মাদকের ভয়াল থাবা: আক্রান্ত যুবসমাজ
মুফতী মুহাম্মদ নোমান কাসেমী
প্রতিটি দেশের তরুণ ও যুবসমাজ সে দেশের সম্পদ। যুবসমাজ বিপথগামী হলে দেশ ও জাতির অধ:পতন নেমে আসে। যুবক বয়সের যেমন ভাল দিক আছে, তেমনি মন্দ দিকও আছে। তরুণ ও যুবসমাজকে ভাল কাজে নিয়োজিত করতে পারলে অনেক সুফল আশা করা যায়। তরুণ ও যুবসমাজ দেশ ও দেশের কল্যাণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত দু:খজনক বিষয় হলো, বর্তমানে তরুণ ও যুবসমাজ অনেকটাই বিপথগামী।
সাংসারিক টানাপোড়েন, বেকারত্ব, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে না-পারার দুঃসহ যন্ত্রনা থেকেই আসে হতাশা। হতাশা থেকেই যুবসমাজের এ বিপথগামীতা। তাই মাদকাসক্তরা ভাবে, সাংসারিক সকল ঝামেলা থেকে নিস্কৃতি পেতে হলে মাদকসেবনই বুঝি উত্তম পন্থা। এই ভুল ধারণাই তাদের জীবনে এক সময় কাল হয়ে দেখা দেয়। জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতকে জয় করার মানসিকতা হারিয়ে তারা উদ্ভ্রান্তের মত হয়ে যায়। আখের সমাজের কাছে, পরিবার-পরিজনের কাছে তারা হয়ে উঠে বোঝা। এক পর্যায়ে তারা নিজের জীবনকে মূল্যহীন ভাবতে শুরু করে।
মাদকের নেশা আত্মঘাতী, যা সমাজ, দেশ, মনুষ্যত্ব সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী ডেকে আনছে বিপর্যয়। ব্যক্তিজীবনে যেমন মাদক স্বাস্থ্য, সম্পদ, মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি নষ্ট করে ব্যক্তিকে করে তোলে সমাজের ঘৃণা ও নিন্দার পাত্র, তেমনি তাদের মাঝে দেখা দেয় অস্বাস্থ্য, অলসতা, অকর্মন্যতা এবং সামাজিক অপরাধের সীমাহীন নিষ্ঠুরতা। ধ্বসে যায় তার রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরি, সামাজিক মূল্যবোধের মতো বহু অমূল্য গুণগুলো। এ নেশার কারণেই বিশ্ব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সর্বজনীন মূল্যবোধ, প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধা-ভক্তি সৌহার্দ্য ও ভ্রাতিৃত্ববোধ। তাই মাদক কেবল ব্যক্তিজীবন নয়, সমাজ ও সমষ্টিজীবনেও ডেকে আনছে বিপর্যয়।
বর্তমান বাংলাদেশে মাদকের নেশায় তলিয়ে যাচ্ছে ছাত্র-যুবক তথা তরুণ প্রজন্ম। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। মাদকের ভয়াল থাবায় ধ্বংসের মুখে যুবসমাজ। বর্তমানে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের দিকে মাদকসেবীদের আকর্ষণ বেশি। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর হাজারো মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ছে মাদকে। কিছু মাদক ব্যবসায় নারীদেরকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের নিস্ক্রিয়তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদাসিনতা, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, মাদকের সহজলভ্যতা, মাঝে মাধ্যে র্যাব ও পুলিশের অভিযানে মাদকদ্রব্য সেবন কিংবা বিক্রির দায়ে গ্রেফতারকৃতরা সহজে জামিনে বেরিয়ে আসাসহ বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সচেতন মহলের ধারণা।
বিশিষ্টজনদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের নাম ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এসব মাদক বিক্রির তালিকায় প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানেরা জড়িত রয়েছে। প্রভাবশালীদের কারণে প্রশাসনও নীরব থাকতে বাধ্য হচ্ছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের টাকায় কেনা হয় মাদক। আর ডেলিভারি ম্যানের সাহায্যে মাদক পৌছে দেয়া হয় বিভিন্ন খুচরা বিক্রেতাদের কাছে, খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ভ্রাম্যমান বিক্রেতারা মাদকদ্রব্য বিভিন্ন স্পটে বিক্রি করে ।
পুলিশকে ম্যানেজ করে মাদক ব্যবসা চলে এমন অভিযোগও রয়েছে। জেলা-উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যন্ত মাদকের ছড়াছড়ি হলেও মাদক ব্যবসায়ীরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। এসব মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে স্কুল, কলেজের তরুণ ছাত্ররা। যার ফলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সর্বস্তরের অভিভাবকরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন বাস টার্মিনাল, বিসিক এলাকা, ফুটপাত, বস্তি, হাট-বাজার, পার্কের আশপাশ ও আবাসিক হোটেলসহ বহু স্পটে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মাদক দ্রব্য।
মাদক ব্যবসায়ীরা স্কুল-কলেজের ড্রেস পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সাধু সেজে একাজ করছে, যাতে সহজে তাদেরকে চেনা না যায়। সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় মটর সাইকেল, সিএনজিসহ বিভিন্ন বাহনের মাধ্যমে ভ্রাম্যমান মাদক বিক্রেতারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। দলীয় পরিচয়ে উঠতি বয়ষের তরুণ ও যুবকরা শহরে অনেক রাত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা ও মহল্লায় মাদক সেবন করে। জনশ্রুতি রয়েছে, জনপ্রতিনিধি-রাজনৈতিক ও পেশাজীবি সংগঠনের অনেকেই মাদকের সাথে সম্পৃক্ত। এলাকায় তরুণ ও যুবক মাদক সেবীদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধির ফলে অভিভাবক মহল উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠায় রয়েছেন। অভিভাবক মহল মাদকদ্রব্যের মরন ছোবল থেকে আদরের সন্তানদের বাঁচাতে চান।
বাংলাদেশে মাদক
বাংলাদেশে আফিম ও ভাং এর প্রচলন সুপ্রাচীন। বিগত তিন দশকে হেরোইন, এম্ফিটামিন, কোকেন এবং নানা ভেষজ ওষুধ রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে প্রবেশ করেছে, যা অবৈধ ড্রাগের ভয়াবহতাকে আরও উষকে দিয়েছে। এক সময় মায়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ড কিংবা আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তান থেকে অবৈধ মাদক বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে শুধু পাচার হতো। কিন্তু আজকের বাংলাদেশের চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বাংলাদেশে কর্মরত এক বেসরকারি সংস্থা ২০১৪ এর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লক্ষ নেশাসক্ত মানুষ রয়েছে। যার মধ্যে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের সংখ্যাই বেশী। ক্রমবর্ধমান এই সংখ্যাটি ক্রমশ শহরতলি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের ড্রাগ ও অপরাধ নিবারক সংস্থা যৌথভাবে অবৈধ ড্রাগ সেবন সংক্রান্ত বিষয় পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১২ থেকে ১৮ বছরের কিশোরদের মধ্যে অ্যালকোহল ২১.৪ শতাংশ, ভাং ৩ শতাংশ, আফিম ০.৭ শতাংশ এবং অন্যান্য অবৈধ ড্রাগ ৩.৬ শতাংশ সেবনের প্রবণতা দেখা গেছে।
নেশা করার একটি ভয়াবহ মাধ্যম হচ্ছে ইঞ্জেকশন। সমপ্রতি একটি রিপোর্টে এ-বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হয়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হেরোইন, বুপ্রেনরফিন এবং প্রোপক্সিফেন এর মিশ্রণ ইঞ্জেকশন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রোক্সিভন নামক ঔষুধও ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একটি ইঞ্জেকশনের বহু ব্যবহারের ফলে নেশাসক্তদের মধ্যে এইচআইভি-এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রচন্ড বেড়ে যায়। বর্তমানে ইয়াবার প্রচলন জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায়, ইদানিং যুবতীরাও মাদকাসক্ত হয়ে বিপথে পরিচালিত হচ্ছে।
নেশা সমাজের ব্যপকভাবে প্রধানত পাঁচটি অংশকে অর্থনৈতিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই অংশগুলো হচ্ছে স্বাস্থ্য, উৎপাদন, অপরাধ, নিরাপত্তা, এবং সরকারি কার্যপ্রণালী।
নেশাগ্রস্ত লোকেরা শুধু নিজের ক্ষতি করে এমন নয়, পারিপার্শ্বিক মানুষের নিরাপত্তাও সঙ্কটাপূর্ণ করে তোলে। নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালালে পথ দুর্ঘটনায় চালকের যেমন ক্ষতি হয়, পথযাত্রীদের সমান খেসারত দিতে হয়।
বর্তমান বিশ্বে মাদক দ্রব্য পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ তরুণ-তরুণীদের জীবন। ধ্বসিয়ে দিচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল। সেই সাথে মাদক ব্যবসা বর্তমান বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় চোরাকারবারীরা এই ব্যবসার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে। তাছাড়া ভৌগোলিক কারণে এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক রুট। অধিকন্তু পার্শ্ববর্তী বৃহৎ রাষ্ট্রটি ইচ্ছাকৃতভাবে এদেশের উঠতি বয়সের তরুণদের ধ্বংস করার নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য তাদের সীমান্তে অসংখ্য হেরোইন ও ফেনসিডিল কারখানা স্থাপন করেছে এবং সেখানকার উৎপাদিত সব মাদক দ্রব্য এদেশে ব্যাপকভাবে পাচার করছে। এছাড়া স্থল, নৌ ও বিমান পথের কমপক্ষে ৩০টি রুট দিয়ে এদেশে মাদক আমদানী ও রফতানী হচ্ছে। ফলে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সরকারী মাদক অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের মোট মাদকাসক্তের ৯০ শতাংশই কিশোর, যুবক ও ছাত্র-ছাত্রী। যাদের ৫৮ ভাগই ধূমপায়ী। ৪৪ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। খুবই বিস্ময়কর তথ্য হলো, দেশের মোট মাদকসেবীর অর্ধেকই উচ্চ শিক্ষিত। এভাবে ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও দিন-মজুর, বাস-ট্রাক, বেবিট্যাক্সি ও রিকশাচালকদের মধ্যেও রয়েছে ব্যাপকভাবে মাদকাসক্তি। আর এটা জানা কথা যে, মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
মাদক সেবনের সূচনা যেভাবে হয়
অনেকেই মদের পক্ষাবলম্বন করে বলেন, পার্টি-পরিবেশে একটু আধটু হলে ভালোই লাগে। আমাদের দৌড় ওই পর্যন্তই। এক কি দু’ঢোক। আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখি, আমরা মাতাল হই না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
দীর্ঘ অনুসন্ধানের ফলাফল এই যে, প্রত্যেকটি মদ্যপ মাতালই প্রাথমিক পর্যায়ে সৌখিন পানকারী ছিল। এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে মদ্যপ বা মাতাল হয়ে যাবার জন্য মদ পান শুরু করেছিল। অপরদিকে কোনো সৌখিন মদ পানকারীই একথা বলতে পারবে না যে, দীর্ঘ দিন যাবত এভাবেই দুয়েক ঢোক করেই খেয়ে এসেছি। কোনো দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাইনি। আর মাতাল হলে কেমন লাগে সে স্বাদও পাইনি।
জীবনে একবারও যদি কেউ মাতাল হয়ে লজ্জাস্কর কোনো কাজ করে থাকে সে স্মৃতি তাকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ভোগাবে।
ধরুন, কোনো সৌখিন সামাজিক মদপানকারী, জীবনে মাত্র একবার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাতাল হয়েছিল। আর সেই দিনই তার দ্বারা ধর্ষণ বা আপনজন কারো ওপরে যৌন অত্যাচারমূলক কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে যদি সে, সেই কাজের জন্য দুঃখ প্রকাশ, বা ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ক্ষমা পেয়েও গিয়ে থাকে, তবুও সুস্থ ও স্বাভাবিক একজন মানুষকে সারাজীবনই সে স্মৃতির যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, যে করেছে সে এবং যার ওপর সংঘটিত হয়েছে সে। উভয়কেই এই অপুরণীয় ও অপরিবর্তনীয় ক্ষতির ভোগান্তি পোহাতে হয়।
মাদকের কুফল
মানুষের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সবদিকেই মাদকের কুফল রয়েছে। অতি সংক্ষিপ্তাকারে আমরা এখানে মাদকের কুফলগুলো তুলে ধরছি।
শারীরিক কুফল
(ক) ফুসফুস আক্রান্ত হওয়া। ব্রঙ্কাইটিস, যক্ষ্মা, ক্যান্সার, হৃৎপিন্ড বড় হওয়া, হার্ট ব্লক, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি।
(খ) পাকস্থলী ও পরিপাকতন্ত্র আক্রান্ত হওয়ার ফলস্বরূপ অরুচি, এ্যাসিডিটি, আমাশয়, আলসার, কোষ্ঠকাঠিন্য, কোলন ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ হয়।
(গ) প্রজননতন্ত্র আক্রান্ত হওয়া। ফলে যৌনক্ষমতা হ্রাস, বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী বা খুঁৎওয়ালা সন্তান জন্মদান, সিফিলিস, গণোরিয়া, এইডস প্রভৃতি দূরারোগ্য ব্যাধির সম্ভাবনা দেখা দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন চর্মরোগ হতে পারে। সর্বোপরি শরীরের সার্বিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে যেকোন সময় যেকোনো ধরনের জীবাণু দ্বারা সহজেই একজন মাদকসেবী আক্রান্ত হয়। অনেক মাদকদ্রব্য আছে, যা সেবনে কিডনী বিনষ্ট হয়। মস্তিষ্কের লক্ষ লক্ষ সেল ধ্বংস হয়ে যায়। কোন চিকিৎসার মাধ্যমে যা সারানো সম্ভব হয় না। এর ফলে লিভার সিরোসিস রোগের সৃষ্টি হয়, যার চিকিৎসা দুরূহ।
বিশেষজ্ঞদের মতে মাদক ও ভেজাল খাদ্যের কারণেই মরণব্যাধি লিভার ও ব্লাড ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত বেগে। ফলে বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত।
মানসিক কুফল
মাদকের প্রভাবে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে তার মধ্যে পাগলামি, অমনোযোগিতা, দায়িত্বহীনতা, অলসতা, উদ্যমহীনতা, স্মরণশক্তি হ্রাস, অস্থিরতা, খিটখিটে মেজাজ, আপনজনের প্রতি অনাগ্রহ এবং স্নেহ-ভালোবাসা কমে যাওয়া ইত্যাদি আচরণ প্রতিভাত হয়।
সামাজিক কুফল
প্রাথমিকভাবে তার বন্ধুদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ছোটদের প্রতি স্নেহ কমে আসে। অতঃপর সে ক্রমে নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। সে যেকোনো সুযোগে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। হেন কোন অপকর্ম নেই, যা তার দ্বারা সাধিত হয় না। দুষ্ট লোকেরা টাকার বিনিময়ে সর্বদা এদেরকেই ব্যবহার করে থাকে। এরা সর্বদা মানুষের ঘৃণা কুড়ায় ও সমাজে নিগ্রিহীত হয়।
অর্থনৈতিক কুফল
বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে প্রতি বছর কেবল মাদকের কারণে বিশ্বব্যাপী ২০০ বিলিয়ন ডলার (১৬২০০ বিলিয়ন টাকা) ক্ষতি হয়। ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে মাদক জাতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের বেশী ব্যয় হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা-এর হিসাব মতে বিশ্বে প্রতিদিন ৪৪ হাজার লোক মাদকজনিত কারণে মারা যায়। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, প্রতি বছর খুন, রাহাজানি, আত্মহত্যা, সড়ক ও বিমান দুর্ঘটনা ও অন্যান্য কারণে মৃত্যু সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী মৃত্যু হয় মাদকের কারণে’।
উপরে বর্ণিত শুধুমাত্র মাদকের ক্ষতির হিসাবের সাথে অন্যান্য মাদক দ্রব্য ও জুয়ার হিসাব যোগ করলে দেখা যাবে যে, বিশ্বের সকল আর্থিক ক্ষতির মধ্যে সিংহভাগ ক্ষতি হয় মদ ও জুয়ার কারণে। বর্তমান যুগে ক্রিকেট জুয়া যার শীর্ষে অবস্থান করছে। অথচ মানুষ যদি আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা মানত, তবে তারা এই চূড়ান্ত ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যেত।
ইসলামে মদ্যপান হারাম
মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সর্বোত্তম অনুগ্রহ হলো ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম। যা দ্বারা তিনি মানুষকে শয়তানের পাতা বহু লোভনীয় ফাঁদ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন। তাই কুরআনে বর্ণিত জীবন যাপন পদ্ধতিকে দীনুল ফিতরাহ’ বা মানুষের স্বভাবজাত জীবনব্যবস্থা বলা হয়। এর সকল বিধি-নিষেধের আসল উদ্দেশ্য মানব জাতিকে সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা। মদ মানুষকে তার প্রকৃতগত স্বভাবের ওপর দাঁড়াতে দেয় না। একথা স্বতন্ত্র কোনো ব্যক্তির বেলায় যেমন সত্য তেমনি বৃহত্তর কোনো সমাজের বেলায়ও। মদ মানুষের মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত করে পশুর কাতারে নিয়ে আসে, অথচ মানুষ হলো সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠতম। সর্বোপরি ইসলামে মদ বা নেশা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হারাম।
ইসলামে ঘোষিত হারাম দ্রব্যগুলোর ওপর যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, দীর্ঘ গবেষণা আর আলোচনা পর্যালোচনার পর তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এর মধ্যে সত্যিই ধ্বংসাত্মক পরিণতি রয়েছে। সাময়িক বা ছোটখাটো কোনো কল্যাণ থাকলেও তা সময়ের ব্যবধানে ক্ষতিরই কারণ হয়ে দেখা দেয়। যে দ্রব্য জ্ঞান-বুদ্ধি হ্রাস করে দেয়, নেশা সৃষ্টি করে, ধ্বংস করে মানবীয় গুণাবলি এবং ধ্বংস করে সমাজ ও সভ্যতাকে, তা-ই মাদক। তাইতো ইসলামে তা পুরোপুরি হারাম ঘোষণা করেছে। দেড় হাজার বছর আগেই প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত দরদি ও কঠোর কণ্ঠে আহ্বান করেছেন, মাদককে রুখে দাঁড়াও। সুস্থ সুন্দর সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলো।
শুরুতে ইসলামের মাদকবিরোধিতা পাশ্চাত্য দেশগুলোতে উপহাসের ব্যাপার ছিল। তারা নেশায় বুঁদ হয়ে তুলে ধরেছিল নিজেদের বেহায়াপনা, নোংড়ামি ও নানা ধরনের সভ্যতাবিবর্জিত অমানসিক আচরণ। তারা ইসলামের শাশ্বত কল্যাণকর বাণীগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। অথচ এখন সর্বস্তরে মাদকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। মাদকবিরোধী জনমত গঠনে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই নানা ফোরাম গড়ে উঠেছে। এসবের মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে, ইসলামই চিরসত্য সুমহান আদশের্র নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম ইসলামই মাদক রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারে আহ্বান করেছিল। প্রথমে মাদকবিরোধী আদর্শিক এবং চিন্তার আন্দোলন শুরু করে, পরে সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ইসলাম মাদকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান তুলে ধরে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْاَنْصَابُ وَالْاَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطٰنِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ۰۰۹۰ اِنَّمَا يُرِيْدُ الشَّيْطٰنُ اَنْ يُّوْقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَآءَ فِي الْخَمْرِ وَ الْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ وَعَنِ الصَّلٰوةِ١ۚ فَهَلْ اَنْتُمْ مُّنْتَهُوْنَ۰۰۹۱
‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তি এবং ভাগ্যনির্ধারক স্বরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব এগুলো বর্জন করো, তাহলে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পারবে। শয়তান চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হোক এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। তবু কি তোমরা নিবৃত হবে না?’ (সূরা আল-মায়িদা: ৯০-৯১)
উপর্যুক্ত আয়াতে প্রধান চারটি হারাম বস্তু হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাহলো যথা, মদ, জুয়া, মূর্তি এবং ভাগ্যনির্ধারক স্বর ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, সূরা মায়েদাহ কুরআনের শেষ দিকে নাযিল হওয়া সূরাসমূহের অন্যতম। অতএব এখানে যে বস্তুগুলো হারাম ঘোষিত হয়েছে, সেগুলো আর মনসুখ হয়নি। ফলে তা কিয়ামত পর্যন্ত চিরন্তন হারাম হিসাবেই বাকি থাকবে। অসংখ্য নিষিদ্ধ বস্তুর মধ্যে এখানে প্রধান চারটির উল্লেখ করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, এ চারটি হারাম বস্তু আরও বহু হারামের উৎস। অতএব এসব বন্ধ হলে অন্যগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে।