জামেয়া ওয়েবসাইট

শনিবার-৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ.): বাংলাদেশের কিংবদন্তি মুহাদ্দিস

শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ.): বাংলাদেশের কিংবদন্তি মুহাদ্দিস

মুহাম্মদ আবু জর

প্রাথমিক জীবন

যেসব মহান পুরুষ ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা প্রসারে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন তাঁদের শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন একাধারে সুফি, মুহাদ্দিস এবং বিশিষ্ট ইসলামি আইন বিশারদ। ইসলামি বিষয়াদির পাশাপাশি তিনি ভেষজশাস্ত্র, গণিত, ভূগোল, ও রসায়নশাস্ত্রেও একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন।

শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর জন্মের সন তারিখ সম্পর্কে তেমন নির্ভরযোগ্য কিছু জানা যায় না। তবে তিনি ১২০০ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে বুখারায় জন্ম গ্রহন করেন। প্রথমিক শিক্ষার পাঠও বুখারায়ই সমাপ্ত করেন এবং পরবর্তীতে শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.) উচ্চস্তরের হাদিস শিক্ষার জন্য তৎকালীন ইলমে বিখ্যাত স্থান ইয়েমেনের অধিবাসী হন এবং সেখানেই হাদিস সম্পর্কে সর্বোচ্চস্তরের ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

ভারতবর্ষে আগমন

ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আনুমানিক ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লীতে আগমন করেন। সে সময় গিয়াসউদ্দিন বলবন ভারতবর্ষের শাসনকর্তা ছিলেন।

আল্লাহর এ অলির আগমনে লোকজন খুবই আনন্দিত হয়। অগণিত মানুষ তার দরবারে ভিড় জমাতে থাকে। এক পর্যায়ে তার জনপ্রিয়তা বাদশাহর জনপ্রিয়তাকেও অতিক্রম করে। অবস্থা বেগতিক দেখে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন আবু তাওয়ামাকে বাংলায় পাঠিয়ে দেন। তিনি তদানীন্তন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। ভারত উপমহাদেশের এ মহাপুরুষ অমর হয়ে থাকবেন তার একটি মহান কর্মের জন্য। তিনি সোনারগাঁওয়ে এসেই ইসলামি শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে বর্তমান মোগরাপাড়ার দরগাবাড়ি প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বৃহৎ মাদরাসা ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, হাদিস ও ইসলামি আইনশাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি ভেষজশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, ভুগোলশাস্ত্র এবং রসায়নশাস্ত্রেও বুৎপত্তি অর্জন করেন।

উপমহাদেশের প্রথম মাদরাসার স্থপতি

গবেষকেরা মনে করেন, তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাই উপমহাদেশে ইলমে হাদিসের সর্বপ্রথম বিদ্যাপীঠ। এর আগ পর্যন্ত উপমহাদেশে দুই একজন হাদিস জানা আলেম থাকলেও এত উচ্চ সনদ ও মূলধারার ইমল ও হাদিসের চর্চা শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর মাধ্যমেই শুরু। ইলম অর্জনের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা এখানে ছুটে আসত। হিন্দুস্তানের মাটিতে ইসলামি শিক্ষার যে অঙ্কুরোদগম বীজ লুকিয়ে ছিল, তিনি এসে তা মাটি ফুড়ে বের করে আনেন। সে সময় ওই মাদরাসার ছাত্রসংখ্যা ছিল ১০ হাজার। তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর এখানে হাদিসের শিক্ষা দিয়েছেন।

অন্যান্য কীর্তি

মাদরাসার পাশে সেখানে তিনি একটি খানকাও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মানযিলে মাকামাত নামে তাসাউফ সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তা ছাড়াও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ফিকহ-বিষয়ক যেসব বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেগুলোর সংকলন নিয়ে ফার্সি ভাষায় রচিত নামাযে হক নামে একটি কাব্যগ্রন্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা নিপিবদ্ধ আছে। অনেকে এ গ্রন্থটিকে মাসনবী বনামে হক নামে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে †gv¤^vB থেকে এবং ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। জানা যায় ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর লিখিত পাণ্ডুলিপির অস্তিত্ব সংরক্ষতি আছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিশ্বকোষ মতে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকেই উপমহাদেশে প্রথম হাদিসের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু হয়, শায়খ তাওয়ামা এখানে সহীহ আল-খারী, সহীহ মুসলিমমুসনদে আবু ইয়ালার দরস প্রদান করতেন।

অল্পদিনের মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে অগণিত শিক্ষার্থীরা তার হাদিসের দরসে শরিক হতে থাকে। সুদূর দিল্লী ও সেরহিন্দ থেকে আসা ছাত্ররাও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য এখানে হাজির হয়। বহুসংখ্যক হাদিস বিশারদও তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় আগমন করেন। তিনি তার ভ্রমণকাহিনীতে এ ঐতিহাসিক মাদরাসার কথা উল্লেখ করেন।

ইন্তেকাল

বিখ্যাত হাদিসবিশারদ আবু তাওয়ামা (রহ.) ৭০০ হিজরী মোতাবেক ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পরও বহুদিন এ মাদরাসা চালু ছিল। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কালের পরিক্রমায় এক সময় মাদরাসার শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এখন সেই মাদরাসাটির অস্তিত্ব আর নেই। তবে কালের সাক্ষী হিসেবে ঐতিহাসিক বিদ্যাপীঠটির কিছু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।

১৯৮৪ সালে ইসলামি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) হিন্দুস্তান থেকে সোনারগাঁওয়ে আসেন এবং শায়খ আবু তাওয়ামা (রহ.) প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার ধ্বংসাবশেষ ও বেহাল দশা দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। তিনি এর অদূরে ওই এলাকায় শায়খ শরফুদ্দিনের স্মৃতিকে ভাস্মর করে রাখার জন্য মাদরাসাতুশ শরফ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করে যান।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ