নিয়ত: একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা
সাইফুল ইসলাম
নিয়ত আরবী শব্দ (نية বা نيَّة) অর্থ: الْقَصْدُ وَالإرَادَة উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, অভিলাষ, মনোবাঞ্ছা, মনের ঝোঁক, কোনো কিছু করার ইচ্ছা, কোনো কাজের প্রতি মনকে ধাবিত করা ইত্যাদি। ইংরেজিতে বলা হয় ওহঃবহংরড়হ।১
ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে, মনের মধ্যে কোনো ভাবের উদয় হলে, সে ভাব অনুযায়ী আমল করা কিংবা না করার কোনো দিকেই মন ধাবিত না হলে, মনের ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া সে ভাবকে বলা হয় হাদসুন-নাফস বা ওয়াসওয়াসা। আর সে ভাবকে বাস্তবে রূপদানের জন্য মনকে ধাবিত করার নাম,হাম্ম বা নিয়ত (অভিপ্রায়) এবং মজবুত নিয়তকে বলা হয় ‘আযম তথা সংকল্প।২ আবার নিয়ত (অভিপ্রায়) এবং ইরাদাহ (ইচ্ছা) শব্দ দু‘টি বাহ্যত সমার্থক মনে হলেও এবং কখনো কখনো এক অর্থে ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও উভয়ের মাঝে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমনÑ
এক. ইরাদাহ (ইচ্ছা)-এর সম্পর্ক নিজের কাজের সাথেই নির্দিষ্ট নয়; বরং অন্যের কাজের সাথেও ইরাদাহ (ইচ্ছা)-এর সম্পর্ক হতে পারে। পক্ষান্তরে নিয়তের সম্পর্ক শুধু নিয়তকারীর কাজের সাথেই হয়ে থাকে। যেমন, এটা বলা চলে যে, আমি তোমার নিকট এ ধরণের আচরণের ইরাদাহ বা ইচ্ছা (কামনা) করিনি, কিন্তু এভাবে বলা যায় না যে, আমি তোমার নিকট এ ধরণের আচরণের নিয়ত বা উদ্দেশ্য করিনি।
দুই. ইরাদাহ (ইচ্ছা) সম্ভাব্য কাজের ব্যাপারেই কেবল ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে নিয়ত শব্দটি সম্ভব-অসম্ভব সকল কাজের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর এজন্যই আল্লাহর ব্যাপারে নিয়ত শব্দের ব্যবহার করা যায় না। যেহেতু তাঁর নিকট সবকিছুই সম্ভব তাই তিনি কোনো কাজ করার ইরাদাহ বা ইচ্ছা করেন, নিয়ত নয়। তবে যেহেতু কখনো কখনো উভয় শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হয় তাই কুরআন মজীদে অনেক স্থানে আল্লাহ তাআলা ইরাদাহ শব্দটিকে নিয়ত অর্থে ব্যবহার করেছেন।৩
শরীআতের দৃষ্টিতে নিয়ত ও তার প্রকারভেদ
আল্লামা মাওয়ারদী (রহ.) বলেন,
هِيَ قَصْدُ الشَّيْءِ مُقْتَرِنًا بِفِعْلِهِ.
কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট মনের উদ্দেশ্য।৪
আল্লামা কাযী বায়যাভী (রহ.) বলেন,
النِّيَّة عِبَارَة عَنْ انْبِعَاث الْقَلْب نَحْو مَا يَرَاهُ مُوَافِقًا مِنْ جَلْب نَفْع أَوْ دَفْع ضُرّ، حَالًا أَوْ مَآلًا.
‘বর্তমান বা ভবিষ্যতের ভালো কিংবা খারাপ কোনো স্বার্থের জন্য কোনো কাজের প্রতি মনের অভিনিবেশ।’৫
অর্থাৎ মানুষ কোনো কাজ করার সময় তার মনের অভ্যন্তরে যে উদ্দেশ্য থাকে, যার কারণে মানুষ কাজটি করার জন্য উদ্ভুদ্ধ হয় সে উদ্দেশ্য বা কারণটিকেই শরী‘আতের পরিভাষায় নিয়ত বলা হয়। কোনো ইবাদত করার সময় সে ইবাদতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সংক্রান্ত মনের ভাব বা অবস্থাই নিয়ত। নিয়ত ভালো কিংবা খারাপ উভয়ই হতে পারে। শরীআতের দৃষ্টিতে নিয়ত দু’প্রকার:
১. ইখলাস
২. রিয়া।
যখন কোনো মানুষ আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত করে তখন সে ইবাদত সংক্রান্ত মনের ওই অবস্থাকে ইখলাস বলা হয়। আর কেউ লোক দেখানো বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ইবাদত করলে ইবাদতকালীন মনের সেই অবস্থাকে বলা হয় রিয়া।
নিয়তের শরয়ী বিধান
ইসলামে নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। সকল ইবাদতের জন্য শুরুতে মনে মনে নিয়ত করে নেওয়া আবশ্যক। নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদতই আদায় হবে না।
নিয়তের উদ্দেশ্য
নিয়তের দুটি উদ্দেশ্য থাকে:
এক. আমল বা কাজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ। অর্থাৎ আমলের উদ্দেশ্য কি লা-শরীক আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি, নাকি সরাসরি আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো সন্তুষ্টি অথবা আল্লাহর সাথে সাথে অন্য কারো সন্তুষ্টিও? তার পার্থক্য নিরূপণ করা। উদাহরণত সালাত আদায় করা। নিয়তের মাধ্যমে সহজে এ পার্থক্য নির্ণয় করা যায় যে, বান্দা কি শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর নির্দেশ পালনার্থেই তা আদায় করছে, নাকি তার সালাত আদায়ের পেছনে লোক-দেখানো কিংবা যশ-খ্যাতি পাওয়ার মতো হীন কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে।
দুই. আমল বা ইবাদতের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা অথবা ইবাদতকে অভ্যাসগত নিত্যকর্ম থেকে পৃথক করা। যেমনÑ যোহরের সালাতকে আসরের সালাত থেকে পৃথক করা এবং রমযান মাসের সাওমকে অন্য মাসের সাওম থেকে পৃথক করা যায় নিয়তের মাধ্যমে। আবার নিয়তের দ্বারাই অপবিত্রতার গোসলকে অভ্যাসগত পরিচ্ছন্নতা ও শীতলতা লাভের গোসল থেকে ভিন্ন করা যায়।
নিয়ত: প্রসঙ্গ আল-কুরআন
এক. আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَاعْبُدِ اللّٰهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّيْنَؕ۰۰۲
তুমি আল্লাহর ইবাদত করো তাঁরই জন্য ইবাদতকে বিশুদ্ধ করে। [সূরা আয-যুমার: ০২]
তিনি অন্যত্র আরো বলেন,
اَلَا لِلّٰهِ الدِّيْنُ الْخَالِصُؕ ۰۰۳
‘জেনে রাখুন, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহরই নিমিত্ত। [সূরা আয-যুমার: ৩]
উক্ত আয়াতদ্বয়ে দীন (دين) শব্দটি আনুগত্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সম্বোধন করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যকে তারই জন্য খাঁটি করুন। যাতে শির্ক, রিয়া ও যশ-খ্যাতির উদ্দেশ্যের নাম-গন্ধও না থাকে। এরই তাগিদার্থে দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, খাঁটি ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই শোভনীয়। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এর যোগ্য নয়। আবু হুরায়রা (রাযি.) হতে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে বললেন, আমি মাঝে মাঝে দান-খয়রাত করি অথবা কারো প্রতি অনুগ্রহ করি, এতে আমার নিয়ত আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিও থাকে এবং এটাও থাকে যে, মানুষ আমার প্রশংসা করুক।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, আল্লাহ তাআলা এমন কোনো বস্তু কবূল করেন না, যাতে অন্যকে শরীক করা হয়। অতঃপর তিনি প্রমাণস্বরূপ: اَلَا لِلّٰهِ الدِّيْنُ الْخَالِصُؕ ۰۰۳ আয়াতখানি তিলাওয়াত করলেন।৬
বস্তুত নিয়তের একনিষ্ঠতা অনুপাতে আল্লাহর নিকট আমল গৃহীত হয়। কুরআনে করীমের অনেক আয়াত সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহর কাছে আমলের হিসাব গণনা দ্বারা নয়, ওজন দ্বারা হয়ে থাকে। আর আমলের মূল্যায়ন ওজন নিষ্ঠাপূর্ণ নিয়তের অনুপাতে হয়ে থাকে এবং পূর্ণ খাঁটি নিয়ত এই যে, আল্লাহ ব্যতীত কাউকে লাভ-লোকসানের মালিক গণ্য করা যাবে না। নিজের কাজকর্মে কাউকে ক্ষমতাশীল মনে করা যাবে না এবং কোনো ইবাদত ও আনুগত্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কল্পনা ও ধ্যান করা যাবে না। যে সাহাবায়ে কেরাম মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রথম সারিতে অবস্থিত, তাদের আমলের পরিমাণ তেমন একটা বেশি দেখা যাবে না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের সামান্য আমল অবশিষ্ট উম্মতের বড় বড় আমলের চেয়ে উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠ তো তাদের পূর্ণ ঈমান ও পূর্ণ নিষ্ঠার কারণেই ছিল।৭
ইমাম বুখারী (রহ.) সহীহ আল-বুখারীর শেষ বাবের শিরোনাম করেছেন,
بَابُ قَوْلِ اللهِ تَعَالَىٰ: وَ نَضَعُ الْمَوَازِيْنَ الْقِسْطَ ؕ ۰۰۴۷
অধ্যায়: আমি ইনসাফের পাল্লা স্থাপন করবো। [সূরা আল-আম্বিয়া: ৪৭] আল্লাহর এ উক্তি।৮
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ আলেমের মত হলো, কিয়ামতের দিন মানুষের আমলকে ওজন করা হবে; গণনা নয়। আর এ ক্ষেত্রে মানুষের একই আমলের মধ্যে ওজনের কম বেশি হবে তাদের নিয়তের কারণে এবং আমলের মধ্যে ইখলাস কম-বেশি হওয়ার কারণে।
আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (রহ.) বলেন,
رُبَّ عَمَلٍ صَغِيْرٍ تُعَظِّمُهُ النِّيَّةُ، وَرُبَّ عَمَلٍ كَبِيْرٍ تُصَغِّرُهُ النِّيَّةِ.
নিয়ত অনেক ক্ষুদ্র আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। আবার অনেক বৃহৎ আমলকেও তা ক্ষুদ্র করে দেয়।৯
নিয়তের গুরুত্ব আমলের চেয়েও বেশি। মানুষের নিয়ত তার আমলের চেয়ে অধিক কার্যকারী। যেমনÑ এক ব্যক্তি ৬০/৭০ বছর ঈমান অবস্থায় জীবিত ছিলো এবং ইবাদত করল; কিন্তু তার এ নিয়ত ছিলো যে, সে যদি সব সময় জীবিত থাকতো তাহলে ঈমান অবস্থায়ই থাকতো এবং ইবাদত করতে থাকতো। এজন্যই মৃত্যুর পর সে অনন্ত কাল জান্নাতে থাকবে। পক্ষান্তরে বেঈমানরা ৬০/৭০ বছর জীবিত থাকলেও তাদের নিয়তে এটা থাকে যে, তারা যত দিন জীবিত থাকবে বেঈমান অবস্থাতেই থাকবে। তাই তারাও এরূপ বদ-নিয়তের কারণে সব সময় জাহান্নামে থাকবে।১০
দুই. অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الْاٰخِرَةِ نَزِدْ لَهٗ فِيْ حَرْثِهٖ١ۚ وَمَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهٖ مِنْهَا وَمَا لَهٗ فِي الْاٰخِرَةِ مِنْ نَّصِيْبٍ۰۰۲۰
‘যে পরকালের ফসল প্রত্যাশা করে আমরা তার জন্য সে ফসল আরো বাড়িয়ে দেই। আর যে ইহকালের ফসল কামনা করে আমরা তাকে এর কিছু দিয়ে দেই। কিন্তু পরকালে তার জন্য কিছু থাকবে না।’ [সূরা আশ-শূরা: ২০]
তিন. অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّقُوْلُ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهٗ فِي الْاٰخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ۰۰۲۰۰
‘যে সকল লোকেরা বলে যে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে দান করুন। তাদের জন্য পরকালে কোনো অংশ নেই।’ [সূরা আল-বাকারা: ২০০]
চার. অন্য আয়াতে আছে,
لَنْ يَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْؕ ۰۰۳۷
‘আল্লাহর কাছে কখনো এগুলোর (কুরবানীর) গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের (অন্তরের) তাকওয়া।’ [সূরা আল-হজ: ৩৭]
কুরবানীর ক্ষেত্রে করবানীর জন্তুর গোশত ও রক্ত নয়; বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে আল্লাহর আদেশ পালন করাই কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতী শফী (রহ.) লিখেন যে, কুরবানী একটি মহান ইবাদত। কিন্তু আল্লাহর কাছে এর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না এবং করবানীর উদ্দেশ্যও এগুলো নয়; বরং আসল উদ্দেশ্য জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা এবং পূর্ণ আন্তরিকতাসহ রবের আদেশ পালন করা।[১১] অন্যান্য সব ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যও তাই। সালাতে উঠা-বসা করা এবং সাওমে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকা আসল উদ্দেশ্য নয় । বরং আল্লাহর আদেশ পালন করাই আসল লক্ষ্য। আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র।
পাঁচ. অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْحَيٰوةَ الدُّنْيَا وَ زِيْنَتَهَا نُوَفِّ اِلَيْهِمْ اَعْمَالَهُمْ فِيْهَا وَ هُمْ فِيْهَا لَا يُبْخَسُوْنَ۰۰۱۵ اُولٰٓىِٕكَ الَّذِيْنَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْاٰخِرَةِ اِلَّا النَّارُ١ۖٞ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوْا فِيْهَا وَ بٰطِلٌ مَّا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ۰۰۱۶
‘যারা পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের দুনিয়াতে আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেই এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই হল সে সব লোক আখেরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া কিছুই নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ করেছে আর যা কিছু উপার্জন করেছিল সবই বিনষ্ট হলো।’ [সূরা হূদ: ১৫-১৬]
মুআবিয়া (রাযি.), মায়মুন ইবনে মিহরান ও মুজাহিদ (রহ.) প্রমুখ উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, অত্র আয়াতে ঐ সব লোকের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে যারা তাদের যাবতীয় সৎকাজ শুধু পার্থিব ফায়দা হাসিলের জন্য করে থাকে, চাই সে আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসী কাফির হোক অথবা নামধারী মুসলিম হোক, যে পরকালকে মৌখিক স্বীকার করেও কার্যত: সে দিকে কোনো লক্ষ্য রাখে না বরং পার্থিব লাভের দিকেই সম্পূর্ণ মগ্ন ও বিভোর থাকে।১২ সহীহ মুসলিমে আনাস (রাযি.) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা কারো প্রতি যুলুম করেন না। সৎকর্মশীল মুমিন ব্যক্তিরা দুনিয়াতে আংশিক প্রতিদান লাভ করে থাকে এবং পূর্ণ প্রতিদান আখেরাতে লাভ করবে। আর কাফিররা যেহেতু আখেরাতের কোনো ধ্যান-ধারনাই রাখে না, তাই তাদের প্রাপ্য হিস্যা ইহজীবনেই তাদেরকে পুরোপুরি ভোগ করতে দেওয়া হয়। তাদের সৎ কার্যাবলীর প্রতিদানস্বরূপ তাদেরকে ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েশ, বস্তুগত উন্নতি ও ভোগ-বিলাসের সামগ্রী দান করা হয়। অবশেষে যখন আখেরাতে উপস্থিত হবে, তখন সেখানে তাদের প্রাপ্তব্য কিছুই থাকবে না।’১৩
আয়াতটি অবতরণের প্রেক্ষাপট বা শানে নুযূল
ইসলাম বিরোধীদেরকে যখন আযাবের ভয় দেখানো হতো, তখন তারা নিজেদের দান-খয়রাত, জনসেবা ও জনহিতকর কাজসমূহকে সাফাইরূপে তুলে ধরতো। তারা বলত যে, এতসব সৎকাজ করা সত্ত্বেও আমাদের শাস্তি হবে কেন? উক্ত আয়াতে সে মনোভাবেরই জবাব দেওয়া হয়েছে। জবাবের সারকথা এই যে, প্রতিটি সৎকার্য গ্রহণযোগ্য ও পারলৌকিক মুক্তির কারণ হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে, সেটি একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার জন্য তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তরীকা মোতাবেক হতে হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তদিয় রাসূলের প্রতি ঈমানই রাখে না ,তার কার্যকলাপ গুণ-গরিমা, নীতি-নৈতিকতা প্রাণহীন দেহের ন্যায়। যার বাহ্যিক আকৃতি অতি সুন্দর হলেও আখেরাতে তার কানাকড়িরও মূল্য নেই। তবে দৃশ্যত সেটা যেহেতু পুণ্যকার্য ছিল এবং তা দ্বারা বহু লোক উপকৃত হয়েছে, তাই আল্লাহ তাআলা এহেন তথাকথিত সৎকার্যকে সম্পূর্ণ বিফল ও বিনষ্ট করেন না; বরং এসব লোকের যা মুখ্য উদ্দেশ্য ও কাম্য ছিল যেমন তার সূনাম ও সম্মান বৃদ্ধি হবে, লোকে তাকে দানশীল, মহান ব্যক্তিরূপে স্মরণ করবে, নেতারূপে তাকে বরণ করবে ইত্যাদি আল্লাহ তাআলা স্বীয় ইনসাফ ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে তা ইহজীবনেই দান করেন । অপরদিকে আখেরাতে মুক্তি লাভ করা যেহেতু তাদেরও কাম্য ছিলনা এবং প্রাণহীন সৎকার্য আখেরাতের অপূর্ব ও অনন্ত নিআমতসমূহের মূল্য হওয়ার যোগ্য ছিলনা, কাজেই আখেরাতে তার কোনো প্রতিদানও লাভ করবে না । বরং নিজেদের কুফরী, শিরকী ও গুনাহের কারণে জাহান্নামের আগুনে চিরকাল তাদের জ্বলতে হবে।
ছয়. অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّيْنَ۠ۙ۰۰۴ الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَۙ۰۰۵ الَّذِيْنَ هُمْ يُرَآءُوْنَۙ۰۰۶ وَيَمْنَعُوْنَ الْمَاعُوْنَؒ۰۰۷
‘অতএব দুর্ভাগ্য সে সব সালাত আদায়কারীর, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে বে-খবর। যারা তা লোক দেখানোর জন্য করেএবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দেয় না।’ [সূরা আল-মাঊন: ৪-৭]
উক্ত পাঁচটি আয়াতে সেসব মুনাফিকদের কথা আলোচনা করা হয়েছে যারা লোক দেখানো এবং ইসলামের দাবীকে প্রমাণ করার জন্য বাহ্যত সালাতসালাত আদায় করে। কিন্তু তারা যেহেতু সালাতসালাত ফরয হওয়াকেই স্বীকার করে না তাই তারা সময়ের কোনো গুরুত্ব প্রদান করে না। তদ্রƒপ মূল সালাতেও অলসতা করে- এবং তারা (مَاعُونَ) তথা যৎকিঞ্চিৎ তুচ্ছ বস্তু যেমনÑ কুড়াল, কোদাল, রান্না-বান্নার পাত্র, ছুরি ইত্যাদি কার্পন্যবশত প্রতিবেশিদেরকে দেয় না। উক্ত আয়াতগুলোতে এ কথার প্রতি কঠোর সতর্কবাণী রয়েছে যে, লোক দেখানোর জন্য সালাত আদায় বা অন্য কোনো ইবাদত করা মুনাফিকদের স্বভাব। কোনো মুসলিম যদি একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ছাড়া লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করে তবে তা হবে মুনাফিকসুলভ আচরণ। যা সওয়াব প্রাপ্তির যোগ্যতা রাখে না।
সাত. অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدٰوةِ وَ الْعَشِيِّ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَهٗ وَ لَا تَعْدُ عَيْنٰكَ عَنْهُمْ١ۚ تُرِيْدُ زِيْنَةَ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا١ۚ وَ لَا تُطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَهٗ عَنْ ذِكْرِنَا وَ اتَّبَعَ هَوٰىهُ وَ كَانَ اَمْرُهٗ فُرُطًا۰۰۲۸
‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের রবকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে। এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নেবেন না এবং যার মনকে আমার স্মরণ হতে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।’ [সূরা আল-কাহাফ: ২৮]
অর্থাৎ আপনি নিজেকে তাদের সাথে বেঁধে রাখুন। সম্পর্ক ও মনোযোগ তাদের প্রতি নিবদ্ধ রাখুন। কাজে কর্মে তাদের থেকেই পরামর্শ নিন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা খাঁটি নিয়তে সকাল সন্ধ্যায় অর্থাৎ সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইবাদত ও জিকির করে। তাদের কার্যকলাপ একান্তভাবেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত।
আট. অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهٗ فِيْهَا مَا نَشَآءُ لِمَنْ نُّرِيْدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهٗ جَهَنَّمَ١ۚ يَصْلٰىهَا مَذْمُوْمًا مَّدْحُوْرًا۰۰۱۸ وَ مَنْ اَرَادَ الْاٰخِرَةَ وَ سَعٰى لَهَا سَعْيَهَا وَ هُوَ مُؤْمِنٌ فَاُولٰٓىِٕكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَّشْكُوْرًا۰۰۱۹
‘যারা ইহকাল কামনা করে, আমি সে সব লোককে যা ইচ্ছা সত্ত্বর দিয়ে দেই। অতঃপর তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করি। ওরা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে। আর যারা পরকাল কামনা করে এবং মুমিন অবস্থায় তার জন্য যথাযথ চেষ্টা-সাধনা করে, এমন লোকদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে।’ [সূরা বানী ইসরাঈল: ১৮-১৯]
উপর্যুক্ত প্রথম আয়াতটি কাফিরদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যারা নিজেদের প্রত্যেক কাজকে ক্রমাগতভাবে ও সদাসর্বদা শুধু ইহকালের উদ্দেশ্যেই আচ্ছন্ন করে রাখে-পরকালের প্রতি কোনোই লক্ষ্য রাখে না। দ্বিতীয় আয়াতে মুমিনদের কথা বলা হয়েছে অর্থ এই যে, মুমিন যখনই যে কাজে পরকালের ইচ্ছা ও নিয়ত করবে, তার সে কাজ গ্রহণযোগ্য হবে। মুমিনের যে কর্ম খাঁটি নিয়ত সহকারে অন্যান্য শর্তানুযায়ী হবে, তা কবুল করা হবে আর যে কর্ম এরূপ হবে না, তা কবুল করা হবে না।
নয়. অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِيَعْبُدُوا اللّٰهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ١ۙ۬ حُنَفَآءَ وَ يُقِيْمُوا الصَّلٰوةَ وَ يُؤْتُوا الزَّكٰوةَ وَ ذٰلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِؕ۰۰۵
‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং নামায কায়েম করতে ও যাকাত প্রদান করতে। আর এটাই সঠিক ধর্ম।’ [সূরা আল-বাইয়িনা: ৫]
দশ. অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ اِنْ تُخْفُوْا مَا فِيْ صُدُوْرِكُمْ اَوْ تُبْدُوْهُ يَعْلَمْهُ اللّٰهُؕ ۰۰۲۹
‘বলুন, তোমাদের মনে যা আছে তা যদি তোমরা গোপন রাখ কিংবা প্রকাশ করে দাও, আল্লাহ তাআলা তা অবগত আছেন।’ [সূরা আলে ইমরান: ২৯]
নিয়ত: প্রসঙ্গ আল-হাদীস
এক. ওমর ইবন খাত্তাব (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ، وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَىٰ، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُوْلِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَىٰ مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ.
‘যাবতীয় কাজ-আমলের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর মানুষের তাই প্রাপ্য যার সে নিয়ত করবে। অতএব যে ব্যক্তির হিজরত আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর রাসূলের জন্য হবে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই হবে। আর যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব সম্পদ অর্জন কিংবা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার জন্য হবে; তার হিজরত যে নিয়তে করবে তারই জন্য হবে।’১৪
অন্তর্ভুক্ত এ হাদীসটি ইসলামী জীবনাচারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। মানুষের সকল প্রকার কাজকর্মের গ্রহণযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য হওয়া একমাত্র তার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। যাবতীয় আমলের প্রতিদান পাওয়া না পাওয়া সে আমলকারীর নিয়তের খাঁটি-অখাঁটি হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত। এ হাদীস দ্বারা এটা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শরী‘আতে নিয়তের অবস্থান অতি উঁচু স্থানে। বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য হয় না। আমলের শুদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিয়ত। এ কারণে আল্লাহ তাআলা সকল ইবাদতে নিয়তকে খাঁটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোনো আমল কিছুতেই সঠিক হতে পারে না। ওমর (রাযি.) বর্ণিত উক্ত হাদীস থেকে এ বিষয়টিও সাব্যস্ত হয় যে, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই কৃতকর্মের ফলাফল লাভ করে। এমনকি সে নিজের ব্যবহারিক জীবনে পানাহার, উপবেশন, নিদ্রা ইত্যাদির ন্যায় যে কাজগুলো সে অভ্যাস-বশে সম্পাদন করে সে সব কাজও সদিচ্ছা এবং সৎ নিয়তের কারণে পুণ্যময় আমলে পরিণত হতে পারে। পারে সওয়াব অর্জনের মাধ্যম হতে। যেমন কেউ হালাল খাবার খাওয়ার সময় উদর ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ইবাদতের জন্য শক্তি ও সক্ষমতা লাভের নিয়তও যদি করে নেয় তাহলে এর জন্য সে অবশ্যই সওয়াবের অংশিদার হবে।
এমনিভাবে মনোমুগ্ধকর ও মনোরঞ্জক যে কোনো বৈধ বিষয়ও নেক নিয়তের সঙ্গে উপভোগ করলে তা ইবাদতে রূপান্তরিত হয়। উক্ত হাদীসে এ বিষয়টিও লক্ষ্যনীয় যে, নিয়তের সম্পর্ক অন্তরের সাথে। কাজেই কোনো ইবাদতের সময় ‘নিয়তের দো‘আ’ জাতীয় কিছু মুখে উচ্চারণ করা যাবে না; কাজের সাথে অন্তরের উদ্দেশ্যেরও সমন্বয় থাকতে হবে। বরং মুখে উচ্চারণের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। যেমন, যদি কোনো ব্যক্তি জোহরের সালাত আদায় করার সময় অন্তরে জোহরের সালাত আদায় করার নিয়ত করে আর মুখে অন্য সালাতের কথা এসে যায় । তাহলে তার জোহরের সালাতই আদায় হবে। এতে জোহরের সালাতের নিয়তের কোনো ত্রুটি হবে না।১৫
দুই. আয়েশা (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
يَغْزُو جَيْشٌ الْكَعْبَةَ، فَإِذَا كَانُوا بِبَيْدَاءَ مِنْ الْأَرْضِ يُخْسَفُ بِأَوَّلِـهِمْ وَآخِرِهِمْ، قَالَتْ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ! كَيْفَ يُخْسَفُ بِأَوَّلِـهِمْ وَآخِرِهِمْ وَفِيهِمْ أَسْوَاقُهُمْ وَمَنْ لَيْسَ مِنْهُمْ؟ قَالَ:يُخْسَفُ بِأَوَّلِـهِمْ وَآخِرِهِمْ، ثُمَّ يُبْعَثُونَ عَلَىٰ نِيَّاتِهِمْ.
‘একটি বাহিনী কা‘বা ঘরের ওপর আক্রমন করার উদ্দেশ্যে বের হবে। অতঃপর যখন তারা সমতল মরুপ্রান্তরে পৌছবে তখন তাদের প্রথম ও শেষ ব্যক্তি সকলকেই যমীনে ধসিয়ে দেয়া হবে । তিনি (আয়েশা (রাযি.)) বলেন যে, আমি (এ কথা শুনে) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কেমন করে তাদের প্রথম ও শেষ সকলকেই ধসিয়ে দেওয়া হবে? অথচ তাদের মধ্যে তাদের বাজারের ব্যবসায়ী এবং এমন লোক থাকবে যারা তাদের (আক্রমণকারীদের) অন্তর্ভুক্ত নয়। তিনি বললেন, তাদের প্রথম ও শেষ সকলকেই ধসিয়ে দেওয়া হবে। তারপর তাদেরকে তাদের নিয়ত অনুযায়ী পুনরুত্থিত করা হবে।’১৬
অর্থাৎ বাহ্যত কাবা ঘরের ওপর আক্রমনকারীদের দলভুক্ত থাকার কারণে সকলকেই ধসিয়ে দেওয়া হলেও কিয়ামত দিবসের চূড়ান্ত হিসাব নিয়তের ভিত্তিতেই হবে।
তিন. অন্যত্র আয়েশা (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
্রلَا هِجْرَةَ بَعْدَ الْفَتْحِ وَلَكِنْ جِهَادٌ وَنِيَّةٌ وَإِذَا اسْتُنْفِرْتُمْ فَانْفِرُوا.
‘মক্কা বিজয়ের পর (মক্কা থেকে) হিজরত নেই; বরং বাকী আছে জিহাদ ও নিয়ত। সুতরাং যদি তোমাদেরকে জিহাদের জন্য ডাক দেওয়া হয় তাহলে তোমরা বেরিয়ে পড়।’১৭
চার. আবু আবদুল্লাহ জাবের ইবন আবদুল্লাহ আনসারী (রাযি.)মা হতে বর্ণিত; তিনি বলেন,
كُنَّا مَعَ النَّبيِّ ﷺ في غَزَاةٍ، فَقالَ : إِنَّ بالمدِينَةِ لَرِجَالًا ما سِرْتُمْ مَسِيرًا، وَلَا قَطَعْتُمْ وَادِيًا، إلَّا كَانُوا مَعَكمْ حَبَسَهُمُ الْـمَرَضُ.
‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে এক অভিযানে ছিলাম। তিনি বললেন, মদীনাতে কিছু লোক এমন আছে যে, তোমরা যত সফর করছ এবং যে কোনো উপত্যকা অতিক্রম করছ, তারা তোমাদের সঙ্গে রয়েছে। অসুস্থতা তাদেরকে মদীনায় থাকতে বাধ্য করেছে।’১৮
অর্থাৎ পূর্ণ নিয়ত বা সদিচ্ছা থাকার পরও অসুস্থতার কারণে যারা অভিযানে অংশ নিতে পারে নি, শুধুমাত্র নিয়তের কারণে তারাও অভিযান পরিচালনাকারীদের সমপরিমান সাওয়াবের অধিকারী হবে।
পাঁচ. অন্য হাদীসে এসেছে,
وعَنْ أَبِي يَزيدَ مَعْنِ بنِ يَزيدَ بنِ الأخنسِ ، وهو وأبوه وَجَدُّه صحابيُّون، قَالَ: كَانَ أبي يَزيدُ أخْرَجَ دَنَانِيرَ يَتَصَدَّقُ بِهَا، فَوَضعَهَا عِنْدَ رَجُلٍ في الْـمَسْجِدِ، فَجِئْتُ فأَخذْتُها فَأَتَيْتُهُ بِهَا، فقالَ: واللهِ، مَا إيَّاكَ أرَدْتُ، فَخَاصَمْتُهُ إِلى رسولِ اللهِ ﷺ، فقَالَ:لكَ مَا نَوَيْتَ يَا يزيدُ، ولَكَ ما أخَذْتَ يَا مَعْنُ.
‘আবু ইয়াযীদ মা’ন ইবনে ইয়াযীদ ইবনে আখনাস (রাযি.) তিনি (মা’ন) এবং তার পিতা ও দাদা সকলেই সাহাবীবলেন, আমার পিতা ইয়াযীদ দান করার জন্য কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা বের করলেন। অতঃপর তিনি সেগুলো (দান করার জন্য) মসজিদে একটি লোককে দায়িত্ব দিলেন। আমি মসজিদে এসে তার কাছ থেকে অন্যান্য ভিক্ষুকের মত তা নিয়ে নিলাম এবং তা নিয়ে বাড়ি এলাম। (যখন আমার পিতা এ ব্যাপারে অবগত হলেন তখন) বললেন, আল্লাহর কসম! তোমাকে দেওয়ার নিয়ত আমার ছিল না। ফলে (এগুলো আমার জন্য হালাল হবে কি না তা জানার জন্য) আমি আমার পিতাকে নিয়ে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, হে ইয়াযীদ! তোমার জন্য সে বিনিময় রয়েছে যার নিয়ত তুমি করেছ আর হে মা’ন! তুমি যা নিয়েছ তা তোমার জন্য হালাল।’১৯
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সর্বসম্মতিক্রমে আকীদাহ হলো পিতা কর্তৃক নিজ সন্তানকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই। এভাবে যাকাত আদায় হবে না।২০ কিন্তু উক্ত হাদীসে দেখা যাচ্ছে, পিতার যাকাতের টাকা পুত্র গ্রহণ করেছে। তথাপি পিতা কর্তৃক পুত্রকে দেওয়ার নিয়ত না থাকার কারণে এবং পুত্রের তা গ্রহণ করার সময় পিতার যাকাত হওয়ার কথা নিয়তে (জানা) না থাকার রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হে ইয়াযীদ! তোমার জন্য সে বিনিময় রয়েছে যার নিয়ত তুমি করেছ আর হে মা’ন! তুমি যা নিয়েছ তা তোমার জন্য হালাল।
ছয়. অন্য হাদীসে সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাযি.)-কে লক্ষ করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
وَإنَّكَ لَنْ تُنفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغي بِهَا وَجهَ اللهِ إلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتَّىٰ مَا تَجْعَلُ في فِيِّ امْرَأَتِكَ.
‘মনে রেখ, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তুমি যা ব্যয় করবে তোমাকে তার বিনিময় দেওয়া হবে। এমনকি তুমি যে গ্রাস তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দাও তারও তুমি বিনিময় পাবে।’২১
স্ত্রীর মুখে গ্রাস তুলে দেওয়া নিত্য প্রয়োজনীয় একটি পার্থিব কাজ মাত্র। তথাপিও নিয়ত বিশুদ্ধ রেখে শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তা করলে তারও বিনিময় বা সাওয়াব পাওয়া যাবে।
সাত. আবু হুরায়রা (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
إنَّ الله لاَ ينْظُرُ إِلى أجْسَامِكُمْ، وَلا إِلَى صُوَرِكمْ، وَلَكن ينْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعمَالِكُم.
‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের দেহ এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’২২
অর্থাৎ আমল ও আকৃতি মৌলিক বিষয় নয়; বরং নিয়তই মূল।
আট. আবু মূসা আশ‘আরী (রাযি.) হতে বর্ণিত:
سُئِلَ رَسُولُ اللهِ ﷺ عَنِ الرَّجُلِ يُقاتلُ شَجَاعَةً، ويُقَاتِلُ حَمِيَّةً، ويُقَاتِلُ رِيَاءً، أَيُّ ذٰلِكَ في سبيلِ الله ؟ فَقَالَ رَسُول الله: مَنْ قَاتَلَ لِتَكونَ كَلِمَةُ اللهِ هي العُلْيَا، فَهوَ في سَبِيلِ اللهِ.
‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, যে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য যুদ্ধ করে, অন্ধ পক্ষপাতিত্বের জন্য যুদ্ধ করে এবং লোক দেখানোর (সুনাম অর্জনের) জন্য যুদ্ধ করে, এর কোনো যুদ্ধটি আল্লাহর পথে হবে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে উঁচু করার জন্য যুদ্ধ করে একমাত্র তারই যুদ্ধ আল্লাহর পথে হয়।’২৩
দেখুন, অন্ধ পক্ষপাতিত্বের জন্য যুদ্ধ করাও চাই সেটি মুসলিমদের পক্ষেই হোক না কেন আল্লাহর পথের জিহাদ নয়। একমাত্র আল্লাহর কালেমাকে উঁচু করার নিয়তই জিহাদ কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত।
নয়. আবু বাকরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
إِذَا التَقَى الـمُسلِمَان بسَيْفَيهِمَا فالقَاتِلُ وَالمَقْتُولُ في النّارِ قُلتُ : يا رَسُولَ اللهِ! هَذا القَاتِلُ فَمَا بَالُ المقْتُولِ ؟ قَالَ: إنَّهُ كَانَ حَريصاً عَلَى قتلِ صَاحِبهِ.
‘যখন দু’জন মুসলিম তরবারী নিয়ে পরস্পরে লড়াই করে, তখন হত্যাকারী ও নিহত দু’জনই জাহান্নামে যাবে। (বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন) আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারীর জাহান্নামে যাওয়া তো স্পষ্ট; কিন্তু নিহত ব্যক্তির ব্যাপার কী?’ তিনি বললেন, ‘সেও তার সঙ্গীকে হত্যা করার জন্য লালায়িত ছিল।’’২৪
দেখুন, নিহত ব্যক্তির প্রতিপক্ষকে হত্যা করার নিয়ত, সংকল্প বা হত্যা করার জন্য লালায়িত থাকাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) তার জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
দশ. আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত,
عَن رَسُول الله ﷺ، فِيمَا يَروِي عَن رَبّهِ ، قَالَ: إنَّ اللهَ كَتَبَ الحَسَنَاتِ والسَّيِّئَاتِ ثُمَّ بَيَّنَ ذلِكَ، فَمَنْ هَمَّ بحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَها اللهُ تَبَارَكَ وتَعَالى عِنْدَهُ حَسَنَةً كامِلَةً،وَإنْ هَمَّ بهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ عَشْرَ حَسَناتٍ إِلى سَبْعمئةِ ضِعْفٍ إِلى أَضعَافٍ كَثيرةٍ، وإنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ تَعَالَى عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلةً، وَإنْ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ سَيِّئَةً وَاحِدَةً.
‘রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর বরকতময় মহান রব থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন যে, নিশ্চয় আল্লাহ পুণ্য ও পাপসমূহ লিখে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তার ব্যাখ্যাও করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি কোনো নেকী করার সংকল্প করে কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত করতে পারে না, আল্লাহ তাআলা (শুধু নিয়ত করার বিনিময়ে) তাকে একটি পূর্ণ নেকী লিখে দেন । আর সে যদি সংকল্প করার পর কাজটি করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার বিনিময়ে দশ থেকে সাতশ গুণ বরং তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি নেকী লিখে দেন। পক্ষান্তরে যদি সে একটি পাপ করার সংকল্প করে কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত না করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার নিকট একটি পূর্ণ নেকী হিসাবে লিখে দেন। আর সে যদি সংকল্প করার পর ঐ পাপ কাজটি করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ তাআলা মাত্র একটি পাপ লিপিবদ্ধ করেন।২৫
এগার. আবদুল্লাহ ইবন ওমর (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে,
انْطَلَقَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حَتَّىٰ أَوَوْا الْـمَبِيتَ إِلَى غَارٍ فَدَخَلُوهُ فَانْحَدَرَتْ صَخْرَةٌ مِنْ الْـجَبَلِ فَسَدَّتْ عَلَيْهِمْ الْغَارَ فَقَالُوا إِنَّهُ لَا يُنْجِيكُمْ مِنْ هَذِهِ الصَّخْرَةِ إِلَّا أَنْ تَدْعُوا اللهَ بِصَالِحِ أَعْمَالِكُمْ فَقَالَ رَجُلٌ مِنْهُمْ اللَّهُمَّ كَانَ لِي أَبَوَانِ شَيْخَانِ كَبِيرَانِ وَكُنْتُ لَا أَغْبِقُ قَبْلَهُمَا أَهْلًا وَلَا مَالًا فَنَأَى بِي فِي طَلَبِ شَيْءٍ يَوْمًا فَلَمْ أُرِحْ عَلَيْهِمَا حَتَّى نَامَا فَحَلَبْتُ لَهُمَا غَبُوقَهُمَا فَوَجَدْتُهُمَا نَائِمَيْنِ وَكَرِهْتُ أَنْ أَغْبِقَ قَبْلَهُمَا أَهْلًا أَوْ مَالًا فَلَبِثْتُ وَالْقَدَحُ عَلَى يَدَيَّ أَنْتَظِرُ اسْتِيقَاظَهُمَا حَتَّى بَرَقَ الْفَجْرُ فَاسْتَيْقَظَا فَشَرِبَا غَبُوقَهُمَا اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَفَرِّجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيهِ مِنْ هَذِهِ الصَّخْرَةِ فَانْفَرَجَتْ شَيْئًا لَا يَسْتَطِيعُونَ الْـخُرُوجَ قَالَ النَّبِيُّ ^ وَقَالَ الْآخَرُ اللَّهُمَّ كَانَتْ لِي بِنْتُ عَمٍّ كَانَتْ أَحَبَّ النَّاسِ إِلَيَّ فَأَرَدْتُهَا عَنْ نَفْسِهَا فَامْتَنَعَتْ مِنِّي حَتَّىٰ أَلَـمَّتْ بِهَا سَنَةٌ مِنْ السِّنِينَ فَجَاءَتْنِي فَأَعْطَيْتُهَا عِشْرِينَ وَمِائَةَ دِينَارٍ عَلَى أَنْ تُخَلِّيَ بَيْنِي وَبَيْنَ نَفْسِهَا فَفَعَلَتْ حَتَّىٰ إِذَا قَدَرْتُ عَلَيْهَا قَالَتْ لَا أُحِلُّ لَكَ أَنْ تَفُضَّ الْـخَاتَمَ إِلَّا بِحَقِّهِ فَتَحَرَّجْتُ مِنْ الْوُقُوعِ عَلَيْهَا فَانْصَرَفْتُ عَنْهَا وَهِيَ أَحَبُّ النَّاسِ إِلَيَّ وَتَرَكْتُ الذَّهَبَ الَّذِي أَعْطَيْتُهَا اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيهِ فَانْفَرَجَتْ الصَّخْرَةُ غَيْرَ أَنَّهُمْ لَا يَسْتَطِيعُونَ الْخُرُوجَ مِنْهَا قَالَ النَّبِيُّ ^ وَقَالَ الثَّالِثُ اللَّهُمَّ إِنِّي اسْتَأْجَرْتُ أُجَرَاءَ فَأَعْطَيْتُهُمْ أَجْرَهُمْ غَيْرَ رَجُلٍ وَاحِدٍ تَرَكَ الَّذِي لَهُ وَذَهَبَ فَثَمَّرْتُ أَجْرَهُ حَتَّى كَثُرَتْ مِنْهُ الْأَمْوَالُ فَجَاءَنِي بَعْدَ حِينٍ فَقَالَ يَا عَبْدَ اللهِ أَدِّ إِلَيَّ أَجْرِي فَقُلْتُ لَهُ كُلُّ مَا تَرَى مِنْ أَجْرِكَ مِنْ الْإِبِلِ وَالْبَقَرِ وَالْغَنَمِ وَالرَّقِيقِ فَقَالَ يَا عَبْدَ اللهِ لَا تَسْتَهْزِئُ بِي فَقُلْتُ إِنِّي لَا أَسْتَهْزِئُ بِكَ فَأَخَذَهُ كُلَّهُ فَاسْتَاقَهُ فَلَمْ يَتْرُكْ مِنْهُ شَيْئًا اللَّهُمَّ فَإِنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيهِ فَانْفَرَجَتْ الصَّخْرَةُ فَخَرَجُوا يَمْشُونَ.
‘তোমাদের পূর্বে (বনী ইসরাঈলের যুগে) তিন ব্যক্তি একদা সফরে বের হল। চলতে চলতে রাত এসে গেল। তারা রাত কাটানোর জন্য একটি পর্বত-গুহায় প্রবেশ করল। কিছুক্ষণ পরেই একটি বড় পাথর ওপর থেকে গড়িয়ে নীচে এসে গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। এ দেখে তারা বলল যে, এ বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে এই যে, তোমরা তোমাদের নেক আমলসমূহকে ওসীলা বানিয়ে আল্লাহর নিকট দো‘আ কর। সুতরাং তারা স্ব স্ব আমলের ওসীলায় আল্লাহর কাছে দো‘আ করতে লাগল।
তাদের মধ্যে একজন বলল, হে আল্লাহ! তুমি জান যে, আমার অত্যন্ত বৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিল এবং আমি সন্ধ্যাবেলায় সবার আগে তাদেরকে দুধ পান করাতাম। তাদের পূর্বে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও কৃতদাস-দাসী কাউকেই পান করাতাম না। একদিন আমি ঘাসের খোঁজে দূরে চলে গেলাম এবং বাড়ি ফিরে দেখতে পেলাম যে, পিতা-মাতা ঘুমিয়ে গেছে। আমি সন্ধ্যার দুধ দোহন করে তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখলাম তারা ঘুমিয়ে আছে। আমি তাদেরকে জাগানো পছন্দ করলাম না এবং এও পছন্দ করলাম না যে, তাদের পূর্বে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও কৃতদাস-দাসীকে দুধ পান করাই। তাই আমি দুধের বাটি নিয়ে তাদের ঘুম থেকে জাগার অপেক্ষায় তাদের শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অথচ শিশুরা ক্ষুধার তাড়নায় আমার পায়ের কাছে চেঁচামেচি করছিল। এভাবে ফজর উদয় হয়ে গেল এবং তারা জেগে উঠল। তারপর তারা নৈশদুধ পান করল । হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য করে থাকি, তাহলে পাথরের কারণে যে আমরা গুহায় বন্দি হয়ে আছি এ থেকে তুমি আমাদেরকে উদ্ধার কর। এই দো‘আর ফলস্বরূপ পাথর একটু সরে গেল। কিন্তু তাতে তারা বের হতে সক্ষম ছিল না।
দ্বিতীয়জন দোআ করল, ‘হে আল্লাহ! আমার একটি চাচাতো বোন ছিল। সে আমার নিকট সকল মানুষের চেয়ে প্রিয়তমা ছিল। (অন্য বর্ণনা মতে) আমি তাকে এত বেশি ভালোবাসতাম, যত বেশি ভালো পুরুষরা নারীদেরকে বাসতে পারে। একবার আমি তার কু-কর্মের ইচ্ছা করলাম। কিন্তু সে অস্বীকার করল। পরিশেষে সে যখন এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ল, তখন সে আমার কাছে এল। আমি তাকে এ শর্তে ১২০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) দিলাম যেন সে আমার সঙ্গে কু-কর্মে লিপ্ত হয়। এতে সে (অভাবের তাড়নায়) রাজি হয়ে গেল। অতঃপর যখন আমি তাকে আয়ত্তে পেলাম। (অন্য বর্ণনা মতে) যখন আমি তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম, তখন সে বলল, তুমি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং অবৈধভাবে আমার পবিত্রতা নষ্ট করো না। এটা শুনে আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম; যদিও সে আমার একান্ত প্রিয়তমা ছিল। এবং যে স্বর্ণমুদ্রা আমি তাকে দিয়েছিলাম তাও পরিত্যাগ করলাম। হে আল্লাহ! যদি আমি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি তাহলে আমাদের ওপর পতিত মুসীবতকে দূরীভূত কর।’ এই দো‘আর ফলস্বরূপ পাথর আরো কিছুটা সরে গেল কিন্তু তাতে তারা বের হতে সক্ষম ছিল না।
তৃতীয়জন দোআ করল, ‘হে আল্লাহ! আমি কিছু লোককে মজুর রেখেছিলাম। কাজ শেষ হলে আমি তাদের সকলকে মজুরি দিয়ে দিলাম। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন মজুরি না নিয়ে চলে গেল। আমি তার মজুরির টাকা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করলাম। (কিছুদিন পর) তা থেকে প্রচুর অর্থ জমে গেল । অনেক দিন পর একদিন ঐ মজুর এসে বলল, হে আল্লাহর বান্দা তুমি আমার মজুরি দিয়ে দাও । আমি বললাম, এসব উট, গাভী, ছাগল এবং গোলাম যা তুমি দেখছ সবই তোমার মজুরির ফল। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা, তুমি আমার সঙ্গে উপহাস করছ। আমি বললাম, আমি তোমার সাথে উপহাস করছি না (সত্য কথাই বলছি)। সুতরাং আমার কথা শুনে সে তার সমস্ত মাল নিয়ে চলে গেল এবং কিছুই ছেড়ে গেল না। হে আল্লাহ! যদি আমি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি তাহলে যে বিপদে আমরা পড়েছি তা তুমি দূরীভূত কর। এই দো‘আর ফলে পাথর সম্পূর্ণ সরে গেল এবং সকলে (গুহা থেকে) বের হয়ে চলতে লাগল।২৬
বিশুদ্ধ নিয়তে সম্পাদিত আমল আল্লাহর নিকট অতি পছন্দনীয়। উক্ত ঘটনায় তিন ব্যক্তি তাদের বিশুদ্ধ নিয়তে সম্পাদিত আমলের উসিলায় বিপদ মুক্তির জন্য দোআ করার সাথে সাথেই তা গ্রহণ করা হয়েছে।
বারো. ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) বলেছেন,
لا عمل لمن لا نية له، ولا أجر لمن لا حسبة له.
‘যার নিয়ত নেই তার কোনো আমল নেই। এবং যার কোনো সাওয়াবের উদ্দেশ্য নেই তার কোনো পুরস্কার নেই।’২৭
তেরো. আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাযি.) বলেছেন,
لا ينفع قول إلا بعمل، ولا عمل إلا بنية، ولا ينفع قول ولا عمل ولا نية إلا بما وافق السنة.
‘কাজ বা আমল ছাড়া কথায় কোনো ফল নেই। আর বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কাজ বা আমল অসার। আবার কর্ম, কথা ও নিয়ত কোনোটিই কাজে আসবে না, যতক্ষণ না তা রাসূলের সুন্নাতের অনুসারে করা হবে।’২৮
চৌদ্দ. অন্য হাদীসে এসেছে:
إنما هي أهل الدنيا أربعة نفر عبد رزقه الله فيها مالا وعلما فهو يتقي فيه ربه ويصل فيه رحمه ويعمل لله فيه بحقه فهذا بأفضل المنازل وعبد رزقه الله علما ولم يرزقه مالا فهو صادق النية يقول : لو أن لي مالا عملت بعمل فلان فأجرهما سواء.
‘পৃথিবী তো চার শ্রেণির লোকের, এক শ্রেণির লোক রয়েছে যাকে আল্লাহ তাআলা ইলম ও সম্পদ দুটিই দিয়েছেন। সে ইলম অনুযায়ী আমল করা ও সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। এ হলো সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণি। আবার এমন শ্রেণির ব্যক্তিও রয়েছে যাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন কিন্তু সম্পদ দেননি। সে বিশুদ্ধ নিয়তের অধিকারী। সে মনে মনে বলে, ‘যদি আল্লাহ আমাকে সম্পদ দিতেন তাহলে আমি তাঁর সন্তুষ্টির জন্য অমুক অমুক কাজ করতাম’। এ উভয় শ্রেণির সাওয়াব সমান।’২৯
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিশুদ্ধ নিয়তে যাবতীয় আমল সম্পাদন করার তওফীক দান করুন। আমীন।
তথ্যসূত্র
১. লিসানুল আরব (১৪/৩৭৮), আল-মু’জামুল ওয়াফী (১০৯১)
২. ইযাহুল মিশকাত বাংলা (১/২৪৭)
৩. بدائع الفوائد ৩/১৯০, ডক্টর ওসমান শাব্বীর: القواعد الكلية والضوابط الفقهية ৯৩-৯৪,
৪. আল-মানসূর ফিল কাওয়ায়েদ, ৩/২৮৪
৫. আল-আশবাহ ওয়ান-নাযায়ের (৩০)
৬. তাফসীরে কুরতুবির সূত্রে মা‘আরিফুল কুরআন বাংলা (মুফতী শফী রহ.), পৃ. ১১৭২
৭. মাআরিফুল কুরআন বংলা: মুফতী শফী (রহ.) ১১৭৩
৮. বুখারী: খ. ২ অধ্যায়: ৫৮
৯. যাদুদ দায়িয়া: ৬
১০. কাশফুল বারী শারহু সাহীহিল বুখারী ১/৪৮৮
১১. আল্লামা মুফতী শফী (রহ.): মা‘আরিফুল কুরআন বাংলা, পৃ. ৯০২
১২. মুফতী শফী (রহ.), তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন বাংলা, পৃ. ৬২৫
১৩. মুফতী শফী (রহ.), তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন বাংলা, পৃ. ৬২৪-৬২৫
১৪. বুখারী: ৬৬৮৯, মুসলিম: ৫০৩৬।
১৫. আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ: الفتاوى الكبرى (১/২১৪-২১৫)
১৬. বুখারী: ২১১৯
১৭ বুখারী: ২৮২৫ ও মুসলিম: ৪৪৫
১৮. মুসলিম: ৫০৪১
১৯ . বুখারী: ১৪২২
২০. হিদায়া, কিতাবুয যাকাত (১/৯৫)
২১. বুখারী: ১২৯৫, ৬৩৭৩
২২. মুসলিম: ৬৭০৮
২৩ . বুখারী: ২৮১০ ও মুসলিম: ৫০২৮
২৪. বুখারী: ৬৮৭৫ ও মুসলিম: ৭৪৩৫
২৫. মুসলিম: ৩৫৫, সহীহ ইবন হিব্বান: ১০৫
২৬. বুখারী: ২২৭২ ও মুসলিম: ১০০
২৭. যাদুদ দায়িয়াহ ৬
২৮. যাদুদ দায়িয়াহ ৬
২৯. তাবরানী ৩৪৫