কেন বিদেশি ভাষা শিখব?
আসিফ ইমতিয়াজ
আমরা স্বভাবতই আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে, লিখতে ও পড়তে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যেমন ধরুন, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। জন্মের পর থেকেই আমাদের আশেপাশের পরিবেশে সর্বাধিক আনাগোনা ছিল এই ভাষাটির। অবশ্য অবশ্য বাংলা ভাষায় আমাদের পারঙ্গমতা অর্জন করতে হবে।
আমাদের পরিবারের সদস্যরা আমাদের সাথে বাংলা ভাষাতেই বেশি কথা বলেছে। জন্মের পরে একটি বাচ্চার যখন ভাষা শিক্ষা শুরু হয় তখন বাচ্চাটি সেই ভাষা বলতে পটু হয়ে ওঠে যেটি কিনা তার পরিবার বা প্রতিষ্ঠান বলছে বা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে।
এখন আপনি যদি অন্য একটি দেশের কথা মনে করেন; ধরুন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথা। সেখানে হিন্দি তাদের রাষ্ট্রভাষা, অবশ্য ইংরেজির কথাও লেখা আছে। তবে সে দেশের বিভিন্ন প্রদেশের নানান ধরণের আলাদা আঞ্চলিক ভাষাও প্রচলিত রয়েছে। এমনটি বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজাতি বা জেলা-উপজেলা শহরেও লক্ষ্য করা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেনো নিজের রাষ্ট্রভাষা ব্যতীত অন্য ভাষা শিখব। আরবী একটি সমৃদ্ধ ভাষা। মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা আরবী। পবিত্র কুরআন, হাদীস, ফিকহ ও ইসলামী ইতিহাসের মূল গ্রন্থ ও ভাষ্যগুলো আরবী ভাষায় লিখিত। এ ভাষা আয়ত্বে থাকলে ইলমে নববীর মণিমুক্তোগুলো নিজ ভাণ্ডারে জমা করতে পারবো। এ জন্য কিশোর বয়স থেকে নাহু, সারাফ ও ইনশার উপর জোর দিতে হবে। পরবর্তীতে আরব বিশ্বে উচ্চশিক্ষা ও জীবিকা অর্জনে এ ভাষা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
আপনি যদি ইংরেজি ভাষার কথা বলেন, সেক্ষেত্রে বর্তমান এবং পূর্ব উভয় প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে একটু হলেও আলাদা করে রাখতে হয়। আমাদের দেশের কথাই যদি বলি, এখানে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা আবশ্যক করা হয়েছে। অবশ্যই, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। বর্তমানে বিদেশে শিক্ষা অর্জন করতে গেলে এমনকি দেশেও যদি উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে হয়, সেক্ষেত্রে বইগুলি বেশিরভাগ ইংরেজি ভাষাতেই চর্চা করানো হয়।
আমাদের দেশের কথাই বলি। বেশির ভাগ ছাত্র ও তার পরিবারের ইচ্ছা থাকে ‘বড় হয়ে বাইরে লেখাপড়া করতে যেতে হবে এবং বড় ডিগ্রি অর্জন করতে হবে।’ উত্তম ইচ্ছা! এমন ইচ্ছা পূরণের জন্যই মূলত আমাদেরকে ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া হয়। এসব কারণেই আমি ইংরেজি ভাষাকে একটু আলাদা করে রাখতে চাই।
কিন্তু পৃথিবীতে বর্তমানে বিভিন্ন ভাষা বেশ প্রচলিত। এগুলির মধ্যে আরবি, চাইনিজ, ফরাসি, জারমানি, রাশান, স্প্যানিশ অন্যতম। আমরা যদি শুধুমাত্র আমাদের মাতৃভাষা এবং ইংরেজিতেই সীমাবদ্ধ থাকি তবে ভাষাগত দিক থেকে আমাদের নিজস্ব আধিপত্য একটু কমই থাকবে তা বলা যায়।
‘মেড ইন চায়না’ বাক্যটি এখন খুব প্রচলিত। বিভিন্ন ধরণের পণ্য তৈরি ও স্বল্প মূল্যে বিক্রি এবং নানান ধরণের নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কারেও চীন একটি বড় ভূমিকা বর্তমানে পালন করছে। সেখানের বেশিরভাগ লোকজনই ইংরেজি ভাষায় তেমন একটা পারদর্শী নয়। তাছাড়া বিশ্বে চাইনিজ ভাষায় কথা বলে প্রায় এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ! আমরা সাধারণত বিদেশ ভ্রমণে গেলে ইংরেজি ভাষা শিখে যাওয়াকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিন্তু যারা ইংরেজি বোঝে না তাদের সাথে আপনি কোন ভাষায় কথা বলবেন? এত সংখ্যক মানুষ ঈযরহবংব ভাষায় কথা বলে; সেখানে আপনি যদি নিজে এই ভাষাটি শিখে ফেলেন, আপনি অবশ্যই কম লাভবান হবেন না।
এবার কিছু অন্যান্য ভাষার কথা বলি। কিছু নির্দিষ্ট ভাষা নিয়ে একটি তালিকা নিচে তুলে ধরলাম যেখানে বলা হয়েছে উক্ত ভাষায় কথা বলে এরকম কতজন বিশ্বে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ল্যাঙ্গুয়েজেস অ্যান্ড কালচার নিয়ে একটি অন লাইন পোর্টাল বলছে, সারা বিশ্বে প্রায় সাত হাজারের মত ভাষা রয়েছে। একজনের পক্ষে এটি মোটেও সম্ভব নয় যে সে সবকয়টি ভাষা ঠিকঠাকভাবে শিখে ফেলবে। সেজন্য আমরা একটি, দুটি বা কিছুসংখ্যক ভাষা নির্বাচন করে নিতে পারি যেসব কিনা বিশ্বে বহু সংখ্যক মানুষ ব্যবহার করে থাকে। ব্যবসা, সাহিত্য চর্চা, দেশ-বিদেশ ঘুরে দেখা, জ্ঞান অর্জন, সংস্কৃতি চেনা ইত্যাদি নানান বিষয়ে আমরা আরো অনেক ক্ষেত্রে সুবিধা পাবো যদি একাধিক ভাষা আমরা আয়ত্ত করতে পারি।
বর্তমানে আমরা প্রযুক্তির সাথে খুব সুন্দরভাবে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পেরেছি। তবে শিক্ষা, জ্ঞান অর্জন, সাহিত্য চর্চা ইত্যাদি বেশ কিছু বিষয়ে আমরা রীতিমত পিছিয়ে। তার অন্যতম কারণ আমাদের ভাষাগত সীমাবদ্ধতা এবং ভিন্ন ভাষার চর্চা না করার ইচ্ছা। আমাদের যদি একটি বাংলা অথবা ইংরেজি বই পড়তে দেওয়া হয়, তবে বেশির ভাগ মানুষই সেটি নির্বিঘেœ পড়তে পারবে। তবে যদি অন্য কোনো ভাষার একটি বই দেওয়া হয়, দেখা যাবে খুব কম সংখ্যক মানুষ তা পড়তে পারবে।
আমাদের অনেক বই অনুবাদ করে পড়তে হয়। একটি কথা সত্য, অনুবাদ কখনও আসলের স্বাদ দেবে না। কারণ অনেক ক্ষেত্রে অনুবাদক মূল বিষয়টি ঠিকমত ফুটিয়ে তুলতে পারে না। নতুন একটি ভাষা শেখা মোটেও সহজ নয়, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা বাংলা শিখছি পরিবার থেকেই, একদম জন্মের পর থেকেই। আরবী ও ইংরেজি শিখছি যখন বিদ্যালয়ে ও মাদরাসায় যাওয়া শুরু হলো। এ দুটি ভাষা শেখা আমরা মূলত বেশ আগে থেকেই শেখা শুরু করেছি; এ কারণে অনেক চর্চা হয়েছে। ফলে আমাদের কাছে অবশ্যই এ দুটি ভাষা সহজ মনে হয়। একইভাবে, নতুন কোনো ভাষা যদি নিয়মিত চর্চা করতে থাকি, সেটিও এমনি একদিন আয়ত্তে চলে আসবে আমার বিশ্বাস। কারণ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮টি ভাষা জানতেন। এই উদাহরণ কী যথেষ্ট নয়?