গান-বাজনার ব্যাপারে ইসলামের হুকুম
আখতারুজ্জামান মুহাম্মদ সুলাইমান
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা সেগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে।’ [সূরা লুকমান: ৬]
বেশির ভাগ তাফসীরকারকগণ এই আয়াতে ব্যবহৃত আরবি শব্দ লাহওয়াল হাদীস বলতে গানকে বুঝিয়েছেন। সাহাবাদের ভেতর ওলামা, ফুকাহা ও মুফাসসিরীন হিসেবে পরিচিত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং হযরতআবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.)-এই তিনজনেই এই আয়াতকে বাদ্য-বাজনা হারাম হওয়ার দলীল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ইমাম হাসান আল-বাসারী (রহ.) বলেন, তা গান ও বাদ্য শানে নাযিল হয়েছে। [তাফসীর ইবনে কসীর, ৩/৪৫১]
আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমার কণ্ঠ দিয়ে তাদের মধ্যে যাকে পারো প্ররোচিত কর।’ [সূরা আল-ইসরা: ৬৪]
ইসলামে বাদ্য-বাজনা হারাম এবং যারা একে হালাল মনে করে তারা আল্লাহর চরম অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়:
রাসূল (সা) বলেছেন, ‘আমার উম্মাতের মাঝে এমন কিছু লোক আসবে যারা ব্যভিচার, পশম, মদ ও বাদ্য-যন্ত্রকে হালাল করে নেবে।’ [সহীহ আল-বুখারী: ৫৫৯০]
এই সহীহ হাদীস পরিষ্কার বলে দিচ্ছে যে, বাদ্য-যন্ত্র হারাম। যারা হারামে লিপ্ত হবে তারা গুনাহগার হবে আর যারা হারামকে হালাল করে নেবে তারা কুফরিতে লিপ্ত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন নারী ও পুরুষকে এটি শোভা পায়না যে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয় নির্ধারন করে দিবেন তখন তারা এর বিরোধিতা করবে। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে সে অবশ্যই বড়ই ভুলের মধ্যে নিপতিত হবে।’ [সূরা আল-আহযাব: ৩৬]
গান-বাজনার ক্ষতিকর দিকসমূহ
ইসলাম কোন জিনিসের মধ্যে ক্ষতিকারক কোন কিছু না থাকলে তাকে হারাম করেনি। গান ও বাজনার মধ্যে নানা ধরনের ক্ষতিকর জিনিস রয়েছে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এ সম্বন্ধে বলেন, বাজনা হচ্ছে নফসের মদ স্বরূপ| মদ যেমন মানুষের ক্ষতি করে, বাদ্যও মানুষের সেই রকম ক্ষতি করে। যখন গান-বাজনা তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, তখনই তারা শিরকে পতিত হয়। আর তখন তারা ফাহেশা কাজ ও জুলুম করতে উদ্যত হয়। তারা শিরক করতে থাকে এবং যাদের কতল করা নিষেধ তাদেরকেও কতল করতে থাকে। যিনা করতে থাকে। যারা গান-বাজনা করে তাদের বেশির ভাগের মধ্যেই এই তিনটি দোষ দেখা যায়। তাদের বেশির ভাগই মুখ দিয়ে শিস দেয় ও হাততালি দেয়। [মাজমু’ আল-ফাতওয়া, ১০/৪১৭]
শিরকের নিদর্শন: তাদের বেশির ভাগই তাদের শায়খ (পীর) অথবা গায়কদের আল্লাহরই মতই ভালবাসে অথবা আরো অধিক।
ফাহেশার মধ্যে আছে: গান হল যিনার রাস্তাস্বরূপ। এর কারণেই বেশির ভাগ ফাহেশা কাজ অনুষ্ঠিত হয় গানের মজলিসে। ষেখানে পুরুষ, বালক, বালিকা ও মহিলা চরম স্বাধীন ও লজ্জাহীন হয়ে পড়ে। এভাবে গান শ্রবণ করতে করতে নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনে। তখন তাদের জন্য ফাহেশা কাজ করা সহজ হয়ে দাঁড়ায়, যা মদ্যপানের সমতুল্য কিংবা আরও অধিক।
কতল বা হত্যা: অনেক সময় গান শ্রবণ করতে করতে উত্তেজিত হয়ে একে অপরকে কতল করে ফেলে। তখন বলে, তার মধ্যে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল যে জন্য হত্যা করা ছাড়া উপায় ছিল না। তা হতে বিরত থাকা তার ক্ষমতার বাইরে ছিল। আসলে এই সময়ে মজলিসে শয়তান উপস্থিত হয়। আর যাদের উপর শয়তান বেশি শক্তিশালী, তারা অন্যদের কতল করে ফেলে। গান-বাজনা শ্রবণে অন্তরের কোন লাভ হয় না, তাতে কোন উপকারও নেই বরঞ্চ ওতে আছে গোমরাহী এবং ক্ষতি, যা লাভের থেকেও বেশি ক্ষতিকর। উহা রুহের জন্য সে রকম ক্ষতিকর যেমন মদ শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ফলে যারা সঙ্গীত শ্রবণ করে, তাদের নেশা মদ্যপায়ীর নেশা থেকেও অনেক বেশি হয়। তারা ওতে যে মজা পায়, তা মদ্যপায়ীর থেকেও অনেক বেশি। শয়তানও তাদের নিয়ে খেলা করে।
পীর-সূফিদের বিদআতী গানের আসরে শরীয়ত বিরোধী অদ্ভুত কর্মকাণ্ড
এই অবস্থায় শয়তানও তাদের নিয়ে খেলা করে। তারা আগুনে প্রবেশ করে, কেউ গরম লোহা শরীরের মধ্যে কিংবা জিহবায় প্রবেশ করায় অথবা এ জাতীয় কাজ করে। তারা সালাত আদায়ের সময় অথবা কোরআন তেলাওয়াতের সময় এই রকম অবস্থা প্রাপ্ত হয় না। কারণ এগুলি শরীয়ত সম্মত ইবাদত, ঈমানী কাজ, রাসূলের (সা.) কাজ, যা শয়তানকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর অন্যগুলো ইবাদতের নামে বিদআত। এতে আছে শিরক ও শয়তানী কাজ, দার্শনিকের কাজ, যাতে শয়তানরা সহজেই আকৃষ্ট হয়। শরীরের মধ্যে লোহার শলাকা, না রাসূল (সা.), আর না সাহাবীরা প্রবেশ করাতেন। যদি এ কাজ উত্তমই হত তবে অবশ্যই তারা এতে অগ্রগামী হতেন। বরঞ্চ এটাও বিদআতীদের কাজ। আমি তাদেরকে মসজিদে একত্রিত হতে দেখেছি, তাদের সাথে তবলা জাতীয় যন্ত্র দফ ছিল। তারা গান করছিল, আমাদের মদের গ্লাস এনে দাও এবং তা আমাদের পান করাও। আল্লাহর ঘরে বসে মদ জাতীয় দ্রব্যের উচ্চারণ করতে তাদের লজ্জাও হয় না। তারপর উচ্চ আওয়াজে দফ বাজাচ্ছিল এবং উচ্চ আওয়াজে গাইরুল্লাহর নিকট বিপদে উদ্ধার চাচ্ছিল। আর বলছিল, হে খোদা! এভাবে শয়তান তাদের ধোকায় নিপতিত করছিল। তারপর আর একজন তার জামা খুলে একটি লোহার শিক হাতে নিয়ে তার পাঁজরের মধ্যে প্রবেশ করাল। তারপর আর একজন উঠে দাড়িয়ে কাচের একটি গ্লাস ভেঙে তা দাঁত দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করছিল। তখন আমি মনে মনে বললাম, এরা যা বলছে তা যদি সত্যিই সহীহ হয় তবে যেন তারা সেই ইহুদিদের সাথে সাথে যুদ্ধ করে যারা আমাদের ভূমি জবর দখল করে রেখেছে, আর আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে। এসব কাজ যে সব শয়তানরা সেখানে উপস্থিত হয় তারা তাদের সাহায্য করে। কারণ সেসব লোকেরা আল্লাহর স্মরণ হতে দূরে রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে পরম করুণাময়ের জিকির থেকে বিমুখ থাকে আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, ফলে সে এক শয়তানের সঙ্গী হয়ে যায়। আর নিশ্চয়ই তারাই (শয়তান) মানুষদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়। অথচ মানুষ মনে করে তারা হিদায়েত প্রাপ্ত।’ [সূরা আয-খরুফ: ৩৬-৩৭]
আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য শয়তানকে নির্দিষ্ট করে দেন, যাতে তারা আরও গোমরাহ হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বল, যে বিভ্রান্তিতে রয়েছে তাকে পরম করূণাময় প্রচুর অবকাশ দেবেন।’ [সূরা মারইয়াম: ৭৫]
যারা হিন্দুস্তানে গিয়েছেন, যেমন ভ্রমনবিদ ইবনে বতুতা কিংবা অন্যান্যরা, তারা অগ্নিউপাসকদের লোহার শিক শরীরে প্রবেশ করানো হতেও বেশি ভযংকর ঘটনা দেখেছে, যদিও তারা ছিল কাফের। তাই এই ঘটনা কোন কারামত বা অলৌকিক ঘটনা নয়। বরঞ্চ এটা সেসব শয়তানদের ঘটনা যারা এভাবে একত্রিত হয় গান-বাজনার আসরে। দেখা যায়, বেশির ভাগ লোক, যারা শরীরে শিক প্রবেশ করায়, তারা নানা ধরনের পাপে লিপ্ত। এমনকি প্রকাশ্যভাবে তারা আল্লাহর সাথে শিরকে লিপ্ত থাকে। কারণ তারা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের নিকট সাহায্য ভিক্ষা করে। তাহলে কিভাবে কারামতের অধিকারী অলী আল্লাহ হতে পারে? অলী হচ্ছেন সেই মুমিন বান্দা, যিনি সর্বদা এক আল্লাহর নিকট সাহায্য ভিক্ষা করেন। আর মুত্তাকী হচ্ছেন সেসব ব্যক্তি যিনি আল্লাহর সাথে পাপ ও শিরক করা হতে বিরত থাকেন। এসব অলীদের জীবনে হঠাৎ করে কোন কারামত ঘটে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে কোন মানুষের দাবি বা লোক দেখনোর জন্য এটা ঘটে না।
বর্তমান জামানায় গান-বাজনা
বর্তমান জামানায় বেশির ভাগ গান হয় বিয়ের মজলিসে অথবা অন্য কোন উৎসবে, রেডিও ও টেলিভিশনে। এগুলোর বেশির ভাগই ভালবাসা, শাহওয়াত, চুমু, দেখা-সাক্ষাৎ ইত্যাদির উপরে ভিত্তি করে রচিত। তাতে থাকে মুখের, কপালের এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রতঙ্গের বর্ণনা, যা যুবকদের মনে শাহওয়াত জাগিয়ে তোলে, আর তাদের ফাহেশা কাজ ও যিনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর তাদের চরিত্র নষ্ট করে। ইবনুল কাইয়িম (রহ.) গান-বাজনার ক্ষতিকর দিক ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন, ‘বাদ্য-বাজনাকে জিনা-ব্যভিচারের প্ররোচনাদানকারী বলা মোটেই ভুল হবে না, কারণ বাদ্য-বাজনার চেয়ে যিনার দিকে প্ররোচনাদানকারী কার্যকর আর কোন মাধ্যম নেই।’ [ইগাসাতুল লাহফান: ১/২৪৫]
তারা তাদের অশ্লীল গান-বাজনা দিয়ে জাতীয় চরিত্র নষ্ট করে দেয়। তাদের অশ্লীল ও নগ্ন ছবি দিয়ে যুবকদের চরিত্র নষ্ট করে। ফলে, আল্লাহকে ছেড়ে তারা তাদেরকে ভালবাসতে থাকে। এমনকি ১৯৬৭ সালে ইহুদিদের সাথে যুদ্ধের সময় রেডিও হতে বলা হচ্ছিল, তোমরা যুদ্ধে অগ্রসর হতে থাক; কারণ তোমাদের সাথে অমুক অমুক গায়িকা আছে। ফলে, তারা পাপিষ্ট ইহুদিদের সাথে চরমভাবে বিপর্যস্ত ও পরাজিত হয়। বরঞ্চ তাদের বলা উচিৎ ছিল: তোমরা সম্মুখে অগ্রসর হতে থাক তোমাদের সাথে আল্লাহ আছেন, তাঁর সাহায্য নিয়ে। এমনকি এক গায়িকা এই ঘোষণা দিয়েছিল যে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পূর্বে তার প্রতি মাসে কায়রোয় যে মাসিক উৎসব হতো, এ বৎসর তা সে তেলআবিবে করবে, যদি তারা জয়যুক্ত হয়। অন্যদিকে ইয়াহুদিরা যুদ্ধের পর বায়তুল মুকাদ্দাসের গোনাহ মোচনের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিল, আল্লাহ তাদের সাহায্য করার জন্য। এমনকি অনেক তথাকথিত ইসলামিক গানের মধ্যে নানা ধরনের গর্হিত কথা থাকে। যেমন বলা হল, প্রতি নবীরই একটা নির্দিষ্ট অবস্থান আছে, আর হে মুহাম্মাদ! এই সেই আরশ! একে গ্রহণ কর। এই বাক্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে মিথ্যা বানানো হয়েছে। কারণ রাসূল (সা.) কখনই আরশ গ্রহণ করবেন না, আর তাঁর রবও এ কথা বলবেন না।
আকর্ষণীয় ও শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর দ্বারা নারী-পুরুষের ফিতনা
ইবনুল কাইয়িম (রহ.) গানে ব্যবহৃত কণ্ঠস্বর কীভাবে বিপরীত লিঙ্গের নারী-পুরুষের মাঝে ফিতনা তৈরি করতে পারে তা ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন, ‘কবি আল-হুতাইয়া একবার তার মেয়েকে নিয়ে এক আরব ব্যক্তির বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। রাতের বেলা তিনি একজনকে সেখানে গান গাইতে শুনলেন। আল হুতাইয়াহ বাড়ির মালিককে বললেন, এই ব্যক্তিকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখুন। বাড়ির মালিক বললো, কী সমস্যা এতে? তিনি বললেন, গান এমন এক জিনিষ যা অনৈতিক কাজকে উসকে দেয়। আমি চাইনা আমার মেয়ে এই গান শুনুক। হয় আপনি এটি থামানোর ব্যবস্থা করুন, নয়তো আমি আপনার বাড়ি ত্যাগ করবো।’ যে কবির ঠাট্টা-তামাশা আর অপমানসূচক কবিতাকে আরবরা ভয় পেতো, সেই ব্যক্তি যদি গানের খারাপ প্রভাব ও পরিণতিকে ভয় পায়, আর আশংকা প্রকাশ করে যে এর খারাপ প্রভাব তার মেয়ের উপর পড়তে পারে, তাহলে অন্যদের বিষয়ে আপনার কী ধারণা?’ [ইগাসাতুল লাহফান: ১/২৪৫-২৪৭]
বর্তমান জামানায় মহিলারা রেডিও টেলিভিশনে যে ধরণের গান-বাজনা করে, সেই বিষয়ে কী বলবেন আপনি? এই ধরনের গায়িকারা বেশির ভাগই নানা ধরনের ফাসেক ও নগ্ন কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে, আর শরীরের নানাবিধ বর্ণনা দিয়ে যে কবিতা পাঠ করে তাতে বিবিধ ধরনের অবস্থার ও নফসিয়াতের উদ্রেক করে। ফলে যারা এইসব শুনে ও দেখে তা তাদের অন্তরে এমন রোগের সৃষ্টি হয় যা তাদের উৎসাহিত করে তাদের লজ্জা শরম বির্সজন দিতে ও বেহায়াপনায় লিপ্ত হতে। যদি এই গানের সাথে মাতাল করা সুরের মিশ্রন হয়, তবে তো তা তাদের বিবেক-বুদ্ধির বিভ্রম ঘটায়। যারাই গানের নেশায় পড়ে, তাদের তা সেই রকমই ক্ষতি করে যা মদ পান করার পর হয়ে থাকে।
গান অন্তরে নিফাকী সৃষ্টি করে
ইবনে মাসউদ (রাযি.) বলেন, গান অন্তরে মুনাফেকী সৃষ্টি করে, যেমন ভাবে পানি ঘাস সৃষ্টি করে। যিকর অন্তরে ঈমান সৃষ্টি করে, যেমন পানি ফসল উৎপন্ন করে। (সনদটি সহীহ) ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি সব সময় গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকে, তার অন্তরে মুনাফেকীও সৃষ্টি হবে, যদিও তার মধ্যে এর অনুভুতি আসবে না। যদি সে মুনাফেকীর হাকিকত বুঝতে পারত, তবে অব্শ্যই অন্তরে তার প্রতিফলন দেখতে পেত। কারণ কোন বান্দার অন্তরে কোন অবস্থাতেই গানের মহব্বত ও কোরআনের মহব্বত একত্রে সন্নিবেশিত হতে পারে না। তাদের একটি অন্যটিকে অবশ্যই দূর করে দিবে। মূল কথা হলো, গান, বাদ্য-বাজনা হলো শয়তানের বই। সুতরাং এই বই মহামহিম আল্লাহর কিতাবের সাথে এক অন্তরে সহাবস্থান করতে পারে না। [ইগাসাতুল লাহফান: ১/২৪৮-২৫১]
আমরা দেখতে পাই যে, কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করা, গান ও কাওয়ালী শ্রবণকারীদের কাছে খুবই শক্ত ঠেকে। আর কারি যে আয়াত তেলাওয়াত করে, তা দ্বারা তারা মোটেই উপকৃত হয় না। ফলে শরীরে কোন নাড়াচড়া ও অন্তরে কোন উদ্দীপনা আসে না। আর যখনই তারা গান শ্রবণ করে, তখনই তাদের কণ্ঠস্বরে ভয়ের এক প্রভাব সৃষ্টি হয়, অন্তরে এক ভাবের সৃষ্টি হয়, রাত্রি জাগরণ করা মধুর হয়। ফলে দেখতে পাই তারা গান-বাদ্য শ্রবণ করাকে কোরআনে তেলাওয়াত শ্রবণ অপেক্ষা বেশি প্রাধান্য দেয়। বেশির ভাগ লোকই যারা গান ও বাদ্যের ফিৎনায় লিপ্ত আছে, তারা সালাত আদায়ে খুব অলসতা দেখায়। বিশেষ করে জামাতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে।
ইবনে আকীল (রহ.) যিনি হাম্বলী মাযহাবের একজন বড় আলেম, তিনি বলেন, যদি কোন গায়িকা (নিজের স্ত্রী ব্যতিত) গান গায় তবে তা শ্রবণ করা হারাম। এ ব্যপারে হাম্বলী মাজহাবে কোন মতবিরোধ নেই। ইবনে হাযম (রহ.) বলেন, মুসলিমদের জন্য কোন অপরিচিতা মহিলার গান শ্রবণ করে আনন্দ লাভ করা হারাম। ইবনে জাওজী আবুল তাইয়্যিব আত-তাবারির উক্তি ব্যক্ত করেন, গায়রে মাহরাম নারীর গান শ্রবন করা হারাম। [তাবলীস ইবলীস: ২৭৭]
গান-বাজনা শ্রবণের প্রতিকার
১. রেডিও টেলিভিশন, ভিডিও কিংবা অন্য কোন স্থানে যে গান হয়, তা শ্রবণ করা হতে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে অশ্লীল গান হতে, যাতে বাদ্যও বাজান হয়।
২. গান-বাজনার বিপরীত কাজ হল আল্লাহর যিকর করা ও কোরআন তেলাওয়াত করা। বিশেষ করে সূরা বাকারা তেলাওয়াত করা। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে বাড়িতে সূরা বাকারা তেলাওয়াত করা হয় সে বাড়ি হতে শয়তান পলায়ন করে। [সহীহ মুসলিম: ১৮২১]
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়েত ও রহমত।’ [সূরা ইউনুস: ৫৭]
৩. রাসূল (সা.)-এর জীবনী ও শামায়েল (আখলাক) পাঠ করা এবং সাথে সাথে সাহাবায়ে কেরামের জীবনীও অধ্যয়ন করা।
যেসব গান শ্রবণ করা জায়েয
১. ঈদের গান শ্রবণ করা: এ হাদীসটি আয়েশা (রাযি.) হতে বর্ণিত, একদিন রাসূল (সা.) তাঁর ঘরে প্রবেশ করেন। তখন তার ঘরে দুই বালিকা দফ বাজাচ্ছিল। অন্য রেওয়ায়েতে আছে গান করছিল। আবু বকর (রাযি.) তাদের ধমক দেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, তাদের গাইতে দাও। কারণ প্রত্যেক জাতিরই ঈদের দিন আছে। আর আমাদের ঈদ হল আজকের দিন। [সহীহ আল-বুখারী: ৯৪৪, ও মুসলিম: ৮৯২]
২. দফ বাজিয়ে বিয়ে প্রচারের জন্য গান গাওয়া আর তাতে মানুষদের উদ্ধুদ্ধ করা। রাসূল (সা.) বলেছেন, হারাম ও হালালের মধ্যে পার্থক্য হল দফের বাজনা। এই শব্দে বোঝা যায় যে, সেখানে বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। [সুনানে তিরমিযী: ১০০৮ ও ইবনে মাজাহ: ১৮৮৬]
৩. কাজ করার সময় ইসলামী গান শ্রবণ করা, যাতে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে সেসব গানে যদি দুয়া থাকে। এমনকি রাসূল (সা.) পর্যন্ত ইবনে রাওয়াহা (রাযি.) নামক সাহাবীর কবিতা আবৃত্তি করতেন। আর সাথীদেরকে খন্দকের যুদ্ধের সময় পরিখা খনন করতে উদ্ধুদ্ধ করতেন এই বলে যে, হে আল্লাহ কোনই জীবন নেই আখেরাতের জীবন ব্যতীত। তাই আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করুন। তখন আনছার ও মুহাজিনগণ উত্তর দিলেন, আমরাই হচ্ছি সেসব ব্যক্তিবর্গ যারা রাসূলের নিকট বায়আত করেছি জিহাদীর জন্য যতদিনই আমরা জীবিত থাকি না কেন।
আল-বারাআ’ (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) সাহাবীদের নিয়ে যখন খন্দক (গর্ত) খনন করছিলেন, তখন ইবনে রাওয়াহা (রাযি.) এই কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ না থাকতেন তাহলে আমরা হেদায়েত পেতাম না। আর সিয়ামও পালন করতাম না, আর সালাতও আদায় করতাম না। তাই আমাদের উপর সাকিনা (শান্তি) নাযিল করুন। আর যখন শত্রুদের মুকাবিলা করব তখন আমাদের মজবুত রাখুন। মুশরিকরা আমাদের উপর আক্রমণ করেছে, আর যদি তারা কোন ফিৎনা সৃষ্টি করে, তবে আমরা তা ঠেকাবই। বারে বারে আবাইনা শব্দটি তারা উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করছিলেন। [সহীহ আল-বুখারী: ৩০৩৪]
৪. সেসব গান, যাতে আল্লাহর তাওহীদের কথা আছে অথবা রাসূলের সা. মহব্বত ও তার শামায়েল আছে অথবা যাতে জিহাদে উৎসাহিত করা হয় তাতে দৃঢ় থাকতে অথবা চরিত্রকে দৃঢ় করতে উদ্ধুদ্ধ করা হয়। অথবা এমন দাওয়াত দেয়া হয় যাতে মুসলিমদের একে অন্যের প্রতি মহব্বত ও সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। অথবা যাতে ইসলামের মৌলিক নীতি বা সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়। অথবা এই জাতীয় অন্যান্য কথা যা সমাজকে উপকৃত করে দীনী আমলের দিকে কিংবা চরিত্র গঠনের জন্য।
উল্লেখ্য যে, ঈদের সময় ও বিয়ের সময় কেবল মহিলাদের জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে দফ বাজানোর অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। যিকরের সময় এটার ব্যবহার ইসলাম কখনই দেয়নি। রাসূল (সা.) যিকরের সময় কখনই উহা ব্যবহার করেননি। তাঁর পরে তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমগণ কখনই তা করেন নি। বরঞ্চ, ভণ্ড সুফি পীররা তা মুবাহ করেছে নিজেদের জন্য। আর জিকরের দফ বাজানকে তারা সুন্নত বানিয়ে নিয়েছে। বরঞ্চ তা বিদআত। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা দীনের মধ্যে নতুন কোন সংযোজন করা হতে বিরত থেক। কারণ প্রতিটি নতুন সংযোজনই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী। [সহীহ মুসলিম: ৮৬৭ ও সুনানে নাসায়ী: ১৫৭৮]