হাদীসশাস্ত্রে সাহিবে হিদায়া ইমাম বুরহান উদ্দীন আল-মারগীনানী (রহ.)
মাহফুয আহমদ
শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহর ভাষায় হিদায়া হচ্ছে, দারসে নিযামীর সারাংশ এবং দীনী ইলমসমূহের বুনিয়াদ।’ হিদায়াগ্রন্থের লেখক হলেন ষষ্ঠ শতাব্দী হিজরীর শ্রেষ্ঠ হানাফী ফকীহ, শায়খুল ইসলাম বুরহান উদ্দীন আলী ইবনে আবু বকর আল-মারগীনানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৫৯৩ হি.)। তাফসীর, হাদীস, ফিকহসহ দীনী ইলমের প্রত্যেক বিষয়ে তিনি ছিলেন পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। তাঁর সমসাময়িক আলেমগণ এ ব্যাপারে স্পষ্ট মন্তব্য করে গেছেন। তাঁর ভূয়সী প্রশংসাকরেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো ভাইকে ‘সাহেবে হিদায়া ইমাম মারগীনানী মুহাদ্দিস ছিলেন না, তিনি হাদীস জানতেন না!’ বলে মন্তব্য করতে শোনা যাচ্ছে। আর এই সূত্র ধরে হিদায়াগ্রন্থে উল্লেখকৃত হাদীসসমূহের ব্যাপারেও তারা অযথা সন্দেহ সৃষ্টি করার প্রয়াস চালাচ্ছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, সাহেবে হিদায়া ইমাম মারগীনানী (রহ.) নিয়মিত হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং তিনি উঁচুমাপের একজন হাদীসবিশারদ ও হাফিযুল হাদীস ছিলেন। এখানে প্রবন্ধের এ সীমিত পরিসরে হাদীসশাস্ত্রে ইমাম মারগীনানী (রহ.)- এর মান ও মাকাম সম্পর্কে বিজ্ঞ আলেমগণের কিছু মন্তব্য ও বক্তব্য পেশা করা হলো।
আল্লামা মুরতাযা আয-যাবীদী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ১২০৫ হি.) লিখেন,
وسَمِعَ الْـحدِيْثَ، ورَحَلَ وجَمَعَ لِنَفْسِهِ مشْيَخَةً.
‘মারগীনানী হাদীস শ্রবণ করেছেন। হাদীস শিক্ষার জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় সফর করেছেন এবং নিজের জন্য মাশয়াখা সংকলন করেছেন।’[1]
লেখক যে সকল শায়খের সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছেন, যাদের নিকট থেকে হাদীস অর্জন করেছেন অথবা যারা তাকে ইজাযাত প্রদান করেছেন তাঁদের আলোচনা সংবলিত গ্রন্থকে পরিভাষায় ‘মাশয়াখা’ বলা হয়।[2]
আল্লামা মাহমুদ ইবনে সুলাইমান আল-কাফাওয়ী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৯৯০ হি.) বলেন,
كان إمامًا، فقيهًا، حافظًا، محدثًا، مفسرًا.
‘মারগীনানী হাদীস শিক্ষার জন্য সফর করেছেন, হাদীস শিখেছেন, মাশায়েখের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছেন এবং নিজের জন্য মাশয়াখা সংকলন করেছেন।’[3]
আল্লামা আবদুল হাই লাখনোবী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ১৩০৪ হি.) বলেন,
كان إمامًا، فقيهًا، حافظًا، محدثًا.
‘মারগীনানী একজন ইমাম, ফকীহ, হাফিযুল হাদীস, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির ছিলেন।’[4]
প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা খায়রুদ্দীন আর-যিরিকলী লিখেন,
كان حافظا مفسرًا محققًا أديبًا من المجتهدين.
‘মারগীনানী ছিলেন মুজতাহিদদের মাঝে একজন হাফিযুল হাদীস, মুফাসসির, তাত্ত্বিক গবেষক ও সাহিত্যিক।’[5]
বিখ্যাত জীবনীকার ওমর রিযা কাহহালা লিখেন,
المرغيناني الحنفي فقيه، فرضي، محدث، حافظ، مفسر، مشارك في أنواع من العلوم.
‘মারগিনানানী একজন ফকীহ, মুহাদ্দিস, হাফিযুল হাদীস, মুফাসসির, এক কথায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় অংশীদার একজন মহাজ্ঞানী।’[6]
উপর্যুক্ত সবকয়টি উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, সাহেবে হিদায়া ইমাম মারগিনানী (রহ.) শুধুমাত্র একজন ফকীহই ছিলেন তা নয়, বরং ফিকহ ছাড়াও হাদীস, তাফসীর ইত্যাদি বিষয়েও তিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। রিজালশাস্ত্রে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আল্লামা হাফিয শামসুদ্দিন আয-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৭৪৮ হি.) বলেন,
وَكَانَ مِنْ أَوْعِيَةِ العِلْمِ r.
‘তিনি তো জ্ঞানে পরিপূর্ণ এক আধার।’[7]
আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ১৩৯৪ হি.) বলেন,
ويدل على كونه محدثا، حافظا للحديث كثرة ما أودعه في كتبه – لاسيما «الـهداية» – من الأحاديث، وقد اعتنى الحافظ الزيلعي بتخريجها في كتاب سـماه «نصب الراية في تخريج أحاديث الهداية»، ولـخصها الحافظ ابن حجر العسقلاني، فسماه «الدراية لأحاديث الـهداية»، وكل حديث قال فيه الـحافظان: «غريب، لـم نـجده» قد وجدت الكثيـر منه – ولله الـحمد – في كتاب «الـخراج» للإمام أبي يوسف، وفي كتاب «الآثار» له، وفي كتاب «الآثار» للإمام محمد بن الـحسن، وفي كتاب «الحجج» له رحمة الله عليهما.
‘সাহেবে হিদায়া যে মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস ছিলেন এর জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে তাঁর লিখিত গ্রন্থাদি। বিশেষত হিদায়া গ্রন্থে তো তিনি প্রচুর হাদীস বর্ণনা করেছেন‘। হাফিয জামালুদ্দিন যায়লায়ী (রহ.) হিদায়ার হাদীসগুলোর তাখরীজ করেছেন। তাঁর কিতাবের নাম রেখেছেন ‘নাসবুর রায়া ফী তাখরীজি আহাদীসিল হেদায়া‘। অতঃপর হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) নাসবুর রায়ার সারসংক্ষেপ লিখেছেন ‘আদ দিরায়া লি আহাদীসিল হিদায়া” নামক গ্রন্থ। যেসব হাদীসের ব্যাপারে ওই দুই মনীষী غريب কিংবা لـم نـجده বলে মন্তব্য করেছেন, আল-হামদু লিল্লাহ আমি নিজে এসমস্ত হাদীসের অধিকাংশেরই সন্ধান পেয়েছি। বস্তুত ইমাম আবু ইউসুফের কিতাবুল খারাজ ও কিতাবুল আসার এবং ইমাম মুহাম্মদের কিতাবুল আসার এবং কিতাবুল হুজাহ প্রভৃতি গ্রন্থে এসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে।’[8]
এখানে আল্লামা উসমানী (রহ.) এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু জোরদার আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে হিদায়া গ্রন্থে বিভিন্ন রাবী সম্পর্কে এবং অনেক হাদীসের মর্ম উদঘাটন করার ক্ষেত্রে ইমাম মারগীনানী (রহ.)-এর আলোচনা থেকে প্রতিভাত হয় যে, তিনি হাদীসের রিজাল ও তাসহীহ-তাখরীজ সম্পর্কে বিজ্ঞ একজন মুহাদ্দিস ছিলেন।
হাদীসশাস্ত্রে ইমাম মারগীনানী (রহ.)-এর অবস্থান এবং হিদায়া কিতাবে উদ্ধৃত হাদীসসমূহের মান ও মাকাম সম্পর্কে আল্লামা আবদুর রশীদ নুমানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ১৪২০ হি.) তাঁর বিভিন্ন লেখায় অত্যন্ত দালীলিক ও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, তাঁর কিছু কথা এখানে পেশ করা হলো। তিনি লিখেন,
‘ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর অনেক রচনা এখনো বিদ্যমান রয়েছে এবং এগুলোর মধ্যে থেকে বেশকিছু রচনা ছেপে প্রকাশিত হয়ে গেছে। যদিও তাঁদের রচনা অনেক; কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীরও অনেক ইমামের রচনা এখন একেবারেই দুস্প্রাপ্য। পরবর্তী ইমামগণের যে রচনাগুলোতে সেগুলোর সারসংক্ষেপ উদ্ধৃত হয়েছে তা আল-হামদু লিল্লাহ এখনও বিদ্যমান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ শামসুল আইম্মা সারাখসী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৪৯০হি.)-এর মাবসূত, মালিকুল ওলামা আল-কাশানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৫৮৭ হি.) বাদায়িউস সানায়ী এবং শায়খুল ইসলাম বুরহানুদ্দীন মারগীনানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৫৯৩ হি.)-এর হিদায়া এই তিনটি গ্রন্থ উল্লেখ করা যায়। কেননা এই তিন কিতাবে যে পরিমাণ হাদীস ও আসার উল্লেখিত হয়েছে তা মূলত পূর্ববর্তী হানাফী ইমামদের রচনাবলি থেকে গৃহীত। ওই ইমামগণের ওপর আস্থাশীল হয়ে তাঁরা এ হাদীস ও আসারের সনদ ও উদ্ধৃতি উল্লেখ করেননি।
হাফিয কাসিম ইবনে কুতলুবুগাহ (রহ.) মুনইয়াতুল আলমায়ী ফীমা ফাতা মিন তাখরীজিল হিদায়া লিয যায়লায়ীর ভূমিকায় লিখেন, ‘আমাদের পূর্ববর্তী ইমামগণ আল্লাহ তাঁদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। ফিকহী মাসায়েল এবং সেগুলোর দলীল হিসেবে হাদীসে নববী সনদসহ লিখাতেন। ইমাম মুহাম্মদের কিতাবুল আস ও কিতাবুস সিয়ারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তদ্রূপ ইমাম তাহাবী, খাসসাফ, আবু বকর আর-রাযী, কারখী প্রমুখের রীতিও তা-ই ছিলো। তবে মুখতাসারাত শ্রেণির রচনাবলি এর ব্যতিক্রম। পরবর্তী যুগের ব্যক্তিবর্গ পূর্ববর্তীদের রচনাবলির ওপর নির্ভর করে সেই হাদীসগুলো সনদ ও উদ্ধৃতি ছাড়াই নিজেদের রচনায় করেছেন। পরে মানুষ এই সংক্ষিপ্ত রচনাগুলোকেই গ্রহণ করেছে।’[9]
আমাদের ফকীহগণ পূর্ববর্তী ইমামদের প্রতি এরূপ আস্থাশীল ছিলেন যেমন ইমাম বাগাবী ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ সিহাহ সিত্তার প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। এবং যেভাবে ইমাম বাগাবী মাসাবিহুস্ সুন্নাহ গ্রন্থে এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় ওইসব কিতাবের হাদীস সনদ ও উদ্ধৃতি ছাড়া উল্লেখ করেছেন। তদ্রূপ হানাফি ফকীহগণও তাঁদের ইমামগণের বর্ণনাসমূহ নিজেদের রচনায় এভাবেই স্থান দিয়েছেন। পরে যখন তাতারীদের আক্রমণে মুসলিম জাহান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং আজমী অঞ্চলসমূহ থেকে আরম্ভ করে দারুল খিলাফা বাগদাদ পর্যন্ত মুসলিম জাহানের সকল ইলমি কেন্দ্র একে একে বরবাদ হলো তখন পূর্ববর্তীদের রচনাবলির এক বিরাট অংশ বিনষ্ট হয়ে যায়। অনেক গ্রন্থ যা ওই ফিতনার আগে একদম সহজলভ্য ছিল ফিতনার পরে তা একদম হারিয়ে গেল। এজন্যেই পরবর্তী হাফিযে হাদীসগণের মধ্যে যারা হিদায়া বা এধরনের গ্রন্থগুলোর হাদীসের তাখরীজের (সূত্র নির্দেশ) কাজ করেছেন তাদেরকে বিভিন্ন বর্ণনা সম্পর্কে বলতে হয়েছে যে, এই বর্ণনাটি হুবহু এই শব্দে আমরা, ‘পেলাম না।’ কেননা তাঁরা ওই হাদীসগুলো হানাফী ইমামগণের রচনায় তালাশ করার স্থলে পরবর্তী হাদীসবীদগণের ওইসব গ্রন্থে তালাশ করেছেন, যা তাঁদের যুগে প্রসিদ্ধ ও সহজলভ্য ছিল। এখান থেকে হিদায়া গ্রন্থকার সম্পর্কে কারো কারো এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, হাদীস বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি সঙ্কীর্ণ ছিল। তদ্রূপ এই হাদীসগুলো সম্পর্কেও এই ধারণা করেছেন যে, এগুলো বোধহয় দুর্বল হাদীস। অথচ ইলমে হাদীসের সঙ্গে সাহেবে হিদায়ার সম্পর্কও কম ছিল না এবং তিনি যে হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন তাও যয়ীফ নয়। সাহেবে হিদায়া নিজেও অনেক বড় মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস ছিলেন, আর তিনি যে হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন তা পূর্ববর্তী ইমামগণের গ্রন্থাবলি থেকেই গ্রহণ করেছেন। আমরা নিজেও কিছু হাদীসের ক্ষেত্রে দেখেছি যে, হাফিয যায়লায়ী ও হাফিয ইবনে হাজার আল-আসকালানী প্রমুখ হিদায়ার তাখরীজকারগণ স্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছেন যে, ‘হাদীসটি আমরা পাইনি।’ কিন্তু হাদীসগুলো কিতাবুল আসার ও মাবসূতে ইমাম মুহাম্মদ‘ ইত্যাদি গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে। শুধু হিদায়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন তা নয়, সহীহ আল-বুখারীর অনেক তা’লীক সম্পর্কে হাফিয ইবনে হাজার আল-আসকালানী অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। যার মূল কারণ হচ্ছে, ইমামগণের গ্রন্থাদি দুর্লভ হয়ে যাওয়া। অন্যথায় ইমাম বুখারী, সাহেবে হিদায়া প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে এই সন্দেহ করা বাতুলতা যে, তাঁরা কোনো ভিত্তিহীন বর্ণনা রেওয়ায়াত করবেন।’[10]
প্রখ্যাত আলিমে দীন, বিদগ্ধ মুহাদ্দিস, শায়খ জুনায়েদ বাবুনগরী হাফিযাহুল্লাহ তাঁর মুহতারাম পিতার কিতাব তানযীমুদ দিরায়া লি হাল্লি আসয়িলাতিল হিদায়া গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেন,
‘ইলমে হাদীসের সঙ্গে সাহেবে হিদায়ার সম্পর্ক কম ছিলো না,এবং তিনি নিজে অনেক বড় মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস ছিলেন। তিনি যে সকল হাদীস এই কিতাবে উল্লেখ করেছেন তাও যয়ীফ নয়। কেননা এসব হাদীস পূর্ববর্তী ইমামগণের কিতাবাদী থেকে গৃহীত। যদিও কোনো কোনো হাদীসের সনদের মধ্যে কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে, কিন্তু এই দুর্বলতা এ পরিমাণ নয় যে ওই হাদীস সর্বসম্মতিক্রমে দলীল প্রদানযোগ্য থাকবে না। আর এধরণের যয়ীফ হাদীস তো সিহাহ সিত্তাহর কোনো কোনো কিতাবেও বিদ্যমান রয়েছে। অন্যদিকে সাহেবে হিদায়া তাঁর কিতাবে হাদীসসমূহ সনদ ও উদ্ধৃতি ছাড়াই উল্লেখ করেছেন, বাহ্যত এর কারণ হচ্ছে যে, সংক্ষিপ্তকরণের প্রতি লক্ষ্য রেখেই তিনি এমনটি করেছেন। যেভাবে ইমাম বাগাবী ও অন্যান্য বহু মুহাদ্দিসগণ এই পন্থা অবলম্বন করেছেন।’
এরপর বাবুনগরী (আল্লাহ তাআলা সুস্থতার সঙ্গে তাঁকে দীর্ঘজীবী করুন) যফর আহমদ উসমানী ও নুমানী (রহ.)-এর আলোচনার সারাংশে উল্লেখ করেছেন।[11]
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস, প্রখ্যাত মুহাক্কিক আলিমেদীন, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক (দা. বা.) ও তাঁর আল-মাদখাল ইলা উলূমিল হাদীসিশ শারীফ (পৃ. ১০৩-১০৫) গ্রন্থে এ বিষয়ে আকাবিরদের কিছু কথা উল্লেখ করেছেন। তালিবুল ইলম ভাইয়েরা তাও দেখে নিতে পারেন।
আকাবিরের উপর্যুক্ত এসব কথা থেকে হাদীস শাস্ত্রে সাহেবে হিদায়া ইমাম মারগীনানী (রহ.) ও আহাদীসে হিদায়ার মান ও মাকান দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। এরপরে আর কোনো প্রশ্নই অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু আফসোসের বিষয় এই যে, আমাদের কোনো কোনো বন্ধু যখন হিদায়ার কোনো দলীলে কোনো ধরনের ত্রুটি বা দুর্বলতার সন্ধান পান তখন ‘সাহেবে হিদায়া মুহাদ্দিস ছিলেন না’ এ ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হোন না। বরং তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেও দ্বিধাবোধ করেন না যে, হানাফি মাযহাব দলিলের দিক দিয়ে খুব দুর্বল; একটি ভিত্তিহীন মাযহাব। এই মাযহাবের কাজই হলো সহীহ হাদীস ছেড়ে যয়ীফ হাদীস অবলম্বন করা’! নাউজুবিল্লাহ। ওই বন্ধুদের প্রথম ভুল সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তো এই প্রবন্ধে কিছুটা আলোচনা করা হলো।
দ্বিতীয় ভুল সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে এখানে আলোচনা করার সুযোগ নেই। অনুসন্ধিৎসু পাঠক এ বিষয়ে আরব বিশ্বের স্বনামধন্য হাদীস গবেষক শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহর গবেষণালব্ধ অনবদ্য গ্রন্থ আসারুল হাদীসিশ শারীফ (পৃ. ২০৮-২২২) অধ্যয়ন করতে পারেন। সাধারণ পাঠকদের জন্যে শায়খের ওই গবেষনাধর্মী পর্যালোচনার সারসংক্ষেপ আমি ‘হাদীস শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)’ (পৃ. ১৭৫-১৭৯) এ পেশ করেছি। আগ্রহী পাঠক তাও দেখতে পারেন।
[1] মুরতাযা আয-যুবাইদী, তাজুল ‘আরূস মিন জাওয়াহিরিল কামূস, দারুল ফিকর, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৪ হি. = ১৯৯৩ খ্রি.), খ. ১৮, পৃ. ২৪০
[2] মুহাম্মদ আল-কাত্তানী, আর-রিসালাতুল মুসতাতরাফা লি-বায়ানি মাশহূরি কুতুবিস সুন্নাতিল মুর্শারাফা, দারুল বাশায়ির, বয়রুত, লেবনান (ষষ্ঠ সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০০ খ্রি.), পৃ. ৪০
[3] মাওলানা আবদুর রশীদ নুমানী, ইমাম ইবনে মাজাহ আউর ইলমে হাদীস, মীর মুহাম্মদ কুতুবখানা, করাচি, পাকিস্তান, পৃ. ১৯৭
[4] মাওলানা আবদুল হাই লাখনাবী, আল-ফাওয়ায়িদুল বাহিয়া ফী তারাজীমিল হানাফিয়া, মাকতাবায়ে খায়র কসীর, করাচি, পাকিস্তান, পৃ. ১৪১
[5] আর-যিরিকালী, আল-আ’লাম, দারুল ইলম, বয়রুত, লেবনান (পঞ্চদশ সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০২ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ২৬৬
[6] ওমর রিযা কাহহালা, মু’জামুল মুআল্লিফীন, আল-মাতআবাতুল আমিরা, মকতাবাতুল মুসান্না ও দারু ইহইয়ায়িত তুরাস আল-আরাবী, বয়রুত, লেবনান (১৩১১ হি. = ১৮৯৩ খ্রি.), খ. ৭, পৃ. ৪৫
[7] আয-যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, মুআস্সাসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (তৃতীয় সংস্করণ: ১৪০৫ হি. = ১৯৮৫ খ্রি.), খ. ২১, পৃ. ২৩২
[8] যফর আহমদ আল-উসমানী, আল-ইমাম আবু হানীফা ওয়া আসহাবুহুল মুহাদ্দিসুন, ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলুমুল ইসলামিয়া, করাচি, পাকিস্তান (তৃতীয় সংস্করণ: ১৪১৪ হি. = ১৯৯৩ খ্রি.), পৃ. ২১১Ñ২২২
[9] ইবনে কুতলুবুগা, মুনইয়াতুল আলমায়ী ফি মা ফাতা মিন তাখরীজিল হিদায়া লিয যায়লায়ী, মাকতাবাতুল খানজী, কায়রো, মিসর (প্রথম সংস্করণ: ১৩৬৯ হি. = ১৯৫০ খ্রি.), পৃ. ৯
[10] (ক) মাওলানা আবদুর রশীদ নুমানী, ইমাম ইবনে মাজাহ আউর ইলমে হাদীস, মীর মুহাম্মদ কুতুবখানা, করাচি, পাকিস্তান, পৃ. ১৯৬Ñ১৯৮; (খ) মাওলানা আবদুর রশীদ নুমানী, আল-ইমামু ইবনু মাজাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনান, মাকতাবাতুল ইত্তিহাদ দেওবন্দ, ইউপি, ভারত, পৃ. ৭৩
[11] বিস্তারিত দেখুন; আবুল হাসান বাবুনগরী, তানযীমুদ দিরায়া লি হাল্লি আসয়িলাতিল হিদায়া, মুকাদ্দামায়ে ফিকহ, মাকতাবাতুল হাসান বাবুনগর, চট্টগ্রাম (দ্বিতীয়য় সংস্করণ: ১৪০৬ হি. = ১৯৮৫ খ্রি.), পৃ. ৩৩Ñ৩৬