জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি-২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসলাহে নাফসের প্রয়োজনীয়তা

ইসলাহে নাফসের প্রয়োজনীয়তা

মুফতি আমজাদ হোসাইন

রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মানুষের ভেতরে এমন একটি টুকরা আছে ওই টুকরাটি যদি পরিশুদ্ধ হয় তাহলে মানবদেহের পুরো অংশ পরিশুদ্ধ হয়। কিন্তু যদি ওই টুকরাটি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে মানবদেহের পুরো অংশ নষ্ট হয়ে যায়। সেই অংশটির নাম হলো আত্মা।’

মানুষ পৃথিবীতে আগমন করার পর, এক কানে আজান ও এক কানে একামত দেওয়ার কারণ হলো, তাকে বুঝানো হয় তুমি যে দুনিয়াতে এসেছ এ দুনিয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং তুমি দুনিয়াতে যত দিন বেঁচে থাকবে। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে ও তার বাতলানো পথ অবলম্বন করেই বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহর ওপর ইয়াকিন ও বিশ্বাস নিয়েই কবরে যেতে হবে। মানুষের দুনিয়ার হায়াতও খুবই কম। এ সময়ের মধ্যেই আখেরাতের ছামানা তৈরি করতে হবে। জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করতে হবে।

ইসলাম ও শরীয়তের সম্পর্ক হলো মানুষের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে। বাহ্যিক শরীয়তের বিধি-বিধান বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন- নামায, রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদি বিধানসমূহ। পক্ষান্তরে অভ্যন্তরীণ শরীয়তের বিধি-বিধান অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রতঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন কুচরিত্র দূর করে সুচরিত্র অর্জন করা, ইখলাস হাসিল করা, আল্লাহ ও তার ররসুলের মহব্বত লাভ করা ইত্যাদি। আর অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা রুহের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমলগুলো দুই ভাগে বিভক্ত:

এক. এমন কিছু গুণ আছে যা করণীয়।

দুই. কিছু গুণ এমন আছে যা বর্জনীয়।

করণীয় গুণগুলো হলো উত্তম চরিত্র, যা কলবের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাকে আখলাকে হামিদা (উত্তম চরিত্র), আখলাকে হাসানা (সুন্দর চরিত্র), মালাকাতে ফাজেলা (উত্তম জ্ঞান) ও মাকামাত (আধ্যাতিক স্তর) বলা হয়ে থাকে। এ আখলাকে হামিদা মানুষের মাঝে আসে নিম্নের কর্মপন্থাগুলো  অবলম্বন করার দ্বারা:

  1. তাওহিদ: আল্লাহপাকের একত্ববাদ,
  2. ইখলাস: শিষ্টাচার ও আন্তরিকতা,
  3. তওবা: পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া,
  4. হুব্বে ইলাহি: খোদাপ্রেম,
  5. যুহুদ: দুনিয়া ত্যাগী হওয়া,
  6. তাওয়াক্কুল: আল্লাহর প্রতি ভরসা করা,
  7. কানায়াত: অল্পেতুষ্টি,
  8. হিলম: সহিষ্ণুতা,
  9. সবর: ধৈর্য ধারণ করা,
  10. শোকর: কৃতজ্ঞ হওয়া,
  11. সিদক: সত্যবাদী হওয়া,
  12. তাফবীজ: সব বিষয় আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করা,
  13. তাসলীম: নিজেকে আল্লাহর কাছে অর্পণ করা, তাঁর সব ফায়সালা মেনে নেওয়া,
  14. রিযা: আল্লাহর সব সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা,
  15. ফানা: আল্লাহর ওয়াস্তে বিলীন হওয়া।

বর্জনীয় কর্মপন্থাগুলো নিম্নরূপ: খারাপ চরিত্র যা নফসের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাকে আখলাকে রাজিলা (মন্দ চরিত্র), আখলাকে খবিছা (কুচরিত্র ও খারাপ চরিত্র) বলা হয়। যথা-

  1. তমা: লোভ লালসা করা,
  2. অতি লোভ, বেশি আশা করা,
  3. গোসসা: রাগ ও ক্রোধ করা,
  4. কিযব: মিথ্যা বলা,
  5. গীবত: পরনিন্দা করা,
  6. হাসাদ: হিংসা-বিদ্বেষ করা,
  7. বুখ্‌ল: কৃপণতা করা,
  8. রিয়া: লোক দেখানো,
  9. ওজব: নিজ পছন্দ করা,
  10. কিবর: অহংকার করা
  11. হিকদ: পরশ্রীকাতরতা,
  12. হুব্বে মাল: সম্পদের ভালবাসা,
  13. হুব্বে জাহ: সম্মানের লোভ,
  14. হুব্বে দুনিয়া: দুনিয়ার ভালবাসা।

সুতরাং মানুষর বাহ্যিক বিধানাবলি, যেমন- নামায, রোযা, হজ ও যাকাত ইত্যাদিকে সঠিক ও সহিহভাবে আদায় করা জরুরি যা কেউ কখনো অস্বীকার করবে না, তেমন অভ্যন্তরীণ বিধানগুলো, তাওহীদ, ইখলাস, তওবা, হুব্বে ইলাহি, খোদাপ্রেম ইত্যাদির ক্ষেত্রে সংশোধন করা ও অতীব জরুরি বরং বাহ্যিক বিধান সঠিক হওয়া অভ্যন্তরীণ বিধান সঠিক হওয়ার ওপর ভিত্তি। কুরআন পাকের বর্ণনার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার নিয়ম হলো, সাধারণ কোনো কথা স্বাভাবিকভাবে বর্ণনা করে থাকেন। কোনো কসম বা তাকিদের শব্দ ব্যবহার করেন না। কিন্তু বিষয়টি যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তখন একটা বা দুটো কসম ব্যবহার করে বিষয়টি মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন। যথা- একটি জিনিসের কসম করে আল্লাহপাক বলেন, যুগের কসম। আবার কখনো দুটো জিনিসের কসম করে বলেন, তীন ও যয়তুনের কসম। কখনো তিনটা জিনিসের কসম করে বলেন, নূন ও কলম এবং তাঁরা (ফেরেশতারা) যা লিখে তার কসম। কিন্তু তাযকিয়ায়ে নফস’ তথা ইহসান ও আত্মশুদ্ধি হাসিল করার ব্যাপারে সূরা আশ-শামসে সাতটি কসম করে আল্লাহপাক বলেন, শপথ সূর্যের ও তার কিরণের। শপথ চন্দ্রের যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে। শপথ দিবসের যখন সে সূর্যকে প্রখরভাবে প্রকাশ করে। শপথ রাতের যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে। শপথ আকাশের এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেন, তাঁর। শপথ পৃথিবীর এবং যিনি তা বিস্তৃত করেছেন, তাঁর। শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তাঁর। অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে ব্যক্তি নিজেকে শুদ্ধ করে, সে সফলকাম হয়। আর যে ব্যক্তি নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। (সূরা আশ-শামস: ১-১০)

উপর্যুক্ত আয়াতগুলোতে তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি কিভাবে হাসিল হয় তার গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, ইসলাহে নফস’ বা আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি এবং আল্লাহপাকের কাছে তা কত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে আত্মশুদ্ধি গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ