জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঘুষের ভয়াবহতা উত্তরণের উপায়

ঘুষের ভয়াবহতা উত্তরণের উপায়

ঘুষের ভয়াবহতা উত্তরণের উপায়

মো. আবদুল কাদের

 

আল্লাহ তাআলা ঘুষকে করেছেন হারাম। কুরআন ও সুন্নাহর বহু ভাষ্যে সে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে ঘুষের ভয়াবহ পরিণতি তুলে ধরার পাশাপাশি তা থেকে পরিত্রাণের উপায় নির্দেশ করা হয়েছে।

ঘুষের ভয়াবহতা ও তা থেকে উত্তরণের উপায়

ঘুষ একটি সামাজিক ব্যাধি। ঘুষ হচ্ছে স্বাভাবিক ও বৈধ উপায়ে যা কিছু পাওয়া যায় তার ওপর অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়মিত বেতন-ভাতা পাওয়া সত্ত্বেও যদি বাড়তি কিছু অবৈধ পন্থায় গ্রহণ করে তাহলে তা ঘুষ হিসাবে বিবেচিত। অনেক সময় স্বীয় অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ঘুষ দেওয়া হয়। আবার অনেক সময় টাকা-পয়সা ছাড়াও উপহারের নামে নানা সমগ্রী প্রদান করা হয়। সুতরাং যেভাবেই হোক, আর যে নামেই হোক তা ঘুষের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঘুষ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ের ওপরই আল্লাহর লা’নত।’১

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে থেকে হারাম অর্থ গ্রহণই হচ্ছে ঘুষ। এই ঘুষ যারা দেয় তারাও সমান অপরাধী। বে-আইনি ফায়দা হাসিলের জন্য যারা কর্তাব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন সুবিধা বা টাকা পয়সা দিয়ে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে তারাই এই গুনাহ সংঘটনের অন্যতম শরীক। যারা ঘুষকে একটি অঘোষিত ব্যবস্থা হিসেবে প্রশ্রয় দেয় তারাই অপরাধী। দেখা যায় মাঝে মধ্যে বেড়াই ক্ষেত খায়, রক্ষকই হয় ভক্ষক। ন্যায়কে যাদের লালন করার কথা তারাই অন্যায়কে ধারণ করছে। এভাবে দুর্নীতির ডালপালা সারা দেশে বিস্তার লাভ করে।

ঘুষ বা উৎকোচ আসে নজরানার রূপ ধরে। ‘নবী (সা.) একজন সাহাবীকে কর্মচারী নিয়োগ করে যাকাত আদায়ের জন্য পাঠালেন। সে ফিরে এসে রাসূল (সা.)-কে বললেন, এটা যাকাতের মাল আর এটা আমাকে উপঢৌকনস্বরূপ দেওয়া হয়েছে। এতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন, সরকারি কর্মচারীর কী হলো! আমরা যখন তাকে কোনো দায়িত্ব দিয়ে কোথায়ও প্রেরণ করি তখন সে ফিরে এসে বলে এই মাল আপনাদের (সরকারের) এবং এটা আমাকে প্রদত্ত উপহার। সে তার বাড়িতে বসে থেকে দেখুক তাকে উপহার দেওয়া হয় কি-না।’২

একবার এক সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ওমর (রাযি.)-কে কিছু উপহার দিলেন। উপহারগুলো দেখে ওমর (রাযি.) বলেছিলেন, ‘তুমি যে বললে এগুলো বায়তুলমালের, আর এগুলো আমার উপহার! তুমি এই পদ ছেড়ে বাপের ঘরে বসে থাক, দেখ তো কে তোমার জন্য উপহার নিয়ে আসে।’ সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করার এই জ্ঞান ও সাহসের জন্যই নবী (সা.) তাকে আল-ফারুক উপাধি দিয়েছিলেন। কবি ফররুখ বলেছেন, ‘আজকে ওমরপন্থী পথিক দিকে দিকে প্রয়োজন পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণপণ।’

কিন্তু হায়! এখন মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের এই সমাজের চিত্র দেখলে প্রশ্ন জাগে ইসলামের সেই মহান শিক্ষার প্রতিফলন কোথায়? এ জন্যেই কবি নজরুল বলেছেন, ইসলাম সে তো পরশ মানিক তারে কে পেরেছে খুঁজি, পরশে তাহার ধন্য যারা তাদেরই আমরা বুঝি।

ইসলামের পরশ আমাদের কলবে পৌঁছেনি বলেই আজ আমরা ঘুষকে উপহার ভাবি। অফিসের ফাইল ঘুষ না পেলে সামনে চলে না। যার ফলে দেশ ও জাতির কাক্সিক্ষত উন্নতি হয় না। কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে মেধাহীনদের রাজত্ব চলে। ঘুষ দিয়ে যে চাকুরী পেতে হয় সেই চাকুরীকে সেবা মনে করার কোনো কারণ নেই। আর তাই ঘুষ দিয়ে শিক্ষকের চাকুরী পাওয়া লোকটির কাছ থেকে তার ছাত্ররা কতটুকু এলেমদার হবে তা নিয়ে মনে অনেক সংশয় থেকে যায়।

এই ঘুষের জামানায় পাকা দড়িবাজরা তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছে দেখে আল্লাহর নেক বান্দারা মাঝে মাঝে ভাবে যে, নেক নিয়তের কি কোনো দাম নেই? এটা কি বোকামি? কিন্তু তিক্ত ফলের চারা লাগিয়ে যেমন সুমিষ্ট ফলের আশা করা যায় না, তেমনি দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে উঠা ব্যবস্থাপনার কাছে কোনো কল্যাণ আশা করা যায় না। তাই ঘুষ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এরপর যালিমরা বদলে দিল যা তাদের বলা হয়েছিল। তার পরিবর্তে অন্য কথা। এ কারণে যারা যুলুম করল তাদের ওপর নাযিল করলাম আকাশ থেকে এক মহাশাস্তি। কারণ, তারা অধর্ম-অন্যায় কাজ করেছিলো।’ [সূরা আল-বাকারা: ৫৯]

এ আয়াতে সত্যকে বদলে দেওয়ার শাস্তির উল্লেখ আছে। ঘুষও সত্যকে বদলে দেয়। পাসকে ফেল দেখিয়ে দেয়। একজন হকদারের হক বদলে দিয়ে অন্যকে অন্যায়ভাবে দেওয়া হয়। অতীত যামানায়  যারা ঘুষ গ্রহণ করত, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ধর্মের বাণীতে জালিয়াতি করত তাদের সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্য প্রাপ্তির জন্য বলে, এটি আল্লাহর নিকট হতে এসেছে। তাদের হাত যা রচনা করেছে তার জন্য শাস্তি তাদের এবং যা তরা উপার্জন করে তার জন্যও শাস্তি তাদের।’ [সূরা আল-বাকারা: ৭৯]

ঘুষ হচ্ছে একটি হারাম জিনিস। যদিও ঘুষখোর এটাকে হারাম মনে করে না। আয়াতে ঘুষ খেয়ে ধর্মের বাণী বদলে দেওয়ার কথা বলা হলেও সকল জালিয়াতির জন্যই শাস্তি প্রযোজ্য। ঘুষ সব সময় টাকা-পয়সা হয় না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানান বস্তু ও বিষয় হতে পারে। এ জন্যই হাদীসের ভাষায় এটিকে বলে ‘রিশওয়া’ বা দড়ি। দড়ি দিয়ে কুপের ভেতর থেকে বালতি টেনে উঠাবার মত ঘুষ অন্যের হক নিজের ঘরে নিয়ে আসে। এজন্য এই প্রক্রিয়ায় তিনটি পক্ষ থাকে। ১. রাশী  যে ঘুষ প্রদান করে, ২. মুরতাশী  যে ঘুষ গ্রহণ করে এবং ৩. রায়েশ যে অনুঘটক হয়ে কাজ করে।

আল্লামা সান‘আনী তার বিখ্যাত গ্রন্থ সুবুলুস সালাম শারহু বুলুগিল মারাম গ্রন্থে বলেন, ‘রায়েশ বা ঘুষের ঘটক হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে ঘুষখোর ও ঘুষদাতার মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে থাকে।’৩ তবে মূলপক্ষ হচ্ছে দু’টি: যে ঘুষ দেয় ও যে ঘুষ খায়। আব্দুল্লাহ ইবন ওমর (রাযি.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের ওপর আল্লাহর লা’নত।’৪

ইমাম তাবারানী তার আল-মু’জামুস কাবীর গ্রন্থে একটি হাদীস সংকলন করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রিশওয়াহ বিচারের ক্ষেত্রে কুফুরী। লোকেরা নিজেদের মধ্যে এ কাজ করা সুহত।’৫ আগেই বলা হয়েছে রিশওয়াহ অর্থ ঘুষ। তাহলে সুহত অর্থ কী? এ প্রশ্নের উত্তর পাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদীসে: ‘যে গোশত উদগত হয়েছে সুহত থেকে, তার জন্য জাহান্নামের আগুনই বেশি উপযোগী। একজন জিজ্ঞেস করলো, সুহত কী? তিনি বললেন, বিচার বা শাসনকার্যে ঘুষ গ্রহণ।’৬

তাহলে দেখা যায় যে, ঘুষের অর্থে যে নিজে পানাহার করে এবং তার পোষ্যদের পানাহার করায় সকলের জন্যই তা খুবই মন্দ কাজ। এই ঘুষ-লালিত দেহের ইবাদত আল্লাহ কবুল তো করবেনই না বরং তাদের জন্য লাঞ্ছনা, আখিরাতের আগুণ অপেক্ষা করছে।

ইহুদিদের দুর্গতির কারণ হিসেবে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা মিথ্যা শ্রবণে অত্যন্ত আগ্রহশীল এবং অবৈধ (ঘুষ) ভক্ষণে অত্যন্ত আসক্ত।’ [সূরা আল-মায়েদা: ৪২] অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে নবী! আপনি (আহলে কিতাবদের) অনেককেই দেখবেন পাপে, সীমালঙ্ঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে (ঘুষ খাওয়াতে) তৎপর। তারা যা করে নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট।’ [সূরা আল-মায়েদা: ৬২]

আয়াতে ‘অবৈধ ভক্ষণ’ তরজমা করা হলেও হাদীসে এই ‘সুহত’ বা অবৈধ আয়কে ঘুষ হিসেবে তাফসীর করে দেওয়া হয়েছে। তবে সকল প্রকার দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত আয়ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

এই ঘুষের বিষয়টি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতে স্পষ্টতই এসেছে। বিচারের রায়কে প্রভাবিত করা এবং প্রশাসকদেরকে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা থেকে আলাদা করাই যে ঘুষের মূখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তা প্রতিফলিত হয়েছে এই আয়াতে: ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের বা প্রশাসকদের কাছে পেশ করো না।’ [সূরা আল-বাকারা: ১৮৮]

এ আয়াতে ‘হুক্কাম’ অর্থ শাসকগণ, প্রশাসনগণ, বিচারকগণ হতে পারে। আরবী ভাষায় হাকিম বা বহুবচনে হুক্কাম শব্দটি এইসব অর্থে সমানভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কথা বুঝানো হয়েছে যাদের সিদ্ধান্তে একজনের সম্পদে অন্য কেউ অন্যায়ভাবে ভাগ বসাতে পারবে। উপর্যুক্ত আয়াতে وتدلوا بها শব্দটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ হচ্ছে ‘বালতি কুপে ফেলে তা টেনে উঠানো।’ ঠিক তেমনি ঘুষের রশিতে নিজের প্রত্যাশিত বস্তু টেনে আনা হয়। এটি রুপক অর্থে এসেছে।

এজন্যই আল্লামা আলুসী তার তাফসীর রুহুল মা‘আনীতে বলেন, ‘তোমাদের সম্পদের কিছু অংশ অসাধু বিচারক বা প্রশাসকদেরকে ঘুষ হিসেবে দিও না।’ তাফসীরে মাদারেকেও এ আয়াতের ‘বাতেল’ শব্দ দ্বারা ঘুষ বা রিশওয়াহ বুঝানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।৭ এতে প্রমাণিত হলো যে, পবিত্র কুরআনে ঘুষের বিরুদ্ধে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

আজ আমাদের দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার প্রথম দিকে রয়েছে। এই দুর্নীতির নানা রকমের রয়েছে। তবে ঘুষ হচ্ছে প্রধান ও সবচেয়ে ব্যাপক দুর্নীতি। ঘুষের এই ব্যাপকতা কেবল আখিরাতের জন্যই ভয়াবহ নয়; বরং আমাদের এই সামাজিক জীবনেও দুর্ভোগের কারণ।

ঘুষের বিষয়টি এখন আর লুকোছাপা নেই; তা এখন সবারই জানা। বাসে, লঞ্চে, পথে-ঘাটে মানুষ ঘুষের আলাপ করছে। আমাদের আশপাশের লোকজন তা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এ রকম অবস্থার কারণেই আমরা জাতি হিসেবে ক্রমশ বোধহীন হয়ে পড়েছি এবং ভবিষ্যতের অজানা লানত অথবা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি অথবা সন্ত্রাসের আরও প্রকোপ দেখে এক বিরাট ভয় আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ধর্মের বাণী আজ আমাদের জীবনে বাস্তব রূপ ধরে আসলেও আল্লাহর হুকুম পালন করার প্রতি আমাদের আগ্রহ নেই, যা দুঃখজনক হলেও সত্য। এ হচ্ছে এক ভয়াবহ অবস্থা।

ঘুষ আমাদের জাতীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। ঘুষের কারণে মানুষ যোগ্যতার মূল্যায়ণ পাচ্ছে না। ঘুষের চিন্তায় যখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাথা ঘুরতে থাকে তখন হাতের কলম সিরাতুল মুস্তাকীমে চলে না। ঘুষ হচ্ছে সমাজদেহে নীরব মরণ ব্যাধি। সকল নীতি-নৈতিকতা, সমস্ত আইন-কানূন, বিধি-বিধানকে বিধ্বস্ত করে দেওয়ার জন্য ঘুষ নামক এই নমরুদই দায়ী। এ হচ্ছে এক মরণ ভাইরাস যা আমাদের সমাজের সকল ব্যবস্থাপনাকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমাদের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবে না এবং আমরাও একটি সময় অতীতের নমরূদ, ফিরাউনদের ন্যায় অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হব ও আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে যাব। কালব-এর পরিশুদ্ধির জন্য দেহ পরিশুদ্ধ থাকতে হয়।

হালাল রুজি বা সৎ উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু বলে রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন। পক্ষান্তরে অসৎ উপার্জন করে অতি তাড়াতাড়ি সুখের সন্ধান করা আসলে বৃথা। অনেকেই অর্থ উপার্জনে সুবিধাজনক বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করেই তার পেশায় এমনভাবে মগ্ন হয় যেন সে পারে তো দু’দিনেই বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে যায়। লোকের সেবা করা এবং এজন্য ত্যাগী মনোভাব নিয়ে কাজ করার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এক হাদীসে এই তাড়াহুড়া করে অসৎভাবে উপার্জন করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, ‘কোনো প্রাণী তার রিযিক পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কখনও মরবে না। সাবধান! আল্লাহকে ভয় করো এবং আবেদনে সৌন্দর্য বজায় রাখো। তোমার রিযিক ধীরগতিতে আসার কারণে তা আল্লাহর নাফরমানির মাধ্যমে চেয়ো না। কারণ তাঁর নিকট যা আছে তা লাভ করতে হলে তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমেই করতে হবে।’৮

তবে কেউ যদি অন্যের সম্পদ গ্রাস করে তবে তার পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা ইহুদি ছিল, তাদের যুলুমের কারণে আমরা তাদের ওপর এমন সব পবিত্র বস্তু হারাম করে দিয়েছি, যা ছিল তাদের জন্য হালাল। এছাড়াও আল্লাহর পথে অনেক বাধা দেওয়ার জন্য তা করেছিলাম এবং তারা সুদ গ্রহণের কারণে যা তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং অন্যায়ভাবে লোকের ধনসম্পদ গ্রাস করার জন্য। কাফিরদের মর্মন্তুদ শান্তি প্রস্তুত রেখেছি।’ [সূরা আন-নিসা: ১৬০-১৬১]

এমনিভাবে অসৎ উপার্জন করে গাড়ি-বাড়ি, বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভ করার যে তীব্র আকাক্সক্ষা মানুষের মনে জাগে এবং শয়তান এসব অপকর্মকে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করে সামনে তুলে ধরে, এর পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ! ইসলামে ঘুষ সম্পূর্ণরূপে হারাম। ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহিতা উভয়ে জাহান্নামী।তাই আসুন, আমরা তওবা করে ঘুষকে পরিত্যাগ করি, এর বিরুদ্ধাচরণ করি। একে ঘৃণা করি, একে প্রতিরোধ করি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তওফীক দিন। আমীন।

বাঁচার উপায়

 রোগের চিকিৎসার চেয়ে তার প্রতিরোধই হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থা। এ জন্য  ঘুষ লেনদেন সংঘটনের পূর্বেই তার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ  ও বাস্তব ভিত্তিক সর্মসূচীর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়াও নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

ক. আখিরাতের চেতনা জাগ্রতকরণ:

দুনিয়ার জীবনই মানুষের শেষ নয় বরং মৃত্যুর পর মানুষকে আখিরাতের অনন্ত জীবনে প্রবেশ করতে হবে। সেদিন আল্লাহ তাআলার দরবারে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে। মূলত আখিরাতের চেতনা মানুষের জীবনে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকে। যে ব্যক্তি আখিরাতে সত্যিকার বিশ্বাস করে সে কখনও ঘুষ গ্রহণ করতে পারে না। মানুষের দুনিয়ার জীবন হচ্ছে অতি সংক্ষিপ্ত এবং আখিরাতই হচ্ছে অনন্ত জীবন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে বেশি প্রধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম এবং চিরস্থায়ী।’ [সূরা আল-আ’লা: ১৬-১৭] এ চেতনা যখন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হবে, তখন সে অবশ্যই এ থেকে বিরত থাকবে।

খ. হালাল হারামের দিক-নির্দেশনা দান:

অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে জনগণকে হালাল-হারামের দিক নির্দেশনামূলক শিক্ষা প্রদান করা উচিৎ। কেননা ইসলাম হালাল বা বৈধ বিষয় উপার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে এবং হারাম উপার্জন বর্জন করার নির্দেশ দিয়েছে, এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের হালাল এবং পবিত্র যা দিয়েছেন তা হতে তোমরা আহার কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তারই ইবাদত কর।’ [সূরা আন-নাহল: ১১৪]

রাজনৈতিক ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ অনেক সময় অর্থ আত্মসাৎ করে থাকেন। অবৈধভাবে যে কোনো প্রকার অর্থ আত্মসাৎকে ইসলাম হারাম  ঘোষণা করেছে।

গ. দলীয়করণ ও

স্বজনপ্রীতিমুক্ত হওয়া:

চাকুরী ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি সততা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রদান করা জরুরি। কারণ এ সমস্ত চাকুরী প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের নিকট আমানত। ইসলাম এ সমস্ত আমানত তার যোগ্য প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার যথার্থ মালিককে প্রত্যার্পণ কর।’ [সূরা আন-নিসা: ৫৮]

মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নেতা তার অধীনস্থদের জন্য জবাবদিহী করবেন।’৯

ঘ. উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান:

প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প বেতনের কারণে মানুষ ঘুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এজন্য ইসলাম প্রত্যেককে এমন মজুরি বা বেতন প্রদানের কথা বলেছে যে তা দ্বারা সে তার ন্যায়ানুগ ও স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে। শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। কারো ভাই তার অধীনে থাকলে তার উচিৎ নিজে যা খাবে তাই খাওয়াবে। নিজে যা পরবে তাকেও তা পরতে দিবে এবং তাকে দিয়ে এমন কাজ করাবে না যা তার সাধ্যাতীত। কোনোভাবে তার ওপর আরোপিত বোঝা বেশি হয়ে গেলে নিজেও সে কাজে তাকে সাহায্য করবে।’১০

ঙ. যোগ্য, অভিজ্ঞ ও

সৎ কর্মচারী নিয়োগ দান:

প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও অসৎ কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে এসব কর্মকর্তা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েই তার বিনিয়োগকৃত সমুদয় অর্থ উত্তোলনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অতএব, প্রশাসনকে ঘুষের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য সৎ, বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে বলেন, ‘তোমার জন্য সর্বোত্তম কর্মচারী হতে পারে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।’ [সূরা আল-কাসাস: ২৬] ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার মালিককে প্রত্যার্পণ কর।’ [সূরা আন-নিসা: ৫৮] এভাবে ইসলাম সৎ, যোগ্য ও বিশ্বস্ত কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটনের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিতে চায়।

চ. গণসচেতনতা সৃষ্টি:

ঘুষ গ্রহণ এক ধরণের দুর্নীতি। এ দুর্নীতির ভয়াবহতা এবং এর নেতিবাচক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে সকল স্তরের মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। যাতে সমাজের প্রতিটি মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। বিষয়টি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কেননা এদেশের জনগণ ধর্মভীরু এবং সরল প্রকৃতির। তাদেরকে যদি ঘুষের ক্ষতিকর প্রভাব এবং তার ইহকালীন ও পরকালীন পরিণতির বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তা খুব সহজে  প্রতিরোধ সম্ভব। দেশের সকল প্রচার মাধ্যম জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য রেডিও, টেলিভিশনসহ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যদি জনগণকে এর কুফল ও ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করা যায়, তাহলে তা ঘুষ প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ছ. প্রশাসনিক

জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ:

শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের জন্য জবাবদিহিতার কোনো বিকল্প নেই। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত জবাবদিহিতার নিশ্চিতকরণ অফিস আদালতে ঘুষের লেনদেন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নেতা তার অধীনস্থদের জন্য জবাবদিহী করবেন।’১১

জ. ঘুষগ্রহীতাদের

উপযুক্ত শাস্তি প্রদান:

সমাজ থেকে ঘুষ-বাণিজ্য চিরতরে উচ্ছেদ করতে হলে শুধুমাত্র উপদেশ, সতর্কবাণী ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা করেই তার দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না বরং কোনো ব্যক্তি যদি এ কাজে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করবে, যেন মানুষ শাস্তির পরিণতির ভয়ে ঘুষের লেনদেন থেকে দূরে থাকে।

ঝ. মানুষের অধিকার

আদায়ের ব্যপারে সচেষ্ট হওয়া:

ঘুষের মাধ্যমে যে সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয় তার অধিকাংশই মানুষের অধিকার বিষয়ক। যেমন: যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান, প্রমোশন প্রদান, সুযোগ-সুবিধা, স্বজনপ্রীতি ও অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদি। অধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ক্ষমা না করলে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না।

ঞ. সম্পদ অর্জনে

ইসলামী নীতি অবলম্বন:

সম্পদের মোহ এবং উচ্চাভিলাষী জীবন-যাপনই ঘুষের লেনদেনের অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষ মৃত্যুর কথা এবং আখিরাতকে ভুলে এসবে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এজন্য আল-কুরআনে বারবার মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ [সূরা আলে ইমরান: ১৮৫]

তাছাড়া হাদীসে এসেছে, ‘পার্থিব ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর লোকের কাছে যা আছে তার লালসা পরিত্যাগ কর। তাহলে অন্যরা তোমাকে ভালোবাসবে।’১২ তাই অর্থ উপার্জনে হালাল-হারামের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।

ট. মানব মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া:

মানুষ দ্রুত বিত্তের অধিকারী হওয়ার জন্য সাধারণত ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) বিত্তশালীর চেয়ে বিত্তহীনের বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে মর্যাদার মাপকাঠি অর্থবিত্ত নয় বরং ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে যে যতবেশী তাকওয়াসম্পন্ন বা আল্লাহভীরু, সে ততবেশী মর্যাদাবান। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত যে অধিক আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনকারী।’ [সূরা আল-হুজুরাত: ১৩]

বর্তমানে ঘুষ বাণিজ্য এ দেশকে ধ্বংস ও অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করছে। অথচ সরকার নির্বিকার। আগামী দিনের সুস্থ-সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় এটি অবশ্যই পরিত্যজ্য। এটি যত আলোচিত হবে জনগণ এ বিষয়ে তত সচেতন হবে এবং তার সুফল ভোগে সমর্থ হবে। এ প্রবন্ধে উল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ যদি সমাজে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সমাজ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সরকারের উচিৎ দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকরী ও অর্থবহ করার মাধ্যমে ঘুষ-বাণিজ্য প্রতিরোধে এগিয়ে আসা।

তথ্যসূত্র

১. হাদীসটি ইবন মাজাহ সংকলন করেছেন, হাদীস: ২৩১৩

২. আবূ দাঊদ, সুলাইমান ইবন আশআশ, আস-সুনান, ৩/৩৫৩, হাদীস: ২৯৪৩

৩. সুবুলুস সালাম, ৪/১২৪

৪. আহমদ ইবন হাম্বল, আল-মুসনদ, ২/৩৮৭

৫. আল-মু‘জামুস কাবীর লিত তাবরানী, হাদীস: ৯১০০

৬. কানযুল উম্মাল, খ. ৩

৭. তাফসীরে মাদারেক, ১/৭৬

৮. বাযযার, ইবন মাসউদ (রাযি.) থেকে

৯. সহীহ বুখারী, হাদীস: ৮৯৩

১০. সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৫৪৫

১১. সহীহ বুখারী, হাদীস: ৮৯৩

১২. ইবন মাজাহ, হাদীস: ৪১০২

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ