চিন্তার বিশুদ্ধি মানুষকে আখিরাতমুখী করে
মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে নবী-রাসূলদের দায়িত্ব সম্পর্কে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায় তার মধ্যে তাযকিয়া বা লোকদের জীবনকে পরিশুদ্ধির কাজ ছিল অন্যতম। আর এই আত্মশুদ্ধির কাজে মূল চালিকাশক্তি ছিল আল্লাহর কালাম আল-কুরআন। আমাদের সমাজের কিছু লোককে দেখা যায় যারা হেদায়াত লাভের জন্য, আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আল্লাহর কালাম আল-কুরআনের কাছে পথের সন্ধান না করে এদিক সেদিক যায়; অথচ তাদের হাতের কাছেই রয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, আল্লাহর নৈকট্য লাভের আসল উৎস আল-কুরআন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে বলেন, যারা জ্ঞানবান মানুষ, তারা তোমার প্রতি তোমার প্রভূর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এই গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যে, এই গ্রন্থই হচ্ছে সত্য, এটিই মানুষকে পরম পরাক্রান্ত ও প্রশংসিত প্রভূর দিকে নিয়ে যায়।’ [সূরা আল সাবা: ৬]
পবিত্র কুরআন মজিদের শুরুতে সূরা আল ফাতিহায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে আমাদেরকে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন যেন আমরা কেবল তাঁর কাছেই সঠিক পথের সন্ধান (সিরাতুল মুসতাকিম) জানতে চাই।
আমরা আগেই বলেছি, পৃথিবীতে নবী-রাসূলদের অন্যতম প্রধান মিশন ছিল মানুষের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা। পবিত্র কুরআনে যতবার এই আত্মশুদ্ধির প্রসঙ্গটি আলোচনা করা হয়েছে ততবারই অনিবার্যভাবে আল-কুরআনের কথা বলা হয়েছে। যেমনÑ ‘যেমন আমি তোমাদের প্রতি তোমাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে তোমাদেরকে আমার আয়াত পড়ে শোনায়, তোমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও উৎকর্ষিত করে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয় এবং যেসব কথা তোমাদের অজ্ঞাত তা তোমাদের জানিয়ে দেয়।’ [সুরা আল-বাকারা: ১৫১]
‘তিনি সেই সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ পড়ে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন। অথচ এর আগে তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’ [সূরা আল-জুমুআ: ২]
‘প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার লোকদের প্রতি আল্লাহ এ বিরাট অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদেরই মধ্য হতে এমন একজন নবী বানিয়েছেন যে তাদেরকে আল্লাহর আয়াত শোনান, তাদের জীবনকে ঢেলে তৈরি করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেন। অথচ এর পূর্বে এসব লোকই সুস্পষ্ট গোমরাহির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। [সূরা আলে ইমরান: ১৬৪]
মহানবীর বিপ্লবী জীবনাদর্শের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে চরম পাপাচারে নিমজ্জিত একটি অধঃপতিত, বর্বর ও অসভ্য জনগোষ্ঠীকে এমনভাবে পরিশুদ্ধ করলেন যে, তারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হলেন এবং মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার উৎকর্ষে এতটা সফল হলেন যে, সমগ্র মানব জাতির সামনেই তারা চিরকালের আদর্শ হয়ে থাকলেন। জগৎবাসীর সামনে তারা মানবীয় মাহাত্মের মূর্ত প্রতীক এবং সত্যের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে থাকলেন। মানবতার আদর্শ ও পথ-প্রদর্শক হয়ে তারা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিলেন এবং পথহারা মানুষকে পথের দিশা দিয়ে মানবতার সম্মান ও গৌরবকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তাঁদের এই কৃতিত্বের কথা, তাঁদের এই নেতৃত্ব, মাহাত্ম ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বয়ং আল-কুরআনে এভাবে ঘোষিত হয়েছে, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবতার কল্যাণের জন্যই তোমাদের আবির্ভাব। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর ওপর প্রবল প্রত্যয় নিয়ে চল।’ [সূরা আলে ইমরান: ১১০]
প্রশ্ন হল কোন যাদুর কাঠির স্পর্শে একজন নিরক্ষর মানুষ একটি দুধর্ষ, বর্বর, রক্তপিপাষু জাতিকে, একটি চরম পশু সমাজকে যেখানে দারিদ্র ও বলাৎকারের ভয়ে পিতা তার আপন কন্যাকে আতুড় ঘরেই মেরে ফেলতো কিংবা জীবন্ত মাটিচাপা দিত; যেখানে নারী ছিল শুধুই ভোগের পণ্য, যেখানে যেনা-ব্যভিচার-পাপাচার ক্যান্সারের মত পুরো সমাজদেহকে আক্রান্ত করেছিল, অশি¬লতা, নোংরামির যেখানে কোন সীমা ছিল না, ছিল না নারীর ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তার কোন সামান্য নিশ্চয়তা; যার কারণে মেয়ে শিশুর জন্মকে পিতা-মাতা কখনো স্বাগত জানাতো না; মানুষের জান-মাল-ইজ্জতের কোন নিরাপত্তা যে সমাজে ছিল না; তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই যেখানে মাসের পর মাস বছরের পর বছর মারামারি, খুনাখুনিই লেগেই থাকত; চরম স্বার্থপরতা আর ভোগবাদী মানসিকতা যাদেরকে পশুতে পরিণত করেছিল, এমনি শত গোত্রে বিভক্ত ও ছিন্ন-ভিন্ন একটি ‘ব্যর্থ’ সমাজ ও রাষ্ট্রকে তিনি কীভাবে পরিশুদ্ধ করে একটি সুসংহত ও শ্রেষ্ঠজাতিতে পরিণত করলেন? কোন পদ্ধতিতে? কোন শক্তিতে?
বলাবাহুল্য, ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআনই হলো সেই সৌভাগ্যের পরশ পাথর, যার স্পর্শে একটি গৌরবহীন জাতি গৌরবদীপ্ত হয়, সম্মানহীন জাতি সম্মান লাভ করে। ঐশী পথনির্দেশ বা হেদায়াত হলো সেই চিরন্তন আবে হায়াত, যা মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির অনন্ত উৎস। আল্লাহর নূর বা ঐশী আলোক হলো সেই চিরন্তন রক্ষাকবচ, যা মানুষের ইজ্জত, সম্মান ও নিরাপত্তার পাহারাদার। আরবের সেই বর্বর লোকগুলো আল্লাহর কালামকে, তাঁর হেদায়াতকে মাথায় তুলে ধরেছিল, তারা আল¬াহর আয়াতকে সম্মান করেছিল আর এ ব্যাপারে মুহাম্মদ (সা.)-কে রাসূল অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে তাঁকে চরম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আর আল্লাহর কালামের বিশেষত্ব হচ্ছে, পৃথিবীতে আল্লাহর কালামকে যারা সম্মান করবে বিনিময়ে আল্লাহও দুনিয়া ও আখেরাতে তাদেরকে সম্মানিত করবেন, গৌরবান্বিত করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা: ‘আমার নেক বান্দাগণই পাবে পৃথিবীর উত্তরাধিকার।’ [সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৫]
প্রথম মানব-মানবী বাবা আদম আর মা হাওয়াকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময়ও আল¬াহ এ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর আমার পক্ষ থেকে যে জীবনবিধান তোমাদের কাছে পাঠানো হবে যারা আমার সে হেদায়াতকে মেনে চলবে তাদের জন্য ভয়-ভীতি ও চিন্তার কোন কারণ থাকবে না। আর যারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে এবং আমার বাণী ও আদেশ নিষেধকে মিথ্যা গণ্য করবে, তারা নিশ্চয়ই জাহান্নামী হবে এবং সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।’ [সূরা আল-বাকারা: ৩৮-৩৯]
হেদায়াত হলো আল্লাহর নূর। এ নূরের অভাবেই পৃথিবীতে ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। তখন নানাবিধ সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে মানব সমাজ। আর এ কারণেই আল্লাহর নবী-রাসূলগণ কোন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন না করে আল্লাহর এ নূরকেই মানুষের চিত্তে প্রজ্জ্বলিত করে সমাজ-মানসকে পরিশুদ্ধ ও নিস্কলুস করার করার চেষ্টা করেছেন। মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করার মাধ্যমে একটি সামগ্রীক বা পূর্ণাঙ্গ সমাজ-বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আসলে মানুষের ঈমান বা তাদের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার পরিশুদ্ধিই হলো আত্মশুদ্ধি বা সমাজ-সংস্কারের প্রথম সোপান। আর এ চিন্তার বিশুদ্ধি বা ঈমানের অনিবার্য দাবিই হচ্ছে তা মানুষের কর্মধারাকে আখেরাতমুখী করে দেবে, আল্লাহর হুকুম পালনে, স্রষ্টার সামনে নিজেকে সোপর্দ করে দিতে, তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করতে উদ্বুদ্ধ করবে। তখন নফসের গোলামী, লোভ, হিংসা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা মানুষের কাছে খুবই জঘন্য, হীন ও ইতরতা বলে মনে হবে। নফসের তাড়নায় কখনো কোন ভুল করে ফেললেও এ ঈমানই আবার তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে এবং নফসের গোলামী ও পাপের জন্য সে অনুতপ্ত হবে এবং এজন্য বার বার সে প্রভুর কাছে লজ্জিত হবে, ক্ষমা ভিক্ষা করবে। এ প্রসঙ্গে মহানবী বলেছেন, ‘ঈমানদার ব্যক্তি ও ঈমানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে খুঁটির সাথে (দড়িবাঁধা) ঘোড়া, সে চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত খুঁটির দিকেই ফিরে আসে। অনুরূপভাবে ঈমানদার ব্যক্তিও ভুল করে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ঈমানের দিকেই ফিরে আসে। অতএব তোমরা মুত্তাকী লোকদেরকে তোমাদের খাদ্য খাওয়াও এবং ঈমানদার লোকদের সাথে ভাল ব্যবহার কর।’ [বায়হাকী]
কাজেই ঈমানদারী আর নফসের গোলামী এ দুটো কখনো একসাথে চলতে পারে না। বরং আমলের পরিশুদ্ধিই হলো ঈমানদারীর বৈশিষ্ট্য। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সবর (ধৈর্য ও সহনশীলতা) আর ছামাহাত (দানশীলতা, নমনীয়তা ও উদারতা) হচ্ছে ঈমান।’ [সহীহ মুসলিম]
নফসের সংকীর্ণতার কারণে দেখা যায় যে, মানুষ নিজের জন্য তো সব সময় ভাল জিনিসটি পছন্দ করে, কিন্তু অপরের বেলায় তা ভুলে যায়; নিজে ভাল জিনিসটি গ্রহণ করে অপরকে খারাপটি প্রদান করে। যেমন অনেক সময় দেখা যায় যে, আমরা পঁচা ও পুরাতন টাকা বেছে বেছে অন্যকে দেই, আর ভাল ও নতুন টাকা নিজের কাছে রেখে দিই। কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতি কিন্তু এর বিপরীত। এ প্রসঙ্গে মহানবীর (সঃ) বাণী হচ্ছে Ñ ‘তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তার ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ না করবে।’ [সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম]
এ ঈমানদারীর বৈশিষ্ট সম্পর্কে মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ তার কামনা-বাসনাকে আমার উপস্থাপিত দীনের অধীন না করবে।’ [শরহু সুন্নাহ]
একবার এক সাহাবী মহানবীকে জিজ্ঞেস করলেন যে, ঈমান কাকে বলে, তার নিদর্শন বা পরিচয় কি? তখন মহানবী যা উত্তর করলেন তা হলো: ‘তোমাদের ভাল কাজ যখন তোমাদেরকে আনন্দ দিবে এবং অন্যায় ও খারাপ কাজ যখন তোমাদেরকে অনুতপ্ত করবে তখন তুমি বুঝবে যে, তুমি মুমিন ব্যক্তি।’ [মুসনাদে আহমদ]
কাজেই বাস্তব কর্মক্ষেত্রের কঠিন ময়দানে আল্লাহর আনুগত্যই হচ্ছে ঈমানের অনিবার্য দাবি। ইসলামের পরিভাষায় একেই আমলে সালেহ বা নেক আমল বলা হয়। বাস্তব আনুগত্যের ক্ষেত্রে এসে মানুষের ঈমান ও বিবেক যে অগ্নি-পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, সে পরীক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে মানুষের সত্তার যে বিনির্মাণ হয় তাতেই হয় তার যথার্থ তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি। আর ইসলামের দৃষ্টিতে এটিই হচ্ছে মনুষ্যত্বের যথার্থ বিকাশ-প্রক্রিয়া। কিন্তু এই বাস্তব কর্ম ও পরীক্ষা ক্ষেত্রকে শয়তানের হাতে ছেড়ে দিয়ে যদি কেউ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক উপাসনা আর বাহ্যিক বেশভুষাকেই আত্মশুদ্ধির একমাত্র উপায় মনে করে তাহলে সে ব্যক্তি সমাজে একজন দীনদার পরহেজগার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে হয়তো আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে, কিন্তু তার এ আত্মতৃপ্তি পরকালে খুব একটি কাজে আসবে না।