রবিবার-১৬ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি-৯ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আমি যৌবন বলছি

আমি যৌবন বলছি

আমি যৌবন বলছি

এইচ. এম. তানভীর সিরাজ

 

আমি যৌবন। আমি একটি নিরাপদ, নিরপরাধ শব্দ। আমি একটি বাক্যের একটি অংশ, বক্তার বক্তব্যেও সম্পূরক আমি। আমার একটি অর্থ আছে। যুবকাল ও যুবাবস্থা এবং তরুণ ও তারুণ্য বয়স ইত্যাদি আমাকে বোঝায়। আমি জীবনের বসন্তকাল। মানুষ আমাকে নিয়ে বেশ ফূর্তি করে তাদের উত্তুঙ্গ যৌবনে। আমি আজ এতবেশি দুর্নামে নিক্ষেপিত হচ্ছি; অপমানিত হচ্ছি যূথবদ্ধ নিশ্ছিদ্র অবাধ মেলামেশার প্রেমময় বন্ধনে আর বরেণ্য, বর্ণাঢ্য ছাত্ররা অনৈতিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্বশিক্ষিত ছাত্রদের আজেবাজে কাজে। অনেকসময় আমি অভাক হয়ে ভাবতে থাকি, মানুষ তাহলে এও পারে, যা পশুকে পর্যন্ত হার মানায়! মাঝেমধ্যে নানা কাগজের সমীকরণী তথ্যচিত্র মিলে যায়। আমি লজ্জিত হয়। আমাকে লাঞ্ছিত করার জন্য চুপটি করে ঘাপটি মেরে সুযোগের জন্য বসে আছে কিছু যুবক!

আমি বরাবরই বলে আসছি আমার নিরপরাধের কথা। আমার পক্ষে জ্ঞানীরাই একমাত্র মুখ খুলেন, কথা বলেন। তারা বলেন, ‘আমার কোনো দোষ নেই। তবে অন্যরা আমাকে অপব্যবহার, লাঞ্ছিত আর অপমানিত করে।’

অপরাধবিজ্ঞানী বলেন, শিক্ষিত সমাজ আজ তাদের লেখায়, কথায় আর বয়ানে বক্তব্যে আমাকে যে পরিমাণ নাজেহাল করছে, তা নিয়ে আজ আমি বেশ চিন্তিত। মানুষ শৈশব থেকে কৈশোরে, কিশোর থেকে যৌবনে প্রতিনিয়ত পদার্পণ করছে। এ পদার্পণ তাদের জীবনের অলংকার আর ভবিষ্যতের হাতিয়ার। যে সিঁড়ি বেয়ে শিশুকে যৌবনের সংযোগস্থাপন করে সেই সিঁড়ির নাম জীবনবসন্ত। অপব্যবহারে লিপ্ত করে আমার আপাদমস্তক কলঙ্কিত হচ্ছে। আমার কী অপরাধ বলেন?! সব অপরাধ অসামাজিক। সমাজ যতই ভালো হবে, যুবসমাজ ততই ভালো হবে।

আমি কেবল এ সময় নই, আমি সোনালি যুগেও ছিলাম সোনালি মানুষদের সাথে। আমি পূর্ণমাত্রায় নিরাপদ ছিলাম, ষোলআনা নির্দোষ ছিলাম নবী-রাসূলদের জীবনে আর নবী ঘোষিত তিন সোনালি যুগেও। তার পরেই শুরু হয়েছে আমার অবনতি, কলঙ্ক আর বেহায়াপনা এবং লাঞ্ছনা। যুবক-যুবতীদের প্রতি আমার মিনতি; তারা যেন আমাকে দুর্নামের ভাগে ভাগি না করে।

আমি যৌবন বলছি,

আজকাল যুবসমাজ নষ্ট হওয়ার পেছনে

অভিভাবকই অধিকাংশে দায়ী।

এমন কিছু কারণ নিচে আলোকপাত করা হলো।

১. তাকে দীনী শিক্ষা না দেওয়া

আদম সন্তানের দীনী শিক্ষার প্রথমস্তর বা প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন হল মায়ের কোল আর শিক্ষা লাভের মোক্ষম সময় হল শিশুকাল। যখন তাদের মনস্তাত্বিক অবস্থা পরিপক্ব থাকে যেকোনো কথা বা জ্ঞান গ্রহণ করতে। সরলভাষায় বলি, তখন তাদের মেধাশক্তি এত বেশি ক্ষুধার্ত থাকে যে, যা পায় তা গিলে খেতে চায়।

যেমনটি আপনারাও দেখেছেন। পিচ্ছিকে যা শিখানো হয় তাই সে শিখে আর তোতাপাখির ন্যায় অনর্গল বলে দেয়। কথায় আছে, ছোট বয়সে যা শিখে তা, পাথরে গাঁথুনির ন্যায় গাঁথে। নেতিবাচক হলুদ সংকেত দিয়ে দয়ার নবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক বনি আদম তার ফিতরতের (ফিতরতে ইসলামের) উপর জন্মগ্রহণ করে। সুতরাং তার মা-বাবা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান আর অগ্নিপূজক বানায়।’ (হাদীস)

আর এই জন্যই আল্লাহ তাআলা পাক কালামে বলেছেন, ‘জাহান্নামীদের কেউ কেউ বলবে,আল্লাহ, আমরা আমাদের নেতাদের (অনুসৃতদের) আর বড়দের কথা মত চলেছি, আনুগত্য করেছি তাদের। সুতরাং তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছে। আল্লাহ, আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করেন।’ (কুরআন)

এখান থেকে বোঝা যায় কচিকাঁচা বাচ্চা-কাচ্চাদের দীনী ইলম শিক্ষা না দেয়ায় অনুসৃতব্যক্তিরা মহাপ্রলয়ে ফেঁসে যেতে হবে।

মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ তাঁর ছোটদের ফাযায়েল ২য় খণ্ডে লিখেছেন, ‘ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোররা কী শিক্ষা লাভ করছে? তাদের হৃদয়ের নরম মাটিতে কিসের বীজ বপন করা হচ্ছে?

ঈমান ও বিশ্বাসের এবং আমল ও আখলাকের পুষ্প-বৃক্ষের, নাকি শিরক ও কুফুরির এবং অসত্য ও অসুন্দরের কণ্টক-বৃক্ষের?

এজন্য বলতে চাই যে, আমাদের কোমলমতি শিশুদের আমরা দীনীশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলি, অন্যথায় তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর জলে পড়তে হবে।

২. সৎসঙ্গ

সঙ্গ ভালো হয় যার, আপাদমস্তক সুন্দর হয় তার। আল্লাহ তাআলাও বেশ তাকীদ দিয়েছেন এর প্রতি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘সত্যিকার বা সৎবান্দাদের সাথেই থাকো।’ (আল-কুরআন)

দারুল উলুম হাটহাজারীতে আমার প্রবীণ উস্তাদ মাওলানা আরমান (কাতেব সাহেব)-কে বলতে শুনেছি, চার জিনিশ মানুষের কপাল ভালো হওয়ার আলামত। যথা-

  1. বন্ধু-বান্ধব সৎ হওয়া,
  2. দীনদার স্ত্রী হওয়া,
  3. ছেলেসন্তান ফরমাবরদার হওয়া,
  4. আর দেশে আয়ের ব্যবস্থা হওয়া।

পারস্যের কবি শেখ সাদীর কথা মনে পড়ে গেলো। শেখ সাদীর ‘সৎসঙ্গ’ নামে একটি কবিতা আছে, যা আজও আমাদের সৎসঙ্গের সুফল বুঝতে সাহায্য করে নীচে তা উল্লেখ করা হল:

সৎসঙ্গ

একদা স্নানের আগাড়ে বসিয়া হেরিনু মাটির ঢেলা,

হাতে নিয়া তারে শুকিয়ে দেখিনু রয়েছে সুবাস মেলা।

কহিনু তাহারে কস্তুরি তুমি? তুমিকি আতরদান?

তোমার গায়েতো সুবাস ভরা, তুমিকি গুলিস্তান?

কহিল ওসব কিছু আমি নহি, আমি অতি নীচ মাটি,

ফুলের সহিত থাকিয়া তাহার সুবাসে হইনু খাঁটি। (সংগৃহীত)

সন্তানদের ভালো মানুষের সংস্পর্শে না রাখা বা তাদের কাছে যাওয়া-আসা না করালে তাহযীব-তামাদ্দুনের ঘাটতি থেকেই যায়। যার ফলশ্রুতিতে ইভটিজিং, রাহাজানি, ছিনতাই, গুম, হত্যা আর চুরি-ডাকাতির মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সোহবত, সৎসঙ্গ আর সংস্পর্শের আমলটি বেশ প্রচলিত ছিল সোনালি তিনযুগে। তাই বলতে চাই সৎসঙ্গের বিকল্প নেই।

৩. অবাধ মেলামেশা

মুক্তমনার এই সময়ে পর্দাহীনতায় যা দেখার, তা দেখছে বিশ্বের সচেতন জনগণ। অবাধ মেলামেশা বলতেই পর্দাহীনতা আর বেহায়াপনাকেই বোঝায়।

মুসলিম ঐতিহ্যের কথা শুনে আমরা কান সুখ করে থাকি, তবে আমি কি একটিবার চিন্তা করেছি কেন আমরা গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম ঐতিহ্যকে হাত ছাড়া করেছি? যতসব অপরাধ তাদের নয়, আমাদের।

বেপর্দা নামক মুখ চাহনি বন্ধ করতে হযরত উমরের ভূমিকা আমরা কিভাবে অস্বীকার করতে পারি! তিনি বেহায়াপনা দূর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন পরপুরুষের ছোবল থেকে নারী সমাজকে রক্ষা করতে। এ উদ্দেশ্যে তিনি রাসূলে করীম (সা.)-কে বলেছিলেন, যদি আপনি উম্মাহাতুল মুমিনিদের পর্দার আদেশ করতেন! (সহীহ আল-বুখারী)

হিজাব বা পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার আগে এ আশা করেছিলেন তিনি। তখনই আল্লাহ তাআলা পর্দা বা হিজাবের আয়াত অবতীর্ণ করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

عَسٰى رَبُّهٗۤ اِنْ طَلَّقَكُنَّ اَنْ يُّبْدِلَهٗۤ اَزْوَاجًا خَيْرًا مِّنْكُنَّ مُسْلِمٰتٍ مُّؤْمِنٰتٍ قٰنِتٰتٍ تٰٓىِٕبٰتٍ عٰبِدٰتٍ سٰٓىِٕحٰتٍ ثَيِّبٰتٍ وَّ اَبْكَارًا۰۰۵

‘তিনি যদি তোমাদের সকলকে তালাক দিয়ে দেন, তবে তাঁর প্রতিপালক তোমাদের পরিবর্তে শীঘ্রই তাকে দিতে পারেন এমন স্ত্রী, যারা হবে তোমাদের চেয়ে উত্তম, মুসলিম, মুমিন, তওবাকারী, ইবাদতগুজার, রোযাদার তাতে তাদের পূর্বে স্বামী থাকুক বা কুমারী হোক। (সূরা আত-তাহরীম: ৫)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাঁর হাবীবের পরিবারের ব্যাপারে যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় অনেককিছুই রয়েছে।

চলুন, এবার আমরা অবাধ মেলামেশার কুফল নিয়ে ডকুমেন্ট দেখি।

একদিন হযরত আলী (রাযি.) ও ফাতেমা (রাযি.) রাসূল (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হলে তাঁরা দেখেন যে, তিনি কাঁদছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে রাসূল (সা.) বলেন, আমি একশ্রেণীর নারীকে (মেরাজের রাতে) দেখলাম তাদের চুলে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের মগজ বেরিয়ে যাচ্ছে। আরেক শ্রেণির নারীকে দেখলাম জিভে বেঁধে তাদের ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে আর তাদের গলায় গরমপানি ঢেলে দেয়া হচ্ছে। তৃতীয় প্রকার নারী দেখলাম, তাদের পা’দুটি স্তনের সাথে আর দুই হাত কপালের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। চতুর্থ প্রকার নারী দেখলাম যাদের স্তনে বেঁধে ওল্টো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পঞ্চম প্রকার নারী দেখলাম যাদের মাথা ইঁদুরের মাথার মতো, অথচ তাদের পুরো শরীর গাধার মতো। ষষ্ঠ প্রকার নারী দেখলাম তাদের আকৃতি কুকুরের মতো। আগুন তাদের মুখ দিয়ে ঢুকছে আর পায়ুপথ দিয়ে তা বেরিয়ে যাচ্ছে। ফেরেশতারা আগুনের তৈরি মুগুড় দিয়ে অবিরত তাদের পেটাচ্ছে।’

একথা শুনে ফাতেমা (রাযি.) দাঁড়িয়ে গেলেন আর জিজ্ঞেস করলেন, আব্বাজান, কোন গোনাহের কারণে তাদের এতো কঠিন শাস্তি?

রাসূল (সা.) বলেন, একশ্রেণীর নারীকে (মেরাজের রাতে) দেখলাম তাদের চুলে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, তারা পুরুষের দেখা থেকে নিজেদের চুল বাঁচিয়ে রাখতো না। (চুল খোলা রেখে বাজার-হাটে যেতে অভ্যস্ত ছিলো)।

আরেক শ্রেণির নারীকে দেখলাম জিভে বেঁধে তাদের ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের দোষ হলো, তারা স্বামীদের কষ্ট দিতো। (স্বামীদের জিভ দিয়ে আঘাত করতো)।

তৃতীয় প্রকার যাদের পাদুটি স্তনের সাথে আর দুই হাত কপালের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাদের ওপর সাপ-বিচ্ছু ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তারা ঋতুবতী ও সহবাসের পর ফরজ গোসল করে ভালো করে পবিত্র হতো না আর নামাজের ব্যাপারে বিদ্রুপ করতো।

চতুর্থ প্রকার নারী। তারা অসতী নারী ছিলো। যারা পরপুরুষের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হতো।

পঞ্চম প্রকার নারী, যাদের মাথা ইঁদুরের মাথার মতো, অথচ তাদের পুরো শরীর গাধার মতো। ওই নারীরা মানুষের ওপর অপবাদ দিতো আর মিথ্যাকথা বলতো।

ষষ্ঠ প্রকার নারী যারা কুকুরের মতো। আগুন তাদের মুখে ঢেলে দেয়া হচ্ছে আর তা পায়ুপথ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। তারা ওই নারী, যারা লোকদের হিংসে করতো আর কাউকে উপকার করে তা বলে বেড়াতো। (আল-কাবায়ের লিয-যাহাবী, পৃ. ১৭৭, যৌবনের মৌবনে, পৃ. ১১০-১১১)

‘নারী-পুরুষের লাগামহীন মেলামেশা আর প্রবৃত্তি পূরণের অবাধ স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ফলাফলস্বরূপ পশ্চিমা সমাজের নারীরা অহরহ হয় ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার। এমনকি এই বিকৃত আচরণ থেকে সে সমাজের নিষ্পাপ শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পায় না। নারী স্বাধীনতার অগ্রপথিক যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে ধর্ষিত হয় একজন নারী, আর বছরে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় সাড়ে সাত লক্ষে। (সূত্র: দি আগলি ট্রুথ, মাইকেল প্যারেন্টি)

জর্জ ল্যান্ডসি তার এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন যে, হাইস্কুলের ছাত্রীদের কম পক্ষে ৪৫% স্কুল ছাড়ার পূর্বেই নষ্ট হয়ে যায়।

সহশিক্ষার অবাধ মেলামেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের তুলনায় কলেজ ও হাইস্কুলের জীবনে যৌনঅপরাধ বেশি সংঘটিত হয়ে থাকে। কারণ এ বয়সে মেয়েরা কম ম্যাচেউরড্‌ থাকে, ফলে তারা সঙ্গী-সাথীদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় বেশি। (ইসলাম যৌনবিধান, আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, পৃ. ২৬১)

আর আমি মনে করি ভার্সিটি লাইফে তারা যৌবনের তাড়নায় স্বেচ্ছায় ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে থাকে।

৪. প্রত্যেক অনুষ্ঠানে যেতে দেয়া

আমার আপমার ছেলেমেয়েকে সংযত রাখতে আমাদের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা হল জবাবদিহিতা।

কোথায়, কখন, কবে আর কেনইবা গিয়েছিলে। এমন প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে তাদেরকে, তাহলে তারা সীমাবদ্ধ হয়েই চলাফেরা করবে আর সাবধানতা অবলম্বন করবে।

আরেকটি বিষয় আমরা অভিভাবকদের চরমভাবে অন্তরীকরণ করতে হবে যে, যত্রতত্র যেতে দেওয়া থেকে হুঁশিয়ার করা আর প্রতিরোধ করা এবং পূর্ণ প্রচণ্ডতার সাথে তাদেরকে হাতের নাগালে রাখার চেষ্টা করা, আর না হয়, ভবিষতে তারা আমাদের গলারকাঁটা হয়ে দাঁড়াবে।

তাই বলতে হয়, সন্তানদের বেহায়াপনা থেকে রক্ষা করার অন্যতম মাধ্যম হল জবাবদিহিতার পরিমাণ বাড়ানোর সাথে সাথে নির্লজ্জ শিক্ষাখাত ও অনুষ্ঠান থেকে বারণ করা।

৫. উচ্চশিক্ষার বায়না

উচ্চশিক্ষার বায়না দিয়ে যুবক-যুবতীদেরকে ঘরের বাইরে যাওয়াকে উন্মুক্ত করা। চিন্তাহীনভাবেই অনুমতি প্রদান করা, আর জবাবদিহিতা না করা যে, কোথায়,কার সাথে যাচ্ছে। এই তো সেইদিনের কথা। যাচ্ছিলাম বাসায়। গাড়িতে উঠে দেখি বড়ভাই ছোটবোনকে বিদায় দিতেই অন্য একটি ছেলে হুট করে গাড়িতে চড়ে বসে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে, আস্তে আস্তে কথা আরম্ভ করে আর ধীরে-সুস্থে আওয়াজ ছোট থেকে প্রকাশ্যে রূপ নেয় আর ঘনিষ্ঠতার ঘনত্ব প্রকাশ্য হতে শুরু করে, বলা-বলি জাহির হল। ছেলেটা জিজ্ঞেস করে বসল, কী রে, ভাইয়া কী বলল রে? মেয়ে, না, মানে বাসায় গিয়ে মাকে ইত্যাদি বলতে বলেছেন। ছেলেমেয়েদের কী এক অগ্নিতাপ বাকিদের বিরক্ত করে তুলছে! তাদের বাবার সমান মানুষের সামনেও কথা বলতে তাদের নির্লজ্জতা আমাকে অবাক করে। কারণ শয়তান তাদের কুকাজকে সুকাজে শ্রী দিয়ে তাদের সামনে পেশ করছে এবং ক্ষণস্থায়ী মজা দিচ্ছে তাদের মনে-প্রাণে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطٰنُ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ۰۰۴۳

‘এবং তারা যা করেছিল শয়তান তাদেরকে বোঝাল যে, এটাই উত্তম কাজ।’ (সূরা আল-আনআম: ৪৩)

এজন্য বলছিলাম সামান্য কিছু সময় অস্বাদকে স্বাদে পরিণত করে তাদেরকে জাহান্নানের দিকে রাহবারি করছে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন।

৬. পড়ার নামে বয়স ভারী করা

পড়াশুনার কারণ দর্শিয়ে বয়স ভারি করা। আজকাল আমরা যেটা দেখতে পাই, তা হল, শিক্ষার্জনের নামে ছেলেমেয়েদের বয়স ভারি করা। যে কারণে হয় কী, নিজেদের যৌবনকে মুক্তমনার দোহাই দিয়ে অবাধ মেলামেশার মাধ্যমে নষ্ট সম্পর্কের সূচনা করা।

তারা এই পথের পথিক না হত যদি না হত সামাজিক অবস্থা অসামাজিকতার সয়লাবে। সাধারণভাবে চিন্তা করলে বিষয়টি বুঝে আসে। একজন ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হয় ১২-১৪ বছর বয়সে আর বিয়ে করে প্রায় ৩০-৩৫ বছর বয়সে, তাহলে পূর্ণযৌবনতার সাথে কতবছর পার্থক্য হয়ে গেল! একজন মেয়ে সাবালেক হয় ৯-১২ বছর বয়সে আর বিয়ে হয় ১৮-২৫ বছর বয়সে।

এর মাঝে নিজেদের যৌবনের খোরাক মিটাতে না পেরে তারা যার শরণাপন্ন হয়, তা হল, অবৈধ প্রেমময় বন্ধন।

এই অভিশপ্ত সম্পর্ক থেকে বাঁচনোর উপায় একালে নেই বললে, একটু বেশি হবে কি? মোটেই না। আচ্ছা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা করে না যারা, ইউটিউব, গুগল ইত্যাদিতে নষ্টামিতে সময় কাটাই তারা। তবে যারা ইমাম শাফেয়ীর মতকে প্রাধান্য দিয়ে এবাদতে চির কুমার হয়ে থাকতে চান, তারা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। মাযহাব বর্ণনা আমার উদ্দেশ্য নই।

সমাজ উন্নয়নে নারীদের অগ্রণী ভূমিকার কথা বলে পারিবারিকভাবে নারী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করছে অনেকে।

আমরাও বলছি না যে, নারীশিক্ষা না জায়েয, তবে সম্পূর্ণ পর্দার ভেতরে মহিলা মাদরাসার মতো হওয়া চাই, কারণ বিদ্যার্জন যেমন- ফরয, পর্দা করা আরোও বড় ফরয, আমার গবেষণা। যে শিক্ষাঙ্গনে পর্দা মুখ্য বিষয় নয়, সেই প্রতিষ্ঠানে পড়া ঐচ্ছিকও নয়।

মাবাবা থাকেন গ্রামে ছেলেমেয়েকে পাঠান শহরে বিদ্যা শিক্ষার জন্য, কিন্তু বেচারা আর বেচারি নিজের যৌবনের কাছে হার মেনে প্রেমলীলার পাশাপাশি লীভটুগেদারেও (অবৈধভাবে একসাথে বাস করা) বাধ্য হয়!

দোষ তাদের নয়, আমাদের। এসবের পাপের বোঝা অভিভাবকরাই বহন করবেন। আল্লাহ আমাদের বুঝবার তাওফিক দান করেন।

৭. বন্ধুত্বে সমীকরণ

আমরা একটু আগেই বলেছি যে, কারোর সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ প্রকাশের পূর্বে চিন্তা করতে হবে, কার বন্ধুত্ব আমাকে ধন্য করবে, আর কার বন্ধুত্ব আমাকে অপমানিত করবে? আবার বয়সের বিষয়টিও সমানে সামনে রাখতে হবে।

বামধারার লেখক-সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখতে পাই আমরা। তারা মেয়ে আর নাতনীর বয়সী মেয়ের সাথে অ্যাফেয়ার্স করে বসে! এ কোনো বন্ধুত্ব নই, বরং এটা বদমায়েশি এবং অসামাজিকতার পরিচায়ক। যদি অমুসলিম হয় তাহলে তো বন্ধুত্বের প্রশ্নই উঠে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

اِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللّٰهُ وَرَسُوْلُهٗ وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوا الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَ يُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَ هُمْ رٰكِعُوْنَ۰۰۵۵

‘‘তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে বিনীত হয়ে। (সূরা আল-মায়িদা: ৫৫)

একথা বলে পয়েন্টটি শেষ করতে চাই যে, জীবনপথে চলার ক্ষেত্রে বন্ধুর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

৮. সময়মত বিয়ে না দেওয়া

(আগের আলোচনার সাথে) আমাকে (যৌবন) নিয়ে হাশরের মাঠেও প্রশ্ন করা হবে। পাঁচ প্রশ্নের একটি হল, তোমার যৌবন কোথায় ধ্বংস করেছো? সোয়াল আসবে। উত্তর যেন সুন্দর আসে, তার জন্য বলছি, আমাকে (যৌবনকে) অপমানের গ্লানি থেকে নিরাপদ রেখে নিজেদের ভবিষ্যৎকে সুন্দর ও উজ্জ্বল করার প্রতি ব্রতি হোন।

৯. গৌরবোজ্জ্বল কিছু যুবক

আমি (যৌবন) এমন কিছু যুবক নিয়ে গর্ব করি, যারা তাদের যৌবনকে সম্মান করেছে, মর্যাদা দিয়েছে।

তাই তারা ভবিষ্যতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের চেয়েও বেশি আলোকিত হয়ে আছে, থাকবে ইতিহাসের পাতায়।

যেমনিভাবে আলোকিত ভবিষ্যৎ হিসেবে আলোচনা করতে পারি ইবনে জাওযীর কথা। তারা বর্তমানকে যত্ন করেছে, তাই ভবিষ্যৎও তাদের যথেষ্ট সম্মান করে।

আল্লামা জাওযী (রহ.)-এর ওয়াজ মাহফিল গোটা বাগদাদকে অভিভূত ও মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। এক একটি ওয়াজ মাহফিলে লক্ষ পর্যন্ত লোক হত। দশ-পনের হাযার লোকের কম কোনো মাহফিলেই দেখা যেত না। তাঁর হাতে তাওবাকারীদের কোনো সীমা-সরহদ ছিল না। পরিমাপ করে দেখা গেছে, বিশ হাযার ইহুদী ও খ্রিষ্টান তাঁর হাতে মুসলমান হয়েছিল এবং এক লক্ষের মত লোক তওবাহ করেছিল।’ (সূত্র: সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, খ. , পৃ. ২৩৮)

ইমাম বুখারী (রহ.) তাদের একজন। তিনি চৌদ্দ বছর বয়সে হাদিসের জন্য ভ্রমণ শুরু করেন। বুখারা থেকে মিসর পর্যন্ত সকল রাষ্ট্র তিনি চিরুনির ন্যায় আঁচড়ে ফেলেন। আবু হাতিম রাযী (রহ.) বলেন, আমি নয় হাযার মাইলের বেশি দূরত্ব পদব্রজে অতিক্রম করি। এরপর আমি মাইলের হিসাব গণনা করা ছেড়ে দিই।’ স্পেনের মুহাদ্দিস ইবনে হায়ওয়ান স্পেন, ইরাক, হিজায ও য়ামানের শায়খগণের থেকে হাদিস গ্রহণ করেন।

মোটকথা তিনি তুঞ্জা থেকে সুয়েজ পর্যন্ত গোটা আফ্রিকা মহাদেশ, অতঃপর লোহিত সাগর পাড়ি দেন। (সূত্র: সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস,খ. , পৃ. ৮৫)

শায়খ মহিউদ্দিন (রহ.) বলেন, ‘আমি পড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সবধরনের ব্যাখ্যা লিখে রাখতাম। যে কোনো অস্পষ্ট শব্দের অর্থ ও মর্ম, যে কোনো অস্পষ্ট বাক্যের বিশ্লেষণ। যে কোনো জটিল কঠিন শব্দের ভাষাগত ব্যবধান ও পার্থক্য লিখে রাখতাম।’ (সূত্র: ইলমের ভালোবাসায় চিরকুমার, আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, পৃ. ১৮২)

তবে দুঃখের সাথেই বলতে হয়, আমাদের অনেক ছাত্রভাইকে দেখা যায় সবক বা দরসে অমনোযোগী হয়ে নানা চিন্তায় বিভোর থাকতে। আপানাদের মাঝে যে যৌবন, তাদের মধ্যেও একই যৌবন ছিল।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ