জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু যার আল-গিফারী (রাযি.)

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু যার আল-গিফারী (রাযি.)

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু যার আল-গিফারী (রাযি.)

 

বাইরের জগতের সাথে মক্কার সংযুক্তি ঘটিয়েছে যে ‘অদ্দান’ উপত্যকাটি, সেখানেই ছিল ‘গিফার’ গোত্রের বসতি। মক্কার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা ওখান দিয়ে সিরিয়া যাতায়াত করত। এসব  কাফেলার নিরাপত্তার বিনিময়ে যে সামান্য অর্থ লাভ করতো তা দিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করতো। ডাকাতি, রাহাজানিও ছিল তাদের পেশা। যখন কোন বাণিজ্য কাফেলা তাদের দাবি অনুযায়ী খাদ্যসামগ্রী বা অর্থ আদায় করত না তখন তারা লুটতরাজ চালাতো।

জুনদুন ইবন জুনাদাহ, আবু যার নামেই যিনি পরিচিত তিনিও ছিলেন এ কবীলারই সন্তান। বাল্যকাল থেকেই তিনি অসীম সাহস, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও দূরদৃষ্টির জন্য ছিলেন সকলের থেকে স্বতন্ত্র। জাহেলি যুগে জীবনের প্রথম ভাগে তাঁর পেশাও ছিল রাহাজানি। ‘গিফার’ গোত্রের একজন দুঃসাহসী ডাকাত হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর জীবনে ঘটে গেল এক বিপ্লব। তাঁর গোত্রীয় লোকেরা এক আল্লাহ ছাড়া যে সকল মূর্তির পূজা করত, তাতে তিনি গভীর ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেন। সমগ্র আরববিশ্বে সে সময় যে ধর্মীয় অনাচার, অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের সয়লাব চলছিল তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তিনি অধীরভাবে অপেক্ষা করতে থাকেন এমন একজন নবীর, যিনি মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও অন্তরকে পরিচ্ছন্ন করে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে তাদের নিয়ে আসবেন।

তিনি রাহাজানি পরিত্যাগ করে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদাতের দিকে ঝুঁকে পড়েন, যখন সমগ্র আরব দেশ গুমরাহীর অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল। হযরত আবু মা’শার বলেন, ‘আবু যার (রাযি.) জাহেলি যুগেই মুওয়াহহিদ বা একত্ববাদী ছিলেন। এক আল্লাহ ছাড়া কাকেও তিনি উপাস্য বলে বিশ্বাস করতেন না, অন্য কোন মূর্তি বা দেবদেবীর পূজাও করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ও আল্লাহর ইবাদাত মানুষের কাছে পরিচিত ছিল। এ কারণে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আবির্ভাবের সংবাদ তাঁকে দিয়েছিল, বলেছিল, ‘আবু যার, তোমার মত মক্কার এক ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে থাকেন।’

তিনি কেবল মুখে মুখেই তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন না, সেই জাহেলি যুগে নামাযও আদায় করতেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাতের তিন বছর পূর্ব থেকেই নামায আদায় করতাম।’ লোকেরা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাকে উদ্দেশ্য করে?’ বললেন, ‘আল্লাহকে।’ আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কোন দিকে মুখ করে?’ বলেছিলেন, ‘যে দিকে আল্লাহ ইচ্ছা করতেন।’

তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটিও বেশ চমকপ্রদ। ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়, তিনি তাঁর গোত্রের সাথে বসবাস করছিলেন। একদিন সংবাদ পেলেন, মক্কায় এক নতুন নবীর আবির্ভাব হয়েছে। তিনি তাঁর ভাই আনিসকে ডেকে বললেন, ‘তুমি একটু মক্কায় যাবে। সেখানে যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেন এবং আসমান থেকে তাঁর কাছে ওহী আসে বলে প্রচার করে থাকেন, তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করবে, তাঁর মুখের কিছু কথা শুনবে। তারপর ফিরে এসে আমাকে অবহিত করবে।’

আনিস মক্কায় চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী শ্রবণ করে নিজ গোত্রে ফিরে এলেন। আবু যার (রাযি.) খবর পেয়ে তখনই ছুটে গেলেন আনিসের কাছে। অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে নতুন নবী সম্পর্কে নানা কথা তাকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। আনিস বললেন,

—‘কসম আল্লাহর। আমি তো লোকটিকে দেখলাম, মানুষকে তিনি মহৎ চরিত্রের দিকে আহবান জানাচ্ছেন। আর এমন সব কথা বলেন যা কাব্য বলেও মনে হলো না।’

—‘মানুষ তাঁর সম্পর্কে কী বলাবলি করে?’

—‘কেউ বলে তিনি একজন যাদুকর, কেউ বলে গণক, আবার কেউ বলে কবি।’

—‘আল্লাহর কসম! তুমি আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারলে না, আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হলে না। তুমি কি পারবে আমার পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে, যাতে আমি মক্কায় গিয়ে স্বচক্ষেই তাঁর অবস্থা দেখে আসতে পারি?’

—‘নিশ্চয়ই। তবে আপনি মক্কাবাসীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন।’

পরদিন প্রত্যুষে আবু যার (রাযি.) চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে নিলেন কিছু পাথেয় ও এক মশক পানি। সর্বদা তিনি শঙ্কিত, ভীতচকিত। না জানি কেউ জেনে ফেলে তাঁর উদ্দেশ্য। এ অবস্থায় তিনি পৌঁছলেন মক্কায়। কোন ব্যক্তির কাছে মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কোন কথা জিজ্ঞেস করা তিনি সমীচীন মনে করলেন না। কারণ, তাঁর জানা নেই এ জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিটি মুহাম্মদ (সা.)-এর বন্ধু না শত্রু।

দিনটি কেটে গেল। রাতের আঁধার নেমে এল। তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তিনি শুয়ে পড়লেন মাসজিদুল হারামের এক কোণে। আলী ইবন আবী তালিব যাচ্ছিলেন সে পথ দিয়েই। দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, লোকটি মুসাফির। ডাকলে, ‘আসুন আমার বাড়িতে।’ আবু যার (রাযি.) গেলেন তাঁর সাথে এবং সেখানেই রাতটি কাটিয়ে দিলেন। সকাল বেলা পানির মশক ও খাবারের পুটলিটি হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলেন মসজিদে। তবে দু’জনের একজনও একে অপরকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না।

পরের দিনটিও কেটে গেল। কিন্তু নবীর সঙ্গে পরিচয় হলো না। আজও তিনি মাসজিদেই শুয়ে পড়লেন। আজও  আলী (রাযি.) আবার সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। বললেন, ব্যাপার কি, লোকটি আজও  তাঁর গন্তব্যস্থল চিনতে পারেনি? তিনি তাকে আবার সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এ রাতটিও সেখানে কেটে গেল। এদিনও কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করলেন না। একইভাবে তৃতীয় রাতটি নেমে এলো। আলী (রাযি.) আজ বললেন,

—‘বলুন তো আপনি কি উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন?’

তিনি বললেন, ‘আপনি যদি আমার কাছে অঙ্গীকার করেন আমার কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের দিকে আমাকে পথ দেখাবেন, তাহলে আমি বলতে পারি।’ আলী (রাযি.) অঙ্গীকার করলেন।

আবু যার (রাযি.) বললেন,

‘আমি অনেক দূর থেকে মক্কায় এসেছি, নতুন নবীর সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তিনি যেসব কথা বলেন তার কিছু শুনতে।’

আলী (রাযি.)-এর মুখমণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তিনি নিশ্চিত সত্য নবী।’ একথা বলে তিনি নানাভাবে নবী (সা.)-এর পরিচয় দিলেন। তিনি আরও বললেন, ‘সকালে আমি যেখানে যাই, আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি আমি আপনার জন্য আশংকাজনক কোন কিছু লক্ষ্য করি তাহলে প্রস্রাবের ভান করে দাঁড়িয়ে যাব। আবার যখন চলবো, আমাকে অনুসরণ করে চলতে থাকবেন। এভাবে আমি যেখানে প্রবেশ করি আপনিও সেখানে প্রবেশ করবেন।’

প্রিয় নবীর দর্শন লাভ ও তাঁর ওপর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ শ্রবণ করার প্রবল আগ্রহ ও উৎকণ্ঠায় আবু যার (রাযি.) সারাটি রাত বিছানায় স্থির হতে পারলেন না। পরদিন সকালে মেহমান সঙ্গে করে আলী (রাযি.) চললেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাড়ির দিকে। আবু যার তাঁর পেছনে পেছনে। পথের আশপাশের কোন কিছুর প্রতি তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এভাবে তাঁরা পৌঁছলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট। আবু যার (রাযি.) সালাম করলেন।

—‘আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ।’ রাসূল (সা.) জবাব দিলেন,

—‘ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ।’

এভাবে আবু যার (রাযি.) সর্বপ্রথম ইসলামী কায়দায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সালাম পেশ করার গৌরব অর্জন করেন। অতঃপর সালাম বিনিময়ের এ পদ্ধতিই গৃহীত ও প্রচারিত হয়।

রাসূল (সা.) আবু যারকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াতও তিলাওয়াত করে শুনালেন। সেখানে বসেই আবু যার (রাযি.) কালেমায়ে তাওহীদ পাঠ করে নতুন দীনের মধ্যে প্রবেশের ঘোষণা দিলেন।

এর পরের ঘটনা আবু যার (রাযি.) এভাবে বর্ণনা করেছেন, ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে আমি মক্কায় অবস্থান  করতে লাগলাম। তিনি আমাকে ইসলামের নানান বিষয় শিক্ষা দিলেন, কুরআনের কিছু আয়াত পাঠের প্রশিক্ষণও দিলেন। আমাকে বললেন, ‘মক্কায় কারও কাছে তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করবে না। কেউ জানতে পেলে আমি তোমার জীবনের আশংকা করছি।’

বললাম, ‘যার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ করে বলছি, আমি মক্কা ছেড়ে যাব না, যতক্ষণ না মাসজিদে গিয়ে কুরাইশদের মাঝে প্রকাশ্যে সত্যের দাওয়াত দিচ্ছি।’ রাসূল (সা.) চুপ হয়ে গেলেন।

আমি মাসজিদে এলাম। কুরাইশরা তখন একত্রে বসে গল্প গুজব করছে। আমি তাদের মাঝখানে হাজির হয়ে যতদূর সমস্ত উচ্চকণ্ঠে m‡¤^vab করে বললাম, ‘কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।’

আমার কথাগুলি তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই তারা ভীত-চকিত হয়ে পড়লো। একযোগে তারা লাফিয়ে উঠে বলল, এই ধর্মত্যাগীকে ধর। তারা দৌড়ে এসে আমাকে বেদম প্রহার শুরু করলো। রাসূলের (সা.) চাচা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব দেখে চিনতে পারলেন। তাদের হাত থেকে বাঁচানের জন্য তিনি আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তারপর তাদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা নিপাত যাও! গিফারী গোত্রের এবং তোমাদের বাণিজ্য কাফিলর গমনাগমন পথের লোককে হত্যা করছো? তারা আমাকে ছেড়ে দিল।

একটু সুস্থ হয়ে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ফিরে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, ‘তোমাকে ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলাম না?’ বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! নিজের মধ্যে আমি প্রবল ইচ্ছা অনুভব করছিলাম। সে ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি মাত্র।’ তিনি বললেন, ‘তোমার গোত্রের কাছে ফিরে যাও। যা দেখে গেলে এবং যা কিছু শুনে গেলে তাদের অবহিত করবে, তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাবে। হতে পারে আল্লাহ তোমার দ্বারা তাদের উপকৃত করবেন এবং তোমাকে প্রতিদান দেবেন। যখন তুমি জানবে, আমি প্রকাশ্যে দাওয়াত দিচ্ছি, আমার কাছে চলে আসবে।’

আমি ফিরে এলাম আমার গোত্রীয় লোকদের আবাসভূমিতে। আমার ভাই আনিস এলো আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি করলেন?’ বললাম, ‘ইসলাম গ্রহণ করে বিশ্বাসী হয়েছি।’ তক্ষুণি আল্লাহ তাঁর অন্তর-দুয়ার উন্মুক্ত করে দিলেন। সে বলল, ‘আপনার দীন প্রত্যাখ্যান করার ইচ্ছা আমার নেই। আমি ইসলাম গ্রহণ করে বিশ্বাসী হলাম।’ তারপর আমরা দু’ভাই একত্রে আমাদের মায়ের কাছে গিয়ে তাঁকেও ইসলামের দাওয়াত দিলাম।’ ‘তোমাদের দু’ভাইয়ের দীনের প্রতি আমার কোন অনীহা নেই’ একথা বলে তিনিও ইসলাম কবুল করার ঘোষণা দিলেন।

সেই দিন থেকে এই বিশ্বাসী পরিবার নিরলসভাবে গিফার গোত্রের মানুষের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে থাকে। এ কাজে কখনও তারা হতাশ হননি, কখনও মনোবল হারাননি। তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টায় এ গোত্রের বিপুল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে নামাযের জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এক দল লোক বলে, আমরা আমাদের ধর্মের ওপর অটল থাকবো। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় এলো আমরা ইসলাম গ্রহণ করবো। রাসূলের (সা.) মদীনায় হিজরতের পর তারাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ গিফার গোত্র সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘গিফার গোত্র- আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেছেন, আর আসলাম গোত্র আল্লাহ তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিয়েছেন।’

আবু যার (রাযি.) মক্কা ফিরে এসে গোত্রীয় লোকদের সাথে মরুভূমিতে অবস্থান করতে থাকেন। একে একে বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। অতঃপর তিনি মদীনায় এলেন এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহচর্য Aej¤^b করলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আবেদন করলেন তাঁর খিদমতের সুযোগ দানের জন্য। তাঁর এ আবেদন মঞ্জুর করা হল। মদীনায় অবস্থানকালে সবটুকু সময় তিনি অতিবাহিত করতেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সেবায়। এটাই ছিল তাঁর সর্বাধিক প্রিয় কাজ। তিনি নিজেই বলতেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খিদমত করতাম, আর অবসর সময়ে মসজিদে এসে বিশ্রাম নিতাম।’

ইবনে ইসহাক বলেন, আবু যার (রাযি.) হিজরাত করে মদীনায় এলে রাসুল (সা.) মুনজির ইবন ’আমর ও আবু যারের মধ্যে ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক ওয়াকিদীর মত হল, আবু যার (রাযি.) মীরাসের আয়াত নাযিল হওয়ার পর মদীনায় হিজরাত করে এসেছিলেন। সুতরাং ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপনের নিয়মটি রহিত হয়ে গিয়েছিল।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে তাঁর যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না। তবে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণের একটি ঘটনা আল্লামা ইবন হাজার আসকালানী আল-ইসাবা গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন তাবুকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তখন লোকেরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে গমনের ব্যাপারে ইতঃস্তত ভাব প্রকাশ করতে লাগলো। কোন ব্যক্তিকে দেখা না গেলে সাহাবীরা বলতেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, অমুক আসেনি।’ জবাবে তিনি বলতেন, ‘যদি তার উদ্দেশ্য মহৎ হয় তাহলে শিগগিরই আল্লাহ তাকে তোমাদের সাথে মিলিত করবেন। অন্যথায় আল্লাহ তাকে তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার দিক থেকে তোমাদের নিরাপদ করেছেন।’ এক সময় আবু যারের নামটি উল্লেখ করে বলা হল ‘সেও পিঠটান দিয়েছে।’ প্রকৃত ঘটনা হল, তাঁর উটটি ছিল মন্থরগতি। প্রথমে তিনি উটটিকে দ্রুত চালাবার চেষ্টা করেন কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে নিজের কাঁধে উঠিয়ে পায়ে হাঁটা শুরু করেন এবং অগ্রবর্তী মানযিলে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাথে মিলিত হন। এক সাহাবী দূর থেকে তাঁকে দেখে বলে উঠলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, রাস্তা দিয়ে কে যেন একজন আসছে।’ তিনি বললেন, ‘আবু যারই হবে।’ লোকেরা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে চিনতে পার। বলল, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, এতো আবু যারই।’ তিনি বললেন,

‘আল্লাহ আবু যারের ওপর রহম করুন। সে একাকী চলে, একাকীই মরবে, কিয়ামাতের দিন একাই উঠবে।’ (তারীখুল ইসলাম, আল্লামা জাহাবী, ৩য় খণ্ড) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বানীটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

হযরত আবু যার (রাযি.) ছিলেন প্রকৃতিগতভাবেই সরল, সাদাসিধে, দুনিয়া বিরাগী ও নির্জনতা-প্রিয় স্বভাবের। এ কারণে রাসূলে পাক (সা.) তাঁর লকব দিয়েছিলেন ‘মসিহুল ইসলাম’। রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর তিনি দুনিয়ার সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন। প্রিয় নবীর বিচ্ছেদে তাঁর অন্তর অভ্যন্তরে যে দাহ শুরু হয়েছিল তা আর কখনও প্রশমিত হয়নি। এ কারণে হযরত আবু বকরের ইনতিকালে তাঁর ভগ্ন হৃদয় আরও চুরমার হয়ে যায়। তাঁর দৃষ্টিতে তখন মদীনার সুশোভিত উদ্যানটি পত্র-পল্লবহীন বলে প্রতিভাত হয়। তিনি মদীনা ত্যাগ করে শামে (সিরিয়া) প্রবাসী হন।

আবু বকর ও ওমর (রাযি.)-এর খিলাফতকাল পর্যন্ত ইসলামের সহজ ও সরল জীবন ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। বিজয় ও ইসলামী খিলাফতের বিস্তৃতির সাথে যখন ধন ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য দেখা দেয় তখন স্বাভাবিকভাবেই চাকচিক্য ও জৌলুস সে স্থান দখল করে নেয়। হযরত উসমান (রাযি.)-এর যুগেই বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে শানশওকাতের সূচনা হয়। সাধারণ জনজীবনে এর কিছুটা প্রভাব পড়ে। তাদের মধ্যে নবী (সা.)-এর আমলের সরলতার পরিবর্তে ভোগ ও বিলাসিতার ছাপ ফুটে ওঠে। আবু যার (রাযি.) মানুষের কাছে নবী (সা.)-এর আমলের সেই সহজ সরল আড়ম্বরহীন জীবনধারার অনুসরণ আশা করতেন। তাঁর প্রত্যাশা ছিল সকলেই তাঁর মন ধন-দৌলতের প্রতি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত হোক। তাঁর আল্লাহ নির্ভর বিশ্বাস ও মতবাদে আগামীকালের জন্য কোন কিছুই আজ সঞ্চয় করা যাবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, অন্যকে অভুক্ত ও উলংগ রেখে সম্পদ পুঞ্জিভূত করার কোন অধিকার কোন মুসলিমের নেই। হযরত মুআবিয়া (রাযি.) ও অন্যান্য আমীরগণ মনে করতেন সম্পদশালী লোকদের ওপর আল্লাহ যে যাকাত ফরয করেছেন তা সঠিকভাবে আদায় করার পর অতিরিক্ত অর্থ জমা করার ইখতিয়ার প্রতিটি মুসলিমের আছে। এ মতপার্থক্য বৃদ্ধি পেয়ে শেষ পর্যন্ত ঝগড়া ও বচসার রূপ লাভ করে। আবু যার (রাযি.) অত্যন্ত নির্ভীকভাবে সে সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হওয়ার কারণে তাদের কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের লক্ষ্যবস্তু বলে গণ্য করতে থাকেন।

وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ١ۙ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِيْمٍۙ۰۰۳۴

‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জিভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা তাদের মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও।’ (সুরা আত-তাওবা: ৩৪)

এ আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে ইহুদি ও নাসারাদের আলোচনা এসেছে। এ কারণে মুআবিয়া (রাযি.)-এর বক্তব্য ছিল, এ আয়াতের সম্পর্ক সেসব বিধর্মীদের সাথে। আর আবু যার (রাযি.) মনে করেন, আয়াতটির উদ্দেশ্য মুসলিম অমুসলিম সকলেই। দ্বিতীয়ত আবু যার (রাযি.) আল্লাহর পথে ব্যয় না করার অর্থ এই বুঝাতেন যে, সে নিজের ধন সম্পদ আল্লাহর পথে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দেয় না। আর মুআবিয়া (রাযি.)-এর ধারণা ছিল এটা কেবল যাকাতের সাথে সম্পৃক্ত। এভাবে হযরত আবু যার (রাযি.) স্বীয় চিন্তা-দর্শন ও মত অনুযায়ী অত্যন্ত কঠোরভাবে সমালোচনা আরম্ভ করেন। হযরত মুআবিয়া (রাযি.) মনে করেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে শামে যে কোন সময় বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তিনি খলীফা উসমান (রাযি.)-কে নাজুক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলেন এবং অনুরোধ করলেন তিনি যেন আবয যারকে মদীনায় তলব করেন। হযরত উসমান তাঁকে মদীনায় ডেকে পাঠান।

একদিন আবযু যার বসে আছেন। তাঁরই সামনে খলীফা উসমান (রাযি.) কা’ব (রাযি.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে ব্যক্তি সম্পদ পুঞ্জিভুত করে, তার যাকাত দেয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয়ও করে- এমন ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কী ধারণা পোষণ করেন?’ কা’ব (রাযি.) বললেন, ‘এ ব্যক্তি সম্পর্কে ভালো আশা পোষণ করা যায়।’ এ কথা শুনে আবু যার (রাযি.) তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কা’বের মাথার ওপর হাতে লাঠিটি তুলে ধরে বললেন, ‘ইহুদি নারীর সন্তান, (কা’ব ইহুদির সন্তান ছিলেন) তুমি এর মর্ম কি বুঝবে। কিয়ামাতের দিন এমন ব্যক্তির অন্তরকেও বৃশ্চিক দংশন করবে।’ হযরত উসমান শেষ পর্যন্ত আবু যারকে বললেন, ‘আপনি আমার কাছে থাকুন, দুগ্ধবতী উটনী প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় আপনার দরজায় হাজির হবে।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘তোমার এ দুনিয়ার কোন প্রয়োজন আমার নেই।’ এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন। অবশেষে হযরত উসমান তাঁকে অনুরোধ জানালেন, মদীনা থেকে বহু দূরে মরুভূমির মাঝখানে ‘রাবজা’ নামক স্থানে গিয়ে বসবাস করার জন্য। অনেকে মতে তিনি স্বেচ্ছায় সেখানে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। লোকালয়ে থেকে বহুদূরে নির্জন প্রান্তরে ভোগ বিলাসী জীবনকে পরিহার করে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পরকাল-আসক্ত জীবনকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে আমরণ সেখানে পড়ে থাকেন। হযরত আবু যারের ওফাতের কাহিনীটাও অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং চমকপ্রদও বটে। হিজরী ৩১ মতান্তরে ৩২ সনের তিনি ‘রাবজা’র মরুভূমিতে ইনতিকাল করেন। তাঁর সহধর্মিনী তাঁর অন্তিমকালীন অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে:

‘আবু যার (রাযি.)-এর অবস্থা যখন খুবই খারাপ হয়ে পড়লো, আমি তখন কাঁদতে শুরু করলাম। তিনি বললেন, কাঁদছো কেন? বললাম, এক নির্জন মরুভূমিতে আপনি পরকালের দিকে যাত্রা করছেন। এখানে আমার ও আপনার ব্যবহৃত বস্ত্র ছাড়া অতিরিক্ত এমন বস্ত্র নেই যা দ্বারা আপনার কাফন  দেওয়া যেতে পারে। তিনি বললেন, কান্না থামাও। তোমাকে একটি সুসংবাদ দিচ্ছি। রাসূল (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, ‘যে মুসলিমের দুই অথবা তিনটি সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য তাই-ই যথেষ্ট। তিনি কতিপয় লোকের সামনে, তার মধ্যে আমিও ছিলাম, বলেছিলেন, তোমাদের মধ্যে একজন মরুভূমিতে মৃত্যুবরণ করবে এবং তার মরণ সময়ে মুসলিমদের একটি দল সেখানে অকস্মাৎ উপস্থিত হবে।’ আমি ছাড়া সেই লোকগুলির সকলেই লোকালয়ে ইন্তিকাল করেছে। এখন একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সে ব্যক্তি আমি। আমি কসম করে বলছি, আমি মিথ্যা বলছিনা এবং যিনি এ কথা বলেছিলেন তিনিও কোন মিথ্যা বলেননি। তুমি রাস্তার দিকে চেয়ে দেখ গায়েবী সাহায্য অবশ্যই এসে যাচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘এখন তো হাজীদেরও প্রত্যাবর্তন শেষ হয়েছে, রাস্তায়ও লোক চলাচল বন্ধ।’ তিনি বললেন, ‘না’ তুমি যেয়ে দেখ।’ সুতরাং এক দিকে গৌড়ে গিয়ে টিলার ওপর উঠে দূরে তাকিয়ে দেখছিলাম, অপর দিকে ছুটে এসে তাঁর শুশ্রুষা করছিলাম। এরূপ ছুটাছুটি ও অনুসন্ধান চলছিল। এমন সময় দূরে কিছু আরোহী দৃষ্টিগোচর হলো। আমি তাদেরকে ইশারা করলে তারা দ্রুতগতিতে আমার নিকট এসে থেমে গেল। আবু যার (রাযি.) সম্পর্কে তারা প্রশ্ন করলো, ‘ইনি কে?’ বললাম, ‘আবু যার।’ ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবী?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ ‘মা বাবা কুরবান হোক’ একথা বলে তারা আবু যারের কাছে গেল। আবু যার (রাযি.) প্রথমে তাদেরকে রাসূল (সা.)-এর ভবিষ্যৎ বাণী শানালেন। তারপর অসিয়ত করলেন, ‘যদি আমার নিকট অথবা আমার স্ত্রীর নিকট থেকে কাফনের পরিমাণ কাপড় পাওয়া যায় তাহলে তা দিয়েই আমাকে দাফন দেবে।’ তারপর তাদেরকে কসম দিলেন, যে ব্যক্তি সরকারের ক্ষুদ্রতম পদেও অধিষ্ঠিত সে যেন তাঁকে কাফন না পরায়। ঘটনাক্রমে এক আনসারী যুবক ছাড়া তাদের মধ্যে অন্য সকলেই কোন না কোন সরকারী দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। আবু যার (রাযি.) তাকেই কাফন পরাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ কাফেলাটি ছিল ইয়ামনী। তারা কুফা থেকে আসছিল। আর তাদের সাথে ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাযি.)। এ কাফেলার সাথে তিনি ইরাক যাচ্ছিলেন। তিনিই আবু যারের জানাযার ইমামতি করেন এবং সকলে মিলে তাঁকে ‘রাবজার’ মরুভূমিতে দাফন করেন।’

হযরত আবু যার (রাযি.) থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট আটাশ। তন্মধ্যে বারোটি হাদীস মুত্তাফাক আলাইহি অর্থাৎ বুখারী ও মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছে। দুটি বুখারী ও সাতটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদের তুলনায় তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা এত কম হওয়ার কারণ তিনি সবসময় চুপচাপ থাকতেন, নির্জনতা পছন্দ করতেন এবং মানুষের সাথে মেলামেশা কম করতেন। এ কারণে তাঁর জ্ঞানের তেমন প্রচার হয়নি। অথচ হযরত আনাস ইবন মালিক, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস প্রমুখের ন্যায় বিদ্বান সাহাবীগণ তাঁর নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন। ইবন আসাকির তাঁর তারীখে দিমাশক গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

হযরত আলী (রাযি.)-কে আবু যারের জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘এমন জ্ঞান তিনি লাভ করেছেন যা মানুষ অর্জন করতে অক্ষম। তারপর সে জ্ঞান আগুনে সেক দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে কিন্ত তা থেকে কোন খাদ বের হয়নি।’ এ মহান সাধক ও দুনিয়া নিরাসক্ত সাহাবী সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আসমানের নীচে ও যমীনের ওপরে আবু যার (রাযি.) সর্বাধিক সত্যবাদী ব্যক্তি।’

হযরত উসমান (রাযি.)-এর খিলাফতকালে আবু যার (রাযি.) একবার হজ্জে গেলেন। এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘উসমান মিনায় অবস্থানকালে চার রাকা’আত নামায আদায় করেছেন (অর্থাৎ কসর করেননি)।’ বিষয়টি তাঁর মনঃপুত হলো না। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিন্দা করে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.), আবু বকর ও উমারের পেছনে আমি নামায আদায় করেছি। তাঁরা সকলে দু’ রাকা’আত  পড়েছেন।’ একথা বলার পর তিনি নিজেই ইমামতি করলেন এবং চার রাকা’আতই আদায় করলেন। লোকেরা বলল, ‘আপনিইতো আমীরুল মু’মিনীনের সমালোচনা করলেন আর এখন নিজেই চার রাকাআত আদায় করলেন।’ তিনি বললেন, ‘মতভেদ খুবই খারাপ বিষয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমার পরে যারা আমীর হবে তাদের অপমান করবে না। যে ব্যক্তি তাদের অপমান করার ইচ্ছা করবে সে ইসলামের সুদৃঢ় রজ্জু স্বীয় কাঁধ থেকে ছুড়ে ফেলবে এবং নিজের জন্য তাওবার দরজা বন্ধ করে দেবে।’ (মুসনদে আহমাদ, ৫/১৬৫)

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইনতিকালের পর যখনই পবিত্র নামটি তাঁর জিহ্বায় এসে যেত, চোখ থেকে অঝোরে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতো। আহনাফ ইবনে কায়েস বর্ণনা করে, ‘আমি একবার বাইতুল মাকদাসে এক ব্যক্তিকে একের পর এক সাজদাহ করতে দেখলাম। এতে আমার অন্তরে এক বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল। আমি যখন দ্বিতীয়বার তার কাছে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনি কি বলতে পারেন আমি জোড় না বেজোড় নামায আদায় করেছি?’ তিনি বললেন, ‘আমি না জানলেও আল্লাহ নিশ্চয়ই জানেন।’ তারপর বললেন, ‘আমার বন্ধু আবুল কাসিম আমাকে বলেছেন’ এতটুকু বলেই তিনি কাঁদতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘আমার বন্ধু আবুল কাসিম আমাকে বলেছেন।’ এবারও কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে গেল। অবশেষে নিজেকে সম্বরণ করে নিয়ে বললেন, ‘আমার বন্ধু আবুল কাসিম (সা.) বলেছেন, যে বান্দা আল্লাহকে একটি সাজদাহ করে, আল্লাহ তার একটি দরজা বৃদ্ধি করেন এবং তার একটি পাপ মোচন করে একটি নেকী লিপিবদ্ধ করেন।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কে?’ তিনি বললেন, ‘আবু যার- রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবী।’

একদিন এক ব্যক্তি আবু যারের নিকট এলো। সে তাঁর ঘরের চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো। গৃহস্থালীর কোন সামগ্রী দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—‘আবু যার, আপনার সামান-পত্র কোথায়?

—‘আখিরাতে আমার একটি বাড়ি আছে। আমার সব উৎকৃষ্ট সামগ্রী সেখানেই পাঠিয়ে দিই।’

একদা সিরিয়ার আমীর তাঁর নিকট তিনশ’ দীনার পাঠালেন। আর বলে পাঠালেন, এ দ্বারা আপনি আপনার প্রয়োজন পূর্ণ করুন। ‘শামের আমীর কি আমার থেকে অধিকতর নীচ কোন আল্লাহর বান্দাকে পেলেন না?—একথা বলে তিনি দীনারগুলো ফেরত পাঠালেন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ