সীরাতে রাসূল (সা.) অধ্যয়নে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে
আফসোসের সাথে বলতে হয় বাংলাদেশি অধিকাংশ মুসলমানের ঘরে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন, কর্ম ও অবদানের উপর রচিত কোন সীরাত গ্রন্থ নেই। পবিত্র কুরআনের তাফসীর ও সাহাবায়ে কেরামের আলোকিত জীবনালেখ্য থাকার তো প্রশ্নই আসে না। অথচ প্রতিটি মানুষের হাতে এনড্রয়েড ও আইফোনসহ দামি মোবাইল আছে। ঘরে আছে টিভি, ফ্রিজ, ওভেন ও ফার্ণিচার। গল্প উপন্যাসের বইতে বুকসেল্প ভর্তি। আমরা আমাদের নবীজীর ঈমান-আমলের মেহনত, ইবাদাত-মুয়ামালাত, জীবন সংগ্রাম, সমাজ পরিবর্তন, দাওয়াত-তাবলিগ, রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিগত জীবনাচার সম্পর্কে জানতে অনাগ্রহী। এটি নিসন্দেহে দেওলিয়াপনার বহিঃপ্রকাশ। আত্মপরিচয়ের ঘাটতি। বাংলাদেশি ও বিদেশি বিজ্ঞ লেখকদের রচিত এবং অনুদিত প্রামাণিক সীরাতগ্রন্থ সারাদেশের লাইব্রেরীতে শোভা পাচ্ছে। না পড়লে আমরা জানবো কী করে? ওয়ায ও সীরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলে সীরাতের উপর যে আলোচনা ও বয়ান হয় তা ক্ষণস্থায়ী। সুন্নাত ও আদর্শ অনুসরণের জন্য ধারাবাহিক ও দীর্ঘস্থায়ী পর্যালোচনা আবশ্যক। এটা পাওয়া যেতে পারে সীরাতগ্রন্থ অধ্যয়নের মাধ্যমে। আল-হামদু লিল্লাহ রবিউল আওয়াল মাস আসলে সারা দেশে ওয়ায, সীরাত (মাহফিল পালনের বাড়তি ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়। বাকি ১১ মাস এ তৎপরতা সীমিত হয়ে পড়ে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ও সাধনা মানবজাতির জন্য উৎকৃষ্ট আদর্শ ও পাথেয়। পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ব্যক্তি বিশেষত কার্লাইল, জর্জ বার্নার্ড শ, ওয়াট, উইলিয়াম ম্যুর, মহাত্মা গান্ধী মহানবী (সা.)-এর জীবনী অধ্যয়ন শেষে যেসব মন্তব্য করেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। আইরিশ ঔপন্যাসিক জর্জ বার্নার্ড শ ও মহাত্মা গান্ধীর মন্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য:
‘মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি আমি সবসময় সুউচ্চ ধারণা পোষণ করি কারণ এর চমৎকার প্রাণবন্ততা। আমার কাছে মনে হয় এটাই একমাত্র ধর্ম যেটা সদা পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে যা প্রত্যেক যুগেই মানুষের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম। আমি তাঁর (মুহাম্মদ) সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছি, চমৎকার একজন মানুষ এবং তাঁকে অবশ্যই মানবতার ত্রাণকর্তা বলতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি তাঁর মতো ব্যক্তির নিকট যদি আধুনিক বিশ্বের একনায়কতন্ত্র অর্পণ করা হতো তবে এর সমস্যাগুলো তিনি এমনভাবে সফলতার সাথে সমাধান করতেন যা বহু প্রতিক্ষীত শান্তি ও সুখ আনয়ন করতো। আমি ভবিষ্যতবাণী করছি যে মুহাম্মদের ধর্মবিশ্বাস আগামীদিনের ইউরোপের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, যা ইতোমধ্যে বর্তমান ইউরোপে গ্রহণযোগ্যতা পেতে আরম্ভ করেছে।’ (Sir George Bernard Shaw in The Genuine Islam, Vol. 1, No. 8, 1936 )
‘আমি জীবনগুলোর মধ্যে সেরা একজনের জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম যিনি আজ লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে অবিতর্কিতভাবে স্থান নিয়ে আছেন। যেকোন সময়ের চেয়ে আমি বেশি নিশ্চিত যে ইসলাম তরবারির মাধ্যমে সেইসব দিনগুলোতে মানুষের জীবন-ধারণ পদ্ধতিতে স্থান করে নেয়নি। ইসলামের প্রসারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবীর দৃঢ় সরলতা, নিজেকে মূল্যহীন প্রতিভাত করা, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক ভাবনা, বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য নিজেকে চরমভাবে উৎসর্গ করা, তাঁর অটল সাহস, ভয়হীনতা, ঈশ্বর এবং তাঁর (নবীর) ওপর অর্পিত দায়িত্বে অসীম বিশ্বাস। এ সব-ই মুসলমানদেরকে সকল বাধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। যখন আমি মুহাম্মদের জীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড বন্ধ করলাম তখন আমি খুব দুঃখিত ছিলাম যে এই মহান মানুষটি সম্পর্কে আমার পড়ার আর কিছু বাকি থাকলো না।’ (Mahatma Gandhi, statement published in Young India, 1924.)
সীরাতচর্চাকে ব্যাপকতা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। দেশব্যাপী সীরাত অ্যাওয়ার্ড, রচনা প্রতিযোগিতা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে ওলামা-মাশায়েখ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন