জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১০ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্রিটেনজুড়ে কওমী মাদরাসার সৌরভ

ব্রিটেনজুড়ে কওমী মাদরাসার সৌরভ

ব্রিটেনজুড়ে কওমী মাদরাসার সৌরভ

মাহমুদুল হাসান

 

(এক)

দশ বছর আগের কথা। ২০০৮ সন, মেয়েদের ব্রিটেন নিয়ে এসেছি। জাগতিক শিক্ষারব্যবস্থা এখানে বিশ্বমানের। কিন্তু আধ্যাত্মিক শিক্ষার ব্যাপারে কি হবে—এ ভবনা যখন চিন্তাকে গ্রাস করে রাখল তখন জামিয়াতুল কওসার নামে একটি বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেলাম। তবে তা লন্ডন হতে কয়ে’শ কিলোমিটার দূরে ল্যন্স্যসটার শহরে অবস্থিত। আমরা কিছু পরিবার প্রতিষ্ঠানটি ভিজিটের সিদ্ধান্ত নিলাম। উক্ত প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক এক অনুষ্ঠানে আমরা কোচ নিয়ে খুব ভোরে যাত্রা শুরু করলাম। দুপুরের আগে আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। প্রতিষ্ঠানটির আঙিনায় পৌঁছে চক্ষু চড়ক গাছ। বিস্মিত দৃষ্টিতে চতুর্দিকে তাকাচ্ছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি। সবুজ আঙিনায় চোখ জুড়িয়ে যায়, সু-বিস্তৃত মাঠ, বনজ প্রকৃতি, ভিক্টোরিয়ান যুগের বিশাল অট্টালিকা, ঐতিহ্যের ছাপ ও প্রধান ফটকের কারুকাজ সবকিছু মিলে মন আনন্দে ভরে গেল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনের প্যাটার্নে এ ভবনটি নির্মিত কোন একসময় এটি ছিল রয়্যাল হাসপিটাল। সময়ের বিবর্তনে এটি এখন ইউরোপের সর্ববৃহৎ বালিকা মাদরাসা ও মহিলা কলেজ। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের ছাত্রীরা এসে ইসলামের উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করে। এখানে দারুল উলুম দেওবন্দের পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ডে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। ১৯৯৬ সন হতে এ প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে পশ্চিমা মুসলিমজনগোষ্ঠীর জন্য আদর্শ মা ও নারী দা’ওয়া কর্মী সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। মুসলিম কোন দেশেও এত সুন্দর ইসলামী প্রতিষ্ঠান পাওয়া প্রায় দুষ্কর।

(দুই)

বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ অনন্য নজীর হল ব্রিটেন। ২০১১ সনের সর্বশেষ আদমশুমারিতে ব্রিটেনে ছোট-বড় অসংখ্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের অবস্থানের তথ্য সুস্পষ্ট উঠে এসেছে। এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হল মুসলিম ও ইসলামে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী। সানডে এক্সপ্রেসের (আগস্ট ২০১৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গির্জায় যাতায়াতকরীর চেয়ে মসজিদে আগমনকারীর সংখ্যা বেশি ব্রিটেনে। ইসলামের সাথে ব্রিটেনের যোগাযোগ সু-প্রাচীন। ইংরেজ কবি Geoffrey choucer (১৩৪২) মুসলিম বিদ্বানদের কথা তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ঈধহঃবৎনঁৎু ঞধষব-এ উল্লেখ করেছেন। ক্রসেড যুদ্ধের পর রানি এলিজাবেথ-১ উসমানী সুলতান মুরাদকে স্প্যানিশ রণতরীর বহরের বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। জন নিলসন প্রথম ইংরেজ যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ১৫৮৩ সনে। ইংরেজিতে প্রথম কুরআন অনুবাদ করেন। আলেকজ্যন্ডার রস ১৬৪৯ সনে। ব্রিটেনের সর্বপ্রথম কোন মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে বিষয়ে ভিন্নভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও ব্রিটিশ আইনমজ্ঞ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়ামের প্রতিষ্ঠিত লিভারপুল মসজিদটি অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। ১৮৮৭ সনে তিনি এ মসজিদ ও মদীনা হাউজ নামে একটি এতীমখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি ইসলাম কবুল করেছিলেন ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে ইসলাম বিস্তৃত হয়েছিল বলেই তিহাস থেকে জানা যায়। ১৮৭৩ সনের পর হতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে তাদের অনেক কর্মচারী ভারতবর্ষ হতে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাতে শুরু করে। এভাবে ধীরে ধীরে ব্রিটেনে মুসলমানদের স্থায়ী বসবাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমানে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মুসলিম ব্রিটেনে বাসকরছে যা মোট জনসংখ্যার ৪.৪% শতাংশ। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া হতে আগতরাই সংখ্যাগরিষ্ট।

(তিন)

ব্রিটেনকে যারা নিজেদের বাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করছেন তারা মূলত দুটি সংস্কৃতি ও দুটি জগতের টানাপোড়নে বাস করেন। একটি হল নিজেদের রেখে আসা দেশের কৃষ্টি এবং দ্বিতীয়টি হল নতুন দেশের কৃষ্টি। এ দুয়ের মাঝে সমন্বয় সাধনে তাদের অনেক ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হয়। বিশেষত প্রথম দিকে যারা ইমিগ্রেন্ট হয়ে এসেছিলেন সেসব মুসলিমদের সাংস্কৃতিক টানাপোড়ন ছিল অতিমাত্রায়। ক্রমান্বয়ে মুসলমানরা নিজেদের মত করে একটি আবহ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বহুলাংশে। প্রথম প্রজন্ম যারা এদেশকে নিজেদের ঠিকানা করে ছিলেন তারা নিজেদের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে বিপদে পড়ে ছিলেন। মূলধারার ইংলিশ স্কুলে তাদের সন্তানরা যাচ্ছে কিন্তু তাদের খাবার, পোশাক, নামায, পর্দা ও নিজস্ব ধর্মীয় চেতনার সাথে স্কুলের পরিবেশ কোনভাবে খাপ খাচ্ছিল না। মুসলমানরা এ বিষয়ে চিন্তিত ও তটস্থ হয়ে উঠেছিল। তারা শহরে শহরে সংঘবদ্ধ হল এবং কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের চাহিদাগুলো পেশ করতে লাগল। ধীরে ধীরে স্কুলগুলো কিছুটা হলেও মুসলিমছাত্র-ছাত্রীদের ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণের পদক্ষেপ নিল। কিন্তু তা পুরো চাহিদার তুলনায় ছিল নিতান্ত অপ্রতুল। তখন মুসলমানরা নিজস্ব স্কুলে ও মাদরাসা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করল। বর্তমানে পুরো ইংল্যান্ডজুড়ে প্রায় ১৫৬টি পূর্ণাঙ্গ মাদরাসা বা ইসলামি স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি স্কুল সরকারি ফান্ড দ্বারা পরিচালিত আর অন্যগুলো প্রাইভেট অর্থে নির্বাহ হয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করা কিছুটা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। যেখানে মূলধারার স্কুলগুলো সম্পূর্ণ ফ্রি, সেখানে মুসলিম স্কুল বা মাদরাসায় পড়াতে হলে অভিভাবকদের উল্লেখযোগ্য টিউশনফি ও অন্যান্য খরচ গুনতে হয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠান মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের মাত্র ০.৫ শতাংশকে ধারণ করতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ‘অপেক্ষমান তালিকা’ রয়েছে। সাধারণত মুসলিম নতুন প্রজন্মে যারা বাধ্যতামূলক স্কুলে যাবার বয়সে রয়েছে তারা মূলধারা স্কুলে যায়। তাদের ইসলামী ভাবধারা শিক্ষা ও কুরআন শেখার জন্য মুসলিম কমিউনিটি শহরে শহরে কিছু খ-কালীন মাদরাসা গড়ে তুলেছে। এসব মাদরাসা মূলত মসজিদকেন্দ্রিক। সন্ধ্যাকালীন বা সপ্তাহান্তে (শনি-রবিবার) এসব মাদরাসা পরিচালিত হয়। এ জাতীয় কয়েক হাজার মাদরাসা ব্রিটেনব্যাপী বিস্তৃত আছে। এ ব্যবস্থাকে Supplementary Islamic বলা হয়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা ও নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি শেখানোর জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে পরিচালনা করে। ইহুদীদের সিনাগগে, খ্রিস্টানদের গির্জায় এবং হিন্দু ও শিখদের মন্দিরে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে মুসলিম স্কুলগুলো খুবই কর্মচঞ্চল ও দ্রুত বিশ্বমান হচ্ছে।

(চার)

ভবিষ্যত আলিম ও আলিমা সৃষ্টির জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেগুলোকে সাধারণত ‘দারুল উলুম’ নামে অভিহিত করা হয়। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ হতে এ নাম গৃহীত। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদরাসা ও স্কুল সমান্তরালে পরিচালিত হয়। ব্রিটিশ ন্যশনাল কারিকুলাম বাধ্যতামূলকভাবে আঠার বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্রদের পড়াতে হবে। পাশাপাশি পাবলিক পরীক্ষা যেমন ও লেভেল এবং এ লেভেলে অংশ গ্রহণ করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ Ofsted-এর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার আওতায় থাকে। শিক্ষার মান ও পরিবেশ যেন ব্রিটিশ স্ট্যন্ডারে থাকে সে বিষয়গুলো এখানে নিশ্চিত করতে হয়। এ জাতীয় দরুল উলুম বা উচ্চতর কওমী মাদরাসা যেখানে দাওরা হাদীস পর্যন্ত পাঠদান করা হয় তার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। কোন কোন দরুল উলুম বিভিন্ন শহরের অন্যান্য মূলধারার ইংলিশ স্কুলের চেয়ে পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছি এবং সকলের সু-দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। সাধারণত প্রতিষ্ঠানসমূহ আবাসিক। ছাত্র-ছাত্রীরা ইসলামী পরিবেশে শুধু জ্ঞানই অর্জন করে না, বরং উন্নত জীবনধারা ও অধ্যাত্মও চর্চা করার সুযোগ পায়। মূলত সত্তর ও আশির দশক হতে এসব ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ১৯৭৮ সনে ইউরোপের তাবলীগী মারকায প্রতিষ্ঠিত হয় ডিইজবারি শহরে এবং পাশাপাশি ১৯৮০ সনে সেখানে চালু হয় মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম। ‘জমিয়াত তালিমুল ইসলাম’ বা Institute of Islamic education নামে এ কওমী মাদরাসাটি প্রাচীন একটি বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সু-পরিচিত। প্রচুর আলিম ইতোমধ্যে এখান থেকে গ্রাজুয়েট হয়েছেন। তবে ব্রিটেনের সর্বপ্রাচীন মাদরাসা হলব্যরিতে প্রতিষ্ঠিত দারুল ব্যরি। ১৯৭৩ সনে শায়খুল হাদীস যাকারিয়া কান্দলভী (রহ.)-এর ছাত্র, ভারতের গুজরাটের অধিবাসী হযরত ইউসুফ মোতালা এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সূচনা করেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরও বড় বড় দরুল উলুম ও মাদরাসার গোড় পত্তন করেন। তার হাতে ইডিইজবারি মাদরাসা, দারুল উলুম কিড মিনিস্টার, জামিয়াতুল ইমাম মুহাম্মদ যাকারিয়া ব্রাডফোর্ড (মহিলা মাদরাসা), মাদরাসা মিসবাহুল উলুম ব্রার্ডফোর্ড, মারকাযুল উলুম ব্লাকবার্ণ (বালক-বালিকামাদরাসা), মাদরাসা আল-ইমাম মুহাম্মদ যাকারিয়া বল্টন, মাদরাসা আল-ইমাম মুহাম্মদ যাকারিয়া প্রেসটন, আযহার একাডেমী লন্ডন ইত্যাদি খ্যাতমান মাদরাসা স্থাপিত হয়। ৭৫ শতাংশ ইংরেজি ভাষাভাষী ওলামা এসব প্রতিষ্ঠান হতে গড়ে উঠেছেনব লেধারণ করা হয়। হযরত ইউসুফ মোতালা কওমী মাদরাসা বিস্তারেও ব্রিটেনজুড়ে দীন প্রচারে অবিস্মরনীয় ভূমিকা পালনক রছেন।

উপরের এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও লানক্যসটারে জামিয়াতুল কওসার মহিলা মাদরাসা, জামিয়াতুল হুদা নটিংহাম মহিলা মাদরাসা, দারুল উলুম বার্মিংহাম, জামিয়াতুল ইলমে ওয়াল হুদা ব্লাকবার্ন এবং লন্ডন দারুল উলুম ব্রিটেনও বৃহত্তর ইউরোপে দীনের সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছে। দিন দিন এসব প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠুক বিশ্বমানের, সময়োপযোগী ও উজ্জীবিত এবং সংখ্যায় আরও অধিক—এ প্রত্যাশা ও মুনাজাত আমাদের।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ