রাসুল (সা.)-এর সুন্নাত ইবাদত কবুলের মাপকাঠি
মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যে রাসূলেরে আনুগত্য করলো সে পকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য করলো।’ [সূরা আন-নিসা: ৮০]
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে আমার সুন্নতকে জীবিত করল, সে আমাকে ভালোবাসল। আর যে আমাকে ভালবাসল, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’ [তিরমিযী শরীফ]
মুসলিম জাতির পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে সুন্নতের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সুন্দর ও সৌরভময় করতে মহানবী হযরত মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (সা.) ৬৩ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে উম্মতকে দিয়েছেন সুন্দর ও উজ্জ্বলময় পথনির্দেশ, যা আমাদের নিকট সুন্নত নামে সুপরিচিত। ইসলামে এমন কোন বিষয় নেই, যে সম্পর্কে ইসলাম দিক নির্দেশনা দেয়নি। লেবাস-পোষাক, চুল, বিয়ে-সাদী, ওলীমা এবং অসুস্থতা, চিকিৎসা ও রোগীর সেবাতেও রাসূল (সা.)-এর সুন্নত রয়েছে।
লেবাস-পোষাকের সুন্নত ১১টি
১. রাসূল (সা.) সাদা রঙের কাপড় পছন্দ করতেন। [শামায়িলে তিরমিযী, পৃ. ৫ ও সুনানে ইবনে মাজাহ, ১/২৫৫]
২. পাঞ্জাবি, শার্ট-কোর্ট ইত্যাদি পরিধান করার সময় প্রথমে ডান হাত আস্তিনে প্রবেশ করাবেন, তারপর বাম হাত। পাজামা ও প্যান্ট পরার সময়ও প্রথমে ডান পা তারপর বাম পা ঢোকাবেন। [সুনানে তিরমিযী, ১/৩০৬]
৩. প্যান্ট, শেলোয়ার ও লুঙ্গি টাখনুর ওপরে রাখবেন। টাখনুর নিচে পরলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘শরীরের নিম্নাংশের কাপড়কে যারা টাখনুর নিচে নামিয়ে রাখে তাদের প্রতি আল্লাহ রহমতের দৃষ্টিতে তাকান না।’ [সহীহ আল-বুখারী, ২/৮৬১ ও সহীহ মুসলিম, ২/১৪৯]
৪. নতুন কাপড় পরিধান করে নিচের দোয়াটি পড়বেন: আল্হাম্দু লিল্লা-হিল্লাযী কাছা-নী হা-যাচ্ছাওবা ওয়া রযাক্বানীহি মিন্ গায়রি হাওলিম্ মিন্নী ওয়া লা- কুয়্যা।
অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাকে এই কাপড় পরিধান করিয়েছেন এবং কোন চেষ্টা-শক্তি ব্যতীত আমাকে রিয্ক দান করেছেন। [সুনানে আবু দাউদ, ২/২০২]
৫. পাগড়ির নিচে টুপি রাখা সুন্নত। [মিরকাতুল মাফাতীহ, ৮/২১৫]
৬. রাসূল (সা.)-এর নিকট পাঞ্জাবি খুবই প্রিয় ছিল। [সুনানে তিরমিযী, ১/৩০৬; সুনানে আবু দাউদ, ২/২০২ ও সুনানে ইবনে মাজাহ, ১/২৫৫Ñ২৫৬]
৭. কালো রঙের পাগড়ি বাঁধা সুন্নত। পাগড়ির প্রান্তস্থিত কারু ছেড়ে দেওয়া সুন্নত। [সুনানুন নাসায়ী, ২/২৯৯]
৮. মাথায় টুপি দেওয়া সুন্নত। [মিরকাতুল মাফাতীহ, ৮/২১৫]
৯. শার্ট ও পাঞ্জাবি ইত্যাদি খোলার সময় আস্তিন থেকে প্রথমে বাম হাত তারপর ডান হাত বের করবেন। প্যান্ট-শেলোয়ারের ক্ষেত্রেও প্রথমে বাম পা, তারপর ডান পা বের করবেন। [সুনানে তিরমিযী, ১/৩০৬]
১০. জুতা-স্যান্ডেল প্রথমে ডান পায়ে পরবেন, তারপর বাম। [সহীহ আল-বুখারী, ২/৮৭০ ও সহীহ মুসলিম, ২/১৯৭]
১১. খোলার সময় প্রথমে বাম পায়ের জুতা খুলবনে, তারপর ডান। [সহীহ আল-বুখারী, ২/৮৭০ ও সহীহ মুসলিম, ২/১৯৭]
চুল রাখার সুন্নতসমূহ
১. রাসূল (সা.)-এর চুল মোবারক কানের মধ্যমাংশ পর্যন্ত লম্বা ছিল। অন্য রেওয়ায়েত মুতাবেক কান পর্যন্ত ছিল। অন্য আরেকটি রেওয়ায়েতে একদম কানের লতি পর্যন্ত দীর্ঘ হওয়ার কথা বর্ণিত আছে। কানের লতির কাছাকাছি ছিল এমন বর্ণনাও পাওয়া যায়। [শামায়িলে তিরমিযী, পৃ. ৩, গুনয়াতুত তালিবীন, পৃ. ৪৩Ñ৪৪ ও মিরকাতুল মাফাতীহ, ৮/২৭৯]
২. কানের লতি বা তার সামান্য নিচে পর্যন্ত পুরো মাথার চুল রাখা সুন্নত। পুরো মাথা ন্যাড়া করে ফেলাও সুন্নত। চুল কাটতে হলে পুরো মাথায় সমানভাবে কাটতে হবে। সামনে বা পিছনের দিকে লম্বা রেখে ইংলিশ স্টাইলে চুল রাখা বৈধ নয়। মাথার অর্ধাংশ ন্যাড়া করে অপর অংশে চুল রাখাও বৈধ নয়। সকল মুসলমানকে আল্লাহ হেফাজত করুন। [বেহেশতী জেওর, ১১/১১৫]
৩. হাদীস শরীফে পাড়ি লম্বা করা এবং গোঁফ খাটো করার নির্দেশ আছে। [সহীহ আল-বুখারী, ২/৫৭৫ ও সহীহ মুসলিম, ২/১২৯] দাড়ি সেভ করা এবং এক মুষ্টি থেকে কম রাখা বা ফ্রেসকাট দাড়ি রাখা হারাম। [বেহেশতী জেওর, ১১/১১৫]
আল্লাহ পাক সকল মুসলমানকে হেফাজত করুন। এক মুষ্টি পরিমাণ দাড়ি রাখা ওয়াজিব। এটি সুন্নহ তথা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
৪. গোঁফ খুব ভালোভাবে কেটে ফেলা সুন্নত। ঝাঁটার মতো লম্বা গোঁফ রাখার ব্যাপারে হাদীসে শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। [বেহেশতী জেওর, ১১/১১৫]
৫. নাভীর নিচের লোম, বগলের লোম, গোঁফ ও নখ ইত্যাদি ভালোভাবে কেটে পরিস্কার পরিছন্ন থাকা বাঞ্চনীয়। ৪০ দিন পর্যন্ত এগুলো পরিস্কার না করলে গোনাহ হবে। [সহীহ আল-বুখারী, ২/৮৭৫]
৬. চুল ধোয়া, তেল দেওয়া এবং চিরুনির সাহায্যে পরিপাটি করে রাখা সুন্নত। [আওজাযুল মাসালিক, ১২/২৬৮]
৭. আঁচাড়নোর সময় ডানদিক থেকে শুরু করা সুন্নত। [বেহেশতী জেওর, ১১/১১৬ ও সহীহ আল-বুখারী, ১/৬১]
৮. চুল আঁচড়ানোর জন্য বা অন্য কোনো প্রয়োজনে আয়না দেখলে নিচের দোয়া পড়া। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ২/৩৮১ ও হিসনে হাসীন, পৃ. ৩৪৬]
নিকাহ (বিয়ে-সাদী)-এর সুন্নতসমূহ
১. অনাড়ম্বর, লৌকিকতামুক্ত এবং যৌতুকবিহীন বিয়েই হল সুন্নতী তথা বরকতময় বিয়ে। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ২/২৬৮]
২. বিয়ের জন্য দীনদার ও সম্ভ্রান্ত সম্বন্ধ তালাশ করা এবং প্রস্তাব পাঠানো সুন্নত। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ২/২৬৭]
৩. জুমার দিন ও শাওয়াল মাসে বিয়ে করা সুন্নত। [মিরকাতুল মাফাতীহ, ৬/২৭৬]
৪. বিয়ের এ’লান করা সুন্নত। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ২/২৭২]
৫. সাধ্যানুযায়ী মোহর (দেনমোহর) নির্ধারণ করা সুন্নত। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ২/২৭৭]
৬. বাসর রাতে স্ত্রীর কপালে হাত রেখে নিচের দোয়াটি পড়বেন, আল্লা-হুম্মা ইন্নী— আছ্আলুকা খায়রাহা- ওয়া খায়রা মা- জাবাল্তাহা- ‘আলাইহি, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন্ র্শারি ওয়া মিন্ র্শারি মা- জাবাল্তাহা- ‘আলাইহি।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এই মহিলার কল্যাণ এবং তার উত্তম স্বভাব-চরিত্রের প্রার্থনা করছি। এবং তার অনিষ্ট এবং খারাপ চরিত্র থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। [সুনানে আবু দাউদ, ১/২৯৩ ও সুনানে ইবনে মাজাহ, ১/১৩৮]
৭. স্ত্রীর সাথে সহবাস করার পূর্বে নিচের দোয়াটি পড়বেন, সন্তানদের ওপর শয়তান প্রভাব ফেলতে পারবে না। কোন ধরণের ক্ষতিও সাধন করতে পারবে না।
উচ্চারণ: বিছ্মিল্লা-হি, আল্লা-হুম্মা জান্নিব্নাশ্ শায়ত্বানা ওয়া জান্নিবিশি শায়ত্বানা মা- রযাক্ব্তানা-।
অর্থ: আল্লাহর নামে আমি কর্মটি করতে যাচ্ছি। হে আল্লাহ, আমাদেরকে শয়তান থেকে হেফাজত করুন। আর আমাদের অনাগত সন্তানকেও শয়তানের কবল থেকে হেফাজত করুন। [সহীহ আল-বুখারী, ২/৭৭৬, সুনানে আবু দাউদ, ১/২৯৩ ও সুনানে ইবনে মাজাহ, ১/১৩৮]
সহবাসের পূর্বে দোয়াটি পড়লে এ সহবাসের কারণে মাতৃগর্ভে যে সন্তান আসবে কোন দিন শয়তান তার ক্ষতিসাধন করতে পারবে না।
ওলীমা
বাসর রাত অতিবাহিত হওয়ার পর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং গরীব-মিসকিনদের ওলীমা খাওয়ানো সুন্নত। ওলীমার জন্য বড় ধরনের আয়োজন করার প্রয়োজন নেই। নিজের সাধ্য অনুযায়ী ছোট খাটো আয়োজন করে বন্ধু-বান্ধবদের খানা খাওয়ালেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে।
এ ধরনের খারাপ ওলীমা থেকে বিরত থাকা চাই। ওলীমার সময় অবশ্যই সুন্নতের নিয়্যত থাকতে হবে। দীনদার গরীব লোকদেরই সর্বপ্রথম দাওয়াত করতে হবে। ধনীদেরও দাওয়াত করতে পারেন। লোকদেখানোই যদি ওলীমার উদ্দেশ্য হয়, তখন সওয়াব পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আল্লাহ অসন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। [সহীহ আল-বুখারী, ২৭৭৮]
অসুস্থতা, চিকিৎসা ও রোগীর সেবার সুন্নতসমূহ
১. অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসা করানো সুন্নত। চিকিৎসা তো করাবেনই, তবে শেফা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হবে এটা বিশ্বাস করতে হবে। [আল-মিনহাজু শরহু সহীহ মুসলিম ইবনিল হাজ্জাজ, ২/২২৫]
২. কালোজিরা এবং মধু দ্বারা চিকিৎসা করা সুন্নত। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এ দু’বস্তুতে শেফা রেখেছেন।’ অনেক হাদীসে এ দু’গুণাগুণের বর্ণনা আছে। [সহীহ আল-বুখারী, ২/৮৪৮]
৩. চিকিৎসা করানোর সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী বস্তুসমূহ হতে সর্তক থাকা জরুরি। [সহীহ আল-বুখারী, ২/৮৪৮]
৪. অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখতে যাওয়া সুন্নত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রোগীদের দেখতে যাও, শুশ্রƒশা কর।’ হযরত জাবির (রাযি.) বর্ণনা করেন, ‘আমি একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূল (সা.) আমাকে দেখতে এসেছিলেন।’ [সহীহ আল-বুখারী, ২/৮৪৪]
৫. রোগী দেখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে তাড়াতাড়ি চলে আসা সুন্নত। আপনি সেখানে গেঁড়ে বসে থাকলে রোগীর কষ্ট হতে পারে। তার পরিবারের লোকদের কাজ-কর্মে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ১/১৩৮]
৬. রোগীদের শান্ত¦না দেওয়া সুন্নত। আল্লাহ সবকিছুর ক্ষমতা রাখেন, আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন ইনশা আল্লাহ এধরনের কথাবার্তা বলবেন। ভয় সৃষ্টিকারী কোন কথা রোগীর সামনে উচ্চারণ করবেন না। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ১/১৩৭]
৭. রোগী দেখার সময় রোগীর উদ্দেশ্যে বলবেন, লা- বা’ছা ত্বাহূরুন্ ইন্শা—-আল্লা-হ।
অর্থ: কোন ভয় নেই ইনশাআল্লাহ, এ রোগের দরুন আপনার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।
অথবা রোগীর সুস্থতা কামনার্থে ৭বার নিচের দোয়াটি পাঠ করবেন, আছ্আলুল্লা-হাল্ ‘আযীমা রব্বাল্ ‘র্আশিল্ ‘আযীমি আইঁ ইয়াশ্ফীকা।
অর্থ: আমি আরশে আযীমের পালনকর্তা মহান আল্লাহর দরবারে আপনার স্স্থুতা কামনা করছি। [সহীহ আল-বুখারী, ২/৮৪৪Ñ৮৪৫]
আল্লহ তায়ালা আমাদের জীবনকে রাসূল (সা.)-এর সুন্নতের আলোকে জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন
লেখক: খতিব, জামিয়া বায়তুল করীম জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম