জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আন্তরিকতা এবং আন্তরিক উপদেশ

আন্তরিকতা এবং আন্তরিক উপদেশ

মূল: ইমাম আন-নাওয়াবী (রহ.)

ভাষান্তর: জহিরুল কাইয়ুম

 

তামীম আদ-দারী (রাযি.) বলেন, নবী (সা.) (তিনবার করে) বলেছেন, ‘দীন হলো নাসীহাহ (আন্তরিকতা এবং আন্তরিক উপদেশ)।’ আমরা বললাম, কার প্রতি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসুলুল্লাহ এবং মুসলিমদের নেতা ও সাধারণ মানুষের প্রতি।’ [সহীহ মুসলিম: ৫৫]

উল্লিখিত হাদীসের ব্যাখ্যায় [শারহ সহীহ মুসলিম, ২/৩৮] ইমাম আন-নাওয়াবী (রহ.) (মৃ. ৬৭৬ হি.) বলেন, ‘যখন আল্লাহ তাআলার প্রতি আন্তরিকতার কথা বলা হয়, তখন তার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর ওপর ঈমান (বিশ্বাস) রাখা এবং তাঁর সাথে কোনোকিছুকে শরীক না করা। তাঁর গুণ এবং বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে ইলহাদ না করা বা সেগুলোকে অবজ্ঞা সহকারে পরিবর্তন না করা। তাঁর বর্ণনা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর জন্য নির্ধারিত পূর্ণাঙ্গ, নিখুঁত, সর্বোচ্চ গুণাবলী ব্যবহার করা এবং তাঁর ওপর কোনো প্রকার ত্রুটি, দুর্বলতা, অক্ষমতা ইত্যাদি আরোপ না করা। কোনো অবস্থাতেই তাঁর অবাধ্যতায় লিপ্ত না হওয়া। তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই কোনোকিছুকে ভালোবাসা বা ঘৃণা করা। যারা তাঁর আনুগত্য করে তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা এবং যারা তাঁর অবাধ্য তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। যারা তাঁকে অবিশ্বাস কিংবা অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। তাঁর অনুগ্রহকে স্বীকার করা এবং সেগুলোর জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর প্রশংসা করা। সকল কাজে আন্তরিকতা বজায় রাখা। যেগুলো উল্লেখ করা হলো সেগুলোর প্রতি অন্যদেরকে আহ্বান জানানো এবং উৎসাহ দেওয়া। আল-খাত্তাবী (রহ.) (মৃ. ৩৮৮ হি.) বলেছেন, ‘এই ধরণের আন্তরিকতা মূলত বান্দার নিজের প্রতি আন্তরিকতাকেই বোঝায়। কারণ আল্লাহ কোনো বান্দার আন্তরিকতার মুখাপেক্ষী নন।’

যখন আল্লাহর কিতাবের প্রতি আন্তরিকতার কথা বলা হয়, তখন তার অর্থ হলো বিশ্বাস করা যে, এটি আল্লাহ তাআলার বাণী এবং তাঁর পক্ষ থেকেই অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁর সৃষ্ট মানুষের কথা এমন হতে পারে। তাঁর সৃষ্টি জগতের কারও কথা এর সমতুল্য নয়। অতঃপর তা তেলাওয়াত করা এবং এতে যেভাবে বলা আছে, ঠিক সেভাবেই এর নির্দেশনা অনুসরণ করে এর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান দেখানো। তেলাওয়াতের সময় খুশু (বিনয় ও আনুগত্য) সহকারে তেলাওয়াত করা। প্রতিটি হরফ শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা। যারা তাহরীফ (বিকৃতি এবং পরিবর্তন) এর মাধ্যমে কুরআনের অপব্যাখ্যা করে এবং যারা কুরআনের ওপর আক্রমণ করে, তাদেরকে প্রতিহত করা। কুরআনে যা আছে তা বিশ্বাস করা। এর বিধানসমূহকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নেমে নেওয়া। এর বিজ্ঞানময় শাখা এবং দৃষ্টান্তগুলো জানা। এর সাবধানবানীগুলো গ্রহণ করা এবং বিস্ময়কর ঘটনাগুলো সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করা। এর সুস্পষ্ট আয়াতগুলোর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন যাপন করা এবং যেসব আয়াত মানুষের চিন্তাশক্তির বাইরে, সেগুলোকে সত্য বলে মেনে নিয়ে ক্ষান্ত থাকা। কুরআনের কোন বিষয়গুলো ব্যাপক অর্থবোধক এবং কোন বিশেষ অর্থবোধক, কোনগুলো রহিত হয়ে গেছে এবং কোনগুলোর দ্বারা রহিত হয়েছে—সকল বিষয়ে অনুসন্ধান করে জেনে নেওয়া। কুরআনের বৈজ্ঞানিক শাখাগুলো প্রচার করা এবং সেগুলোর প্রতি মানুষকে আহ্বান করা। এসবই হলো কুরআনের প্রতি আন্তরিকতা।

যখন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর প্রতি আন্তরিকতার কথা বলা হয়, তখন তার অর্থ হলো, তিনি যে সত্যবাণীসহ প্রেরিত হয়েছেন তা সত্য বলে সাক্ষ্য দেওয়া। তাঁর দেওয়া আদেশ এবং নিষেধের অনুগত্য করা। তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে বাস্তবায় করার মাধ্যমে তাঁকে সাহায্য এবং সহযোগিতা করা। যারা তাঁর শত্রু, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। যারা তাঁর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছে, নিজেকে তাদের কাতারে শামিল করা। তাঁর সম্মান ও অধিকারকে শ্রদ্ধা করা। তাঁর জীবনাচরণ এবং সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করা এবং সমুন্নত রাখা। তাঁর দাওয়াত (দীন ইসলামের প্রতি আহ্বান) এবং শরীয়াকে (আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামি আইন) মানুষের মাঝে প্রচার করা। এসব ব্যাপারে উদ্ভূত যেকোনো সংশয় নির্মূল করা। হাদীস বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া। হাদীসের অর্থ উপলব্ধি করা এবং সেগুলো মেনে চলার জন্য মানুষকে আহ্বান করা। হাদীস অধ্যয়ন এবং শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা, কোমলতা ও দয়া অবলম্বন করা। এর প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা এবং গুরুত্ব দেওয়া। হাদীস পাঠের সময় সঠিক আদব বা শিষ্টাচার প্রদর্শন করা। সঠিক এবং পর্যাপ্ত জ্ঞান ছাড়া হাদীস বিষয়ে মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকা। হাদীস বিশেষজ্ঞদের যথাযোগ্য সম্মান দেখানো। আচার-আচরণ বিষয়ক হাদীসগুলোকে জীবনে বাস্তবায়ন করা। আহলুল বায়ত (নবী পরিবারের সদস্য) এবং সাহাবাগণকে ভালোবাসা। যারা সাহাবাদের নামে বিদ‘আহ্‌ (ইসলামে নতুন ইবাদত কর্ম) প্রচলন ঘটায় তাদেরকে এড়িয়ে চলা। এমনকি যারা একজন মাত্র সাহাবীর বিরুদ্ধেও কোনো কটূকথা বললে, তাদেরকে এড়িয়ে চলা।

যখন মুসলিম নেতাদের প্রতি আন্তরিকতার কথা বলা হয়, তখন তার অর্থ হলো, তাদেরকে সত্যের ওপর অবিচল থাকতে সাহায্য করা। তারা সত্যের ওপর থাকলে তাদের আনুগত্য করা। সত্যের মাধ্যমে তাদেরকে দিক নির্দেশনা প্রদান করা। সদয়চিত্ত এবং ভদ্রতা সহকারে তাদেরকে পরামর্শ দেওয়া এবং স্মরণ করিয়ে দেওয়া। তারা যেসব বিষয়ে অমনোযোগী এবং উদাসীন, সেগুলোর প্রতি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। মুসলিমরা এখনও যেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেগুলো পূরণ করতে তাঁদেরকে সাহায্য করা। তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা। সাধারণ মানুষের হৃদয়কে তাদের প্রতি আনুগত্যের দ্বারা সুসংহত করে তোলা। আল-খাত্তাবী (রহ.) বলেন, ‘তাদের প্রতি আন্তরিকতা থাকলেই তাদের পেছনে সালাত আদায় করা যায়, তাদের সঙ্গী হয়ে জিহাদ করা যায়, তাদের কাছে যাকাত জমা দেওয়া যায় এবং তাঁদের পক্ষ থেকে অবিচার অথবা খারাপ আচরণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করে থাকা যায়। তাদের প্রতি আন্তরিকতা থাকলে তাদের মিথ্যা প্রশংসা করা যায় না এবং তাদের সৎকর্মশীলতার জন্য দো‘আ করা যায়।’ এখানে মুসলমানদের নেতা বলতে কেবল সত্যাশ্রয়ী এবং ন্যায়পরায়ণ খলিফাদেরকেই বুঝানো হয়েছে। অধিকিন্তু, মুসলমানদের শাসনকার্যের জন্য কেউ প্রশাসনের কোনো দায়িত্বে থাকলে, তাকেও নেতা বুঝানো হয়েছে। আল-খাত্তাবী এই কথাগুলো বলার পর আরও উদ্ধৃত করেছেন, ‘এখানে ইমামদেরকেও বুঝানো হয়েছে যারা আলেম (দীন ইসলাম সম্পর্কে সুগভীর এবং বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী)। তাদের প্রতি আন্তরিকতার মধ্যে আরও রয়েছে: তাদের দেওয়া তথ্যকে সত্য বলে গ্রহণ করা, ইসলামের বিধান অনুযায়ী সেগুলোর অনুসরণ করা এবং তাদের সম্পর্কে সুধারনা পোষণ করা।’

যখন সাধারণ মুসলিমদের (খালিফা এবং আলেমগণ ছাড়া অন্যান্যরা) প্রতি আন্তরিকতার কথা বলা হয়, তখন তার অর্থ হলো, দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জীবনে কল্যাণকর বিষয়ের প্রতি তাদেরকে আহ্বান করা। দীন ইসলামের যেসব বিষয়ে তারা অজ্ঞ, সেসব বিষয়ে তাদেরকে শিক্ষা দান করে ওইসব ক্ষতিকর বিষয় থেকে তাদেরকে দূরে রাখা। এক্ষেত্রে তাদেরকে কথা এবং কাজের মাধ্যমে সাহায্য সহযোগিতা করা। তাদের ভুলত্রুটিগুলো গোপন রাখা এবং তাদের অভাব অভিযোগ পূরণ করা। তাদের জন্য ক্ষতিকর এমন সবকিছু তাদের থেকে দূর করা এবং তাদের জন্য কল্যাণকর এমন সবকিছুর ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করা। ভদ্রতা, আন্তরিকতা এবং সহমর্মিতার সাথে তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ করা এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা। সাধারণ মুসলিমদের মধ্য থেকে যারা বয়োবৃদ্ধ, তাদের প্রতি সম্মান এবং তরুণদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা। প্রয়োজনে মৃদু তিরস্কার করা এবং তাদের সাথে প্রতারণাপূর্ণ অভিনয় না করা। নিজের জন্য যেটা ভালো মনে হয়, তাদের জন্যও সেটা ভালো হিসেবে গ্রহণ করা। নিজের জন্য যা ক্ষতিকর মনে হয়, তাদের জন্যও সেটা ক্ষতিকর মনে করা। কথা ও কর্মের মাধ্যমে তাদের সুনাম ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করা। আন্তরিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট উল্লিখিত সবগুলো বিষয় যেন তারা তাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারে সে জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করা এবং পরামর্শ দেওয়া। আনুগত্যের সাথে কাজ করার জন্য তাদের অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলা। আর আল্লাহ সকল বিষয় সবচেয়ে ভালো জানেন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ