

লেখক: পরিচালক, মারকাযুদ দীন আল-ইসলামি ঢাকা, আশরাফবাদ, ঢাকা-১২১১

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ